আক্বাবাহর বায়‘আত
১ম বায়‘আত (البيعة الأولى) যিলহাজ্জ ১১ নববী বর্ষ : ৬জন ইয়াছরেবী যুবকের ইসলাম গ্রহণ)
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
একাদশ নববী বর্ষের হজ্জের মওসুম (জুলাই ৬২০ খ্রিঃ)। দিনের বেলায় আবু লাহাব ও অন্যান্যদের পিছু লাগা ও পদে পদে অপদস্থ হবার ভয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) রাত্রির গভীরে দাওয়াতে বের হওয়ার মনস্থ করেন। সেমতে তিনি একরাতে আবুবকর ও আলীকে সাথে নিয়ে বহিরাগত বিভিন্ন হজ্জ কাফেলার লোকদের সঙ্গে তাদের তাঁবুতে বা বাইরে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিতে থাকেন। এমন সময় তাঁরা মিনার আক্বাবাহ গিরিসংকটের আলো-অাঁধারীর মধ্যে কিছু লোকের কথাবার্তা শুনে তাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসায় জানতে পারলেন যে, তারা ইয়াছরিব থেকে হজ্জে এসেছেন এবং তারা ইহূদীদের মিত্র খাযরাজ গোত্রের লোক। তারা ছিলেন সংখ্যায় ছয়জন এবং সকলেই ছিলেন তরতাযা তরুণ। তারা ছিলেন ইয়াছরিবের জ্ঞানী ও নেতৃস্থানীয় যুবকদের শীর্ষস্থানীয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের মধ্যে বসে পড়লেন। অতঃপর তাওহীদের দাওয়াত দিলেন এবং কুরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করে শুনালেন। তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করল। তারা ইতিপূর্বে ইহূদীদের নিকটে শুনেছিল যে, সত্বর আখেরী নবীর আবির্ভাব ঘটবে। তারা বলত, ... যামানা নিকটবর্তী হয়েছে। এখন একজন নবী আগমন করবেন, যার সাথে আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব ‘আদ ও ইরাম জাতির ন্যায়’ (অর্থাৎ তোমাদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলব)। তারা এভাবেই আমাদের হুমকি দিত।[1] ফলে ইনিই যে সেই নবী, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হয়ে তখনই ইসলাম কবুল করল।
অতঃপর তারা বলল, দু’বছর পূর্বে সমাপ্ত বু‘আছ যুদ্ধের ফলে ইয়াছরিববাসীগণ পর্যুদস্ত হয়ে গেছে। পারস্পরিক হানাহানি ও শত্রুতার ফলে তাদের সমাজে এখন অশান্তির আগুন জ্বলছে। অতএব এ অবস্থায় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যদি ইয়াছরিবে হিজরত করেন, তবে তাঁর আহবানে সেখানে শান্তি স্থাপিত হতে পারে এবং আউস ও খাযরাজ উভয় দল তাঁর নেতৃত্ব মেনে নিতে পারে। ফলে তাঁর চাইতে অধিকতর সম্মানিত ব্যক্তি সেখানে আর কেউ হবে না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের দাওয়াত শুনলেন এবং তাদেরকে ফিরে গিয়ে ইয়াছরিবের ঘরে ঘরে ইসলামের দাওয়াত পৌঁছাতে বললেন (যাতে হিজরতের পরিবেশ সৃষ্টি হয়)।
উপরোক্ত সৌভাগ্যবান ৬ জন খাযরাজী যুবনেতা ছিলেন- আব্দুল মুত্ত্বালিবের মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জার গোত্রের আস‘আদ বিন যুরারাহ (أَسْعَدُ بْنُ زُرَارَةَ)। ইনি ছিলেন কনিষ্ঠতম। কিন্তু ইনিই ছিলেন তাদের নেতা।[2] (২) একই গোত্রের ‘আওফ বিন হারেছ বিন রেফা‘আহ (عَوْفُ بْنُ الْحَارِثِ بْنِ رِفَاعَةَ) (৩) বনু যুরায়েক্ব গোত্রের রাফে‘ বিন মালেক বিন আজলান (رَافِعُ بْنُ مَالِكِ بْنِ الْعَجْلاَنِ) (৪) বনু সালামাহ গোত্রের কুৎবা বিন ‘আমের বিন হাদীদাহ (قُطْبَةُ بْنُ عَامِرِ بْنِ حَدِيدَةَ) (৫) বনু হারাম গোত্রের ওক্ববা বিন ‘আমের বিন নাবী (عُقْبَةُ بْنُ عَامِرِ بْنِ نَابِيْ) (৬) বনু ওবায়েদ বিন গানাম গোত্রের জাবির বিন আব্দুল্লাহ বিন রিআব (جَابِرُ بْنُ عَبْدِ اللهِ ابْن رِئَابِ) (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)।[3]
উক্ত ৬ জন তরুণের দাওয়াতই মদীনায় হিজরতের বীজ বপন করে। যা মাত্র তিন বছরের মাথায় গিয়ে বাস্তব ফল দান করে। এটি স্রেফ ইসলাম কবুলের সাধারণ বায়‘আত ছিল। এতে কোন শর্ত বা কোন বিশেষ নির্দেশনা ছিলনা বিধায় জীবনীকারগণ এটিকে বায়‘আত হিসাবে গণনা করেননি। যদিও এটাই ছিল প্রথম বায়‘আত এবং পরবর্তী দু’টি বায়‘আতের ভিত্তি।
২য় বায়‘আত (البيعة الثانية যিলহাজ্জ ১২ নববী বর্ষ : ১২ জনের ইসলাম গ্রহণ):
গত বছর হজ্জের মওসুমে ইসলাম কবুলকারী ৬ জন যুবকের প্রচারের ফলে পরের বছর নতুন সাত জনকে নিয়ে মোট ১২ জন ব্যক্তি হজ্জে আসেন। গতবারের জাবের বিন আব্দুল্লাহ এবার আসেননি। দ্বাদশ নববী বর্ষের যিলহজ্জ মাসের (মোতাবেক জুলাই ৬২১ খৃঃ) এক গভীর রাতে মিনার পূর্ব নির্ধারিত আক্বাবাহ নামক স্থানে তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই স্থানটিকে এখন জামরায়ে আক্বাবাহ বা বড় জামরাহ বলা হয়। মিনার পশ্চিম দিকের এই সংকীর্ণ পাহাড়ী পথ দিয়ে মক্কা থেকে মিনায় যাতায়াত করতে হত। এই সংকীর্ণ সুড়ঙ্গ পথকেই ‘আক্বাবাহ’ বলা হয়। এখানেই আইয়ামে তাশরীক্বের এক গভীর রাতে আলো-অাঁধারীর মধ্যে আক্বাবাহ্র অত্র বায়‘আত অনুষ্ঠিত হয়, যা ছিল পরবর্তী পর্যায়ে মাদানী জীবনে ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনের বীজ বপন সমতুল্য। এই বায়‘আত ছিল মহিলাদের বায়‘আতের ন্যায়। যা তাদের উপর যুদ্ধ ফরয হওয়ার পূর্বে সম্পন্ন হয়েছিল (ইবনু হিশাম ১/৪৩১)।
এই বায়‘আতে গত বছরের পাঁচজন ছাড়াও এ বছর নতুন যে সাতজন উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা হলেনঃ (১) বনু নাজ্জার গোত্রের মু‘আয বিন হারেছ বিন রিফা‘আহ (مُعَاذُ بْنُ الْحَارِثِ ابْنِ رِفَاعَةَ) (২) বনু যুরায়েক্ব গোত্রের যাকওয়ান ইবনু ‘আব্দে ক্বায়েস (ذَكْوَانُ بْنُ عَبْدِ قَيْسِ) (৩) বনু গানাম গোত্রের ‘উবাদাহ বিন সামেত (عُبَادَةُ بْنُ الصَّامِتِ) (৪) বনু গানামের মিত্র গোত্রের ইয়াযীদ বিন ছা‘লাবাহ (يَزِيدُ بْنُ ثَعْلَبَةَ) (৫) বনু সালেম গোত্রের আববাস বিন ওবাদাহ বিন নাযালাহ (عَبَّاسُ بْنُ عُبَادَةَ بْنِ نَضَلَةَ) (৬) বনু ‘আব্দিল আশহাল গোত্রের আবুল হায়ছাম মালেক ইবনুত তাইয়েহান (أَبُو الْهَيْثَمِ مَالِكُ بْنُ التَّيِّهَانِ) (৭) বনু ‘আমর বিন ‘আওফ গোত্রের ‘ওয়ায়েম বিন সা‘এদাহ (عُوَيْمُ بْنُ سَاعِدَةَ)। শেষোক্ত দু’জন ছিলেন আউস বংশের এবং বাকীগণ ছিলেন খাযরাজ বংশের। তন্মধ্যে ১ম ব্যক্তি ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর দাদার মাতুল গোষ্ঠী বনু নাজ্জারের অন্তর্ভুক্ত’ (ইবনু হিশাম ১/৪৩৩)।
২য় বায়‘আত অনুষ্ঠান (انعقاد البيعة الثانية) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
অত্র বায়‘আতে অংশগ্রহণকারী সাহাবী ‘উবাদাহ বিন সামেত (রাঃ) বলেন,
أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ : تَعَالَوْا بَايِعُونِى عَلَى أَنْ لاَ تُشْرِكُوا بِاللهِ شَيْئًا وَلاَ تَسْرِقُوا وَلاَ تَزْنُوا وَلاَ تَقْتُلُوا أَوْلاَدَكُمْ وَلاَ تَأْتُونَ بِبُهْتَانٍ تَفْتَرُونَهُ بَيْنَ أَيْدِيكُمْ وَأَرْجُلِكُمْ وَلاَ تَعْصُونِى فِى مَعْرُوفٍ، فَمَنْ وَفَى مِنْكُمْ فَأَجْرُهُ عَلَى اللهِ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَعُوقِبَ بِهِ فِى الدُّنْيَا فَهُوَ لَهُ كَفَّارَةٌ، وَمَنْ أَصَابَ مِنْ ذَلِكَ شَيْئًا فَسَتَرَهُ اللهُ فَأَمْرُهُ إِلَى اللهِ، إِنْ شَاءَ عَاقَبَهُ وَإِنْ شَاءَ عَفَا عَنْهُ، قَالَ فَبَايَعْنَاهُ عَلَى ذَلِكَ، متفق عليه-
‘রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদের বললেন যে, তোমরা এসো আমার নিকটে বায়‘আত কর এই মর্মে যে, (১) তোমরা আল্লাহর সঙ্গে কোন কিছুকে শরীক করবে না (২) চুরি করবে না (৩) যেনা করবে না (৪) নিজেদের সন্তানদের হত্যা করবে না (৫) কাউকে মনগড়া অপবাদ দিবে না (৬) সঙ্গত বিষয়ে আমার অবাধ্যতা করবে না। তোমাদের মধ্যে যারা এগুলি পূর্ণ করবে, আল্লাহর নিকটে তার জন্য পুরস্কার রয়েছে। আর যদি কেউ এগুলির কোনটি করে এবং দুনিয়াতে তার শাস্তি হয়ে যায়, তাহলে সেটি তার জন্য কাফফারা হবে। পক্ষান্তরে যদি কেউ এগুলির কোনটি করে, অতঃপর আল্লাহ তা গোপন রাখেন, তবে তার ব্যাপারটি আল্লাহর উপরেই ন্যস্ত থাকবে। চাইলে তিনি বদলা নিবেন, চাইলে তিনি ক্ষমা করবেন’। রাবী ‘উবাদাহ বিন সামেত বলেন, অতঃপর আমরা উক্ত কথাগুলির উপরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকট বায়‘আত করলাম’।[বুখারী হা/১৮, ৩৮৯২; মুসলিম হা/১৭০৯; মিশকাত হা/১৮] ইতিহাসে এটাই আক্বাবার প্রথম বায়‘আত বা ‘আক্বাবায়ে ঊলা হিসাবে পরিচিত। যদিও প্রকৃত প্রস্তাবে এটি ছিল ২য় বায়‘আত।
বায়‘আতের গুরুত্ব (أهمية البيعة) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(১) বায়‘আতে বর্ণিত ছয়টি বিষয়ের প্রতিটি ব্যক্তিগত, পারিবারিক ও সামাজিক জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলি শুধু সেযুগেই নয়, বরং সর্বযুগেই গুরুত্বপূর্ণ। বর্ণিত বিষয়গুলি সমাজে ব্যাপ্তি লাভ করলে সমাজে শান্তি ও শৃংখলা বিনষ্ট হয়। জাহেলী আরবে এগুলি বিনষ্ট হয়েছিল বলেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এ বিষয়গুলি গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। আজকালকের কথিত সভ্য দুনিয়ায় এগুলি প্রকট আকারে বিদ্যমান। আধুনিক কলাকৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে যা ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। অতএব দুনিয়াপূজারী সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা আখেরাতমুখী করার ব্যাপারে যতক্ষণ পর্যন্ত সমাজনেতা ও রাষ্ট্রনেতাগণ আল্লাহর নামে অঙ্গীকারাবদ্ধ না হবেন, ততক্ষণ পর্যন্ত সমাজে ও রাষ্ট্রে কাংখিত শান্তি ও স্থিতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না।
(২) বায়‘আত (الْبَيْعَةُ) অর্থ অঙ্গীকার। ছাহেবে মির‘আত ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (রহঃ) বলেন,
سُمِّيَتِ الْمُعَاهَدَةُ عَلَى الإسلامِ بِالْمُبَايَعَةِ تَشْبيهاً لِّنَيْلِ الثَّوَابِ فِيْ مُقَابَلَةِ الطَّاعَةِ بِعَقْدِ الْبَيْعِ الَّذِي هُوَ مُقَابَلَةُ مَالٍ، كَأَنَّهُ بَاعَ مَا عِنْدَهُ مِنْ صَاحِبِهِ وَأَعْطَاهُ خَالِصَةَ نَفْسِهِ وَطَاعَتِهِ كَمَا فِيْ قَوْلِهِ تَعَالَى: (إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ) الآية
‘ইসলামের উপরে কৃত অঙ্গীকারকে বায়‘আত এজন্য বলা হয়েছে যে, ব্যবসায়িক চুক্তির বিপরীতে যেমন সম্পদ লাভ হয়, আমীরের নিকটে বায়‘আতের মাধ্যমে আনুগত্যের বিপরীতে তেমনি পুণ্য লাভ হয়। সে যেন আমীরের নিকটে তার খালেছ হৃদয় ও আনুগত্য বিক্রয় করে দেয়। যেমন আল্লাহ বলেন,إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِينَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُمْ بِأَنَّ لَهُمُ الْجَنَّةَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের জান ও মাল খরীদ করে নিয়েছেন জান্নাতের বিনিময়ে...’ (তাওবাহ ৯/১১১)।[4]
দুনিয়াবী সমাজ ব্যবস্থায় পরস্পরের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টির জন্য শপথ ও অঙ্গীকার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মুসলিম-অমুসলিম সব সমাজেই এটি রয়েছে। লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের ভিন্নতা এবং কার্যের ধরণ অনুযায়ী অঙ্গীকারের ধরণ ও ভাষা পরিবর্তিত হয়। ইসলামী জীবন ও সমাজ গঠনের লক্ষ্যে নেতা ও কর্মীর মধ্যে আল্লাহর নামে অঙ্গীকার করতে হয়। ইসলামী পরিভাষায় যাকে বায়‘আত বলা হয়। এর একমাত্র লক্ষ্য থাকে ইসলামী বিধান মেনে নিজের জীবন, পরিবার ও সমাজ গঠনের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং আখেরাতে জান্নাত লাভ করা। যার মধ্যে কোন দুনিয়াবী স্বার্থ থাকে না। যিনি যত বেশী আল্লাহর বিধান মেনে চলবেন, তিনি তত বেশী নেকী উপার্জন করবেন। সেকারণ ইসলামী ইমারত ও বায়‘আত এবং অন্যান্য নেতৃত্ব ও শপথ গ্রহণের মধ্যে আলো ও অন্ধকারের পার্থক্য রয়েছে। তাই ইসলামের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে ইমারত ও বায়‘আতের গুরুত্ব সর্বাধিক।
নবীগণ এ তরীকাতেই সমাজ সংস্কারের কাজ করেছেন। শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) মাক্কী ও মাদানী জীবনে একই তরীকা অবলম্বন করেছেন। সর্বদা উক্ত নীতি অব্যাহত থাকবে, যদি না তাওহীদী সমাজ গঠনের মহান লক্ষ্যে যোগ্য ও বিশ্বস্ত কোন আমীর ও মামূর পরস্পরে আল্লাহর নামে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন। যদিও সেখানে দৃঢ় বিশ্বাসী, কপট বিশ্বাসী, শিথিল বিশ্বাসী ও সুবিধাবাদী এমনকি বায়‘আত ভঙ্গকারীরাও থাকবে। যেভাবে নবীযুগে বায়‘আতকারীদের মধ্যেও ছিল। কিন্তু তাই বলে নীতির পরিবর্তন হবে না।
রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক উভয় ক্ষেত্রে এটি যরূরী। রাসূল (সাঃ) মাক্কী জীবনে সামাজিক এবং মাদানী জীবনে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উভয় ক্ষেত্রে আমীর ছিলেন। রাষ্ট্রীয় আমীর ইসলামের দন্ডবিধি সমূহ জারী করবেন। কিন্তু সামাজিক বা সাংগঠনিক আমীর সেটা করবেন না। তবে উপদেশ ও অনুশাসন জারি রাখবেন। যার মাধ্যমে ইসলামের বিধিনিষেধ সমূহ সামাজিক জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। সর্বোপরি জামা‘আতবদ্ধ জীবন যাপনের ইসলামী নির্দেশ বাস্তবায়নের মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভ করা সম্ভব হবে। অতএব অমুসলিম বা ফাসেক মুসলিম উভয় সরকারের শাসনামলে মুমিনের কর্তব্য হল, (১) শাসকের প্রতি অনুগত থাকা এবং ইসলামী আমীরের অধীনে জামা‘আতবদ্ধভাবে দেশে ইসলামী বিধান ও নিজেদের বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ইসলামী পন্থায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। (২) বিভিন্ন উপায়ে সরকারকে নছীহত করা। (৩) সরকারের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করা এবং পরিশেষে যালেম সরকারের বিরুদ্ধে আল্লাহর নিকটে কুনূতে নাযেলাহ পাঠ করা।
মোটকথা দেশে ইসলামী খেলাফত থাক বা না থাক, সমাজ পরিচালনায় ইসলামী আমীর থাকতেই হবে। নইলে ফাসেক নেতৃত্বে সমাজ বিপর্যস্ত হবে। যা আল্লাহর কাম্য নয়। এ কারণেই রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ তার গর্দানে আমীরের বায়‘আত নেই, সে জাহেলী (পথভ্রষ্ট) হালতে মৃত্যুবরণ করল। ক্বিয়ামতের দিন তার (মুক্তির জন্য) কোন দলীল (ওযর) থাকবে না’ (মুসলিম হা/১৮৫১)।
৩য় বায়‘আত, বায়‘আতে কুবরা (البيعة الثالثة البيعة الكبرى) : (যিলহাজ্জ ১৩ নববী বর্ষ: ৭৫জনের ইসলাম গ্রহণ)
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
দ্বাদশ নববী বর্ষের যিলহাজ্জ মাসে অনুষ্ঠিত আক্বাবাহ্র ২য় বায়‘আতে অংশগ্রহণকারী ১২ জন মুসলমানের সাথে পরের বছর যিলহাজ্জ মাসে (জুন ৬২২ খৃঃ) অনুষ্ঠিত আক্বাবাহর ৩য় বায়‘আতে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন মহিলাসহ মোট ৭৫ জন ইয়াছরিববাসী হজ্জে এসে বায়‘আত গ্রহণ করেন। এটিই ইসলামের ইতিহাসে বায়‘আতে কুবরা (الْبَيْعَةُ الْكُبْرَى) বা বড় বায়‘আত নামে খ্যাত। যা ছিল রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মাদানী জীবনের ভিত্তি স্বরূপ এবং আগামীতে ঘটিতব্য ইসলামী সমাজ বিপ্লবের সূচনাকারী। এই সময় মুছ‘আব বিন ওমায়ের (রাঃ) মক্কায় ফিরে আসেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে ইয়াছরিবে দাওয়াতের অবস্থা ও গোত্র সমূহের ইসলাম কবুলের সুসংবাদ প্রদান করেন। যা রাসূল (সাঃ)-কে হিজরতে উদ্বুদ্ধ করে।
মূলতঃ আক্বাবাহর বায়‘আত তিন বছরে তিনবার অনুষ্ঠিত হয়। ১১ নববী বর্ষে আস‘আদ বিন যুরারাহ্র নেতৃত্বে ৬ জন ইয়াছরিববাসীর প্রথম ইসলাম কবুলের বায়‘আত। ১২ নববী বর্ষে ১২ জনের দ্বিতীয় বায়‘আত এবং ১৩ নববী বর্ষে ৭৩+২=৭৫ জনের তৃতীয় ও সর্ববৃহৎ বায়‘আত- যার মাত্র ৭৫ দিনের মাথায় ১৪ নববী বর্ষের ২৭শে ছফর বৃহস্পতিবার মক্কা হতে ইয়াছরিবের উদ্দেশ্যে রাসূল (সাঃ)-এর হিজরতের সূচনা হয়।
বিবরণ : ১২ই যিলহজ্জ দিবাগত রাতের এক তৃতীয়াংশ অতিক্রান্ত হলে নিজ নিজ সম্প্রদায়ের লোকদের গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকা অবস্থায় পূর্বোক্ত ৭৫ জন ইয়াছরেবী হাজী রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাক্ষাতের জন্য বের হন এবং পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্বাবাহ্র সুড়ঙ্গ পথে অতি সঙ্গোপনে হাযির হন। অল্পক্ষণের মধ্যেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় চাচা আববাসকে সাথে নিয়ে উপস্থিত হন, যিনি তখনও প্রকাশ্যে মুসলমান হননি। তবে তিনি কখনও রাসূল (সাঃ)-কে একা ছাড়তেন না।
কুশলাদি বিনিময়ের পর প্রথমে আববাস কথা শুরু করেন। তিনি বলেন, মুহাম্মাদ আমাদের মাঝে কিভাবে আছেন তোমরা জানো। তাকে আমরা আমাদের কওমের শত্রুতা থেকে নিরাপদে রেখেছি এবং তিনি ইযযতের সাথে তার শহরে বসবাস করছেন। এক্ষণে তিনি তোমাদের ওখানে হিজরত করতে ইচ্ছুক। এ অবস্থায় তোমরা তার পূর্ণ যিম্মাদারীর অঙ্গীকার করলে আমাদের আপত্তি নেই। কিন্তু যদি এমনটি হয় যে, তোমরা তাকে নিয়ে গেলে, অতঃপর বিপদ মুহূর্তে তাকে পরিত্যাগ করলে, তাহলে তোমরা তাকে নিয়ে যেয়ো না। তিনি আমাদের মধ্যে সসম্মানেই আছেন’।
আববাসের বক্তব্যের পর প্রতিনিধি দলের মধ্য থেকে কা‘ব বিন মালেক বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা আববাসের কথা শুনেছি। এক্ষণে تَكَلَّمْ يَا رَسُولَ اللهِ فَخُذْ لِنَفْسِكَ وَلِرَبِّكَ مَا أَحْبَبْتَ ‘আপনি কথা বলুন এবং আপনার নিজের জন্য ও নিজ প্রভুর জন্য যে চুক্তি আপনি ইচ্ছা করেন, তা করে নিন’। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রথমে কুরআন থেকে কিছু আয়াত তেলাওয়াত করেন। অতঃপর তাদেরকে ইসলাম কবুলের আহবান জানান। অতঃপর তিনি বলেন,أُبَايِعُكُمْ عَلَى أَنْ تَمْنَعُونِى مِمَّا تَمْنَعُونَ مِنْهُ نِسَاءَكُمْ وَأَبْنَاءَكُمْ ‘আমি তোমাদের বায়‘আত নেব এ বিষয়ের উপর যে, তোমরা আমাকে হেফাযত করবে ঐসব বিষয় থেকে, যেসব বিষয় থেকে তোমরা তোমাদের নারী ও সন্তানদেরকে হেফাযত করে থাক’। সাথে সাথে বারা বিন মা‘রূর রাসূল (সাঃ)-এর হাত ধরে বললেন, نَعَمْ وَالَّذِي بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لَنَمْنَعَنَّكَ مِمَّا نَمْنَعُ مِنْهُ أُزُرَنَا ‘হ্যাঁ! ঐ সত্তার কসম যিনি আপনাকে সত্য সহ প্রেরণ করেছেন, অবশ্যই আমরা আপনাকে হেফাযত করব ঐসব বিষয় থেকে, যা থেকে আমরা আমাদের মা-বোনদের হেফাযত করে থাকি’।[5] এ সময় আবুল হায়ছাম ইবনুত তাইয়েহান বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের সঙ্গে ইহূদীদের সন্ধিচুক্তি রয়েছে। আমরা তা ছিন্ন করছি। কিন্তু এমন তো হবে না যে, আমরা এরূপ করে ফেলি। তারপর আল্লাহ যখন আপনাকে জয়যুক্ত করবেন, তখন আপনি আবার আপনার সম্প্রদায়ের কাছে ফিরে আসবেন ও আমাদের পরিত্যাগ করবেন’?
জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুচকি হেসে বললেন, بَلْ الدَّمَ الدَّمَ، وَالْهَدْمَ الْهَدْمَ، أَنَا مِنْكُمْ وَأَنْتُمْ مِنِّي، أُحَارِبُ مَنْ حَارَبْتُمْ، وَأُسَالِمُ مَنْ سَالَمْتُمْ ‘না! বরং তোমাদের রক্ত আমার রক্ত, তোমাদের ইযযত আমার ইযযত। আমি তোমাদের থেকে এবং তোমরা আমার থেকে। তোমরা যাদের সঙ্গে যুদ্ধ করবে, আমিও তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করব। তোমরা যাদের সঙ্গে সন্ধি করবে, আমিও তাদের সঙ্গে সন্ধি করব’।[6] এরপর সবাই যখন বায়‘আত গ্রহণের জন্য এগিয়ে এল, তখন আববাস বিন ওবাদাহ বিন নাযালাহ (যিনি গত বছর বায়‘আত করেছিলেন,) সকলের উদ্দেশ্যে বিশেষ করে নিজের গোত্র খাযরাজদের উদ্দেশ্যে বললেন, هَلْ تَدْرُونَ عَلاَمَ تُبَايِعُونَ هَذَا الرَّجُلَ؟ ‘তোমরা কি জানো কোন কথার উপরে তোমরা এই মানুষটির নিকটে বায়‘আত করছ? সবাই বলল, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তোমরা লাল ও কালো (আযাদ ও গোলাম) মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ব্যাপারে তাঁর নিকটে বায়‘আত করতে যাচ্ছ। যদি তোমাদের এরূপ ধারণা থাকে যে, যখন তোমাদের সকল সম্পদ নিঃশেষ হয়ে যাবে এবং তোমাদের সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা করা হবে, তখন তোমরা তাঁর সঙ্গ ছেড়ে যাবে, তাহলে এখনই ছেড়ে যাও। কেননা তাঁকে নিয়ে যাওয়ার পরে যদি তোমরা তাঁকে পরিত্যাগ কর, তাহলে ইহকাল ও পরকালে চরম লজ্জার বিষয় হবে। আর যদি তোমাদের ইচ্ছা থাকে যে, তোমাদের মাল-সম্পদের ধ্বংস ও সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যা সত্ত্বেও এ চুক্তি অক্ষুণ্ণ রাখবে, যার প্রতি তোমরা তাঁকে আহবান করছ, তাহলে অবশ্যই তা সম্পাদন করবে। কেননা আল্লাহর কসম! এতেই তোমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক জীবনের জন্য মঙ্গল নিহিত রয়েছে’ (ইবনু হিশাম ১/৪৪৬)।
আববাস বিন ওবাদাহর এই ওজস্বিনী ভাষণ শোনার পর সকলে সমবেত কণ্ঠে বলে উঠল, قَالُوا: فَإِنَّا نَأْخُذُهُ عَلَى مُصِيبَةِ الْأَمْوَالِ، وَقَتْلِ الْأَشْرَافِ، فَمَا لَنَا بِذَلِكَ يَا رَسُولَ اللهِ إنْ نَحْنُ وَفَّيْنَا (بِذَلِكَ)؟ قَالَ: الْجَنَّةُ. قَالُوا: اُبْسُطْ يَدَكَ، فَبَسَطَ يَدَهُ، فَبَايَعُوهُ ‘আমরা তাঁকে গ্রহণ করছি আমাদের মাল-সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি ও সম্ভ্রান্ত লোকদের হত্যার বিনিময়ে। কিন্তু যদি আমরা এই প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করি, তবে এর বদলায় আমাদের কি পুরস্কার রয়েছে হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, জান্নাত। তারা বলল, হাত বাড়িয়ে দিন। অতঃপর তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং তারা সবাই তাঁর হাতে বায়‘আত করল’ (ইবনু হিশাম ১/৪৪৬)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, رَبِحَ الْبَيْعُ لا نُقِيلُ ولا نَسْتقيلُ ‘ব্যবসা চুক্তি লাভজনক হয়েছে। আমরা কখনো তা রহিত করব না বা রহিত করার আবেদন করব না’।[কুরতুবী হা/৩৪৯৪; ইবনু জারীর হা/১৭২৮৪]
হযরত জাবের (রাঃ) বর্ণিত অন্য রেওয়ায়াতে এসেছে যে, লোকেরা বলে উঠল, فَوَاللهِ لاَ نَذَرُ هَذِهِ الْبَيْعَةَ وَلاَ نَسْتَقِيلُهَا ‘আল্লাহর কসম! আমরা এই বায়‘আত পরিত্যাগ করব না এবং রহিত করার আবেদন করব না’।[7] একই রাবী কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, فَوَاللهِ لاَ نَدَعُ هَذِهِ الْبَيْعَةَ أَبَداً وَلاَ نَسْلُبُهَا أَبَداً ‘আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই এই বায়‘আত পরিত্যাগ করব না এবং তা বাতিল করব না’ (আহমাদ হা/১৪৪৯৬, সনদ সহীহ)।
এ সময় দলনেতা এবং কাফেলার সর্বকনিষ্ঠ সদস্য আস‘আদ বিন যুরারাহ পূর্বের বক্তার ন্যায় কথা বললেন এবং পূর্বের ন্যায় সকলে পুনরায় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করলেন। অতঃপর তিনিই প্রথম বায়‘আত করলেন। এরপর একের পর এক সকলে রাসূল (সাঃ)-এর হাতে হাত রেখে অঙ্গীকার গ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ বায়‘আত অনুষ্ঠিত হয়।
আববাস উক্ত আনছার প্রতিনিধি দলের প্রতি ভালভাবে লক্ষ্য করে দেখেন এবং বলেন যে, ‘এরা সবাই তরুণ বয়সের। এদেরকে আমি চিনিনা’। এতে প্রমাণিত হয় যে, উক্ত দলে যুবকদের আধিক্য ছিল। প্রতিনিধি দলের মহিলা দু’জনের বায়‘আত হয় মৌখিক অঙ্গীকারের মাধ্যমে। সৌভাগ্যবতী এই মহিলা দু’জন হলেন বনু মাযেন গোত্রের উম্মে ‘উমারাহ নুসাইবা বিনতে কা‘ব(أُمُّ عُمَارَةَ نُسَيْبَةُ بِنْتُ كَعْبٍ) এবং বনু সালামাহ গোত্রের উম্মে মানী‘ আসমা বিনতে ‘আমর(أُمُّ مَنِيْعٍ أَسْمَاء بِنْتُ عَمْرٍو)।[ইবনু হিশাম ১/৪৬৬-৬৭; আহমাদ হা/১৫৮৩৬; আর-রাহীক্ব ১৪৮ পৃঃ] উবাদাহ বিন সামেত (রাঃ) এই বায়‘আতকে ‘বায়‘আতুল হারব’ বা যুদ্ধের বায়‘আত বলে অভিহিত করেন।[ইবনু হিশাম ১/৪৫৪; আহমাদ হা/২২৭৫২] কা‘ব বিন মালেকের বর্ণনায় এসেছে যে, প্রথম বায়‘আত করেন বারা বিন মা‘রূর। বনু আব্দিল আশহাল বলতো প্রথম বায়‘আতকারী ছিলেন তাদের গোত্রের আবুল হায়ছাম মালেক ইবনুত তাইয়েহান।[ইবনু হিশাম ১/৪৪৭; আহমাদ হা/১৫৮৩৬] অবশ্য বনু নাজ্জার ধারণা করত যে, তাদের গোত্রের আস‘আদই প্রথম বায়‘আত করেন’ (ইবনু হিশাম ১/৪৪৭)। আর দলনেতা ও প্রথম দাঈ হিসাবে এটাই স্বাভাবিক। তবে আবেগের বসে কেউ আগে বায়‘আত করলে সেটাও অসম্ভব নয়।
বায়‘আতনামা (تقرير البيعة) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━
عَنْ جَابِرٍ قَالَ: قُلْنَا يَا رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلاَمَا نُبَايِعُكَ قال: (১) عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِى النَّشَاطِ وَالْكَسَلِ (২) وَعَلَى النَّفَقَةِ فِى الْعُسْرِ وَالْيُسْرِ (৩) وَعَلَى الأَمْرِ بِالْمَعْرُوفِ وَالنَّهْىِ عَنِ الْمُنْكَرِ (৪) وَعَلَى أَنْ تَقُولُوا فِى اللهِ لاَ تَأْخُذُكُمْ فِيهِ لَوْمَةُ لاَئِمٍ (৫) وَعَلَى أَنْ تَنْصُرُونِى إِذَا قَدِمْتُ يَثْرِبَ فَتَمْنَعُونِى مِمَّا تَمْنَعُونَ مِنْهُ أَنْفُسَكُمْ وَأَزْوَاجَكُمْ وَأَبْنَاءَكُمْ وَلَكُمُ الْجَنَّةُ (৬) وَفِى رِوَايَةٍ عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ رَضِىَ اللهُ عَنْهُ: وَعَلَى أَنْ لاَ نُنَازِعَ الأَمْرَ أَهْلَهُ
‘জাবের (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি বলেন, আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা কোন কথার উপরে আপনার নিকটে বায়‘আত করব? তিনি বললেন, (১) সুখে-দুঃখে সর্বাবস্থায় আমার কথা শুনবে ও তা মেনে চলবে (২) কষ্টে ও সচ্ছলতায় (আল্লাহর রাস্তায়) খরচ করবে (৩) সর্বদা ন্যায়ের আদেশ দিবে ও অন্যায় থেকে নিষেধ করবে (৪) আল্লাহর জন্য কথা বলবে এভাবে যে, আল্লাহর পথে কোন নিন্দুকের নিন্দাবাদকে পরোয়া করবে না (৫) যখন আমি ইয়াছরিবে তোমাদের কাছে হিজরত করে যাব, তখন তোমরা আমাকে সাহায্য করবে এবং যেভাবে তোমরা নিজেদের ও নিজেদের স্ত্রী ও সন্তানদের হেফাযত করে থাক, সেভাবে আমাকে হেফাযত করবে। বিনিময়ে তোমরা ‘জান্নাত’ লাভ করবে’।[আহমাদ হা/১৪৪৯৬; সহীহাহ হা/৬৩] (৬) ওবাদাহ বিন সামেত (রাঃ) বর্ণিত অপর রেওয়ায়াতে এসেছে যে, ‘এবং আমরা নেতৃত্বের জন্য ঝগড়া করব না’।[ইবনু হিশাম ১/৪৫৪; মুসলিম হা/১৭০৯ (৪১); মিশকাত হা/৩৬৬৬]
বস্ত্ততঃ প্রায় দেড় হাযার বছর পূর্বে নেওয়া বায়‘আতের শর্তগুলির প্রতিটির গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা এ যুগেও পুরোপুরিভাবে মওজুদ রয়েছে। সেদিনেও যেমন জান্নাতের বিনিময়ে নেওয়া বায়‘আত সর্বাত্মক সমাজবিপ্লবের কারণ ঘটিয়েছিল, আজও তেমনি তা একই পন্থায় সম্ভব, যদি আমরা আন্তরিক হই।
১২ জন নেতা মনোনয়ন (تعيين إثنى عشر نقيبا) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
৭৫ জনের বায়‘আত সম্পন্ন হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাদের মধ্য হতে ১২ জনকে প্রতিনিধি (নাক্বীব) বা নেতা নির্বাচন করে দিলেন। তার মধ্যে ৯ জন খাযরাজ ও ৩ জন আউস গোত্র হতে। খাযরাজ গোত্রের নয়জন হলেন- (১) বনু নাজ্জারের আবু উমামাহ আস‘আদ বিন যুরারাহ (২) সা‘দ বিন রবী‘ (৩) আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা (৪) রাফে‘ বিন মালেক (৫) বারা বিন মা‘রূর (৬) আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর (৭) উবাদাহ বিন সামেত (৮) সা‘দ বিন ওবাদাহ (৯) মুনযির বিন ‘আমর।
আউস গোত্রের তিনজন হলেন, (১০) উসায়েদ বিন হুযায়ের (১১) সা‘দ বিন খায়ছামা (১২) রেফা‘আহ বিন আব্দুল মুনযির (আহমাদ হা/২২৮২৬)।
অতঃপর তিনি তাদের নিকট থেকে পুনরায় নেতৃত্বের দায়িত্ব পালনের বায়‘আত গ্রহণ করলেন।[8]
বায়‘আতের ফলাফল (ثمرة البيعة) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
আক্বাবাহর এই বায়‘আত এক যুগান্তকারী ফলাফল আনয়ন করে। যেমন-
(১) গোত্রীয় হানাহানিতে বিপর্যস্ত ও যুদ্ধক্লান্ত ইয়াছরিববাসী, আউস ও খাযরাজ দুই পরস্পরবিরোধী যুদ্ধমান গোত্র পুনরায় ঈমানের বন্ধনে আবদ্ধ হল। যা কোন দুনিয়াবী স্বার্থের ভিত্তিতে ছিল না। বরং কেবলমাত্র জান্নাতের স্বার্থে নিবেদিত ছিল।
(২) তাদের মধ্যে গোত্রীয় জাতীয়তার উপরে নতুন ঈমানী জাতীয়তার বীজ বপিত হল। যা তাদেরকে নতুন জীবনবোধে উদ্দীপিত করে তুলল।
(৩) বহিরাগত সূদী কারবারী ইহূদী-নাছারাগণ আউস ও খাযরাজ দুই বড় গোত্রের মধ্যে যুদ্ধ লাগিয়ে এতদিন ধরে যে অর্থনৈতিক ফায়েদা লুটে আসছিল, তার অবসানের সূচনা হল।
(৪) এর ফলে হিজরতের ক্ষেত্র প্রস্তুত হল এবং হিজরতের পূর্বেই ইয়াছরিববাসীগণ রাসূল (সাঃ)-কে বরণ করে নেবার জন্য সার্বিক প্রস্তুততি গ্রহণ করতে লাগল।
(৫) নতুন ঈমানী জাতীয়তার অনুভূতিতে আপ্লুত হয়ে ইয়াছরিববাসীগণ মক্কার নির্যাতিত মুহাজিরগণকে নিজেদের ভাই হিসাবে গ্রহণ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠলো। ঈমানী ভ্রাতৃত্বের এই অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপনের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল আক্বাবাহর এই মহান বায়‘আতের মাধ্যমে। এরপরেই রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কার নির্যাতিত মুসলমানদের ইয়াছরিবে হিজরতের নির্দেশ দেন।
আয়াত নাযিল (نزول الآية فى بشارة هذه البيعة) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
এই ঐতিহাসিক বায়‘আতকে স্বাগত জানিয়ে আল্লাহপাক স্বীয় রাসূলের নিকটে আয়াত নাযিল করে বলেন,
إِنَّ اللهَ اشْتَرَى مِنَ الْمُؤْمِنِيْنَ أَنْفُسَهُمْ وَأَمْوَالَهُم بِأَنَّ لَهُمُ الجَنَّةَ يُقَاتِلُوْنَ فِيْ سَبِيْلِ اللهِ فَيَقْتُلُوْنَ وَيُقْتَلُوْنَ وَعْدًا عَلَيْهِ حَقًّا فِي التَّوْرَاةِ وَالإِنجِيْلِ وَالْقُرْآنِ وَمَنْ أَوْفَى بِعَهْدِهِ مِنَ اللهِ فَاسْتَبْشِرُوْا بِبَيْعِكُمُ الَّذِيْ بَايَعْتُمْ بِهِ وَذَلِكَ هُوَ الْفَوْزُ الْعَظِيْمُ- (التوبة ১১১)
‘নিশ্চয়ই আল্লাহ খরীদ করে নিয়েছেন মুসলমানদের জান ও মাল জান্নাতের বিনিময়ে। তারা যুদ্ধ করে আল্লাহর রাস্তায়। অতঃপর মারে ও মরে। এই সত্য প্রতিশ্রুতি রয়েছে তওরাত, ইনজীল ও কুরআনে। আর আল্লাহর চাইতে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় কে অধিক? অতএব তোমরা সুসংবাদ গ্রহণ কর সেই লেন-দেনের উপরে যা তোমারা করেছ তার সাথে। আর এ হল এক মহান সাফল্য’।[9]
[1]. ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা বাক্বারাহ ৮৯ আয়াত, সনদ হাসান; সীরাহ সহীহাহ, সনদ হাসান ১/১২২ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/২১১; সনদ যঈফ, তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ২০৮।
[2]. ইবনু হিশাম ১/৫০৭-০৮। ১১ নববী বর্ষের হজ্জের মওসুমে (জুলাই ৬২০ খৃঃ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর হাতে সর্বপ্রথম বায়‘আতকারী ৬ জন যুবকের কনিষ্ঠতম নেতা, যার নেতৃত্বে মদীনায় সর্বপ্রথম ইসলাম প্রচারিত হয় এবং পরবর্তী দু’বছরে ৭৩ জন পুরুষ ও ২ জন নারী মক্কায় এসে বায়‘আত করেন। অতঃপর ১৪ নববী বর্ষের রবীউল আউয়াল মাসে (সেপ্টেম্বর ৬২২) হিজরত সংঘটিত হয় এবং ৬ মাস পরে ১ম হিজরী সনের শাওয়াল মাসে অল্প বয়সে তাঁর মৃত্যু হয় ও বাক্বী‘ গোরস্থানে ১ম সাহাবী হিসাবে কবরস্থ হন। মুহাজিরগণ বলেন, উসমান বিন মায‘ঊন (রাঃ) ছিলেন প্রথম মৃত্যুবরণকারী’ (আল-ইস্তী‘আব; আল-ইছাবাহ, ক্রমিক ১১১)। সুহায়লী বলেন, আউস গোত্রের কুলছূম বিন হিদাম সর্বপ্রথম মারা যান। তার কয়েকদিন পরেই আস‘আদ বিন যুরারাহ মৃত্যুবরণ করেন। উল্লেখ্য যে, রাসূল (সাঃ) মদীনায় হিজরত করে প্রথম ক্বোবাতে কুলছূম বিন হিদামের বাড়িতে অবস্থান করেন। তিনি ছিলেন অতি বৃদ্ধ এবং তিনিই ছিলেন হিজরতের পর অল্প দিনের মধ্যে সর্বপ্রথম মৃত্যুবরণকারী সাহাবী (ইবনু হিশাম ১/৪৯৩-টীকা ১)। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৪২৯-৩২; আর-রাহীক্ব ১৩৫ পৃঃ। জাবের বিন আব্দুল্লাহ বিন রিআব আনছারদের মধ্যে প্রথম ইসলাম কবুল করেন। ইনি বদর, ওহুদ, খন্দকসহ রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সকল যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। ইনি বিখ্যাত সাহাবী জাবের বিন আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর আনছারী (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুমা) নন (ইবনু হিশাম ১/৪৩০- টীকা ৭)।
[4]. ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী (১৩২২-১৪১৪ হিঃ/১৯০৪-১৯৯৪ খৃঃ), মির‘আতুল মাফাতীহ শরহ মিশকাতুল মাছাবীহ (বেনারস, ভারত : ৪র্থ সংস্করণ ১৪১৯/১৯৯৮ খৃঃ) হা/১৮-এর ব্যাখ্যা ১/৭৫ পৃঃ ‘ঈমান’ অধ্যায়।
[5]. আরবরা মহিলাদের উপনাম إزار অর্থাৎ তহবন্দ বলে থাকে। إزار এর বহুবচন হল أُزُر (ইবনু হিশাম ১/৪৪২ টীকা-২)।
[6]. ইবনু হিশাম ১/৪৪২-৪৪৩; ইবনু কুতায়বা বলেন, আরবরা কোন সন্ধি চুক্তি করার সময় বলত,دَمِى دَمُكَ وَهَدْمِى هَدْمُكَ (يعنى الْحُرْمَة) ‘আমার রক্ত তোমার রক্ত, আমার ইযযত তোমার ইযযত’ (ঐ, টীকা -৬)।
[7]. আহমাদ হা/১৪৬৯৪ সনদ সহীহ; হাকেম হা/৪২৫১, ২/৬২৪-২৫; আর-রাহীক্ব ১৫০ পৃঃ; ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবাহ ১১১ আয়াত।
[8]. ইবনু হিশাম ১/৪৪৬। প্রসিদ্ধ আছে যে, এসময় তিনি বলেছিলেন, أَنْتُمْ عَلَى قَوْمِكُمْ بِمَا فِيهِمْ كُفَلاَءُ كَكَفَالَةِ الْحَوَارِيِّينَ لِعِيسَى ابْنِ مَرْيَمَ، وَأَنَا كَفِيلٌ عَلَى قَوْمِي ‘তোমরা তোমাদের সম্প্রদায়ের উপরে তাদের ভাল-মন্দের ব্যাপারে দায়িত্বশীল, ঈসা (আঃ)-এর হাওয়ারীগণের দায়িত্বের ন্যায়। আর আমি আমার কওমের উপরে (মুসলমানদের উপরে) দায়িত্বশীল’ (আর-রাহীক্ব ১৫১-৫২ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ যঈফ (ঐ, তা‘লীক্ব ৯৫-৯৬; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ১৫০)।
[9]. তওবাহ ৯/১১১; কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর উক্ত আয়াত।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন