হত্যাকান্ডের কারণ
এ বিষয়ে কুরআন যা বলেছে তা এই যে, দু’ভাই আল্লাহর নামে কুরবানী করেছিল। কিন্তু আল্লাহ একজনের কুরবানী কবুল করেন, অন্যজনেরটা করেননি। তাতে ক্ষেপে গিয়ে একজন অন্যজনকে হত্যা করে, যার কুরবানী কবুল হয়েছিল।
উল্লেখ্য যে, সে যুগে কুরবানী কবুল হওয়ার নিদর্শন ছিল এই যে, আসমান থেকে একটি আগুন এসে কুরবানী নিয়ে অন্তর্হিত হয়ে যেত। যে কুরবানীকে উক্ত অগ্নি গ্রহণ করত না, সে কুরবানীকে প্রত্যাখ্যাত মনে করা হ’ত। ক্বাবীল কৃষিকাজ করত। সে কার্পণ্য বশে কিছু নিকৃষ্ট প্রকারের শস্য, গম ইত্যাদি কুরবানীর জন্য পেশ করল। হাবীল পশু পালন করত। সে আল্লাহর মহববতে তার উৎকৃষ্ট দুম্বাটি কুরবানী করল। অতঃপর আসমান থেকে আগুন এসে হাবীলের কুরবানীটি নিয়ে গেল। কিন্তু কাবীলের কুরবানী যেমন ছিল, তেমনি পড়ে রইল। এতে ক্বাবীল ক্ষুব্ধ হল এবং হাবীলকে বলল, لَأقْتُلَنَّكَ ‘আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব’। হাবীল তখন তাকে উপদেশ দিয়ে মার্জিত ভাষায় বলল,
إِنَّمَا يَتَقَبَّلُ الله ُمِنَ الْمُتَّقِينَ، لَئِن بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لَأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ-
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তাক্বওয়াশীল বান্দাদের থেকে (কুরবানী) কবুল করে থাকেন। এক্ষণে যদি তুমি আমাকে হত্যা করতে উদ্যত হও, তবে আমি তোমাকে পাল্টা হত্যা করতে উদ্যত হব না। কেননা আমি বিশ্বচরাচরের পালনকর্তা আল্লাহ্কে ভয় করি’ (মায়েদাহ ৫/২৭-২৮)।
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, হাবীলের কুরবানী দেওয়া দুম্বাটিই পরবর্তীতে ইবরাহীম (আঃ) কর্তৃক ইসমাঈলকে কুরবানীর বিনিময় হিসাবে জান্নাত থেকে পাঠানো হয়।[1]
আহলে কিতাব-এর মধ্যে যুগ যুগ ধরে প্রসিদ্ধি আছে যে, হত্যাকান্ডের স্থলটি ছিল উত্তর দামেষ্কে ‘ক্বাসিয়ূন’ (قاسيون ) পাহাড়ের একটি গুহায়। যা আজও ‘রক্তগুহা’ (مغارة الدم ) নামে খ্যাত। যদিও এর কোন নিশ্চিত ভিত্তি নেই।[2]
কুরতুবী বলেন, ক্বাবীল স্রেফ হিংসা বশে হাবীলকে হত্যা করেছিল। সে চায়নি যে, ছোট ভাই হাবীল তার চাইতে উত্তম ব্যক্তি হিসাবে সমাজে প্রশংসিত হৌক (তাফসীর কুরতুবী) ইবনু কাছীর বলেন, ইতিপূর্বে মায়েদাহ ২০ হ’তে ২৬ আয়াত পর্যন্ত ৭টি আয়াতে মূসার প্রতি বনু ইস্রাঈলের অবাধ্যতা এবং তার শাস্তি স্বরূপ তীহ প্রান্তরে তাদের দীর্ঘ ৪০ বছরের বন্দীত্ব বরণের লাঞ্ছনাকর ইতিহাস শুনানোর পর মদীনার ইহুদীদেরকে আদম পুত্রদ্বয়ের পারস্পরিক হিংসার মর্মান্তিক পরিণামের কথা শুনানো হয়েছে একারণে যে, তারা যেন স্রেফ হিংসা বশে শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অবাধ্যতা না করে এবং কুরআনকে অস্বীকার না করে’ (তাফসীর ইবনু কাছীর)। কেননা তারা শেষনবীকে চিনলেও তাকে মানেনি