মদীনায় বিজয়ের খবর
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা আনছারীকে মদীনার উচ্চ ভূমিতে এবং যায়েদ বিন হারেছাহকে নিম্নভূমিতে পাঠিয়ে দেন মদীনায় দ্রুত বিজয়ের খবর পৌঁছানোর জন্য। ঐ সময় রাসূল (সাঃ)-এর কন্যা ও হযরত উসমানের স্ত্রী রুক্বাইয়া (রাঃ)-কে দাফন করে মাটি সমান করা হচ্ছিল। যার অসুখের কারণে রাসূল (সাঃ) উসমান ও উসামা বিন যায়েদকে মদীনায় রেখে গিয়েছিলেন তার সেবা-শুশ্রূষা করার জন্য।[ইবনু হিশাম ১/৬৪২; বায়হাক্বী হা/১৮৩৬৬; হাকেম হা/৪৯৫৯]
অন্য দিকে ইহূদী ও মুনাফিকরা রাসূল (সাঃ)-এর পরাজয় এমনকি তাঁর নিহত হবার খবর আগেই রটিয়ে দিয়েছিল। অতঃপর নিশ্চিত খবর জানতে পেরে মুহাজির ও আনছার সাহাবীগণ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ ও আল্লাহু আকবার ধ্বনিতে মদীনা মুখরিত করে তোলেন এবং রাসূল (সাঃ)-কে অভ্যর্থনার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন (আর-রাহীক্ব ২২৭ পৃঃ)।
গণীমত বণ্টন :
━━━━━━━━━
যুদ্ধ শেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বদরে তিনদিন অবস্থান করেন। উবাদাহ বিন সামেত (রাঃ) বলেন যে, এরি মধ্যে গণীমতের মাল নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হয়, যা এক সময়ে চরমে ওঠে। যারা শত্রুদের পিছু ধাওয়া করেছিল ও কাউকে হত্যা ও কাউকে বন্দী করেছিল, তারা তার সব মাল দাবী করল। আরেক দল যারা গণীমত জমা করেছিল, তারা সব মাল তাদের বলে দাবী করল। আরেক দল যারা রাসূল (সাঃ)-কে পাহারা দিয়ে তাঁকে হেফাযত করেছিল, তারাও সব নিজেদের বলে দাবী করল। এ সময় সূরা আনফাল ১ম আয়াত নাযিল হয়। يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَنْفَالِ قُلِ الْأَنْفَالُ لِلَّهِ وَالرَّسُولِ فَاتَّقُوا اللهَ وَأَصْلِحُوا ذَاتَ بَيْنِكُمْ وَأَطِيعُوا اللهَ وَرَسُولَهُ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন করছে যুদ্ধলব্ধ গণীমতের মাল বণ্টন সম্পর্কে। বলে দাও, গণীমতের মাল সবই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং পরস্পরে মীমাংসা করে নাও। আর তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য কর যদি তোমরা মুমিন হয়ে থাক’ (আনফাল ৮/১)। অতঃপর সেমতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সব মাল তার নিকটে জমা করতে বলেন।
যুদ্ধবন্দী হত্যা :
━━━━━━━━━
অতঃপর রাসূল (সাঃ) বদর থেকে রওয়ানা দিয়ে ‘ছাফরা’ (الصَّفْرَاء) গিরি সংকট অতিক্রম করে একটি টিলার উপরে গিয়ে বিশ্রাম করেন এবং সেখানে বসে গণীমতের সমস্ত মালের এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকী মাল সৈন্যদের মধ্যে সমভাবে বণ্টন করে দেন।[ইবনু হিশাম ১/৬৪৩; আহমাদ হা/২২৮১৪] এর পূর্বে ছাফরা গিরিসংকটে কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী দুষ্টমতি নযর বিন হারিছকে রাসূল (সাঃ)-এর আদেশক্রমে হযরত আলী (রাঃ) হত্যা করেন। এই শয়তান ইরাকের ‘হীরা’ থেকে নাচগানে পারদর্শী সুন্দরী নর্তকীদের খরীদ করে এনে মক্কাবাসীদের বিভ্রান্ত করত। যাতে কেউ রাসূল (সাঃ)-এর কথা না শোনে ও কুরআন না শোনে। এরপর ‘ইরকুয যাবিয়াহ’(عِرْقُ الظَّبْيَة) নামক স্থানে পৌঁছে আরেক শয়তানের শিখন্ডী উক্ববা বিন আবু মু‘আইত্বকে হত্যার নির্দেশ দেন’।[ইবনু হিশাম ১/৬৪৪; আল-বিদায়াহ ৩/৩০৫] যে ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-কে কা‘বাগৃহে সালাতরত অবস্থায় গলায় চাদর পেঁচিয়ে এবং পরে মাথায় উটের ভুঁড়ি চাপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেছিল (বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৬৩৭৮, ৫২০)। একে মারেন আছেম বিন সাবিত আনছারী (রাঃ)। মতান্তরে হযরত আলী (রাঃ)। এই দু’জন ব্যক্তি বন্দীর মর্যাদা পাবার যোগ্য ছিল না। কেননা তারা ছিল আধুনিক পরিভাষায় শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী (مِنْ أَكَابِرِ مُجْرِمِى الْحَرْب)।
মদীনায় অভ্যর্থনা :
━━━━━━━━━━━
বিজয়ী কাফেলা রাওহা (الرَّوْحَاء) পৌঁছলে মদীনা থেকে আগমনকারী অগ্রবর্তী অভ্যর্থনাকারী দলের সাথে প্রথম মুলাকাত হয় (ইবনু হিশাম ১/৬৪৩)। তারা বিপুল উৎসাহে বিজয়ী রাসূলকে অভ্যর্থনা জানায়। তাদের উচ্ছ্বাস দেখে রাসূল (সাঃ)-এর সাথী সাহাবী সালামা বিন সালামাহ(سَلَمَةُ بنُ سَلاَمَة) বলেন,مَا الَّذِي تُهَنِّئُونَنَا بِهِ وَاللهِ إِنْ لَقِينَا إِلاَّ عَجَائِزَ صُلْعًا كَالْبُدْنِ الْمُعَقَّلَةِ، فَنَحَرْنَاهَا ‘তোমরা কিজন্য আমাদের মুবারকবাদ দিচ্ছ’? ‘আল্লাহর কসম! আমরা তো কিছু টেকো মাথা বুড়োদের মুকাবিলা করেছি মাত্র, যারা ছিল বাঁধা উটের মত, যাদেরকে আমরা যবহ করেছি’। তার কথা বলার ঢং দেখে রাসূল (সাঃ) মুচকি হেসে বললেন, يَا ابْنَ أَخِي أُولَئِكَ الْمَلَأُ الأَكْبَرُ ‘হে ভাতিজা! ওরাই তো বড় বড় নেতা’।[ইবনু হিশাম ১/৬৪৩-৪৪; হাকেম হা/৫৭৬৭; যঈফাহ হা/২২৩৫] এ সময় সাহাবী উসায়েদ বিন হুযায়ের আনছারী(أُسَيدُ بنُ الْحُضَير) যিনি বদর যুদ্ধে শরীক ছিলেন না, তিনি সাক্ষাৎ করে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আপনাকে বিজয় দান করেছেন ও আপনার চক্ষুকে শীতল করেছেন। আল্লাহর কসম! আমি একথা ভেবে বদরে গমন হতে পিছনে থাকিনি যে, আপনার মুকাবিলা শত্রুদের সাথে হবে। ظَنَنْتُ أَنَّهَا عِيرٌ وَلَوْ ظَنَنْتُ أَنَّهُ عَدُوٌّ مَا تَخَلَّفْتُ ‘আমি তো ভেবেছিলাম এটা স্রেফ বাণিজ্য কাফেলা আটকানোর বিষয়। যদি বুঝতাম যে, এটা শত্রুদের বিরুদ্ধে মুকাবিলা, তাহলে আমি কখনো পিছনে থাকতাম না’। রাসূল (সাঃ) বললেন, (صَدَقْتَ) ‘তুমি সত্য বলেছ’ (আল-বিদায়াহ ৩/৩০৫)। পরের বছর ওহুদ যুদ্ধে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে আনছার বাহিনীর মধ্যে আউসদের পতাকাবাহী নিযুক্ত করেন। অতঃপর একদিকে কন্যা হারানোর বেদনা অন্যদিকে যুদ্ধ বিজয়ের আনন্দ এরি মধ্যে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় প্রবেশ করেন।
১ম ঈদুল ফিৎর :
━━━━━━━━━━
ইবনু ইসহাক বলেন, রামাযানের শেষে বা শাওয়াল মাসে রাসূল (সাঃ) বদর যুদ্ধ থেকে ফারেগ হন (ইবনু হিশাম ২/৪৩)। অতঃপর এমাসেই অর্থাৎ ২য় হিজরী সনে রামাযানের সিয়াম ও যাকাতুল ফিৎর ফরয করা হয়। যাতে যাকাতের নিছাবসমূহ বর্ণিত হয় (মির‘আত ৬/৩৯৯, ৩)। এটি আশ্রিত ও দুস্থ মুসলমানদের জন্য আশীর্বাদ হিসাবে দেখা দেয়। অতঃপর এ বছর ১লা শাওয়াল প্রথম ঈদুল ফিৎরের উৎসব পালিত হয়, যা মুসলমানদের নিকটে সত্যিকারের বিজয়োৎসবে পরিণত হয় (আর-রাহীক্ব ২৩১-৩২ পৃঃ)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন