শনিবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৫

তাবূক যুদ্ধ

 

তাবূক যুদ্ধ

(৯ম হিজরীর রজব মাস)
মুতার যুদ্ধে রোমকদের বিরুদ্ধে প্রথম অভিযানের ১৩ মাস পর এটি ছিল তাদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযান। আর এটিই ছিল রাসূল (সাঃ)-এর অংশগ্রহণে তাঁর জীবনের শেষ যুদ্ধ।
এই অভিযানে মুসলিম বাহিনীতে সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩০,০০০ এবং রোমকদের সৈন্য সংখ্যা ছিল ৪০,০০০-এর বেশী। যাদের মধ্যে লাখাম ও জুযামসহ অন্যান্য আরব খ্রিষ্টান গোত্রসমূহ ছিল। যারা ইতিমধ্যে শামের বালক্বা (بَلْقَاء) পর্যন্ত এসে গিয়েছিল। গত বছরে মুতার যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয়ের প্রতিশোধ নেবার জন্য তারা সরাসরি মদীনায় হামলার এই গোপন প্রস্তুততি নেয়। তাতে মদীনার সর্বত্র রোমক ভীতির(خَوْفُ غَسَّانَ) সঞ্চার হয়। কিন্তু এতদসত্ত্বেও রাসূল (সাঃ) তাদের প্রতিরোধে রোমান সীমান্ত অভিমুখে যাত্রা করলে তারা সংবাদ পেয়ে ভীত হয়ে পালিয়ে যায়। রামাযান মাসে মুসলিম বাহিনী বিনা যুদ্ধে জয়ী হয়ে মদীনায় ফিরে আসে। এই অভিযান কালে সূরা তওবার অনেকগুলি আয়াত নাযিল হয়। পঞ্চাশ দিনের এই দীর্ঘ সফরে ৩০ দিন যাতায়াতে এবং ২০ দিন তাবূকে অবস্থানে ব্যয়িত হয়।[1] বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-


পটভূমি :
━━━━━
ত্বায়েফ থেকে ফেরার কাছাকাছি ছয় মাস পরে ৯ম হিজরীর রজব মাসে প্রচন্ড গ্রীষ্মের মধ্যে এই অভিযান প্রেরিত হয় (ইবনু হিশাম ২/৫১৫-১৬)। তাবূক ছিল মদীনা থেকে ৭৭৮ কি. মি. উত্তরে সঊদী আরবের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত। তৎকালীন সময়ের অর্ধেক পৃথিবীর একচ্ছত্র অধিপতি রোম সম্রাটের সিরিয় গবর্ণরের বিরুদ্ধে ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে পরিচালিত ‘মুতা’ অভিযানে এক অসম যুদ্ধে রোমকদের পিছু হটার ফলে আরব উপদ্বীপে মুসলিম শক্তির শ্রদ্ধাপূর্ণ প্রভাব বিস্তৃত হয়। তাতে যুগ যুগ ধরে রোমকদের শাসন-শোষণে নিষ্পিষ্ট আরবদের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন জাগরিত হয়। বিশেষ করে আরব ভূখন্ডের সীমান্তবর্তী রোম শাসিত শাম রাজ্যের জন্য তা একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখা দেয়।
এ সময় মদীনার আউস গোত্রের অন্যতম সাবেক নেতা এবং খাযরাজ গোত্রের উপরেও যার যথেষ্ট প্রভাব ছিল, ধর্মগুরু আবু ‘আমের আর-রাহেব ৮ম হিজরীর শেষ দিকে হোনায়েন যুদ্ধের পর সবদিক থেকে নিরাশ হয়ে অবশেষে শামে (সিরিয়া) চলে যান। কেননা এটি তখন ছিল আরব ভূমিতে খ্রিষ্টান শাসনের কেন্দ্রবিন্দু। তিনি সেখানে গিয়ে ‘নাছারা’ হন। অতঃপর রোম সম্রাটকে মদীনা আক্রমণের জন্য প্ররোচনা দিতে থাকেন। এ উদ্দেশ্যে মদীনার মুনাফিকদের সাথে তিনি পুরা যোগাযোগ রাখেন এবং তাদেরকে দিয়ে তিনি মসজিদে ক্বোবার অদূরে ‘মসজিদে যেরার’ নির্মাণ করান। যাতে মসজিদের আড়ালে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র হিসাবে এটাকে ব্যবহার করা যায়। ত্বাবারী যুহরীর বরাতে ‘মুরসাল’ সূত্রে (ত্বাবারী হা/১৭২০০) বর্ণনা করেন যে, বনু ‘আমর বিন ‘আওফ গোত্রে মসজিদে ক্বোবা নির্মিত হলে তার প্রতি হিংসাবশে তার ভাই বনু গুন্ম বিন ‘আওফ গোত্রের লোকেরা এই মসজিদ নির্মাণ করে (কুরতুবী হা/৩৪৮৫)।
রোম সম্রাটকে আবু ‘আমের বুঝাতে সক্ষম হন যে, মদীনায় মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে তার একটি বিরাট দল রয়েছে। যারা বাহ্যিকভাবে মুহাম্মাদের দলে মিশে আছে। বাইরে থেকে রোমকরা হামলা করলেই তারা ঘুরে দাঁড়াবে এবং রোমকদের সহজ বিজয় লাভ হবে। উল্লেখ্য যে, ওহুদ যুদ্ধে শহীদ এবং ফেরেশতারা যার লাশ গোসল করান, সেই বিখ্যাত সাহাবী হানযালা ছিলেন এই ফাসেক আবু ‘আমেরের পুত্র। রাসূল (সাঃ) তাকে ইসলামের দাওয়াত দিলে সে অস্বীকার করে। ফলে রাসূল (সাঃ) তার নামকরণ করেন আবু ‘আমের আল-ফাসেক্ব’(فَسَمَّاهُ رَسُوْلُ اللهِ صلى الله عليه وسلم الفَاسِقَ)। তিনি তাকে বদদো‘আ করেন, যেন সে মদীনা থেকে দূরে জনবিচ্ছিন্ন হয়ে নির্জন কোন স্থানে মৃত্যুবরণ করে। পরে তিনি শামের ক্বিন্নাসরীন (قِنَّسْرِين) যেলায় নিঃসঙ্গ অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।[1]

একদিকে রাজনৈতিক বাস্তবতা অন্যদিকে আবু ‘আমেরের এই প্ররোচনা রোম সম্রাটকে মদীনা হামলায় উৎসাহিত করল। পূর্ণরূপে শক্তি সঞ্চয়ের পূর্বেই উঠতি ইসলামী শক্তিকে অংকুরে বিনাশ করার সংকল্প নিয়ে তারা ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুততি শুরু করে। যাতে রোম সাম্রাজ্য সংলগ্ন আরব এলাকা থেকে ভবিষ্যতে কোনরূপ বিদ্রোহের হুমকি সৃষ্টি না হয়।
রোমকদের উক্ত হুমকি মুকাবিলা করাই ছিল তাবূক অভিযানের প্রত্যক্ষ কারণ। দ্বিতীয় কারণ ছিল তাদের কুফরী আদর্শের হুমকি মুকাবিলা করা। কারণ তারা ছিল ইহূদীদের পরে আরবদের নিকটতম দুশমন শক্তি। আহলে কিতাব হলেও তাদের অধিকাংশ ত্রিত্ববাদের কুফরী আক্বীদায় বিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিল। তাদেরকে প্রকৃত তাওহীদের দিকে আহবান করা এবং অন্যদেরকে তাদের মন্দ প্রভাব থেকে বাঁচানো এই অভিযানের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। আর এটাই হল ইসলামী জিহাদের মূল রূহ। যেমন আল্লাহ বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا قَاتِلُوا الَّذِينَ يَلُونَكُمْ مِنَ الْكُفَّارِ وَلْيَجِدُوا فِيكُمْ غِلْظَةً وَاعْلَمُوا أَنَّ اللهَ مَعَ الْمُتَّقِينَ ‘হে মুমিনগণ! তোমরা তোমাদের নিকটবর্তী কাফেরদের সাথে যুদ্ধ কর। তারা যেন তোমাদের মধ্যে কঠোরতা অনুভব করে। আর জেনে রেখ যে, আল্লাহ সর্বদা মুত্তাক্বীদের সঙ্গে থাকেন’ (তওবা ৯/১২৩)। যাতে এর মাধ্যমে আরব উপদ্বীপ কাফেরমুক্ত হয় এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। যেমন আল্লাহ বলেন,وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ كُلُّهُ لِلَّهِ ‘আর তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর যতক্ষণ না ফিৎনা (কুফরী) শেষ হয় এবং দ্বীন পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়’ (আনফাল ৮/৩৯)।
প্রত্যক্ষ কারণ যেটাই থাক না কেন আল্লাহর ইচ্ছা ছিল সম্ভবতঃ এটাই যে, খন্দক, খায়বর, মুতা ও মক্কা বিজয় শেষে আরবের সমস্ত অঞ্চল থেকে যখন দলে দলে গোত্রনেতারা মদীনায় গিয়ে আত্মসমর্পণ করছে, তখন বাকী শাম ও তৎসন্নিহিত খ্রিষ্টান শাসিত এলাকাগুলি ইসলামী খেলাফতের অধীনস্ত হৌক। আলহামদুলিল্লাহ সেটাই হয়েছিল এবং কোনরূপ রক্তপাত ছাড়াই তাবূক অভিযানে খ্রিষ্টান শাসকরা সন্ধিচুক্তি করতে বাধ্য হয়। অতঃপর খেলাফতে রাশেদাহর সময় সমস্ত আরব উপদ্বীপ কাফেরমুক্ত হয়। ফালিল্লাহিল হাম্দ।


রোমকদের আগমনের খবর :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
এইরূপ ভীতিকর অবস্থার মধ্যে শাম থেকে মদীনায় আগত তৈল ব্যবসায়ী নাবাত্বী দলের মাধ্যমে সংবাদ পাওয়া গেল যে, রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস তার একজন বিখ্যাত সেনাপতির অধীনে ৪০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত করেছেন। যার মধ্যে লাখাম, জুযাম প্রভৃতি খ্রিষ্টান গোত্রগুলি সহ অন্যান্য আরব মিত্র গোত্রসমূহ রয়েছে। তাদের অগ্রবর্তী বাহিনীটি মদীনা অভিমুখে ইতিমধ্যে সিরিয়ার বালক্বা (الْبَلْقَاء) নগরীতে পৌঁছে গেছে (ইবনু সা‘দ ২/১২৫; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬২)।
খবরটি এমন সময় পৌঁছল, যখন ছিল গ্রীষ্মকাল এবং ফল পাকার মৌসুম। মানুষের মধ্যে ছিল ক্ষুধা ও দারিদ্রে্যর তীব্র কষাঘাত। রাস্তা ছিল বহু দূরের এবং অতীব ক্লেশকর।


নাজাশীর মৃত্যু ও গায়েবানা জানাযা আদায় :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
সুহায়লী বলেন, হাবশার বাদশাহ আছহামা নাজাশী(الأصحمة النجاشي) ৯ম হিজরীর রজব মাসে মৃত্যুবরণ করেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) সাহাবীগণকে নিয়ে বাক্বী‘ গারক্বাদের মুছাল্লায় গিয়ে তার গায়েবানা জানাযা আদায় করেন।[2] নাজাশী মুসলমান ছিলেন এবং রাসূল (সাঃ) ও মুসলমানদের একান্ত হিতাকাংখী ও নিঃস্বার্থ সাহায্যকারী ছিলেন। জাবের (রাঃ) বলেন, তার মৃত্যুর দিন রাসূল (সাঃ) সবাইকে অবহিত করে বলেন,مَاتَ الْيَوْمَ رَجُلٌ صَالِحٌ، فَقُوْمُوْا فَصَلُّوْا عَلَى أَخِيْكُمْ أَصْحَمَةَ ‘আজ একজন সৎ ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেছেন। অতএব তোমরা দাঁড়িয়ে যাও এবং তোমাদের ভাই আছহামার জন্য জানাযার সালাত আদায় কর’ (বুখারী হা/৩৮৭৭)। হুযায়ফা বিন আসীদ আল-গিফারী (রাঃ) হতে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, তিনি বলেন,صَلُّوْا عَلَى أَخٍ لَّكُمْ مَاتَ بِغَيْرِ أَرْضِكُمْ ‘তোমরা তোমাদের একজন ভাইয়ের জানাযা পড়। যিনি তোমাদের দেশ ব্যতীত অন্য দেশে মৃত্যুবরণ করেছেন’ (আহমাদ হা/১৬১৯২; ইবনু মাজাহ হা/১৫৩৭)।


রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রার ঘোষণা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) চিন্তা করলেন যে, আরব এলাকায় রোমকদের প্রবেশ করার আগেই তাদেরকে তাদের সীমানার মধ্যেই আটকে দিতে হবে। যাতে আরব ও মুসলিম এলাকা অহেতুক ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। অন্য সময় রাসূলুললাহ (সাঃ) ‘তাওরিয়া’ (التَّوْرِيَة) করেন। অর্থাৎ একদিকে যাওয়ার কথা বলে অন্যদিকে যেতেন। কিন্তু এবার তিনি সরাসরি ঘোষণা করলেন যে, রোমকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে হবে। অতঃপর এ ব্যাপারে তিনি সবাইকে জোরালোভাবে উৎসাহিত করতে থাকেন। যাতে ভীতি ঝেড়ে ফেলে সবাই যুদ্ধের জন্য জোরে-শোরে প্রস্তুততি নিতে পারে। দেখা গেল যে, কেবল মুনাফিকরা ব্যতীত সবাই যুদ্ধে যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠলো। মক্কাবাসীদের নিকটে ও অন্যান্য আরব গোত্রগুলির নিকটে খবর পাঠানো হল। একই সময়ে সূরা তওবার অনেকগুলি আয়াত নাযিল হল মুনাফিকদের যুদ্ধভীতির বিরুদ্ধে ও মিথ্যা ওযর-আপত্তির বিরুদ্ধে। এতদ্ব্যতীত জিহাদের ফযীলত এবং এতদুদ্দেশ্যে দান-ছাদাক্বার ফযীলত সম্পর্কে অনেকগুলি আয়াত নাযিল হয়। এতে মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। গ্রীষ্মের খরতাপ, ফসল কাটার মৌসুম, দীর্ঘ সফরের কষ্ট সবকিছু ভুলে গিয়ে তাদের মধ্যে শুরু হয় জিহাদে গমন করার ও জিহাদ ফান্ডে দান করার প্রতিযোগিতা।
এই বাহিনীকে ‘জায়শুল উসরাহ’(جَيْشُ الْعُسْرَةِ) অর্থাৎ ‘ক্লেশকর যুদ্ধের সেনাবাহিনী’ বলে অভিহিত করা হয়। এসময় মুনাফিকরা মসজিদে ক্বোবার অনতিদূরে একটি মসজিদ নির্মাণ করে এবং সেখানে গিয়ে সালাত আদায়ের জন্য রাসূল (সাঃ)-কে দাওয়াত দেয়। রাসূল (সাঃ) তাবূক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে সেখানে যাবেন বলে কথা দেন। ইতিহাসে এটি ‘মসজিদে যেরার’(مَسْجِدُ الضِّرَار) বা ‘অনিষ্টকারী মসজিদ’ নামে পরিচিত’ (ইবনু হিশাম ১/৫২২; তওবা ৯/১০৭)।
জিহাদে গমনের নির্দেশ প্রচারিত হওয়ার পর মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। সকলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জিহাদের প্রস্তুততি শুরু করে দেয়। যাদের বাহন ছিল না, তারা ছুটে আসেন রাসূল (সাঃ)-এর কাছে বাহনের জন্য। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সবাইকে বাহনের ব্যবস্থা করতে পারলেন না। ফলে যারা বাহন পেলেন না, তারা জিহাদে যেতে না পারার দুঃখে কেঁদে বুক ভাসান। ইতিহাসে এরা ‘আল-বাক্কাঊন’ (ক্রন্দনকারীগণ) নামে খ্যাত।[3]


জিহাদ ফান্ডে দানের প্রতিযোগিতা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, مَنْ جَهَّزَ جَيْشَ الْعُسْرَةِ فَلَهُ الْجَنَّةُ ‘যে ব্যক্তি জায়শুল উসরাহর প্রস্তুততিতে দান করবে, তার জন্য জান্নাত’ (বুখারী হা/২৭৭৮)। উক্ত হাদীছ শোনার পর মুসলমানদের মধ্যে দানের প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়।
(১) উমর (রাঃ) বলেন, (তাবূক যুদ্ধের সময়) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সবাইকে ছাদাক্বার নির্দেশ দিলেন। তখন আমার নিকটে পর্যাপ্ত সম্পদ ছিল। আমি মনে মনে বললাম, দানের প্রতিযোগিতায় আজ আমি আবুবকরের উপরে জিতে যাব। তিনি বলেন, অতঃপর আমি আমার সমস্ত মালের অর্ধেক নিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হলাম। তিনি বললেন, পরিবারের জন্য কি পরিমাণ রেখে এসেছ? আমি বললাম, অনুরূপ পরিমাণ। এ সময় (২) আবুবকর (রাঃ) তাঁর সমস্ত মাল-সম্পদ নিয়ে হাযির হলেন। রাসূল (সাঃ) বললেন, হে আবুবকর! তোমার পরিবারের জন্য কি পরিমাণ রেখে এসেছ? তিনি বললেন,أَبْقَيْتُ لَهُمُ اللهَ وَرَسُولَهُ ‘তাদের জন্য আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি’। উমর বলেন, তখন আমি মনে মনে বললাম, আর আমি কখনোই তাঁর উপরে জিততে পারব না’।[4] এতে বুঝা যায় যে, দু’জনের মধ্যে উমর (রাঃ) প্রথম ছাদাক্বা নিয়ে আসেন।
(৩) উসমান গণী (রাঃ) ১০০০ স্বর্ণমুদ্রা নিয়ে আসেন। স্বর্ণমুদ্রাগুলি যখন রাসূল (সাঃ)-এর কোলের উপরে তিনি ঢেলে দেন, তখন রাসূল (সাঃ) সেগুলি উল্টে-পাল্টে বলতে থাকেন,مَا ضَرَّ ابْنَ عَفَّانَ مَا عَمِلَ بَعْدَ الْيَوْمِ، يُرَدِّدُهَا مِرَاراً ‘আজকের দিনের পর কোন আমলই ইবনু ‘আফফানের (অর্থাৎ উসমানের) কোন ক্ষতিসাধন করবে না’। কথাটি তিনি কয়েকবার বলেন’।[5] এই বিপুল দানের জন্য তাঁকেمُجْهِزُ جَيْشِ الْعُسْرَةِ অর্থাৎ ‘তাবূক যুদ্ধের রসদ যোগানদাতা’ বলা হয়।[6]
(৪) আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব বহু মাল-সামান নিয়ে আসেন। (৫) এতদ্ব্যতীত ত্বালহা, সা‘দ বিন ওবাদাহ, মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ প্রমুখ প্রচুর মাল-সম্পদ দান করেন। এভাবে এক মুদ, দুই মুদ করে কম-বেশী দানের স্রোত চলতে থাকে। মহিলাগণ তাদের গলার হার, হাতের চুড়ি, পায়ের অলংকার, কানের রিং, আংটি ইত্যাদি যার যা গহনা ও অলংকার ছিল, সবই রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে পাঠিয়ে দেন। কেউ সামান্যতম কৃপণতা করেননি (সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/১০০; আর-রাহীক্ব ৪৩৩ পৃঃ)। আছেম বিন ‘আদী ১০০ অসাক্ব অর্থাৎ হিজাযী ছা‘ হিসাবে প্রায় ১৪,৩৫৯ কেজি খেজুর জমা দেন (ইবনু হিশাম ২/৫৫১)। এ সময় উমাইরাহ বিনতে সুহায়েল বিন রাফে‘ দুই ছা‘ খেজুর, আবু খায়ছামা আনছারী এক ছা‘ এবং আবু ‘আক্বীল হাছহাছ অথবা হাবহাব আনছারী (রাঃ) অর্ধ ছা‘ বা অর্ধ থলি (نِصْفُ صُبْرَةٍ) খেজুর নিয়ে আসেন’ (কুরতুবী)। আবু ‘আক্বীল বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি সারা রাত দুই ছা‘ খেজুরের বিনিময়ে অন্যের ক্ষেতে পানি সেচেছি। সেখান থেকে এক ছা‘ পরিবারের জন্য রেখে এসেছি এবং এক ছা‘ এখানে এনেছি’ (আল-ইছাবাহ ক্রমিক ১০২৬০)। তখন রাসূল (সাঃ) নির্দেশ দিলেন তার ঐ খেজুরগুলি ছাদাক্বার স্তূপের উপর ছড়িয়ে দিতে। অতঃপর তার জন্য দো‘আ করলেন, بَارَكَ اللهُ فِيمَا أَعْطَيْتَ وَفِيمَا أَمْسَكْتَ ‘আল্লাহ তাতে বরকত দিন যা তুমি দান করেছ এবং যা তুমি (পরিবারের জন্য) রেখে দিয়েছ’। তখন কিছু লোক এতে হাসাহাসি করে বলল, নিশ্চয় আল্লাহ ও তাঁর রাসূল এসব দান থেকে অমুখাপেক্ষী’ (ত্বাবারী হা/১৭০১২; কুরতুবী, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবা ৭৯ আয়াত, সনদ যঈফ)।
সবশেষে আব্দুর রহমান বিন ‘আওফ (রাঃ) এসে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! ছাদাক্বা দানকারী আর কেউ বাকী আছে কি? রাসূল (সাঃ) বললেন, না। তখন তিনি তার মোট সম্পদের অর্ধেক ৪০০০ দিরহাম বা ১০০ উক্বিয়া স্বর্ণমুদ্রা দান করেন। এ সময় উমর ইবনুল খাত্ত্বাব বলেন, তুমি কি পাগল? তিনি বললেন, আমি পাগল নই। অতঃপর বলেন, আমার মোট ৮০০০ দিরহামের মাল রয়েছে। তন্মধ্যে ৪০০০ দিরহাম রেখেছি আমার পরিবারের জন্য এবং বাকী ৪০০০ দিরহাম আমি আমার প্রতিপালককে ঋণ দিলাম। তখন রাসূল (সাঃ) খুশী হয়ে বললেন,بَارَكَ اللهُ فِيمَا أَعْطَيْتَ وَفِيمَا أَمْسَكْتَ ‘আল্লাহ তাতে বরকত দিন যা তুমি দান করেছ এবং যা তুমি রেখে দিয়েছ’। এ সময় এক ছা‘ বা অর্ধ ছা‘ করে যারা দান করেন, সকলের উদ্দেশ্যে তিনি একই দো‘আ করেন। তখন মুনাফিকরা বলল, আল্লাহর কসম! এটি স্রেফ ‘রিয়া’ ও শ্রুতি মাত্র। কেননা আল্লাহ এসব দান থেকে অমুখাপেক্ষী’ (ত্বাবারী হা/১৭০০৪, ১৭০১৭; ইবনু কাছীর, তাফসীর তওবা ৭৯ আয়াত, সনদ যঈফ)।
আবু মাসঊদ আনছারী (রাঃ) বলেন, আমাদেরকে ছাদাক্বার আদেশ দেওয়া হল। তখন আমরা সবাই তা বহন করে নিয়ে গেলাম। এ সময় আবু ‘আক্বীল অর্ধ ছা‘ ছাদাক্বা নিয়ে এলেন। অন্য একজন তার চাইতে কিছু বেশী নিয়ে এল। তখন মুনাফিকরা বলল, নিশ্চয় আল্লাহ এইসব ছাদাক্বা থেকে অমুখাপেক্ষী। তারা বলল, এরা এগুলি করছে লোক দেখানোর জন্য। তখন সূরা তওবা ৭৯ আয়াতটি নাযিল হয়’ (বুখারী হা/৪৬৬৮)।
উক্ত আয়াতে আল্লাহ বলেন, الَّذِينَ يَلْمِزُونَ الْمُطَّوِّعِينَ مِنَ الْمُؤْمِنِينَ فِي الصَّدَقَاتِ وَالَّذِينَ لاَ يَجِدُونَ إِلاَّ جُهْدَهُمْ فَيَسْخَرُونَ مِنْهُمْ سَخِرَ اللهُ مِنْهُمْ وَلَهُمْ عَذَابٌ أَلِيمٌ ‘যারা স্বেচ্ছায় ছাদাক্বা দানকারী মুমিনদের প্রতি বিদ্রূপ করে এবং যাদের স্বীয় পরিশ্রমলব্ধ বস্ত্ত ছাড়া কিছুই নেই তাদেরকে উপহাস করে, আল্লাহ তাদেরকে লাঞ্ছিত করেন এবং তাদের জন্য রয়েছে মর্মন্তুদ শাস্তি’ (তওবা ৯/৭৯)।


মুনাফিকদের অবস্থান :
━━━━━━━━━━━━━
তাবূক যুদ্ধে মুনাফিকদের অবস্থান ছিল খুবই জঘন্য। যাতে মুসলিম বাহিনী মদীনা থেকে বের না হয় এবং রোমকদের হামলার পথ সুগম হয়, সেজন্য তাদের চেষ্টার অন্ত ছিল না। সেকারণ তাদের ও দুর্বল ঈমানদারদের লক্ষ্য করে সূরা তওবা ৩৮ থেকে ১১০ পর্যন্ত পরপর ৭২টি আয়াত নাযিল হয়। তাতে মুমিনদের ঈমান বৃদ্ধি পায় ও মুনাফিকদের বিষয়ে তারা অধিক সজাগ হয়।
মুনাফিকরা নিজেরা তো দান করেনি। উপরন্তু এই দানকে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করেছিল (তওবা ৯/৭৯)। তাদের ঠাট্টা যেন এরূপ ছিল যে, বিশ্বশক্তি রোমক বাহিনীকে এরা দু’চারটি খেজুর দিয়ে পরাস্ত করতে চায়। কিংবা দু’চারটা খেজুর দিয়েই এরা রোম সাম্রাজ্য জয়ের দিবা স্বপ্ন দেখছে।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইয়ের নেতৃত্বে মুনাফিকরা নানা অজুহাতে জিহাদ থেকে পিছিয়ে থাকে। উপরন্তু তারা গোপনে মুমিনদের বলতে থাকে যে, মুহাম্মাদ ও তার সাথীরা কেউ আর মদীনায় ফিরতে পারবেনা। রোম সম্রাট ওদের বন্দী করে বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে দিবেন। তারা বলে,لاَ تَنْفِرُوا فِي الْحَرِّ ‘তোমরা এই গরমে বের হয়োনা’ (তওবা ৯/৮১)। তাদের প্ররোচনায় কেউ কেউ গিয়ে মিথ্যা অজুহাত দেখিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট থেকে জিহাদে না যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করে’ (তওবা ৯/৪৩)। এ সময় মদীনার বেদুঈনদের মুনাফেকী ও অবাধ্যতা ছিল খুবই বেশী’ (তওবা ৯/৯৭)।[ইবনু হিশাম ২/৫১৫-১৬; আর-রাহীক্ব ৪২০ পৃঃ] মদীনার শহর এলাকা ছেড়ে পার্শ্ববর্তী বস্তী এলাকাতেও মুনাফেকী ছড়িয়ে পড়ে। যাদেরকে রাসূল (সাঃ) জানতেন না। কিন্তু আল্লাহ জানতেন’ (তওবা ৯/১০১)। আল্লাহ পাক এসব মুনাফিকদের ওযর কবুল করতে এবং তাদের কথা বিশ্বাস করতে রাসূল (সাঃ)-কে নিষেধ করেন’ (তওবা ৯/৯৪)। এমনকি কুরআন তাদেরকে ‘অপবিত্র’ (رِجْسٌ) বলে আখ্যায়িত করে’ (তওবা ৯/৯৫)।
এভাবে মুমিন ও মুনাফিকদের মধ্যে আমলে ও আচরণে বিভক্তি রেখা সৃষ্টি হয়। ক্বোবায় মুনাফিকদের তৈরী ‘মসজিদে যেরারে’ রাসূল (সাঃ)-কে সালাত আদায়ে নিষেধ করা হয়’ (তওবা ৯/১০৭-০৮)। তাবূক যুদ্ধ থেকে ফিরে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই-এর জানাযায় শরীক হওয়ার পর থেকে সকল মুনাফিকের জানাযায় শরীক হওয়ার ব্যাপারে স্থায়ী নিষেধাজ্ঞা জারী করা হয়’ (তওবা ৯/৮৪)। তাবূক যুদ্ধে মুনাফিকদের বৃহদাংশ যোগদান করেনি। দু’চার জন যারা গিয়েছিল, তারা গিয়েছিল স্রেফ ষড়যন্ত্র করার জন্য। এমনকি ফেরার পথে তাদের মধ্যে ১২ জন রাসূল (সাঃ)-কে এক পাহাড়ী সরু পথে হত্যার চেষ্টা করে (আল-বিদায়াহ ৫/১৯)।
তাছাড়া ঐ সময় ছিল ফল পাকার মৌসুম। যে কারণে মদীনা থেকে বের হওয়া তখন ছিল বড়ই কষ্টকর বিষয়।
মদীনার এই সার্বিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে আল্লাহপাক আয়াত নাযিল করে বলেন,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِنَّمَا الْمُشْرِكُونَ نَجَسٌ فَلاَ يَقْرَبُوا الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ بَعْدَ عَامِهِمْ هَذَا وَإِنْ خِفْتُمْ عَيْلَةً فَسَوْفَ يُغْنِيكُمُ اللهُ مِنْ فَضْلِهِ إِنْ شَاءَ إِنَّ اللهَ عَلِيمٌ حَكِيمٌ ‘হে মুমিনগণ! মুশরিকগণ (শিরকী আক্বীদার কারণে) নাপাক বৈ কিছুই নয়। অতএব তারা যেন এ বছরের পর মাসজিদুল হারামের নিকটবর্তী না হয়। (ব্যবসা-বাণিজ্য তাদের হাতে থাকার কারণে) তোমরা যদি দারিদ্রে্যর ভয় কর, তবে সত্বর আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তোমাদেরকে অভাবমুক্ত করে দিবেন যদি তিনি চান। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/২৮)। যারা অজুহাত দিয়ে পিছিয়ে থাকার অনুমতি চেয়েছিল, তাদের প্রতি ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, لَوْ كَانَ عَرَضًا قَرِيبًا وَسَفَرًا قَاصِدًا لَاتَّبَعُوكَ وَلَكِنْ بَعُدَتْ عَلَيْهِمُ الشُّقَّةُ وَسَيَحْلِفُونَ بِاللهِ لَوِ اسْتَطَعْنَا لَخَرَجْنَا مَعَكُمْ يُهْلِكُونَ أَنْفُسَهُمْ وَاللهُ يَعْلَمُ إِنَّهُمْ لَكَاذِبُونَ ‘যদি গণীমত নিকটবর্তী হত এবং সফর কাছাকাছি হত, তাহলে ওরা অবশ্যই তোমার অনুগামী হত। কিন্তু তাদের নিকট (শাম পর্যন্ত) সফরটাই দীর্ঘ মনে হয়েছে। তাই সত্বর ওরা আল্লাহর নামে শপথ করে বলবে, সাধ্যে কুলালে অবশ্যই আমরা তোমাদের সাথে বের হতাম। এভাবে (শপথ করে) তারা নিজেরা নিজেদের ধ্বংস করে। অথচ আল্লাহ জানেন যে ওরা অবশ্যই মিথ্যাবাদী’ (তওবা ৯/৪২)। অতঃপর দৃঢ় বিশ্বাসী মুমিনদের প্রতি আহবান জানিয়ে আল্লাহ বলেন,انْفِرُوا خِفَافًا وَثِقَالاً وَجَاهِدُوا بِأَمْوَالِكُمْ وَأَنْفُسِكُمْ فِي سَبِيلِ اللهِ ذَلِكُمْ خَيْرٌ لَكُمْ إِنْ كُنْتُمْ تَعْلَمُونَ ‘তোমরা বেরিয়ে পড় অল্প সংখ্যায় হও বা অধিক সংখ্যায় হও এবং জিহাদ কর আল্লাহর পথে তোমাদের মাল দ্বারা ও জান দ্বারা। এটাই তোমাদের জন্য উত্তম যদি তোমরা জানতে’ (তওবা ৯/৪১)। আল্লাহর এই আহবানে সাড়া দিয়ে ঈমানদারগণ দলে দলে জিহাদের উদ্দেশ্যে রাসূল (সাঃ)-এর চারপাশে জমা হয়ে যায়। মুজাহিদ বলেন, আয়াতগুলি সবই তাবূক যুদ্ধের ঘটনায় নাযিল হয়েছিল’ (সীরাহ সহীহাহ ২/৫২৮)।


তাবূকের পথে মুসলিম বাহিনী :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━
৯ম হিজরীর রজব মাসের এক বৃহস্পতিবারে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ৩০,০০০ সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী নিয়ে তাবূকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। এটাই ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় সেনা অভিযান। এই সময় তিনি মুহাম্মাদ ইবনে মাসলামাহ আনছারীকে মতান্তরে সিবা‘ বিন উরফুত্বাহ আল-গিফারীকে মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করেন এবং হযরত আলীকে তাঁর পরিবারের দেখাশুনার দায়িত্ব দিয়ে যান। কিন্তু মুনাফিকরা তাকে সম্ভবতঃ ভীতু, কাপুরুষ ইত্যাদি বলে ঠাট্টা করায় ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি পুনরায় গিয়ে পথিমধ্যে সেনাদলে যোগ দেন। তখন সেনাদল দু’তিন মনযিল অতিক্রম করে গেছে। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে কাছে ডেকে সস্নেহে বলেন,أَلاَ تَرْضَى أَنْ تَكُوْنَ مِنِّيْ بِمَنْزِلَةِ هَارُوْنَ مِنْ مُوْسَى؟ إلاَّ أَنَّهُ لاَ نَبِيَّ بَعْدِيْ ‘তুমি কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তুমি আমার নিকটে অনুরূপ হও যেমন হারূণ ছিলেন মূসার নিকটে? তবে পার্থক্য এই যে, আমার পরে আর কোন নবী নেই’ (বুখারী হা/৪৪১৬)। একথা শুনে আলী (রাঃ) খুশী মনে মদীনায় ফিরে গেলেন।


পতাকাবাহীগণ :
━━━━━━━━━
তাবূক যুদ্ধের প্রধান পতাকা ছিল আবুবকর ছিদ্দীক্ব (রাঃ)-এর হাতে। দ্বিতীয় প্রধান পতাকাটি ছিল যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ)-এর হাতে। আউসদের পতাকা ছিল উসায়েদ বিন হুযায়ের (রাঃ)-এর হাতে। খাযরাজদের পতাকা ছিল আবু দুজানাহ (রাঃ)-এর হাতে। মতান্তরে হুবাব ইবনুল মুনযির (রাঃ)-এর হাতে। এছাড়াও আনছারদের অন্যান্য গোত্র এবং আরবদের অন্যান্য দলের পৃথক পৃথক পতাকা ছিল। যেমন যায়েদ বিন সাবেত (রাঃ) বনু মালেক বিন নাজ্জার-এর এবং মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বনু মাসলামাহ-এর পতাকা বহন করেন। তথ্যগুলি সবই এককভাবে ওয়াক্বেদী বর্ণিত। যিনি পরিত্যক্ত (مَتْرُوك)। কিন্তু তাঁর সীরাত গ্রন্থ অগণিত তথ্যাবলী সমৃদ্ধ। সেখান থেকে এই ধরনের তথ্য গ্রহণে কোন ক্ষতি নেই’ (সীরাহ সহীহাহ ২/৫৩২)।


ক্রন্দনকারীগণ :
━━━━━━━━━
অসুখ, দরিদ্রতা, বাহন সংকট প্রভৃতি কারণে যারা জিহাদে যেতে পারেননি, তারা জান্নাত লাভের এই মহা সুযোগ হারানোর বেদনায় কাঁদতে থাকেন। যারা ইতিহাসে ‘ক্রন্দনকারীগণ’ (الْبَكَّاؤون) বলে খ্যাত (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬২-৬৩)। তাদেরই অন্যতম ছিলেন, ‘উলবাহ বিন যায়েদ(عُلْبَةُ بن زَيْدٍ)। যিনি রাত্রি জেগে সালাত আদায় করেন ও আল্লাহর নিকটে কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদেরকে জিহাদের নির্দেশ দিয়েছ ও তাতে উৎসাহিত করেছ। কিন্তু আমার নিকটে এমন কিছু নেই, যা দিয়ে আমি তোমার রাসূলের সঙ্গে যেতে সক্ষম হই এবং আমার দেহে বা সম্পদে যে সব যুলুম হয়েছে, তার প্রতিটি যুলুমের বিনিময়ে প্রত্যেক মুসলমানের উপর আমি ছাদাক্বা করি’। অতঃপর ফজর সালাতের পর রাসূল (সাঃ) সবার উদ্দেশ্যে বললেন, আজ রাতে ছাদাক্বা দানকারী কোথায়? কিন্তু কেউ দাঁড়ালো না। রাসূল (সাঃ) দ্বিতীয়বার বললে ঐ ব্যক্তি দাঁড়াল ও তাঁকে সব খবর জানাল। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন,أَبْشِرْ فَوَاَلَّذِي نَفْسُ مُحَمّدٍ بِيَدِهِ لَقَدْ كُتِبَتْ فِي الزَّكَاةِ الْمُتَقَبَّلَةِ ‘সুসংবাদ গ্রহণ কর! যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন তাঁর কসম করে বলছি, তোমার ছাদাক্বা আল্লাহর কবুলকৃত যাকাতের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে,قَدْ غُفِرَ لَهُ ‘তাকে ক্ষমা করা হয়েছে’।[যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬২-৬৩; সীরাহ সহীহাহ ২/৫২৯-৩০]
আবু মূসা আশ‘আরীর নেতৃত্বে আশ‘আরীগণ এসে বাহনের দাবী করলে রাসূল (সাঃ) তাদেরকে তিনটি উটের বেশী দিতে পারলেন না’ (বুখারী হা/৬৭১৮)। ফলে এইসব দুর্বল ও অক্ষমদের বিষয়ে নাযিল হয়,لَيْسَ عَلَى الضُّعَفَاءِ وَلاَ عَلَى الْمَرْضَى وَلاَ عَلَى الَّذِينَ لاَ يَجِدُونَ مَا يُنْفِقُونَ حَرَجٌ إِذَا نَصَحُوا لِلَّهِ وَرَسُولِهِ مَا عَلَى الْمُحْسِنِينَ مِنْ سَبِيلٍ وَاللهُ غَفُورٌ رَحِيمٌ- وَلاَ عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَا أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لاَ أَجِدُ مَا أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوْا وَأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلاَّ يَجِدُوا مَا يُنْفِقُونَ- ‘কোন অভিযোগ নেই দুর্বলদের উপর, রোগীদের উপর ও ব্যয়ভার বহনে অক্ষমদের উপর, যদি তারা আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি খালেছ ঈমান রাখে। বস্ত্ততঃ সৎকর্মশীলদের বিরুদ্ধে কোনরূপ অভিযোগ নেই। আর আল্লাহ ক্ষমাশীল ও দয়াবান’। ‘অধিকন্তু ঐসব লোকদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই যারা তোমার নিকট এজন্য আসে যে, তুমি তাদের (জিহাদে যাবার) জন্য বাহনের ব্যবস্থা করবে। অথচ তুমি বলেছ যে, আমার নিকটে এমন কোন বাহন নেই যার উপর তোমাদের সওয়ার করাবো। তখন তারা এমন অবস্থায় ফিরে যায় যে, তাদের চক্ষুসমূহ হতে অবিরলধারে অশ্রু প্রবাহিত হতে থাকে এই দুঃখে যে, তারা এমন কিছু পাচ্ছে না যা তারা ব্যয় করবে’ (তওবা ৯/৯১-৯২)। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘নিশ্চয়ই মদীনায় একদল লোক রয়েছে। যারা তোমাদের সাথে অভিযানে অংশগ্রহণ করেনি।... حَبَسَهُمُ الْعُذْرُ ‘ওযর তাদেরকে আটকিয়ে রেখেছিল’ (বুখারী হা/৪৪২৩)।


সেনাবাহিনীতে বাহন ও খাদ্য সংকট :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
সাধ্যমত দান-ছাদাক্বা করা সত্ত্বেও তা এই বিশাল সেনাবাহিনীর জন্য যথেষ্ট ছিল না। ফলে প্রতি ১৮ জনের জন্য একটি করে উটের ব্যবস্থা হয়। যার উপরে তারা পালাক্রমে সওয়ার হতেন। অনুরূপভাবে খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় তারা গাছের ছাল-পাতা খেতে থাকেন। যাতে তাদের ঠোটগুলো ফুলে যায়।
পথিমধ্যে ব্যাপকভাবে পানি সংকটে পড়ায় সবাই রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে এসে পানির অভিযোগ করেন। তখন রাসূল (সাঃ) আল্লাহর নিকটে পানি প্রার্থনা করেন। ফলে আল্লাহ বৃষ্টির মেঘ পাঠিয়ে দেন, যা বিপুল পরিমাণ বৃষ্টি বর্ষণ করে। সেনাবাহিনী তৃপ্তি সহকারে পানি পান করে এবং পাত্রসমূহ ভরে নেয়।[ইবনু হিশাম ২/৫২২; আর-রাহীক্ব ৪৩৪]


হিজর অতিক্রম :
━━━━━━━━━━
গমন পথে মুসলিম বাহিনী ‘হিজর’ এলাকা অতিক্রম করে। যা ছিল খায়বরের অদূরে ওয়াদিল ক্বোরা(وَادِى الْقُرَى) এলাকায় অবস্থিত। এখানে বিগত যুগে ছামূদ জাতি আল্লাহর গজবে ধ্বংস হয়। যারা পাথর কেটে মযবুত ঘর-বাড়ি তৈরী করত(الَّذِينَ جَابُوا الصَّخْرَ بِالْوَادِ) (ফজর ৮৯/৯)। হযরত সালেহ (আঃ) তাদের নিকটে প্রেরিত হয়েছিলেন। কিন্তু তারা তাঁকে অমান্য করে। ফলে তারা আল্লাহর গজবে পতিত হয়।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,لاَ تَدْخُلُوا مَسَاكِنَ الَّذِينَ ظَلَمُوا أَنْفُسَهُمْ، أَنْ يُصِيبَكُمْ مَا أَصَابَهُمْ إِلاَّ أَنْ تَكُونُوا بَاكِينَ. ثُمَّ قَنَّعَ رَأْسَهُ وَأَسْرَعَ السَّيْرَ حَتَّى أَجَازَ الْوَادِىَ ‘তোমরা গজবপ্রাপ্ত ছামূদদের ঘর-বাড়িতে প্রবেশ করো না ক্রন্দনরাত অবস্থায় ব্যতীত। যাতে তাদের যে বিপদ হয়েছে, তোমাদের তেমনটি না হয়। অতঃপর তিনি মাথা নীচু করলেন এবং দ্রুত উক্ত এলাকা অতিক্রম করলেন’ (বুখারী হা/৪৪১৯; মুসলিম হা/২৯৮০)। অর্থাৎ কেউ প্রবেশ করতে চাইলে কাঁদতে কাঁদতে প্রবেশ করবে। অথবা মাথা নীচু করে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করবে। তিনি তাদের নির্দেশ দিলেন যে,فَأَمَرَهُمْ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم- أَنْ يُهَرِيقُوا مَا اسْتَقَوْا وَيَعْلِفُوا الإِبِلَ الْعَجِينَ وَأَمَرَهُمْ أَنْ يَسْتَقُوا مِنَ الْبِئْرِ الَّتِى كَانَتْ تَرِدُهَا النَّاقَةُ ‘তোমরা যে পানি সংগ্রহ করেছ তা ফেলে দাও। উক্ত পানি দিয়ে যদি আটার খামীর করে থাক, তবে তা উটকে খাইয়ে দাও’। আরও নির্দেশ দিলেন যে, ‘সালেহ (আঃ)-এর উষ্ট্রী যে কুয়া থেকে পানি পান করত, তোমরা সেই কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করো’ (মুসলিম হা/২৯৮১)।


মু‘জেযা সমূহ :
━━━━━━━━━
(১) শুষ্ক ঝর্ণায় পানির স্রোত(جريان العين اليابس بماء منهمر) : তাবূকের নিকটবর্তী পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,إنَّكُمْ سَتَأْتُوْنَ غَدًا إنْ شَاءَ اللهُ تَعَالَى عَيْنَ تَبُوْكَ ‘আগামীকাল ইনশাআল্লাহ তোমরা তাবূকের ঝর্ণার নিকটে পৌঁছবে। তবে দিন গরম হওয়ার পূর্বে তোমরা সেখানে পৌঁছতে পারবে না। যদি তোমরা কেউ আগে পৌঁছে যাও, তবে আমি না পৌঁছা পর্যন্ত যেন কেউ ঝর্ণার পানি স্পর্শ না করে’।
মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ) বলেন, আমরা গিয়ে দেখি আমাদের দু’জন লোক আগেই পৌঁছে গেছে এবং কিছু পানিও পান করেছে। (হয়তবা তারা রাসূল (সাঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা জানতে পারেনি)। এ সময় খুব ধীরগতিতে পানি আসছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের কিছু ভৎর্সনা করলেন। অতঃপর ঝর্ণা থেকে অঞ্জলী ভরে একটু একটু করে পানি নিলেন ও সঞ্চয় করলেন। অতঃপর তা দিয়ে স্বীয় হাত ও মুখমন্ডল ধৌত করলেন। অতঃপর ঐ পানি পুনরায় ঝর্ণায় নিক্ষেপ করলেন। ফলে ঝর্ণায় তীব্রগতিতে পানির প্রবাহ সৃষ্টি হল এবং অল্প সময়ের মধ্যে বিপুল পানি রাশি জমা হয়ে গেল। সাহাবায়ে কেরাম তৃপ্তি সহকারে পানি পান করলেন। এসময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মু‘আযকে লক্ষ্য করে বললেন,يُوشِكُ يَا مُعَاذُ إنْ طَالَتْ بِكَ حَيَاةٌ أَنْ تُرَى مَا هَاهُنَا قَدْ مُلِئَ جِنَانًا ‘যদি আল্লাহ তোমার হায়াত দীর্ঘ করেন, তবে তুমি এই স্থানটিকে সবুজ-শ্যামল বাগিচায় পূর্ণ দেখতে পাবে’ (মুসলিম হা/৭০৬ (১০)। উক্ত ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হয়েছে- আলহামদুলিল্লাহ।
তাবূক পৌঁছার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সবাইকে বললেন, আজ রাতে তোমাদের উপর প্রবল বালুঝড়(رِيْحٌ شَدِيْدَةٌ) বয়ে যেতে পারে। সুতরাং তোমাদের কেউ যেন দাঁড়ায় না। যাদের উট আছে, তারা যেন উটকে শক্তভাবে বেঁধে রাখে’। দেখা গেল যে, প্রবল বেগে ঝড় এলো। তখন (সম্ভবতঃ কৌতূহল বশে) একজন উঠে দাঁড়ালো। ফলে ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে ‘ত্বাঈ’ পাহাড়ের(فِي جَبَلِ طَيْءٍ) মাঝখানে নিক্ষেপ করল’ (সহীহ ইবনু হিববান হা/৬৫০১, সনদ সহীহ)।
(২) দুর্বল উট সবল হল(البعير الضعيف صار قويا) : ফাযালাহ বিন উবায়েদ আনছারী (মৃ. ৫৩ হি.) বলেন, তাবূক থেকে ফেরার পথে আমাদের উটগুলি কষ্টে হাসফাস করতে থাকে। রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে বিষয়টি পেশ করা হলে তিনি দো‘আ করে বলেন,اللَّهُمَّ احْمِلْ عَلَيْهَا فِى سَبِيلِكَ إِنَّكَ تَحْمِلُ عَلَى الْقَوِىِّ وَالضَّعِيفِ وَعَلَى الرَّطْبِ وَالْيَابِسِ فِى الْبَرِّ وَالْبَحْرِ ‘হে আল্লাহ! তোমার রাস্তায় এগুলির উপরে আরোহণ করাও। নিশ্চয় তুমি আরোহণ করিয়ে থাক শক্তিশালী ও দুর্বলের উপরে। নরম ও শুষ্ক যমীনের উপরে এবং স্থলভাগ ও সমুদ্রের উপরে’। অতঃপর মদীনায় আসা পর্যন্ত তারা আর দুর্বল হয়নি’। রাবী বলেন, এটি ছিল রাসূল (সাঃ)-এর দো‘আর বরকত। তাঁর এই দো‘আ শক্তিশালী ও দুর্বলের উপরে আমরা ফলতে দেখেছি। অতঃপর সমুদ্রের উপরে ফলতে দেখলাম তখনই, যখন আমরা ২৭ হিজরীতে উসমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর নেতৃত্বে রোমকদের বিরুদ্ধে নৌযুদ্ধে গমন করলাম’ (আহমাদ হা/২৪০০১, হাদীছ সহীহ)। নিঃসন্দেহে এটি ছিল রাসূল (সাঃ)-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মু‘জেযা (সীরাহ সহীহাহ ২/৫৩৫)।


সালাতে জমা ও ক্বছর :
━━━━━━━━━━━━━
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, তাবূক যুদ্ধে পথ চলাকালীন সময়ে রাসূল (সাঃ)-এর নিয়ম ছিল এই যে, তিনি সর্বদা যোহর ও আছরে এবং মাগরিব ও এশাতে জমা (ও ক্বছর) করতেন।[মুসলিম হা/৭০৫ (৫১); আবুদাঊদ হা/১২০৮; তিরমিযী হা/৫৫৩] এতে জমা তাক্বদীম ও জমা তাখীর দু’টিই হত। ‘তাক্বদীম’ অর্থ শেষের সালাতটি পূর্বের সালাতের সাথে জমা করা এবং ‘তাখীর’ অর্থ প্রথমের সালাতটি শেষেরটির সাথে জমা করা (মির‘আত হা/১৩৫৩-এর আলোচনা)। সফরে রাসূল (সাঃ) সুন্নাত-নফল ছাড়াই যোহর ও আছর একত্রে (২+২) পৃথক এক্বামতে জামা‘আতের সাথে অথবা একাকী সালাত আদায় করতেন।[বুখারী হা/১০৯২, ১৬৬২, ১৬৭৩; মিশকাত হা/২৬১৭, ২৬০৭]


বিনা যুদ্ধে জয় ও ফলাফল :
━━━━━━━━━━━━━━━━
মুসলিম বাহিনীর তাবূকে উপস্থিতির খবর শুনে রোমক ও তাদের মিত্ররা এতই ভীত হয়ে পড়ল যে, তারা মুকাবিলার হিম্মত হারিয়ে ফেলল এবং তারা তাদের সীমান্তের অভ্যন্তরে বিভিন্ন শহরে বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়ল। তৎকালীন বিশ্বশক্তির এই বিনাযুদ্ধে পলায়ন সমস্ত আরব উপদ্বীপে মুসলিম শক্তির জন্য অযাচিতভাবে এমন সব রাজনৈতিক সুবিধাদি এনে দিল, যা যুদ্ধ করে অর্জন করা সম্ভব হত না। রোমকদের মিত্র শক্তিগুলি মদীনার প্রতি বশ্যতা স্বীকার করল।


খ্রিষ্টান শাসনকর্তাদের সঙ্গে সন্ধি :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(১) আয়লার (أَيْلَة) খ্রিষ্টান গবর্ণর ইউহান্নাহ বিন রু’বাহ(يُحَنَّةُ بنُ رُؤْبَةَ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খিদমতে হাযির হয়ে সন্ধি করেন এবং তাঁকে জিযিয়া প্রদান করেন। (২) আযরুহ (أذْرُح) ও জারবা (جَرْبَاء)-এর নেতৃবৃন্দ এসে জিযিয়া প্রদান করেন। রাসূল (সাঃ) তাদের প্রত্যেককে সন্ধির চুক্তিনামা প্রদান করেন, যা তাদের কাছে রক্ষিত থাকে। শুধুমাত্র জিযিয়ার বিনিময়ে তাদের জান-মাল-ইয্যত ও ধর্মের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ রাখার গ্যারান্টি দেওয়া হয়। (৩) রাসূল (সাঃ) দূমাতুল জান্দালের শাসনকর্তা উকায়দিরের (أُكَيْدِرُ) নিকটে ৪২০ জন অশ্বারোহী সৈন্যের একটি বাহিনীসহ খালেদ বিন অলীদকে প্রেরণ করেন। যাত্রাকালে তিনি বলে দেন যে,إنَّكَ سَتَجِدُهُ يَصِيْدُ الْبَقَرَ ‘তুমি তাকে জংলী নীল গাভী শিকার করা অবস্থায় দেখতে পাবে’ (বায়হাক্বী হা/১৯১১৪)। সেটাই হল। চাঁদনী রাতে দুর্গটি পরিষ্কার দেখা যায়, এমন দূরত্বে পৌঁছে গেলে হঠাৎ দেখা গেল যে, একটি নীল গাভী জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এসে দুর্গদ্বারে শিং দিয়ে গুঁতা মারছে। এমন সময় উকায়দির গাভীটাকে শিকার করার জন্য লোকজন নিয়ে বের হলেন। এই সুযোগে খালেদ তাকে বন্দী করে ফেললেন। এভাবে রাসূল (সাঃ)-এর ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হয়’ (ইবনু হিশাম ২/৫২৬)।
উকায়দিরকে রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে আনা হল। অতঃপর ২০০০ উট, ৮০০ গোলাম, ৪০০ লৌহবর্ম ও ৪০০ বর্শা দেবার শর্তে এবং জিযিয়া কর প্রদানে স্বীকৃত হওয়ায় তার সঙ্গে সন্ধিচুক্তি সম্পাদিত হল। যেমন ইতিপূর্বে আয়লাহ, তাবূক, ও তায়মার সাথে সম্পাদিত হয়েছিল। একইভাবে রোমকদের মিত্র অন্যান্য গোত্রসমূহ তাদের পুরানো মনিবদের ছেড়ে মুসলমানদের নিকটে এসে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হল।
এভাবে একেবারেই বিনাযুদ্ধে এবং কোনরূপ জানমালের ক্ষয়-ক্ষতি ছাড়াই আল্লাহর গায়েবী মদদে মদীনার ইসলামী খেলাফতের সীমানা বিস্তৃত হয়ে রোম সাম্রাজ্যের প্রান্তসীমা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। ফালিল্লাহিল হাম্দ।




[1]. কুরতুবী হা/৩৪৮৫, ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবা ১০৭-০৮ আয়াত; আর-রাহীক্ব ২৫৮ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৬৭; সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১০৯৫)।
[2]. আর-রউযুল উনুফ ২/১১৯; ইবনু হিশাম ১/৩৪১ টীকা-৪; মুবারকপুরী বলেছেন যে, আছহামা নাজাশীর মৃত্যু তাবূক যুদ্ধের পর রজব মাসে হয়েছে (আর-রাহীক্ব ৩৫২ পৃঃ)। কিন্তু তিনি একথাও বলেছেন যে, রাসূল (সাঃ)-এর তাবূক যুদ্ধে গমন ৯ম হিজরীর রজব মাসে এবং মদীনায় প্রত্যাবর্তন রামাযান মাসে (পৃঃ ৪৩৬)। অতএব তাঁর বক্তব্যের মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে।
[3]. যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬২। প্রসিদ্ধ আছে যে, আবু যার গিফারীর জন্য উট পেতে দেরী হয়। তখন তিনি সরঞ্জামাদি পিঠে নিয়ে পায়ে হেঁটে চলতে থাকেন। অতঃপর এক স্থানে রাসূল (সাঃ) অবতরণ করলে লোকেরা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ঐ ব্যক্তি একাকী হেঁটে আসছে। রাসূল (সাঃ) বললেন, দেখ ওটা আবু যার। অতঃপর লোকেরা ভালোভাবে দেখে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর কসম ঐ ব্যক্তি আবু যার। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, আল্লাহ আবু যারের উপরে রহম করুন! সে একাকী হাঁটে। একাকী মরবে ও একাকী পুনরুত্থিত হবে’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৬৭; ইবনু হিশাম ২/৫২৪)। বর্ণনাটি যঈফ (মা শা-‘আ ২১৭ পৃঃ)।
[4]. তিরমিযী হা/৩৬৭৫; আবুদাঊদ হা/১৬৭৮; মিশকাত হা/৬০২১, সনদ হাসান। অত্র হাদীছে তাবূক যুদ্ধের উল্লেখ নেই। কিন্তু পূর্বাপর সম্পর্ক বিবেচনায় ঘটনাটি তাবূক যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট বলে দৃঢ় প্রতীতি জন্মে। মাক্বরেযী (মৃ. ৮৪৫ হি.) ও মুবারকপুরী সূত্রবিহীনভাবে লিখেছেন যে, আবুবকর (রাঃ) প্রথম দানের সূচনা করেন এবং এর পরিমাণ ছিল ৪০০০ দিরহাম (মাক্বরেযী, ইমতা‘উল আসমা ২/৪৭; আর-রাহীক্ব ৪৩৩)।
[5]. আহমাদ হা/২০৬৪৯; তিরমিযী হা/৩৭০১; মিশকাত হা/৬০৬৪। তিরমিযীর বর্ণনায় এসেছে, مَرَّتَيْنِ (দুই বার)। এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, তিনি স্বর্ণমুদ্রা ছাড়াও ৯০০ উট, গদি ও পালানসহ ১০০ ঘোড়া (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৩৬; আর-রাহীক্ব ৪৩৩ পৃঃ) এবং ২০০ উক্বিয়া রৌপ্য মুদ্রা দান করেন (আর-রাহীক্ব ৪৩৩ পৃঃ)। তবে এগুলির সনদ দুর্বলতা থেকে মুক্ত নয় (সীরাহ সহীহাহ ২/৫২৫)।
[6]. মুহাম্মাদ বিন উমর আল-হাযরামী ওরফে বাহরাক্ব (মৃ. ৯৩০ হি.), হাদায়েকুল আনওয়ার ওয়া মাত্বালি‘উল আসরার ফী সীরাতিন নবীইল মুখতার (জেদ্দা : দারুল মানহাজ, ১ম সংস্করণ ১৪১৯ হি.) ৩৭২ পৃঃ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...