স্রেফ এই হিংসার কারণে যে, ইস্রাঈল বংশে তাঁর জন্ম না হয়ে ইসমাঈল বংশে জন্ম হয়েছিল। এই জ্ঞাতি হিংসা ইহুদীদেরকে মুসলমানদের চিরশত্রুতে পরিণত করেছে। একইভাবে কেবল মাত্র হিংসার কারণেই কাবীল তার সহোদর ছোট ভাই হাবীলকে খুন করেছিল এবং পৃথিবীতে প্রথম হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছিল। কেবল ইহুদী-নাছারা নয়, যুগে যুগে ইসলাম-বিদ্বেষী সকলের অবস্থা প্রায় একইরূপ। আজকের বিশ্বের অশুভ শক্তি বলয় সর্বত্র ইসলামের ও ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে যেভাবে বিষোদ্গার করে যাচ্ছে, তা কেবলি সত্যের বিরুদ্ধে মিথ্যার চিরন্তন হিংসার আধুনিক রূপ মাত্র।
উল্লেখ্য যে, আদম (আঃ)-এর শরী‘আতের বিরোধিতা করে নিজের যমজ সুশ্রী বোনকে জোর করে বিয়ে করার জন্য এবং উক্ত বিয়ের দাবীদার হাবীলকে পথের কাঁটা মনে করে তাকে চিরতরে সরিয়ে দেওয়ার জন্য কাবীল হাবীলকে হত্যা করে ছিল বলে যে ‘আছার’ সমূহ ইবনু জারীর, কুরতুবী, ইবনু কাছীর প্রভৃতি তাফসীরের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, তার সবগুলিই ‘মুরসাল’, যঈফ ও মওযূ। ইবনু কাছীর বলেন, এগুলি স্রেফ ইস্রাঈলী উপকথা মাত্র এবং পরবর্তীতে মুসলমান হওয়া সাবেক ইহুদী পন্ডিত কা‘ব আল-আহবার থেকে নকলকৃত।[আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ১/৮৭ পৃঃ]
আইয়ূব সাখতিয়ানী বলেন, উম্মতে মুহাম্মাদীর মধ্যে এই আয়াতের উপর আমলকারী প্রথম ব্যক্তি হ’লেন তৃতীয় খলীফা হযরত উসমান ইবনু আফফান (ইবনু কাছীর)। যিনি ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও এবং নিজের জীবনের বিনিময়ে হ’লেও বিদ্রোহীদের দমনে মদীনাবাসীকে অস্ত্রধারণের অনুমতি দেননি। ‘ফিৎনার সময় বসে থাকা ব্যক্তি দাঁড়ানো ব্যক্তির চেয়ে উত্তম’ রাসূল (সাঃ)-এর এরূপ নির্দেশনা প্রসঙ্গে হযরত সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! যখন আমাকে হত্যার জন্য আমার ঘরে ঢুকে কেউ আমার দিকে হাত বাড়াবে, তখন আমি কি করব? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, كُنْ كَخَيْرِ ابْنَىْ آدَمَ ‘তুমি আদমের দুই পুত্রের মধ্যে উত্তমটির মত হও’ (অর্থাৎ হাবীলের মত মৃত্যুকে বরণ কর)। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মায়েদাহ ২৮ আয়াতটি পাঠ করে শুনালেন’।[আবুদাঊদ হা/৪২৫৭, ৫৯৬২, তিরমিযী হা/২২০৪]
ইবনু কাছীর বলেন যে, এই সব ‘আছার’ একথা দাবী করে যে, আদম পুত্রদ্বয়ের কুরবানী বিশেষ কোন কারণ বশে ছিল না বা কোন নারীঘটিত বিষয় এর মধ্যে জড়িত ছিল না। কুরআনের প্রকাশ্য অর্থ উক্ত কথা সমর্থন করে, যা মায়েদাহ ২৭ আয়াতে বর্ণিত হয়েছে। অতএব পূর্বাপর বিষয় সমূহ দ্বারা একথাই স্পষ্ট হয় যে, ভ্রাতৃ হত্যার কারণ ছিল স্রেফ এই হিংসা বশতঃ যে, হাবীলের কুরবানী কবুল হয়েছিল, কিন্তু ক্বাবীলের কুরবানী কবুল হয়নি (তাফসীর ইবনু কাছীর)। যদিও এতে হাবীলের কোন হাত ছিল না। ভালোর প্রতি এই হিংসা ও আক্রোশ মন্দ লোকদের মজ্জাগত স্বভাব। যা পৃথিবীতে সর্ব যুগে বিদ্যমান রয়েছে। এর ফলে ভালো লোকেরা সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হ’লেও চূড়ান্ত বিচারে তারাই লাভবান হয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে মন্দ লোকেরা সাময়িকভাবে লাভবান হ’লেও চূড়ান্ত বিচারে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। নির্দোষ হাবীলকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে ক্বাবীল তার আক্রোশ মিটিয়ে সাময়িকভাবে তৃপ্তিবোধ করলেও চূড়ান্ত বিচারে সে অনন্ত ক্ষতির মধ্যে পতিত হয়েছে। সেদিকে ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন, فَأَصْبَحَ مِنَ الْخَاسِرِيْنَ- ‘অতঃপর সে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হ’ল’ (মায়েদাহ ৫/৩০)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন,
لاَ تُقْتَلُ نَفْسٌ ظُلْمًا إلاَّ كَانَ عَلَى ابْنِ آدَمَ الأوَّلِ كِفْلٌ مِنْ دَمِهَا لِأَنَّهُ أَوَّلُ مَنْ سَنَّ الْقَتْلَ، رواه البخاريُّ-
‘অন্যায়ভাবে কোন মানুষ নিহত হলে তাকে খুন করার পাপের একটা অংশ আদমের প্রথম পুত্রের আমলনামায় যুক্ত হয়। কেননা সেই-ই প্রথম হত্যাকান্ডের সূচনা করে’।(বুখারী হা/৩৩৩৫) তিনি আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তির উপর তার ভাইয়ের সম্মানহানি বা অন্য কোন প্রকারের যুলুম রয়েছে, সে যেন তার থেকে আজই তা মুক্ত করে নেয়, সেইদিন আসার আগে, যেদিন তার নিকটে দীনার ও দিরহাম (স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা) কিছুই থাকবে না (অর্থাৎ মৃত্যুর পূর্বে)। যদি তার নিকট কোন সৎকর্ম থাকে, তবে তার যুলুম পরিমাণ নেকী সেখান থেকে নিয়ে নেওয়া হবে। আর যদি তার কোন নেকী না থাকে, তাহলে মযলূমের পাপ সমূহ নিয়ে যালেমের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে’।(বুখারী হা/২৪৪৯)
উক্ত মর্মে কুরআনে বর্ণিত হয়েছে
وَلَيَحْمِلُنَّ اَتْْقَاَلَهُمْ وَأَثْقَاَلاً مَّعَ أَثْقَالِهِمْ وَلَيُسْئَلُنَّ يَوْمَ الْقِيَامَةِ عَمَّا كَانُوْا يَفْتَرُوْنَ-
‘আর তারা অবশ্যই নিজেদের পাপভার বহন করবে ও তার সাথে অন্যদের পাপভার এবং তারা যেসব মিথ্যারোপ করে, সে সম্পর্কে ক্বিয়ামতের দিন অবশ্যই জিজ্ঞাসিত হবে’ (আনকাবূত ২৯/১৩)।
[1]. তাফসীর ইবনু কাছীর, মায়েদাহ ২৭-৩১ আয়াত; গৃহীত। তাফসীর ইবনু জারীর, আব্দুল্লাহ ইবনু আমর (রাঃ) হতে, সনদ জাইয়িদ।
[2]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ (বৈরুত: দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, তাবি) ১/৮৭ পৃঃ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন