শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অভিযান ও যুদ্ধ সমূহ

 

অভিযান ও যুদ্ধ সমূহ

যুদ্ধের অনুমতি সংক্রান্ত আয়াত নাযিলের পর কুরায়েশ বাহিনীর মুকাবিলার জন্য রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনা থেকে মক্কা অভিমুখী রাস্তাগুলিতে নিয়মিত টহল অভিযান প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেন। এ সময় বাইরের বিভিন্ন গোত্রের সাথে তাঁর কৃত সন্ধি চুক্তিসমূহ খুবই ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়। যার এলাকাসমূহ মদীনা হতে মক্কার দিকে তিন মনযিল অর্থাৎ প্রায় পঞ্চাশ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এইসব অভিযানের যেগুলিতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বয়ং অংশ গ্রহণ করতেন, সেগুলিকে ‘গাযওয়াহ’ (غَزْوَةٌ) এবং যেগুলিতে নিজে যেতেন না, বরং অন্যদের পাঠাতেন, সেগুলিকে সারিইয়াহ (سَرِيَّةٌ) বলা হয়। এইসব অভিযানে যুদ্ধ প্রস্তুততি নিয়ে বের হলেও বলতে গেলে কোনটাতেই যুদ্ধ হয়নি। তবে মক্কায় খবর হয়ে গিয়েছিল যে, কুরায়েশদের হুমকিতে মুহাজিরগণ ভীত নন, বরং তারা সদা প্রস্তুত।
উল্লেখ্য যে, সকল অভিযানেই পতাকা থাকতো সাদা রংয়ের এবং পতাকাবাহী সেনাপতি থাকতেন পৃথক ব্যক্তি। এক্ষণে এই সময়ের মধ্যে প্রেরিত অভিযান সমূহ বিবৃত হল, যা নিম্নরূপ।-


১. সারিইয়া সায়ফুল বাহর (سرية سيف البحر) বা সমুদ্রোপকুলে প্রেরিত বাহিনী :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
১ম হিজরী সনের রামাযান মাস (মার্চ ৬২৩ খৃ.)। হযরত হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের নেতৃত্বে ৩০ সদস্য বিশিষ্ট এই মুহাজির বাহিনী প্রেরিত হয় সিরিয়া হতে আবু জাহলের নেতৃত্বে প্রত্যাবর্তনকারী ৩০০ সদস্যের কুরায়েশ কাফেলার গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। উভয় বাহিনী মদীনা থেকে ২৫০ কি.মি. দক্ষিণ-পশ্চিমে লোহিত সাগরের তীরবর্তী ‘ঈছ’ (العِيْص) নামক স্থানে মুখোমুখি হয়। কিন্তু জুহায়না গোত্রের নেতা মাজদী বিন আমর, যিনি ছিলেন উভয় দলের মিত্র, তাঁর কারণে যুদ্ধ হয়নি। এ যুদ্ধে পতাকা বাহক ছিলেন আবু মারছাদ আল-গানাভী (রাঃ)।[আর-রাহীক্ব ১৯৭ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৫৯৫; আল-বিদায়াহ ৩/২৪৪]


২. সারিইয়া রাবেগ (سرية رابغ) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
১ম হিজরীর শাওয়াল মাস। ওবায়দাহ ইবনুল হারেছ বিন মুত্ত্বালিব-এর নেতৃত্বে ৬০ জনের এই মুহাজির বাহিনী প্রেরিত হয়। মদীনা থেকে দক্ষিণে এবং জেদ্দা থেকে ১৪০ কি.মি. উত্তরে অবস্থিত ‘রাবেগ’ অঞ্চলটি বর্তমানে মক্কা প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত। এই অভিযানে রাবেগ উপত্যকায় আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ২০০ জনের এক বাহিনীর মুখোমুখি হলে উভয় পক্ষে কিছু তীর নিক্ষেপ ব্যতীত তেমন কিছু ঘটেনি। তবে মাক্কী বাহিনী থেকে দু’জন দল ত্যাগ করে মুসলিম বাহিনীতে চলে আসেন। যারা গোপনে মুসলমান ছিলেন। যাদের একজন হলেন মিক্বদাদ বিন ‘আমর এবং অন্যজন হলেন উৎবাহ বিন গাযওয়ান। এই যুদ্ধে হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ) কাফেরদের প্রতি সর্বপ্রথম তীর নিক্ষেপ করেন। সেকারণ তিনি أَوَّلُ الْعَرَبِ رَمَى بِسَهْمٍ فِى سَبِيلِ اللهِ ‘আরবদের মধ্যে আল্লাহর রাস্তায় প্রথম তীর নিক্ষেপকারী’ হিসাবে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।[বুখারী হা/৩৭২৮; আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৩১৯৬] রাসূল (সাঃ) তার জন্য দো‘আ করেছিলেন, اللَّهُمَّ سَدِّدْ سَهْمَهُ وَأَجِبْ دَعْوَتَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার তীরকে লক্ষ্যভেদী কর এবং তার দো‘আ কবুল কর’।[আর-রাহীক্ব ১৯৮ পৃঃ; হাকেম হা/৪৩১৪; আল-বিদায়াহ ৮/৭৬] এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন মিসত্বাহ বিন আছাছাহ বিন মুত্ত্বালিব (রাঃ)।[ইবনু হিশাম ১/৫৯১; আল-বিদায়াহ ৩/২৩৪; হাকেম হা/৪৮৬১]


৩. সারিইয়া খাররার (سرية الخرّار) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
১ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাস। সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে ২০ জনের এই মুহাজির দল প্রেরিত হয় কুরায়েশদের গতিবিধি লক্ষ্য করার জন্য। তারা জুহফার নিকটবর্তী ‘খাররার’ উপত্যকা পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসেন। কেননা মক্কার কাফেলা এখান থেকে একদিন আগেই চলে গিয়েছিল। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন মিক্বদাদ বিন ‘আমর (রাঃ)।[ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/১১; আর-রাহীক্ব ১৯৮ পৃঃ]


৪. গাযওয়া ওয়াদ্দান (غزوة ودّان أو الأبواء) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
২য় হিজরীর ছফর মাস (আগষ্ট ৬২৩ খৃঃ)। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সর্বপ্রথম এই অভিযানে নিজেই নেতৃত্ব দেন, যাতে ৭০ জন মুহাজির ছিলেন। মদীনা থেকে ২৫০ কি.মি. দক্ষিণে এই অভিযানে তিনি ১৫ দিন মদীনার বাইরে ছিলেন এবং যাওয়ার সময় খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ (রাঃ)-কে মদীনার আমীর নিযুক্ত করে যান। এই অভিযানেরও উদ্দেশ্য ছিল কুরায়েশ কাফেলার পথ রোধ করা। কিন্তু বাস্তবে তাদের দেখা মেলেনি। তবে এই সফরে লাভ হয় এই যে, তিনি স্থানীয় বনু যামরাহ (بَنُو ضَمْرَة) গোত্রের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনে সমর্থ হন (ইবনু হিশাম ১/৫৯১)। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (রাঃ)।[আর-রাহীক্ব ১৯৮ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৩/২৪৩]


৫. গাযওয়া বুওয়াত্ব (غزوة بواط) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
২য় হিজরীর রবীউল আউয়াল মাস (সেপ্টেম্বর ৬২৩ খৃঃ)। ২০০ সাহাবীকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) স্বয়ং এ অভিযানে বের হন। মদীনা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমে ১০০ কি.মি. দূরে এটি অবস্থিত। উমাইয়া বিন খালাফের নেতৃত্বে ১০০ জনের কুরায়েশ কাফেলার গতিরোধ করাই ছিল এ অভিযানের উদ্দেশ্য। কিন্তু কোন সংঘর্ষ হয়নি। এই অভিযানে বের হওয়ার সময় তিনি আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-কে মদীনার আমীর নিযুক্ত করে যান। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ)।[আর-রাহীক্ব ১৯৯ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৫৯৮]


৬. গাযওয়া সাফওয়ান(غزوة سفوان) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
একই মাসে মক্কার নেতা কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী মদীনার চারণভূমি থেকে গবাদিপশু লুট করে নিয়ে গেলে ৭০ জন সাহাবীকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার পশ্চাদ্ধাবন করেন এবং বদর প্রান্তরের কাছাকাছি সাফওয়ান উপত্যকা পর্যন্ত ধাওয়া করেন। কিন্তু লুটেরাদের ধরতে ব্যর্থ হন। এই অভিযানকে অনেকে গাযওয়া বদরে ঊলা(غَزْوَةُ بَدْرٍ الْأُولَى) বা বদরের প্রথম যুদ্ধ বলে অভিহিত করেছেন। এই সময় মদীনার আমীর ছিলেন যায়েদ বিন হারেছাহ (রাঃ)।
উল্লেখ্য যে, এটাই ছিল মদীনার উপকণ্ঠে কুরায়েশদের প্রথম হামলা। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন আলী ইবনু আবু ত্বালিব (রাঃ)।[আর-রাহীক্ব ১৯৯ পৃঃ; আল-বিদায়াহ ৩/২৪৭]


৭. গাযওয়া যুল-‘উশাইরাহ (غزوة ذى العُشيرة) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
২য় হিজরীর জুমাদাল ঊলা ও আখেরাহ মোতাবেক ৬২৩ খৃষ্টাব্দের নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস। ১৫০ বা ২০০ সাহাবীর একটি দল নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি মূল্যবান রসদবাহী কুরায়েশ কাফেলার গতিরোধে বের হন। কিন্তু ইয়াম্বু‘-এর পার্শ্ববর্তী যুল-‘উশায়রা পর্যন্ত গিয়েও তাদের ধরতে ব্যর্থ হন। এ সময় মদীনার আমীর ছিলেন আবু সালামাহ (রাঃ)। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে এই কুরায়েশ কাফেলাটি বহাল তবিয়তে মক্কায় ফিরে যায় এবং এর ফলেই বদর যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরী হয়। এই অভিযানকালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বনু মুদলিজ ও তাদের মিত্রদের সাথে সন্ধি চুক্তি সম্পাদন করেন। এ যুদ্ধের পতাকা বাহক ছিলেন হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (রাঃ)।[আর-রাহীক্ব ১৯৯ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৫৯৮-৫৯৯; বুখারী হা/৩৯৪৯।]


৮. সারিইয়া নাখলা (سرية نخلة) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
২য় হিজরীর রজব মাস (জানুয়ারী ৬২৪ খৃঃ)। আব্দুল্লাহ বিন জাহশের নেতৃত্বে ৮ বা ১২ জন মুহাজির সাহাবীর একটি ক্ষুদ্র দল প্রেরিত হয়। এ যুদ্ধে প্রেরণের সময় রাসূল (সাঃ) তার হাতে একটি পত্র দেন এবং বলেন, দু’দিন পথ চলার আগ পর্যন্ত যেন পত্রটি না খোলা হয়। দু’দিন চলার পর তিনি পত্র খোলেন এবং পাঠ করার পর সবাইকে বলেন, আমাদেরকে ত্বায়েফ ও মক্কার মধ্যবর্তী নাখলায় অবতরণ করতে বলা হয়েছে এবং সেখানে গিয়ে কুরায়েশ কাফেলার অপেক্ষায় থাকতে বলা হয়েছে। অতএব যিনি শহীদ হতে চান কেবল তিনিই আমার সাথে যাবেন। অথবা ইচ্ছা করলে ফিরে যাবেন। এ ব্যাপারে আমি কাউকে চাপ দিব না তবে আমি যেতে প্রস্তুত’। তখন সাথী মুহাজিরগণের সবাই তাঁর সঙ্গে থাকলেন, কেউই ফিরে আসলেন না। উক্ত মুহাজিরগণের মধ্যে ছিলেন আমীর আব্দুল্লাহ বিন জাহশ ছাড়াও সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ, আবু হুযায়ফা বিন উৎবা বিন রাবী‘আহ, উক্কাশা বিন মিহছান, উৎবা বিন গাযওয়ান, ওয়াক্বিদ বিন আব্দুল্লাহ, খালেদ বিন বুকাইর ও সোহায়েল বিন বায়যা’ প্রমুখ (ইবনু হিশাম ১/৬০১-০২)।
অতঃপর তাঁরা নাখলা উপত্যকায় পৌঁছে একটি কুরায়েশ কাফেলাকে আক্রমণ করেন ও তাদের নেতা আমর ইবনুল হাযরামীকে হত্যা করে দু’জন বন্দী সহ গণীমতের মাল নিয়ে মদীনায় ফিরে আসেন। এটাই ছিল ইসলামের ইতিহাসে প্রথম গণীমত লাভ এবং প্রথম নিহত হওয়ার ঘটনা ও প্রথম দু’ব্যক্তি বন্দী হওয়ার ঘটনা। ঘটনাটি ঘটে রজব মাসের শেষ দিনে। কেননা তারা দেখলেন যদি আমরা যুদ্ধ না করি, তাহলে শত্রু পালিয়ে যায়। এমতাবস্থায় তারা যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। সেকারণ রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বন্দীদের মুক্তি দেন ও নিহত ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের রক্তমূল্য দেন। এ সময় মুসলমানেরা হারাম মাসের বিধান লংঘন করেছে বলে মুশরিকদের রটনার জবাবে সূরা বাক্বারাহ ২১৭ আয়াতটি নাযিল হয়। তাতে বলা হয়,
يَسْأَلُونَكَ عَنِ الشَّهْرِ الْحَرَامِ قِتَالٍ فِيهِ قُلْ قِتَالٌ فِيهِ كَبِيرٌ وَصَدٌّ عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَكُفْرٌ بِهِ وَالْمَسْجِدِ الْحَرَامِ وَإِخْرَاجُ أَهْلِهِ مِنْهُ أَكْبَرُ عِنْدَ اللهِ وَالْفِتْنَةُ أَكْبَرُ مِنَ الْقَتْلِ وَلاَ يَزَالُونَ يُقَاتِلُونَكُمْ حَتَّى يَرُدُّوكُمْ عَنْ دِينِكُمْ إِنِ اسْتَطَاعُوا وَمَنْ يَرْتَدِدْ مِنْكُمْ عَنْ دِينِهِ فَيَمُتْ وَهُوَ كَافِرٌ فَأُولَئِكَ حَبِطَتْ أَعْمَالُهُمْ فِي الدُّنْيَا وَالْآخِرَةِ وَأُولَئِكَ أَصْحَابُ النَّارِ هُمْ فِيهَا خَالِدُونَ-
‘লোকেরা তোমাকে প্রশ্ন করছে নিষিদ্ধ মাস ও তার মধ্যে যুদ্ধ করা সম্পর্কে। তুমি বল, এ মাসে যুদ্ধ করা মহাপাপ। তবে আল্লাহর পথে বাধা সৃষ্টি করা ও তাঁর সাথে কুফরী করা এবং মাসজিদুল হারামে প্রবেশে বাধা দেওয়া ও তার অধিবাসীদের বহিষ্কার করা আল্লাহর নিকটে আরও বড় পাপ। আর ফিৎনা (কুফরী) করা যুদ্ধ করার চাইতে বড় পাপ। বস্ত্ততঃ যদি তারা সক্ষম হয়, তবে তারা সর্বদা তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, যতক্ষণ না তারা তোমাদেরকে তোমাদের দ্বীন থেকে ফিরাতে পারে। আর তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি স্বধর্ম ত্যাগ করবে, অতঃপর কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, তাদের দুনিয়া ও আখেরাতের সকল কর্ম নিষ্ফল হবে। তারা জাহান্নামের অধিবাসী হবে এবং সেখানেই চিরকাল থাকবে’ (বাক্বারাহ ২/২১৭)।[আর-রাহীক্ব ২০০-০১ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/১৫০; ইবনু হিশাম ১/৬০১-০৫] অর্থাৎ মুসলমানদের এই কাজের তুলনায় মুশরিকদের অপকর্মসমূহ ছিল বহু গুণ বেশী অপরাধজনক। এই যুদ্ধে নিহতের বদলা নিতেই আবু জাহল বদরে যুদ্ধ করতে এসেছিল। এই অভিযান শেষে শা‘বান মাসে মুসলমানদের উপরে জিহাদ ফরয হয় (বাক্বারাহ ২/১৯০-৯৩; মুহাম্মাদ ৪৭/৪-৭, ২০)।


ক্বিবলা পরিবর্তন :
━━━━━━━━━━
নাখলা অভিযান শেষ হবার পর ২য় হিজরীর শা‘বান মাসে (ফেব্রুয়ারী ৬২৪ খৃ.) ক্বিবলা পরিবর্তনের আদেশ সূচক আয়াতটি (বাক্বারাহ ২/১৪৪) নাযিল হয়। যাতে ১৬/১৭ মাস পরে বায়তুল মুক্বাদ্দাস হতে কা‘বার দিকে মুখ ফিরিয়ে সালাত আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়।[বুখারী হা/৪০; মুসলিম হা/৫২৫; ইবনু হিশাম ১/৬০৬] এই হুকুম নাযিলের মাধ্যমে কপট ইহূদীদের মুখোশ খুলে যায়। যারা মুসলমানদের কাতারে শামিল হয়েছিল স্রেফ ফাটল ধরানো ও বিশৃংখলা সৃষ্টির জন্য। এখন তারা তাদের নিজস্ব অবস্থানে ফিরে গেল এবং মুসলমানেরাও তাদের কপটতা ও খেয়ানত থেকে বেঁচে গেল। একই সময়ে রামাযানের সিয়াম ও যাকাতুল ফিৎর ফরয করা হয়।[1]


সূক্ষ্ম ইঙ্গিত :
━━━━━━━━
এর মধ্যে মুসলমানদের জন্য সূক্ষ্ম ইঙ্গিত ছিল যে, এখন থেকে একটি নতুন যুগের সূচনা হতে যাচ্ছে, যা ফেলে আসা ক্বিবলা কা‘বাগৃহের উপরে মুসলমানদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। একই সময়ে সূরা বাক্বারাহ ১৯০-১৯৩ আয়াত নাযিল হয়। যাতে বলা হয় وَأَخْرِجُوْهُم مِّنْ حَيْثُ أَخْرَجُوْكُمْ ‘যে স্থান হতে তারা তোমাদের বহিষ্কার করেছে, সে স্থান হতে তোমরাও তাদের বহিষ্কার কর’। অতঃপর যুদ্ধের নিয়মবিধি নাযিল হয় সূরা মুহাম্মাদ ৪-৭ আয়াতে। অতঃপর যুদ্ধ ভয়ে ভীতু কাপুরুষদের নিন্দা করে একই সূরার ২০ আয়াতটি নাযিল হয়। একই সময়ে পরপর এসব আয়াত নাযিলের মাধ্যমে এটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল যে, হক ও বাতিলের মধ্যে একটা চূড়ান্ত বুঝাপড়ার সময়কাল অত্যাসন্ন। কেননা আল্লাহ কখনোই চান না যে, তাঁর পবিত্র গৃহ নাপাক মুশরিক ও পৌত্তলিকদের দখলীভুক্ত হয়ে থাকুক। বলা বাহুল্য ক্বিবলা পরিবর্তনের হুকুম নাযিলের পর রাসূল (সাঃ)-এর মধ্যে এবং সাধারণভাবে সকল মুসলমানের মধ্যে আশা ও আনন্দের ঢেউ জেগে ওঠে এবং তাদের অন্তরে মক্কায় ফিরে যাওয়ার আকাংখা ও উদ্দীপনা তীব্র হয়ে ওঠে, যা উক্ত ঘটনার দেড় মাস পরে বদর যুদ্ধে তাদেরকে বিজয়ী হতে সাহায্য করে।


নাখলা যুদ্ধের ফলাফল :
━━━━━━━━━━━━━━
নাখলা অভিযানের ফলে কুরায়েশদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়। তারা নিশ্চিত হয় যে, অবশেষে তাদের আশংকাই সত্যে পরিণত হতে যাচ্ছে এবং মদীনা এখন তাদের জন্য বিপদসংকুল এলাকায় পরিণত হয়েছে। তারা এটাও বুঝে নিল যে, যেকোন সময় মুহাজিরগণ মক্কা আক্রমণ করতে পারে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও তাদের হঠকারিতা ও উদ্ধত আচরণ থেকে তারা বিরত হল না। তারা সন্ধির পথে না গিয়ে যুদ্ধের পথ বেছে নিল এবং মদীনায় হামলা করে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করে ফেলার উদ্দেশ্যে বদর যুদ্ধে রওয়ানা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। নাখলা যুদ্ধে আমর ইবনুল হাযরামী হত্যার প্রতিশোধ নেওয়াটা ছিল একটি অজুহাত মাত্র।




[1]. ইবনু কাছীর, আল-ফুছূল ফী সীরাতির রাসূল (সাঃ); তাহকীক : মুহাম্মাদ আলী হালাবী আল-আছারী (শারজাহ : দারুল ফাৎহ, ১ম সংস্করণ ১৪১৬/১৯৯৬ খৃ.) ৪৩ পৃঃ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...