তাওহীদী চেতনার ফলাফল
মক্কায় প্রথম ‘অহি’ আগমনের পরপরই নির্দেশ এসেছিল,يَا أَيُّهَا الْمُدَّثِّرُ- قُمْ فَأَنْذِرْ ‘হে চাদরাবৃত! ওঠো, ভয় দেখাও’ (মুদ্দাছছির ৭৪/১-২)। তারপর নির্দেশ এল,يَا أَيُّهَا الْمُزَّمِّلُ، قُمِ اللَّيْلَ ‘হে চাদরাবৃত! ওঠো রাত্রিতে আল্লাহর স্মরণে দাঁড়িয়ে যাও’ (মুযযাম্মিল ৭৩/১-২)। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর শেষনবী ও তাঁর সাথীদেরকে নৈতিক বলে অধিকতর বলিয়ান করে গড়ে তোলার প্রশিক্ষণ সূচী প্রদান করেন। অতঃপর তাদেরকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, إِنَّا سَنُلْقِي عَلَيْكَ قَوْلاً ثَقِيْلاً ‘আমরা সত্বর তোমার উপরে কিছু ভারী কথা নিক্ষেপ করব’ (ঐ, ৭৩/৫)। আর সেই ‘ভারী কথা’-ই ছিল ভবিষ্যৎ ইসলামী সমাজ বিনির্মানের গুরু দায়িত্ব। যার ভিত্তি ছিল আল্লাহ প্রেরিত অহি-র উপরে।
ব্যক্তির নৈতিক ভিত্তি মযবুত না হলে তার মাধ্যমে সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। আর সমাজকে কুসংস্কার মুক্ত করা ও তাকে শয়তানের আনুগত্য হতে বের করে আল্লাহর আনুগত্যে ফিরিয়ে আনা যে কতবড় কঠিন কাজ, তা ভুক্তভোগী মাত্রই জানেন। কিন্তু নবীগণকে তো যুগে যুগে আল্লাহ এজন্যই দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। অন্যান্য নবীগণ স্ব স্ব গোত্র ও অঞ্চলের জন্য প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) প্রেরিত হয়েছিলেন পুরা মানব জাতির জন্য (সাবা ২৫/২৮)। আর সেজন্যই তাঁর দায়িত্বের পরিধি ছিল অনেক ব্যাপক এবং সাথে সাথে অনেক দুরূহ। অঞ্চল ও ভাষাগত গন্ডি পেরিয়ে তাঁর দাওয়াত ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীর সর্বত্র। জাতীয়তার প্রচলিত সংজ্ঞা ভেঙ্গে প্রতিষ্ঠিত হল বিশ্বব্যাপী এক নতুন জাতীয়তা। যাকে বলা হয়, ইসলামী জাতীয়তা। কুরআনে বলা হয়েছে, ‘মুসলিম মিল্লাত’ (হজ্জ ২২/৭৮) বা ‘খায়রে উম্মাহ’ (আলে ইমরান ৩/১১০) অর্থাৎ ‘শ্রেষ্ঠ জাতি’।
ভাষা, বর্ণ ও অঞ্চল ভিত্তিক জাতীয়তার বিপরীতে এ ছিল এক অমর আদর্শ ভিত্তিক বিশ্ব জাতীয়তা। ভিন দেশের, ভিন রং ও বর্ণের ভিন ভাষার সকল মানুষ একই ভাষায় সকলকে সালামের মাধ্যমে সম্ভাষণ জানায়, একই ভাষায় আযান দেয়, একই ভাষায় সালাত আদায় করে। সকলে একই ভাষায় কুরআন ও হাদীছ পড়ে। সবাই এক আল্লাহর বিধান মেনে চলে। সেজন্যই তো দেখা গেল, মাত্র কয়েক বছরের দাওয়াত ও জিহাদের মাধ্যমে বিশ্বসেরা কুরায়েশ বংশের আবুবকর, উমর, উসমান, আলীর পাশে দাঁড়িয়ে পায়ে পা ও কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সালাত আদায় করার মর্যাদা লাভ করল তৎকালীন সমাজের সবচাইতে নিকৃষ্ট শ্রেণীর কৃষ্ণকায় নিগ্রো ক্রীতদাস বেলাল হাবশী, যায়েদ বিন হারেছাহ, মেষ চারক আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। ইসলামের আগমন না ঘটলে সমাজের নিগৃহীত, নিস্পেষিত, নিপীড়িত এইসব মহান মানুষগুলির সন্ধান পৃথিবী কোনদিনই পেত না। এই মহান আদর্শের বরকতেই আমরা দেখেছি ইয়ামনের যেমাদ আযদী, ইয়াছরিবের আবু যার গেফারী, তোফায়েল দাওসী, যুলকালা‘ হিমইয়ারী, ‘আদী বিন হাতেম তাঈ, ছুমামাহ নাজদী, আবু সুফিয়ান উমুভী, আবু ‘আমের আশ‘আরী, কুরয ফিহরী, আবু হারেছ মুছত্বালেক্বী, সুরাক্বাহ মুদলেজী, আব্দুল্লাহ বিন সালাম আহবারে ইহূদী, ছুরমা বিন আনাস রুহবানে নাছারা প্রমুখ ভিন গোত্রের ভিনভাষী ও ভিন ধর্মের লোকদের একই ধর্মে লীন হয়ে পাশাপাশি বসতে ও আপন ভাইয়ের মত আচরণ করতে। ইসলামের বরকতেই দুনিয়া দেখেছে শ্বেতাঙ্গ আবুবকর কুরায়শী ও কৃষ্ণাঙ্গ বেলাল হাবশীকে এবং রোমের খ্রিষ্টান ছুহায়েব রূমী ও পারস্যের অগ্নিপূজক সালমান ফারেসীকে একত্রিত করে একটি অসাম্প্রদায়িক ইসলামী সমাজ গড়তে। আমরা দেখেছি মক্কার মুহাজির ভাইদের জন্য মদীনার আনছার ভাইদের মহান আত্মত্যাগের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। মুষ্টিমেয় ত্যাগপূত এইসব মহান ব্যক্তিদের হাতেই আল্লাহ বিজয়ের সেই মহান মুকুট তুলে দেন, যার ওয়াদা তিনি করেছিলেন।-
هُوَ الَّذِيْ أَرْسَلَ رَسُوْلَهُ بِالْهُدَى وَدِيْنِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّيْنِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُوْنَ ‘তিনিই সেই সত্তা যিনি তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত ও সত্যধর্ম সহকারে। যাতে তিনি একে সকল ধর্মের উপরে বিজয়ী করেন। যদিও মুশরিকরা তা অপসন্দ করে’ (ছফ ৬১/৯)। তিনি মুমিন ও সৎকর্মশীল বান্দাদের হাতে ইসলামী খিলাফত অর্পণের ওয়াদা করেছেন (নূর ২৪/৫৫-৫৬)। তিনি বলেন,وَكَفَى بِاللهِ شَهِيْدًا ‘(এ ব্যাপারে) সাক্ষী হিসাবে আল্লাহই যথেষ্ট’ (ফাৎহ ৪৮/২৮)। অর্থাৎ ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য মুসলমানকে আল্লাহর অনুগ্রহ পাবার যোগ্য করে নিজেদের গড়ে তুলতে হবে। অতঃপর আল্লাহর অনুগ্রহই যথেষ্ট হবে ইসলামের বিজয়ের জন্য। জনবল, অস্ত্রবল সহায়ক শক্তি হলেও তা কখনো মূল শক্তি নয়। মূল শক্তি হল ঈমান এবং যার কারণেই নেমে আসে আল্লাহর সাহায্য। তিনিই মুমিনদের পক্ষে শত্রুদের প্রতিরোধ করেন। যেমন তিনি বলেন,إِنَّ اللهَ يُدَافِعُ عَنِ الَّذِيْنَ آمَنُوْا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ كُلَّ خَوَّانٍ كَفُوْرٍ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের পক্ষ থেকে (শত্রুদের) প্রতিরোধ করেন। আর আল্লাহ কোন খেয়ানতকারী ও অকৃতজ্ঞ ব্যক্তিকে ভালোবাসেন না’ (হজ্জ ২২/৩৮)।
বস্ত্ততঃ আরবরা শিরক ও কুফরী ছেড়ে ঈমানের দিকে ফিরে এসেছিল। আর তাই আল্লাহ তাদের থেকে শত্রুদের হটিয়ে দেন। তৎকালীন বিশ্বশক্তি ক্বায়ছার ও কিসরা পর্যন্ত তাদের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছিল। এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা সর্বত্র ইসলামের বিজয়ী ঝান্ডা উড্ডীন হয়েছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জীবদ্দশাতেই ইসলাম আদর্শিক ও রাজনৈতিক সবদিক দিয়েই বিজয় লাভ করেছিল। ফালিল্লাহিল হাম্দ।
সামাজিক পরিবর্তন :
━━━━━━━━━━━━
ইসলামী শিক্ষার বরকতে দুনিয়াপূজারী মানুষগুলি হয়ে উঠলো আখেরাতের পূজারী। আখেরাতের বিনিময়ে তারা দুনিয়াকে তুচ্ছ জ্ঞান করল। যে কাজে আখেরাতে কল্যাণ নেই, সে কাজ পরিত্যক্ত হল। সম্পদের প্রাচুর্য তাদেরকে দিকভ্রান্ত করতে পারেনি। বরং আখেরাতের স্বার্থে দ্বীনের কাজে অকাতরে সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে নিঃস্ব হয়ে যেতেই তারা অধিক আনন্দ বোধ করলেন। নিজের সবচেয়ে পসন্দের বস্ত্তটি দান করে দিয়ে তাঁরা মানসিক তৃপ্তি পেতেন। দিনের বেলা দাওয়াত ও জিহাদে কিংবা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যস্ততায় সময় কাটলেও রাতটি ছিল স্রেফ আল্লাহর ইবাদতের জন্য নিবেদিত। যে মানুষটি দু’দিন আগেও আল্লাহকে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন মূর্তির শরণাপন্ন হত, মহামূল্য নযর-নেয়ায নিয়ে প্রাণহীন মূর্তির সন্তুষ্টিতে রত ছিল এবং নিজেদের কপোল কল্পিত বিভিন্ন অসীলার মাধ্যমে আল্লাহকে পাওয়ার বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করত, সেই মানুষটিই এখন সবকিছু ছুঁড়ে ফেলে সরাসরি আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করছে। দেহমন ঢেলে দিয়ে তাঁর সন্তুষ্টি কামনায় রাত্রি জাগরণে ও ইবাদতে লিপ্ত হচ্ছে। দু’দিন আগেও যারা পথে-ঘাটে রাহাযানি করত, নারীর ইযযত লুট করত, তারাই আজ অপরের জান-মাল ও ইযযত রক্ষায় হাসিমুখে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। মানুষ এখন একাকী রাস্তায় নির্ভয়ে চলে। ইরাকের হীরা নগরী থেকে একজন পর্দানশীন গৃহবধু একাকী মক্কায় এসে কা‘বাগৃহ তাওয়াফ করে চলে যান নিরাপদে নির্বিঘ্নে। বিপদগ্রস্ত নারীকে শক্তিশালী একজন পরপুরুষ মায়ের মর্যাদা দিয়ে তার বিপদে সাহায্য করছে স্রেফ পরকালীন স্বার্থে।
দু’দিন আগেও যারা সূদ ব্যতীত কাউকে ঋণ দিত না, এখন তারাই সূদকে নিকৃষ্টতম হারাম গণ্য করছে এবং নিঃস্বার্থভাবে মানুষকে ‘কর্যে হাসানাহ’ দিচ্ছে। যেখানে ছিল গাছতলা ও পাঁচতলার আকাশসম অর্থনৈতিক বৈষম্য, সেখানে অবস্থা এমন দাঁড়াল যে, যাকাত নেওয়ার মত হকদার খুঁজে পাওয়া যায় না। দু’দিন আগেও যে সমাজে ছিল মদ্যপান, নগ্নতা, বেহায়াপনা ও যৌনতার ছড়াছড়ি, আজ সেই সমাজে চালু হয়েছে পর্দানশীন, মার্জিত ও সুনিয়ন্ত্রিত জীবনাচার। যে সমাজে ছিল ধর্মের নামে অসংখ্য শিরক-বিদ‘আত ও অর্থহীন লোকাচার। ছিল গোত্রে গোত্রে বিভক্তি ও হানাহানি। আজ সেখানে সৃষ্টি হয়েছে পরস্পরে আদর্শিক মহববত ও ভালোবাসার অটুট বন্ধনের এক জান্নাতী আবহ। সবকিছুই সুন্নাহ দ্বারা সুনিয়ন্ত্রিত ও সুবিন্যস্ত। আগে যেখানে ছিল মানুষের মধ্যে প্রভু ও দাসের সম্পর্ক, ছোট-বড় ও সাদা-কালোর ভেদাভেদ। আজ সেখানে এক আল্লাহর দাসত্বের অধীনে সকল মানুষের অধিকার সমান। অর্থনৈতিক বৈষম্য, বংশীয় কৌলিন্য ও আভিজাত্যের অহংকারের বদলে শ্রেষ্ঠত্ব নির্ণীত হল আল্লাহভীরুতার মাপকাঠিতে। বলা হল, সকল মানুষ এক আদমের সন্তান। আর আদম ছিলেন মাটির তৈরী। তাই কারু কোন অহংকার নেই। বলা হল সকলের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ। তাই তাঁর প্রেরিত বিধান সকলের জন্য সমান। আগে যেখানে দুনিয়াবী ভোগবিলাস ছিল মূল লক্ষ্য। আজ সেখানে দুনিয়া তুচ্ছ, আখেরাতই মুখ্য।
লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের এই আমূল পরিবর্তনের ফলে মুসলমানদের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষা ও সমাজনীতি সবকিছুতেই সূচিত হয় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন। যা পুরা মানব সভ্যতায় আনে এক বৈপ্লবিক অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা। শিক্ষা, সংস্কৃতি, কৃষ্টি ও বিজ্ঞানের অভাবিত উন্নতিতে পরবর্তীকালে মুসলমানদের যে অনন্য অবদানের স্বাক্ষর বিশ্ব অবলোকন করেছিল, তার মূলে ছিল ইসলামের তাওহীদী চেতনার অম্লান ছাপ। তার সর্বজয়ী আবেদনের বাস্তব প্রতিফলন। তাওহীদ ও সুন্নাহর সনিষ্ঠ অনুসারী হতে পারলে মুসলমান আবার তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ বলেন,وَلاَ تَهِنُوا وَلاَ تَحْزَنُوا وَأَنْتُمُ الْأَعْلَوْنَ إِنْ كُنْتُمْ مُؤْمِنِينَ ‘তোমরা হীনবল হয়োনা ও চিন্তান্বিত হয়ো না। তোমরাই বিজয়ী, যদি তোমরা মুমিন হও’ (আলে ইমরান ৩/১৩৯)।
শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ :
━━━━━━━━━━━━
(১) আদর্শিক বিজয় রাজনৈতিক বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
(২) বৃহত্তর রাজনৈতিক বিজয় আদর্শ কবুলে সহায়ক হয়। কিন্তু তাতে সুবিধাবাদীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
(৩) শেষনবী হিসাবে তাঁর মাধ্যমে ইসলামের সার্বিক বিজয় আল্লাহর কাম্য ছিল। কিন্তু সকল যুগে সর্বত্র এটি আবশ্যিক নয়।
(৪) রাজনৈতিক বিজয় সাময়িক। কিন্তু তাওহীদের বিজয় চিরস্থায়ী। তাই ইক্বামতে দ্বীন অর্থ ইক্বামতে হুকূমত নয়, বরং ইক্বামতে তাওহীদ। যার জন্য রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আবশ্যিক কিংবা পূর্ব শর্ত নয়।
(৫) হুকূমত থাক বা না থাক, মুসলমানকে সর্বাবস্থায় তাওহীদের অনুসারী থাকতে হবে। তাহলেই বিশ্বব্যাপী ইসলামের প্রচার ও প্রসার অব্যাহত থাকবে। এমনকি অঞ্চল বিশেষে রাজনৈতিক বিজয় অর্জিত হবে, যদি আল্লাহ চান।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন