খায়বর পরবর্তী যুদ্ধসমূহ
১. গাযওয়া ওয়াদিল ক্বোরা(غزوة وادي القرى) : ৭ম হিজরীর মুহাররম মাস। খায়বর যুদ্ধের পর রাসূল (সাঃ) এখানকার ইহূদীদের প্রতি গমন করেন। দিনভর যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে রাসূল (সাঃ)-এর একজন গোলাম এবং ইহূদী পক্ষে ১১ জন নিহত হয়। বিপুল গণীমত লাভ হয়। ইহূদীরা সন্ধি করে এবং চাষের জমিগুলি তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয় উৎপন্ন ফসলের অর্ধাংশ দেওয়ার শর্তে, যেভাবে খায়বরে করা হয়েছিল। ফাদাক ও তায়মার ইহূদীরা বিনাযুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে ও সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করে।[যাদুল মা‘আদ ৩/৩১৩-১৪; আর-রাহীক্ব ৩৭৮ পৃঃ]
২. সারিইয়া আবান বিন সাঈদ(سرية أبان بن سعيد) : ৭ম হিজরীর ছফর মাস। মদীনার আশপাশের লুটেরা বেদুঈনদের ভীতি প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে আবান বিন সাঈদের নেতৃত্বে নাজদের দিকে এই অভিযান প্রেরিত হয় এবং যথাসময়ে তারা অভিযান সফল করে ফিরে আসেন এবং খায়বরে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে মিলিত হন।[আর-রাহীক্ব ৩৮০ পৃঃ; বুখারী হা/৪২৩৮]
৩. গাযওয়া যাতুর রিক্বা‘(غزوة ذات الرقاع) : ৭ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস। এই যুদ্ধে মদীনার আমীর নিযুক্ত হন আবু যার গিফারী (রাঃ)। মতান্তরে উসমান বিন ‘আফফান (রাঃ)। ইবনু হিশাম, ইবনুল ক্বাইয়িমসহ প্রায় সকল জীবনীকার এই যুদ্ধকে ৪র্থ হিজরীর ঘটনা বলেছেন। কিন্তু আবু মূসা আশ‘আরী ও আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর অংশগ্রহণের কারণে সর্বাধিক ধারণা মতে এটি ৭ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে সংঘটিত হয়েছে বলেই প্রতীয়মান হয়। কেননা তারা ৭ম হিজরীর মুহাররম-ছফর মাসে সংঘটিত খায়বর যুদ্ধের সময় মুসলমান হয়ে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে খায়বরে সর্বপ্রথম সাক্ষাৎ করেন। এই যুদ্ধকে গাযওয়া নাজদ, গাযওয়া বনু মুহারিব ও বনু ছা‘লাবাহ বিন গাত্বফানও বলা হয়ে থাকে (সীরাহ সহীহাহ ২/৪৬২)।
খন্দকের যুদ্ধে শত্রুদের তিনটি প্রধান পক্ষের দু’টি অর্থাৎ কুরায়েশ ও ইহূদী পক্ষকে দমন করার পর তৃতীয় শক্তি নাজদের বনু গাত্বফানের দিকে এই অভিযান প্রেরিত হয়। যারা প্রায়ই মদীনার উপকণ্ঠে ডাকাতি ও লুটতরাজ করত। এদের কোন স্থায়ী জনপদ বা দুর্গ ছিল না। এরা ছিল সুযোগসন্ধানী ডাকাত দল। তাই মক্কা ও খায়বরবাসীদের ন্যায় এদের দমন করা সহজ ছিল না। ফলে এদের বিক্ষিপ্ত সন্ত্রাসী কর্মকান্ডসমূহ প্রতিহত করার জন্য অনুরূপ আকস্মিক হামলাসমূহ পরিচালনা করার প্রয়োজন ছিল। সেমতে খায়বর বিজয় সম্পন্ন করার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ৪০০ অথবা ৭০০ সাথী নিয়ে এদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। আনমার অথবা বনু গাত্বফানের ছা‘লাবাহ ও মুহারিব গোত্রের লোকেরা একত্রিত হয়ে যুদ্ধের প্রস্তুততি নিচ্ছে মর্মে সংবাদ পেয়ে তিনি অগ্রসর হন এবং নাখল (نَخْل) নামক স্থানে তাদের মুখোমুখি হন। কিন্তু তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে যায়। আবু মূসা আশ‘আরী বলেন, আমাদের ৬ জনের জন্য মাত্র একটি উট ছিল, যা আমরা পালাক্রমে সওয়ার হচ্ছিলাম। এ কারণে আমাদের পা সমূহ আহত হয় ও আমার নখ ঝরে পড়ে। ফলে আমরা ছেঁড়া কাপড় দিয়ে পায়ে পট্টি বাঁধি। এ কারণ এ যুদ্ধের নাম হয় যাতুর রিক্বা‘ বা ছেঁড়া পট্টির যুদ্ধ।[বুখারী হা/৪১২৮; মুসলিম হা/১৮১৬]
উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী :
━━━━━━━━━━━━━━
সরাসরি যুদ্ধ না হলেও এই অভিযানে অনেকগুলি ঘটনা ঘটে। যেমন (১) তরবারি গাছে ঝুলিয়ে রেখে ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগে জনৈক মুশরিক বেদুঈন গাওরাছ ইবনুল হারেছ(غَورَثُ بنُ الْحارِث) এসে রাসূল (সাঃ)-এর তরবারি নিয়ে নেয়। অতঃপর তাঁকে হুমকি দিয়ে বলে,أَتَخَافُنِى؟ قَالَ: لاَ. قَالَ فَمَنْ يَمْنَعُكَ مِنِّى؟ قَالَ: اللهُ ‘তুমি কি আমাকে ভয় কর? রাসূল (সাঃ) বললেন, না। সে বলল, বেশ কে এখন তোমাকে আমার থেকে রক্ষা করবে? রাসূল (সাঃ) বলেন ‘আল্লাহ’। তখন সাহাবীগণ তাকে ধমকালেন’।[বুখারী হা/৪১৩৬; মুসলিম হা/৮৪৩] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তখন তার হাত থেকে তরবারি পড়ে যায়। এ সময় রাসূল (সাঃ) তরবারি উঠিয়ে তাকে বললেন, এখন তোমাকে কে রক্ষা করবে? সে বলল, كُنْ كَخَيْرِ آخِذٍ ‘আপনি শ্রেষ্ঠ ধারণকারীর মত হউন! রাসূল (সাঃ) বললেন,أَتَشْهَدُ أَنْ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ؟ ‘তুমি কি সাক্ষ্য দিচ্ছ যে আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই? সে বলল, না। আমি আপনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব না বা আপনার বিরুদ্ধে যারা যুদ্ধ করছে তাদের সহযোগিতাও করব না’। তখন উক্ত প্রতিশ্রুতির উপর তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। রাবী বলেন, অতঃপর সে তার কওমের নিকট গিয়ে বলে,قَدْ جِئْتُكُمْ مِنْ عِنْدِ خَيْرِ النَّاسِ ‘আমি তোমাদের নিকট এসেছি একজন শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির নিকট থেকে’।[আহমাদ হা/১৪৯৭১; হাকেম হা/৪৩২২; মিশকাত হা/৫৩০৫] ওয়াক্বেদী ও ইবনু ইসহাক বলেন, পরে সে মুসলমান হয়ে যায় এবং তার মাধ্যমে বহু লোক ইসলাম কবুল করে। ওয়াক্বেদীর বর্ণনায় এসেছে যে, তার নাম ছিল দা‘ছূর (دَعْثُوْر) এবং সে তখনই ইসলাম কবুল করে। ইবনু হাজার বলেন, প্রকাশ্য বক্তব্যে বুঝা যায় যে, সেটি ছিল পৃথক যুদ্ধের পৃথক ঘটনা (ফাৎহুল বারী হা/৪১৩৪-এর আলোচনা)।
(২) এই দিন রাসূল (সাঃ) এক দলের পর আরেক দলকে নিয়ে ‘সালাতুল খাওফ’ আদায় করেন ফলে অন্যদের দু’রাক‘আত হয় এবং রাসূল (সাঃ)-এর চার রাক‘আত হয় (বুখারী হা/৪১৩৬)।
(৩) যুদ্ধ হতে ফেরার পথে বন্দীনী এক মুশরিক মহিলার স্বামী বদলা হিসাবে মুসলিম বাহিনীর রাতের বেলায় বিশ্রামের সুযোগে পাহারায় নিযুক্ত সাহাবী ‘আববাদ বিন বিশরের(عَبَّادُ بنُ بِشْر) উপরে সালাতরত অবস্থায় পরপর তিনটি তীর নিক্ষেপ করে তাঁকে মারাত্মক আহত করা সত্ত্বেও তিনি সালাত ছেড়ে দেননি। পরে অন্য পাহারা ‘আম্মার বিন ইয়াসির যখন বলেন, আমাকে কেন জাগাননি? তখন তিনি বলেন,إنِّيْ كُنْتُ فِيْ سُوْرَةٍ فَكَرِهْتُ أَنْ اَقْطَعَهَا ‘আমি এমন একটি সূরা পাঠে মগ্ন ছিলাম, যা থেকে বিরত হওয়াটা আমি অপসন্দ করেছিলাম’।[ইবনু হিশাম ২/২০৮-০৯; আর-রাহীক্ব ৩৮১-৮২ পৃঃ; আবুদাঊদ হা/১৯৮] সেটি ছিল সূরা ‘কাহফ’।[আবুদাঊদ হা/১৯৮]
এই অভিযানের ফলে বনু গাত্বফানের লোকেরা আর মাথা উঁচু করেনি। তারা ক্রমে ক্রমে সবাই ইসলাম কবুল করে। তাদের অনেকে মক্কা বিজয়ের অভিযানে ও তার পরে হোনায়েন যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর সাথে যোগ দেয় এবং হোনায়েনের গণীমতের অংশ লাভ করে। মক্কা বিজয়ের পর তারা মদীনায় যাকাত পাঠাতে থাকে। এভাবে আহযাব যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী তিনটি প্রধান শাখার সবগুলিই পদানত হয়। ফলে সর্বত্র শান্তি ও স্থিতি বিরাজ করতে থাকে’ (আর-রাহীক্ব ৩৮১-৮২ পৃঃ)। এই অভিযানের ফলে শামের দিকে মদীনার প্রভাব বিস্তার সহজ হয়ে যায় (সীরাহ সহীহাহ ২/৪৬২)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন