বদর যুদ্ধ পর্যালোচনা
এই যুদ্ধ পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না। বরং আল্লাহর দূরদর্শী পরিকল্পনায় ও বিশেষ ব্যবস্থাপনায় সুনিপূণভাবে সংঘটিত হয় ও বিজয় লাভ হয়। যা পরবর্তী ইসলামী বিজয়ের ভিত্তি হিসাবে পরিগণিত হয়। কারণ ঐদিন মুসলমানরা ছিল নিতান্তই দুর্বল ও কাফেররা ছিল সবল। যেমন আল্লাহ বলেন, وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُونَ ‘আর আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছিলেন বদরের যুদ্ধে। যেদিন তোমরা দুর্বল ছিলে। অতএব তোমরা আল্লাহকে ভয় কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার’ (আলে ইমরান ৩/১২৩)। এমনকি মুসলমানরা যুদ্ধ করবে, না মদীনায় ফিরে যাবে, এ বিষয়েও ছিল পরামর্শ সভায় মতভেদ। পরে আল্লাহর নির্দেশে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় ও তাঁর বিশেষ অনুগ্রহে এ যুদ্ধে বিজয় লাভ হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, إِذْ أَنْتُمْ بِالْعُدْوَةِ الدُّنْيَا وَهُمْ بِالْعُدْوَةِ الْقُصْوَى وَالرَّكْبُ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَلَوْ تَوَاعَدْتُمْ لَاخْتَلَفْتُمْ فِي الْمِيعَادِ وَلَكِنْ لِيَقْضِيَ اللهُ أَمْرًا كَانَ مَفْعُولاً لِيَهْلِكَ مَنْ هَلَكَ عَنْ بَيِّنَةٍ وَيَحْيَى مَنْ حَيَّ عَنْ بَيِّنَةٍ وَإِنَّ اللهَ لَسَمِيعٌ عَلِيمٌ ‘স্মরণ কর, যখন তোমরা (মদীনার) নিকট প্রান্তে ছিলে এবং কাফের বাহিনী ছিল দূরপ্রান্তে। আর (আবু সুফিয়ানের ব্যবসায়ী) কাফেলা ছিল তোমাদের নিম্ন ভূমিতে। যদি তোমরা আগে থেকে যুদ্ধের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে চাইতে, তাহলে (সংখ্যায় অল্প হওয়ার কারণে) তোমরা সে প্রতিশ্রুতি রক্ষায় মতবিরোধ করতে। কিন্তু আল্লাহ (উভয় দলকে যুদ্ধে সমবেত করার) এমন একটি কাজ সম্পন্ন করতে চেয়েছিলেন, যা নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। এটা এজন্য যাতে যে ধ্বংস হবে সে যেন (ইসলামের) সত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ধ্বংস হয় এবং যে বেঁচে থাকবে, সে যেন সত্য প্রতিষ্ঠার পর বেঁচে থাকে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আনফাল ৮/৪২)।
উক্ত আয়াতে পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, বদরের যুদ্ধ আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর কোন পরিকল্পিত বিজয়াভিযান ছিল না।
জানা আবশ্যক যে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর জীবনে প্রায় সকল যুদ্ধই ছিল আত্মরক্ষামূলক কিংবা প্রতিরোধমূলক। কাফির-মুশরিক ও মুনাফিকদের অবিরাম ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও হামলা মুকাবিলা করতে গিয়েই তাঁকে যুদ্ধে লিপ্ত হতে হয়েছিল।
কুরআনী বর্ণনা :
━━━━━━━━━
বদর যুদ্ধ বিষয়ে সূরা আনফাল নাযিল হয়। যার মধ্যে ১-৪৯ পর্যন্ত আয়াতগুলি কেবল বদর যুদ্ধ সম্পর্কেই নাযিল হয়েছে। উক্ত সূরার ১ ও ৪১ আয়াতে গণীমত বণ্টনের নীতিমালা বর্ণিত হয়। তাছাড়া সেখানে মুসলমানদের দুর্বলতা এবং আল্লাহর গায়েবী মদদের কথা যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি উক্ত যুদ্ধের মহৎ উদ্দেশ্যের কথাও বর্ণিত হয়েছে। যার দ্বারা জাহেলী যুগের যুদ্ধের সাথে এ যুদ্ধের পার্থক্য স্পষ্ট হয়ে যায়। সেখানে যুদ্ধবন্দী বিষয়ক নীতি, চুক্তিবদ্ধ গোষ্ঠী ও চুক্তি বহির্ভূত মুমিনদের সাথে ব্যবহার বিধি যেমন বর্ণিত হয়েছে, তেমনি ইসলাম যে কেবল একটি বিশ্বাসের নাম নয়, বরং একটি বাস্তব রীতি-নীতি সমৃদ্ধ সমাজ দর্শনের নাম, সেটাও ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। উক্ত সূরায় আল্লাহ মুসলমানদের প্রতি তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন,
وَاذْكُرُوْا إِذْ أَنْتُمْ قَلِيْلٌ مُّسْتَضْعَفُوْنَ فِي الأَرْضِ تَخَافُوْنَ أَنْ يَّتَخَطَّفَكُمُ النَّاسُ فَآوَاكُمْ وَأَيَّدَكُمْ بِنَصْرِهِ وَرَزَقَكُم مِّنَ الطَّيِّبَاتِ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ- (الأنفال ২৬)-
‘আর স্মরণ কর যখন তোমরা ছিলে সংখ্যায় অল্প ও পৃথিবীতে তোমরা দুর্বল বলে গণ্য হতে। আর তোমরা আশংকা করতে যে, লোকেরা তোমাদের যেকোন সময়ে উঠিয়ে নিয়ে যাবে। অতঃপর আল্লাহ তোমাদের আশ্রয় দেন ও তোমাদেরকে নিজ সাহায্য দ্বারা শক্তিশালী করেন। আর তোমাদেরকে উত্তম বস্ত্ত সমূহ জীবিকারূপে দান করেন, যাতে তোমরা আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও’ (আনফাল ৮/২৬)।
বদর যুদ্ধের গুরুত্ব :
━━━━━━━━━━━
(১) এটাই ছিল মুসলমানদের সাথে মুশরিকদের সর্বপ্রথম ব্যাপকভিত্তিক সশস্ত্র সংঘর্ষ। (২) এটি ছিল ইসলামের টিকে থাকা না থাকার ফায়ছালাকারী যুদ্ধ (৩) এটি ছিল হক ও বাতিলের পার্থক্যকারী। সেকারণ এ যুদ্ধের দিনটিকে পবিত্র কুরআনে ‘ইয়াওমুল ফুরক্বান’ (يَوْمُ الْفُرْقَانِ) বা কুফর ও ইসলামের মধ্যে ‘ফায়ছালাকারী দিন’ (আনফাল ৮/৪১) বলে অভিহিত করা হয়েছে। (৪) বদরের এ দিনটিকে আল্লাহ স্মরণীয় হিসাবে উল্লেখ করে বলেন, وَلَقَدْ نَصَرَكُمُ اللهُ بِبَدْرٍ وَأَنْتُمْ أَذِلَّةٌ فَاتَّقُوْا اللهَ لَعَلَّكُمْ تَشْكُرُوْنَ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের সাহায্য করেছেন বদরের যুদ্ধে। অথচ তোমরা ছিলে দুর্বল। অতএব আল্লাহকে ভয় কর যাতে তোমরা কৃতজ্ঞ হতে পার’ (আলে ইমরান ৩/১২৩)। উল্লেখ্য যে, ‘বদর’ নামটি কুরআনে মাত্র একটি স্থানেই উল্লেখিত হয়েছে।
(৫) এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে হাদীছে অত্যন্ত উচ্চ মর্যাদা বর্ণিত হয়েছে। এমনকি মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে গোপন কথা ফাঁস করে মক্কায় প্রেরিত হাতেব বিন আবু বালতা‘আহ-এর পত্র ধরা পড়ার পর আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে খেয়ানত করার অপরাধে উমর (রাঃ) তাকে হত্যা করার অনুমতি চাইলে রাসূল (সাঃ) বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের সম্পর্কে বলেছেন, اعْمَلُوا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ وَجَبَتْ لَكُمُ الْجَنَّةُ ‘তোমরা যা খুশী কর। তোমাদের জন্য জান্নাত ওয়াজিব হয়ে গেছে’। এ কথা শুনে উমর (রাঃ) কাঁদতে থাকেন’ (বুখারী হা/৬২৫৯)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না’ বলে জনৈক ব্যক্তি মন্তব্য করলে তার উদ্দেশ্যে রাসূল (সাঃ) বলেন, كَذَبْتَ لاَ يَدْخُلُهَا فَإِنَّهُ شَهِدَ بَدْرًا وَالْحُدَيْبِيَةَ ‘তুমি মিথ্যা বললে। সে জাহান্নামে প্রবেশ করবে না। কেননা সে বদরে ও হুদায়বিয়াতে অংশগ্রহণ করেছে’।[মুসলিম হা/২৪৯৫; মিশকাত হা/৬২৪৩] অন্য বর্ণনায় এসেছে, لَنْ يَدْخُلَ النَّارَ رَجُلٌ شَهِدَ بَدْراً وَالْحُدَيْبِيَةَ ‘কখনোই জাহান্নামে প্রবেশ করবে না ঐ ব্যক্তি যে বদরে ও হুদায়বিয়াতে অংশগ্রহণ করেছে’।[আহমাদ হা/১৫২৯৭; সহীহাহ হা/২১৬০]
ফলাফল :
━━━━━━
(১) বদরের যুদ্ধ ছিল কাফেরদের মূল কর্তনকারী ও সত্যকে প্রতিষ্ঠা দানকারী।
এ যুদ্ধের পরে কাফের সমাজে এমন আতংক প্রবেশ করে যে, তারা আর কখনো বিজয়ের মুখ দেখেনি। যেমন আল্লাহ বলেন, وَإِذْ يَعِدُكُمُ اللهُ إِحْدَى الطَّائِفَتِيْنِ أَنَّهَا لَكُمْ وَتَوَدُّوْنَ أَنَّ غَيْرَ ذَاتِ الشَّوْكَةِ تَكُوْنُ لَكُمْ وَيُرِيْدُ اللهُ أَنْ يُّحِقَّ الحَقَّ بِكَلِمَاتِهِ وَيَقْطَعَ دَابِرَ الْكَافِرِيْنَ- لِيُحِقَّ الْحَقَّ وَيُبْطِلَ الْبَاطِلَ وَلَوْ كَرِهَ الْمُجْرِمُوْنَ ‘আর যখন আল্লাহ দু’টি দলের একটির ব্যাপারে তোমাদের সাথে ওয়াদা করেছিলেন যে, সেটি তোমাদের হস্তগত হবে আর তোমরা কামনা করছিলে যাতে কোনরূপ কণ্টক ছাড়াই সেটা তোমাদের হাতে আসে। অথচ আল্লাহ চাইতেন সত্যকে স্বীয় সাহায্যের মাধ্যমে সত্যে পরিণত করতে এবং কাফেরদের মূল কর্তন করে দিতে’। ‘যাতে করে তিনি সত্যকে সত্য এবং মিথ্যাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে দেন, যদিও পাপীরা তাতে নাখোশ হয়’ (আনফাল ৮/৭-৮)।
(২) এ যুদ্ধে বিজয়ের ফলে মুসলমানদের শক্তি ও সাহস বৃদ্ধি পায়। দলে দলে লোকেরা ইসলামে প্রবেশ করতে থাকে। এমনকি মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই খাযরাজী ও তার সাথীরা প্রকাশ্যে ইসলাম কবুলে বাধ্য হয় এবং শত্রুরা ভীত হয়ে চুপসে যায়।
(৩) বদরের যুদ্ধে বিজয় ছিল মক্কা বিজয়ের সোপান স্বরূপ। এর কিছু দিন পূর্বে শা‘বান মাস থেকে কা‘বার দিকে কিবলা পরিবর্তিত হয় এবং বদর যুদ্ধের মাত্র ছয় বছর পরেই ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান তারিখে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে যা পূর্ণতা লাভ করে।
(৪) যুদ্ধটি ছিল অভাবনীয়। কেননা বদর যুদ্ধ পূর্ব পরিকল্পিত ছিল না (আনফাল ৮/৪২)। তেমনি বিজয়টিও ছিল অভাবনীয়। যা স্রেফ আল্লাহর বিশেষ রহমতে সাধিত হয়। যুগে যুগে ইসলামী বিজয় এভাবেই হয়ে থাকে।
(৫) বদর যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অভূতপূর্ব বিজয়ে ৪টি পক্ষ দারুণভাবে ক্ষুব্ধ ও ক্রুদ্ধ হয়। মক্কার কুরায়েশরা, মদীনার ইহূদী ও মুনাফিকরা এবং মদীনার আশপাশের নাজদ প্রভৃতি এলাকার বেদুঈনরা। যারা ছিল স্রেফ দস্যুশ্রেণীর লোক। ঈমান ও কুফর কোনটির প্রতি তাদের কোন আকর্ষণ ছিল না। উপরোক্ত চারটি শ্রেণীর প্রত্যেকেই নিশ্চিত ছিল যে, মদীনায় ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠিত হলে তা অবশ্যই তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যাবে। সেকারণ তারা সাধ্যমত সকল উপায়ে মদীনায় একটি স্থিতিশীল ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করতে থাকে।
(৬) এ যুদ্ধের ফলে ইহূদী গোত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধিশালী গোত্র বনু ক্বাইনুক্বা‘ ভীষণভাবে ভীত ও ক্রুদ্ধ হয়। তাদের ষড়যন্ত্র তুঙ্গে উঠে। ফলে মদীনা থেকে তাদের বহিষ্কার অবশ্যম্ভাবী হয়। বদর যুদ্ধের পরেই ২য় হিজরীর শাওয়াল মাসে যা কার্যকর হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন