বুধবার, ৮ অক্টোবর, ২০২৫

হোনায়েন সংশ্লিষ্ট যুদ্ধসমূহ

 

হোনায়েন সংশ্লিষ্ট যুদ্ধসমূহ

১ সারিইয়া আওত্বাস(سرية أوطاس) : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। হোনায়েন যুদ্ধে পরাজিত মুশরিকদের একটি দল পার্শ্ববর্তী আওত্বাসে গিয়ে আশ্রয় নিলে আবু ‘আমের আল-আশ‘আরীর নেতৃত্বে একটি সেনাদল তাদের ধাওয়া করে তাদেরকে সেখান থেকে হটিয়ে দেয়। কিন্তু দলনেতা আবু ‘আমের শহীদ হন।[ইবনু হিশাম ২/৪৫৪; বুখারী হা/৪৩২৩]
মৃত্যুকালে তিনি ভাতিজা আবু মূসা আশ‘আরীকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত করেন। অতঃপর তাকে অছিয়ত করেন, যেন রাসূল (সাঃ)-কে তার সালাম পৌছে দেন এবং তাঁর কাছে তার জন্য আল্লাহর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনার আবেদন করেন। সে মতে আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-এর আবেদনক্রমে তার শহীদ চাচা আবু ‘আমের আশ‘আরীর জন্য রাসূল (সাঃ) ওযূ করে ক্বিবলামুখী হয়ে একাকী দু’হাত তুলে আল্লাহর নিকট দো‘আ করেন। এসময় আবু মূসার আবেদনক্রমে তার জন্যেও তিনি দো‘আ করেন’ (বুখারী হা/৪৩২৩ ‘আওত্বাস যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ)।

২. সারিইয়া নাখলা(سرية نخلة) : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। হোনায়েন যুদ্ধে পরাজিত পলাতকদের আরেকটি দল নাখলায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। তাদের বিরুদ্ধে যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামের নেতৃত্বে একটি সেনাদল প্রেরিত হয়। সেখানে মুশরিকদের বয়োবৃদ্ধ ও দূরদর্শী নেতা দুরায়েদ বিন ছিম্মাহ(دُرَيْدُ بْنُ الصِّمَّةِ) নিহত হন ও অন্যেরা পালিয়ে যায়। উক্ত বৃদ্ধ নেতা তাদের তরুণ নেতা মালেক বিন ‘আওফকে হোনায়েন যুদ্ধ থেকে নিষেধ করেছিলেন (ইবনু হিশাম ২/৪৫৩)।

৩. সারিইয়া তোফায়েল বিন ‘আমর দাওসী(سرية الطفيل بن عمرو الدوسى) : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। হোনায়েন যুদ্ধের পর ত্বায়েফ যাত্রাকালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তোফায়েল বিন ‘আমর দাওসীকে ‘আমর বিন হুমামাহ দাওসী গোত্রের ‘যুল-কাফফাইন’(ذُو الْكَفَّيْنِ) মূর্তি ধ্বংস করার জন্য পাঠান এবং তাকে নির্দেশ দেন যেন তার কওমের নিকট সাহায্য চায় ও তাদেরকে ত্বায়েফে নিয়ে আসে। অতঃপর তিনি সেখানে দ্রুত গমন করেন ও ‘যুল-কাফফাইন’ মূর্তি ধ্বংস করে দেন। তিনি তার মুখে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেন ও কবিতা পাঠ করেন।-
يَا ذَا الْكَفّيْنِ لَسْتُ مِنْ عُبَّادِكَا + مِيلَادُنَا أَقْدَمُ مِنْ مِيلَادِكَا+إنّي حَشَشْتُ النّارَ فِي فُؤَادِكَا
‘হে যুল-কাফফাইন! আমি তোমার পূজারীদের মধ্যে নই’। ‘আমাদের জন্ম তোমার জন্মের অনেক পূর্বে’। ‘আমি তোমার কলিজায় আগুন দিলাম’।
অতঃপর তাদের ৪০০ দ্রুতগামী লোককে নিয়ে তিনি রাসূল (সাঃ)-এর ত্বায়েফ অবতরণের চার দিন পর সেখানে পৌঁছে যান (যাদুল মা‘আদ ৩/৪৩৩-৩৪; ইবনু হিশাম ১/৩৮৫)।

৪. গাযওয়া ত্বায়েফ(غزوة الطائف) : ৮ম হিজরীর শাওয়াল মাস। হোনায়েন যুদ্ধে শত্রুপক্ষের নেতা মালেক বিন ‘আওফ সহ পরাজিত ছাক্বীফ গোত্রের প্রধান অংশটি পালিয়ে গিয়ে ত্বায়েফের দুর্ভেদ্য দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিল। প্রথমে খালিদের নেতৃত্বে ১০০০ সৈন্যের একটি বাহিনী প্রেরিত হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজে গমন করেন ও ত্বায়েফের দুর্গ অবরোধ করেন। এই অবরোধ ১০ থেকে ১৫ দিন স্থায়ী হয়। এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ১২ জনের অধিক শহীদ হন ও অনেকে আহত হন। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) অবরোধ উঠিয়ে নিয়ে ফিরে আসেন। ৯ম হিজরী সনে তারা মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করে’ (ইবনু হিশাম ২/৪৭৮-৮৭, ২/৫৩৭-৪১)। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-
এটি ছিল মূলতঃ হোনায়েন যুদ্ধেরই বর্ধিত অংশ। হোনায়েন যুদ্ধ হতে পালিয়ে যাওয়া সেনাপতি মালেক বিন ‘আওফ নাছরী তার দলবল নিয়ে ত্বায়েফ দুর্গে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ইতিপূর্বে তার পশ্চাদ্ধাবনের জন্য এক হাযার সৈন্যসহ খালেদ বিন অলীদকে পাঠানো হয়েছিল। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) হোনায়েন-এর গণীমত সমূহ জি‘ইর্রানাহতে জমা করে রেখে নিজেই ত্বায়েফ অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যান। পথিমধ্যে তিনি নাখলা ইয়ামানিয়াহ, ক্বারনুল মানাযিল, লিয়াহ (لِيَة) প্রভৃতি অঞ্চল অতিক্রম করেন এবং লিয়াহতে অবস্থিত মালেক বিন ‘আওফের একটি সেনাঘাঁটি গুঁড়িয়ে দেন। অতঃপর ত্বায়েফ গিয়ে দুর্গের নিকটবর্তী স্থানে শিবির স্থাপন করেন। এই স্থানটি বর্তমানে ‘মসজিদে আব্দুল্লাহ বিন আববাস (রাঃ)’ নামে পরিচিত। ঐ সময় ত্বায়েফ শহরটি ছিল এই মসজিদের দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে। বর্তমানে এটি শহরের অন্তর্ভুক্ত। অতঃপর তিনি দুর্গ অবরোধ করেন। যার সময়কালে মতভেদ থাকলেও বিশ্বস্ত মতে ১০ থেকে ১৫ দিন ছিল। কেননা রাসূল (সাঃ) যুলক্বা‘দাহ মাসের ৬ দিন বাকী থাকতে মদীনায় পৌঁছেছিলেন (সীরাহ সহীহাহ ২/৫০৭-০৮)। অবরোধের প্রথম দিকে দুর্গের মধ্য হতে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষিপ্ত হয়। তাতে মুসলিম বাহিনীর অনেকে হতাহত হন। পরে তাদের উপরে কামানের গোলা নিক্ষেপ করা হয়, যা খায়বর যুদ্ধের সময় মুসলমানদের হস্তগত হয়েছিল। শত্রুরা পাল্টা উত্তপ্ত লোহার খন্ড নিক্ষেপ করে। তাতেও বেশ কিছু মুসলমান শহীদ হন।
এ সময় রাসূল (সাঃ)-এর পক্ষ হতে একটি ঘোষণা প্রচার করা হয় যে,مَنْ خَرَجَ إلَيْنَا مِنَ الْعَبِيْدِ فَهُوَ حُرٌّ ‘যেসব গোলাম আমাদের নিকটে এসে আত্মসমর্পণ করবে, সে মুক্ত হয়ে যাবে’। এই ঘোষণায় ভাল ফল হয়। একে একে ২৩ জন ক্রীতদাস দুর্গ প্রাচীর টপকে বেরিয়ে আসে এবং সবাই মুসলমানদের দলভুক্ত হয়ে যায় (আহমাদ হা/২২২৯)। এদের মধ্যকার একজন ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী হযরত আবু বাকরাহ (রাঃ)। নারী নেতৃত্বের অকল্যাণ সম্পর্কিত সহীহ বুখারীতে বর্ণিত হাদীছের যিনি বর্ণনাকারী। যেখানে রাসূল (সাঃ) বলেন,لَنْ يُفْلِحَ قَوْمٌ وَلَّوْا أَمْرَهُمُ امْرَأَةً ‘ঐ জাতি কখনোই সফলকাম হবে না, যারা তাদের শাসন ক্ষমতা নারীর হাতে সমর্পণ করেছে’।[1] ‘আবু বাকরাহ’ নামটি ছিল রাসূল (সাঃ)-এর দেওয়া উপনাম। কেননা বাকরাহ (بَكْرَة) অর্থ কূয়া থেকে পানি তোলার চাক্কি। যার সাহায্যে তিনি দুর্গপ্রাচীর থেকে বাইরে নামতে সক্ষম হয়েছিলেন। পরে তার মনিবের পক্ষ থেকে তাকে ফেরৎ দানের দাবী করা হলে রাসূল (সাঃ) বলেন, هُوَ طَلِيْقُ اللهِ وَطَلِيْقُ رَسُوْلِهِ ‘সে আল্লাহর মুক্তদাস এবং তাঁর রাসূলের মুক্তদাস’ (আহমাদ হা/১৭৫৬৫; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৪১)।
গোলামদের পলায়ন দুর্গবাসীদের জন্য ক্ষতির কারণ হলেও আত্মসমর্পণের কোন লক্ষণ দেখা গেল না। কেননা তাদের কাছে এক বছরের জন্য খাদ্য ও পানীয় মওজুদ ছিল। উপরন্তু তাদের নিক্ষিপ্ত তীর ও উত্তপ্ত লৌহখন্ডের আঘাতে মুসলমানদের ক্ষতি হতে লাগল। এ সময় রাসূল (সাঃ) বলেন,مَنْ بَلَغَ بِسَهْمٍ فَلَهُ دَرَجَةٌ فِى الْجَنَّةِ ‘যে ব্যক্তি তীরের আঘাতে শহীদ হবে, সে ব্যক্তি জান্নাতে উঁচু সম্মান পাবে’ (আহমাদ হা/১৭০৬৩)। এতে মুসলিম বাহিনীর জোশ আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু দুর্গবাসীদের আত্মসমর্পণের কোন নমুনা পাওয়া গেল না।
এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সকলকে ফিরে আসার আহবান জানালে কেউ রাজি হয়নি। কিন্তু পরে কিছু লোক আহত হওয়া ব্যতীত কোন ফল না হওয়ায় তারা অবরোধ উঠিয়ে ফিরে আসতে রাজি হয়। এ সময় রাসূল (সাঃ)-কে বলা হল, আপনি বনু ছাক্বীফদের উপরে বদ দো‘আ করুন। কিন্তু রাসূল (সাঃ) তাদের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করে বললেন,اللَّهُمَّ اهْدِ ثَقِيْفًا وَأْتِ بِهِمْ ‘হে আল্লাহ! তুমি ছাক্বীফদের হেদায়াত কর এবং তাদেরকে নিয়ে এসো’ (সীরাহ সহীহাহ ২/৫১১)।[2] রাসূল (সাঃ)-এর দো‘আ কবুল হয়েছিল এবং সেনানায়ক মালেক বিন ‘আওফসহ গোত্র নেতা ‘আব্দে ইয়ালীল-এর নেতৃত্বে হাওয়াযেন ও ছাক্বীফ গোত্রের সবাই ৯ম হিজরীর রামাযানে মাত্র ১১ মাসের মাথায় মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করেন। তাদের অন্যতম জনপ্রিয় নেতা ওরওয়া বিন মাসঊদ জি‘ইর্রানাহ থেকে মদীনায় পৌঁছার পূর্বেই রাসূল (সাঃ)-এর সাথে পথে সাক্ষাৎ করেন এবং ইসলাম গ্রহণ করে ত্বায়েফে ফিরে আসেন’ (সীরাহ সহীহাহ ২/৫১৭)।
উল্লেখ্য যে, এই সেই ত্বায়েফ, যেখানে দশম নববী বর্ষে মে-জুন মাসের প্রচন্ড দাবদাহে মক্কা থেকে প্রায় ৯০ কি. মি. পথ পায়ে হেঁটে এসে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ছাক্বীফ নেতাদের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়েছিলেন। বিনিময়ে তাদের নিকট থেকে পেয়েছিলেন তাচ্ছিল্য, কটু-কাটব্য এবং লাঞ্ছনাকর দৈহিক নির্যাতন। অথচ আজ শক্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি তাদের ক্ষমা করে দিলেন এবং হেদায়াতের দো‘আ করলেন। বস্ত্ততঃ এটাই হল ইসলাম!


হতাহতের সংখ্যা :
━━━━━━━━━━
ত্বায়েফ যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ১২ জন শহীদ হন এবং অনেক সংখ্যক আহত হন। কাফেরদের পক্ষে ৩ জন নিহত হয় (সীরাহ সহীহাহ ২/৫১০)।


সুরাক্বার ইসলাম গ্রহণ :
━━━━━━━━━━━━━
এ সময় বনু কিনানাহর নেতা সুরাক্বা বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-মুদলেজী এসে মুসলমান হন। হিজরতকালে তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পশ্চাদ্ধাবন করেন। অতঃপর ব্যর্থ হয়ে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট থেকে একটি ‘নিরাপত্তানামা’(كِتَابَ أَمْنٍ) লিখে নেন। হোনায়েন এসে তিনি সেটি দেখান। ফলে রাসূল (সাঃ) তাকে নিকটে আসার অনুমতি দেন। অতঃপর তিনি ইসলাম কবুল করেন’ (বুখারী হা/৩৯০৬; ইবনু হিশাম ১/৪৯০)।


জি‘ইর্রানাহতে গণীমত বণ্টন :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━
হোনায়েন যুদ্ধের গণীমত বণ্টন না করেই জি‘ইর্রানাহতে জমা রেখে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ত্বায়েফ গিয়েছিলেন। অতঃপর সেখান থেকে ফিরে এসে গণীমত বণ্টন করেন। ইচ্ছাকৃত এই বিলম্বের কারণ ছিল হাওয়াযেন গোত্রের নেতারা ক্ষমাপ্রার্থী হয়ে আসলে তাদের বন্দীদের ও তাদের মালামাল ফেরত দেওয়া। কিন্তু দীর্ঘ সুযোগ পেয়েও হতভাগাদের কেউ আসলো না। অতঃপর ৫ই যুলক্বা‘দাহ ফিরে এসে তিনি যুদ্ধজয়ের রীতি অনুযায়ী গণীমত বণ্টন শুরু করলেন (সীরাহ সহীহাহ ২/৫১১)।


বণ্টন নীতি :
━━━━━━━
নিয়মানুযায়ী গণীমতের এক পঞ্চমাংশ রেখে বাকী সব বণ্টন করে দেওয়া হয়। বণ্টনের ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ‘মুওয়াল্লাফাতুল কুলূব’(مؤلفة القلوب) অর্থাৎ মক্কার নওমুসলিম কুরায়েশ নেতৃবৃন্দের এবং অন্যান্য গোত্রনেতাদের মুখ বন্ধ করার নীতি অবলম্বন করেন। যাতে তাদের অন্তরে ইসলামের প্রভাব শক্তভাবে বসে যায়। সেমতে তাদেরকেই বড় বড় অংশ দেওয়া হয়। যেমন নেতাদের মধ্যে আবু সুফিয়ান ইবনু হারবকে ৪০ উক্বিয়া রৌপ্য এবং ১০০ উট দেওয়া হয়। পরে তার দাবী মতে তার দুই পুত্র ইয়াযীদ ও মু‘আবিয়াকে ১০০টি করে উট দেওয়া হয়। হাকীম বিন হেযামকে প্রথমে ১০০টি পরে তার দাবী অনুযায়ী আরো ১০০টি উট দেওয়া হয়। সাফওয়ান বিন উমাইয়াকে প্রথমে ১০০, পরে ১০০ পরে আরও ১০০ মোট ৩০০ উট দেওয়া হয়। তখন সাফওয়ান বলেন, আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাকে যথেষ্ট দিয়েছেন। ইতিপূর্বে তিনি আমার নিকট সবচাইতে নিকৃষ্ট ব্যক্তি ছিলেন। অতঃপর তিনি আমাকে দিতে থাকেন। অবশেষে এখন তিনি আমার নিকটে সবচাইতে প্রিয় ব্যক্তি’ (মুসলিম হা/২৩১৩)।[3] সাফওয়ান তখনও মুশরিক ছিলেন এবং রাসূল (সাঃ) তাকে মক্কা বিজয়ের দিন থেকে চারমাস সময় দিয়েছিলেন। অতঃপর হারেছ বিন কালদাহকে ১০০ উট এবং অন্যান্য কুরায়েশ নেতাকেও একশ একশ করে উট দেওয়া হয়। অন্যদেরকে মর্যাদা অনুযায়ী পঞ্চাশ, চল্লিশ ইত্যাদি সংখ্যায় উট দিতে থাকেন। এমনকি এমন কথা রটে যায় যে, মুহাম্মাদ (সাঃ) এত বেশী দান করছেন যে, কারু আর অভাব থাকবে না। এর ফলে বেদুঈনরা এসে এমন ভিড় জমালো যে, এক পর্যায়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি গাছের নিকটে কোনঠাসা হয়ে পড়লেন। যাতে তাঁর গায়ের চাদরটা জড়িয়ে গেল। তখন তিনি বলে উঠলেনأيها الناس، رُدُّوْا عَلَيَّ رِدَائِي ‘হে লোকেরা! চাদরটা আমাকে ফিরিয়ে দাও’। যার হাতে মুহাম্মাদের জীবন, তার কসম করে বলছি, যদি আমার নিকটে তেহামার বৃক্ষরাজি গণীমত হিসাবে থাকত, তাও আমি তোমাদের মধ্যে বণ্টন করে দিতাম। তখন তোমরা আমাকে কৃপণ, কাপুরুষ বা মিথ্যাবাদী হিসাবে পেতে না’। তারপর স্বীয় উটের দেহ থেকে একটি লোম উঠিয়ে হাতে উঁচু করে ধরে বললেন,أيُّهَا النَّاسُ، وَاللهِ مَا لِى مِنَ الْفَىْءِ شَىْءٌ وَلاَ هَذِهِ إِلاَّ خُمُسٌ وَالْخُمُسُ مَرْدُودٌ فِيكُمْ ‘হে জনগণ! আল্লাহর কসম! ফাই বা গণীমতের কিছুই আমার কাছে আর অবশিষ্ট নেই। এমনকি এই লোমটিও নেই, এক পঞ্চমাংশ ব্যতীত। যা অবশেষে তোমাদের কাছেই ফিরে যাবে’।[আহমাদ হা/৬৭২৯, আবুদাঊদ হা/২৬৯৪; মিশকাত হা/৪০২৫]
এইভাবে নওমুসলিম মুওয়াল্লাফাতুল কুলূবদের দেওয়ার পর বাকী গণীমত সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে বণ্টন করা হয়। যায়েদ বিন সাবেত (রাঃ)-কে হিসাব করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাতে দেখা যায় যে, প্রতিজন পদাতিকের মাত্র ৪টি উট ও ৪০টি বকরী এবং অশ্বারোহীর ১২টি উট ও ১২০টি করে বকরী ভাগে পড়েছে। এই যৎসামান্য গণীমত নিয়েই তাদেরকে খুশী থাকতে হয় (যাদুল মা‘আদ ৩/৪১৫)।
এ সময় রাসূল (সাঃ) বলেন,فَوَاللهِ إِنِّى لأُعْطِى الرَّجُلَ، وَأَدَعُ الرَّجُلَ ، وَالَّذِى أَدَعُ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنَ الَّذِى أُعْطِى ‘আল্লাহর কসম! আমি কাউকে দেই, কাউকে ছাড়ি। যাকে আমি ছাড়ি, সে আমার নিকটে অধিকতর প্রিয় তার চাইতে, যাকে আমি দেই’ (বুখারী হা/৯২৩)। উভয়ে মুমিন হওয়া সত্ত্বেও একজনকে দিচ্ছেন অন্যজনকে দিচ্ছেন না, সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ)-এর এমন একটি প্রশ্নের উত্তরে রাসূল (সাঃ) বলেন,إِنِّى أُعْطِى رِجَالاً وَأَدَعُ مَنْ هُوَ أَحَبُّ إِلَىَّ مِنْهُمْ لاَ أُعْطِيهِ شَيْئًا مَخَافَةَ أَنْ يُكَبُّوا فِى النَّارِ عَلَى وُجُوهِهِمْ ‘আমি কাউকে দিচ্ছি এবং তাদের মধ্যে যারা আমার নিকট অধিক প্রিয় তাদেরকে ছাড়ছি এজন্য, যাতে তারা উপুড়মুখী হয়ে জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত না হয়’ (আবুদাঊদ হা/৪৬৮৩)। তিনি বলেন,فَإِنِّي أُعْطِي رِجَالاً حَدِيثِي عَهْدٍ بِكُفْرٍ أَتَأَلَّفُهُمْ ‘আমি কুফরী থেকে নতুন আগত লোকদের দিচ্ছি তাদেরকে ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য’ (বুখারী হা/৪৩৩১)।
ইবনু ইসহাকের হিসাব মতে এদিন ১২ জন নেতাকে একশ একশ করে উট দেওয়া হয়। পাঁচ জনকে একশর কিছু কমসংখ্যক দেওয়া হয়। এভাবে ২৯ জনকে দেওয়া হয়। অন্যেরা আরও ২৩ জনের কথা বলেছেন। সর্বমোট ৫২ জন মুওয়াল্লাফাতুল কুলূবকে এই দিন বেশী বেশী দান করা হয়। এদের সকলেরই ইসলাম সুন্দর ছিল, ওয়ায়না বিন হিছন আল-ফাযারীসহ দু’একজন ব্যতীত (সীরাহ সহীহাহ ২/৫১২)।
তৃণভোজী পশুর সম্মুখে এক গোছা ঘাসের অাঁটি ধরলে যেমন সে ছুটে আসে, মানুষের মধ্যে অনুরূপ একদল মানুষ আছে, যাদেরকে দুনিয়ার লোভ দেখিয়েই কাছে টানতে হয়। সদ্য দলে আগত লোকদের মধ্যে অনেকের ক্ষেত্রে রাসূল (সাঃ) উক্ত নীতি অবলম্বন করেন। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম তো পরীক্ষিত মানুষ। দুনিয়া তাদের কাছে তুচ্ছ। আখেরাত তাদের নিকটে মুখ্য। তাই তাদের ব্যাপারে রাসূল (সাঃ)-এর কোন উদ্বেগ ছিল না।




[1]. বুখারী হা/৪৪২৫। পারস্যরাজের ঐ কন্যার নাম ছিল বূরান (بُورَانُ بِنْتُ شِيرَوَيْهِ بْنِ كِسْرَى بْنِ بَرْوِيزَ)। ঘটনা ছিল এই যে, শীরাওয়াইহ তার পিতা পারস্যরাজ কিসরাকে হত্যা করে সিংহাসন দখল করেন। পূর্বেই সেটা বুঝতে পেরে পিতা একটি ছোট ডিববা প্রস্তুত করেন। যার গায়ে লিখে রাখেন ‘যৌন উদ্দীপক ঔষধ’(حُقُّ الْجِمَاعِ)। যে ব্যক্তি এখান থেকে পান করবে, তার উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবে। ডিববাটি তিনি বিষ ভর্তি অবস্থায় তাঁর বিশেষ মালখানায় রেখে দেন। উদ্দেশ্য ছিল আমি নিহত হওয়ার পর ছেলে এটি থেকে খেয়ে দ্রুত মৃত্যুবরণ করবে। সেটিই হল। ছেলে তা থেকে খেল এবং মাত্র ৬ মাসের মধ্যে মারা গেল। ইতিমধ্যেই সে তার ক্ষমতাকে নিরংকুশ করার জন্য তার ভাইদের হত্যা করল। এক্ষণে তার মৃত্যুর পর কোন পুরুষ উত্তরাধিকারী না থাকায় লোকেরা তার কন্যা বূরানকে ক্ষমতায় বসায়। যা পরবর্তীতে পারস্য সাম্রাজ্যের ধ্বংস ত্বরান্বিত করে। পারস্য রাজ কিসরা রাসূল (সাঃ)-এর প্রেরিত পত্র ছিঁড়ে ফেললে তিনি বদদো‘আ করেছিলেন, اللَّهُمَّ مَزِّقْ مُلْكَهُ ‘আল্লাহ তার সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করুন’ (সহীহাহ হা/১৪২৯)। বাস্তবে সেটাই হয়ে গেল। পারস্য সাম্রাজ্য ইতিহাস থেকে মুছে গেল (ফাৎহুল বারী হা/৪৪২৫-এর আলোচনা)। যা আর কখনোই ফিরে আসেনি।
[2]. আহমাদ হা/১৪৭৪৩, সনদ শক্তিশালী, -আরনাঊত্ব; তিরমিযী হা/৩৯৪২, আলবানী বলেন, হাদীছটির সনদ মুসলিমের শর্তানুযায়ী। কিন্তু এটি আবুয্ যুবায়ের সূত্রে বর্ণিত যিনি ‘মুদাল্লিস’ -মিশকাত হা/৫৯৮৬-এর টীকা, ‘মানাক্বিব’ অধ্যায়-৩০, অনুচ্ছেদ-১। সেকারণ এটি যঈফ (আলবানী, দিফা‘ ‘আনিল হাদীছ ৩৪ পৃঃ; ফিক্বহুস সীরাহ ৪৩২ পৃঃ)।
[3]. প্রসিদ্ধ আছে যে, সাফওয়ান হোনায়েন যুদ্ধের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে গণীমতের মালসমূহের দিকে দেখতে থাকেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বলেন, এগুলি সবই তোমার। তখন সাফওয়ান বলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, এগুলি দিয়ে কোন নবী ব্যতীত কেউ কাউকে খুশী করতে পারে না এবং আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি আল্লাহর রাসূল’। ওয়াক্বেদী বর্ণিত অত্র বর্ণনাটি পরিত্যক্ত (মা শা-‘আ ২০০ পৃঃ)।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...