যুদ্ধের অনুমতি
কুরায়েশদের সন্ত্রাসমূলক অপতৎপরতা ও প্রকাশ্য হামলাসমূহ মুকাবিলার জন্য মুসলমানদেরকে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে ইতিপূর্বে হিজরতকালে সূরা হজ্জ ৩৯ ও ৪০ আয়াত নাযিল হয়[তিরমিযী হা/৩১৭১; আহমাদ হা/১৮৬৫]
ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এটাই প্রথম আয়াত, যা কাফিরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অনুমতি দিয়ে হিজরতকালে নাযিল হয়।[তিরমিযী হা/৩১৭১; নাসাঈ হা/৩০৮৫] আর জিহাদের উদ্দেশ্য হল সমাজ থেকে যুলুম ও অন্যায়ের প্রতিরোধ করা।
অন্যত্র আল্লাহ তালূত কর্তৃক অত্যাচারী বাদশাহ জালূতের ধ্বংস প্রসঙ্গে বলেন, وَلَوْلاَ دَفْعُ اللهِ النَّاسَ بَعْضَهُمْ بِبَعْضٍ لَّفَسَدَتِ الأَرْضُ وَلَـكِنَّ اللهَ ذُوْ فَضْلٍ عَلَى الْعَالَمِيْنَ ‘যদি আল্লাহ একজনকে আরেকজনের দ্বারা প্রতিহত না করতেন, তাহলে দুনিয়া ধ্বংস হয়ে যেত। কিন্তু বিশ্ববাসীর প্রতি আল্লাহ একান্তই করুণাময়’ (বাক্বারাহ ২/২৫১)।
ইসলামে জিহাদ বিধান :
━━━━━━━━━━━━━━
‘জিহাদ’ অর্থ সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। শারঈ পরিভাষায় ‘জিহাদ’ হল সমাজে ইসলামী বিধান প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর রাস্তায় সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো। কুফরী শক্তির বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করা যার চূড়ান্ত রূপ। জিহাদের উদ্দেশ্য হল মানুষকে মানুষের দাসত্ব থেকে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে আনা এবং মানুষে মানুষে সাম্য ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা।
(ক) মাক্কী জীবনে কাফেরদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি ছিল না। বলা হয়েছিল, كُفُّوا أَيْدِيَكُمْ وَأَقِيمُوا الصَّلاَةَ وَآتُوا الزَّكَاةَ ‘তোমরা হস্ত সংযত রাখ এবং সালাত আদায় কর ও যাকাত প্রদান কর’... (নিসা ৪/৭৭)। এই নীতি সর্বদা প্রযোজ্য। যখন কুফরী শক্তি প্রবল হবে এবং ইসলামী শক্তি তার তুলনায় দুর্বল থাকবে।
(খ) অতঃপর দেশ থেকে বা গৃহ থেকে বিতাড়িত হওয়ার মত চূড়ান্ত যুলুমের অবস্থায় সশস্ত্র যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হয় দ্বীন ও জীবন রক্ষার্থে। বলা হয়, أُذِنَ لِلَّذِينَ يُقَاتَلُونَ بِأَنَّهُمْ ظُلِمُوا وَإِنَّ اللهَ عَلَى نَصْرِهِمْ لَقَدِيرٌ- ‘যুদ্ধের অনুমতি দেওয়া হল তাদেরকে, যারা আক্রান্ত হয়েছে। কারণ তাদের প্রতি অত্যাচার করা হয়েছে। আর আল্লাহ নিশ্চয়ই তাদেরকে (যুদ্ধ ছাড়াই) সাহায্য করতে সক্ষম’ (হাজ্জ ২২/৩৯)।
(গ) এ সময় কেবল যুদ্ধকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়, وَقَاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ الَّذِينَ يُقَاتِلُونَكُمْ وَلاَ تَعْتَدُوا إِنَّ اللهَ لاَ يُحِبُّ الْمُعْتَدِينَ ‘আর তোমরা লড়াই কর আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে, যারা লড়াই করে তোমাদের বিরুদ্ধে এবং এতে বাড়াবাড়ি করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমালংঘনকারীদের ভালবাসেন না’ (বাক্বারাহ ২/১৯০)। অর্থাৎ স্রেফ পরকালীন স্বার্থেই জিহাদ হবে, দুনিয়াবী কোন স্বার্থে নয় এবং যারা যুদ্ধ করে কেবল তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করবে।
(ঘ) যুদ্ধকালে নির্দেশ দেওয়া হয়, اغْزُوا بِاسْمِ اللهِ فِى سَبِيلِ اللهِ قَاتِلُوا مَنْ كَفَرَ بِاللهِ اغْزُوا وَلاَ تَغُلُّوا وَلاَ تَغْدِرُوا وَلاَ تُمَثِّلُوا وَلاَ تَقْتُلُوا الْوِلْدَانَ وَلاَ أَصْحَابَ الصَّوَامِعِ ‘তোমরা আল্লাহর নামে আল্লাহর রাস্তায় যুদ্ধ কর তাদের বিরুদ্ধে যারা আল্লাহর সাথে কুফরী করে। যুদ্ধ কর, কিন্তু গণীমতের মালে খেয়ানত করো না। চুক্তি ভঙ্গ করো না। শত্রুর অঙ্গহানি করো না। শিশুদের ও উপাসনাকারীদের হত্যা করো না’।[মুসলিম হা/১৭৩১; আহমাদ হা/২৭২৮; মিশকাত হা/৩৯২৯]
(ঙ) অতঃপর কুফরী শক্তির সর্বব্যাপী হামলা থেকে দ্বীন ও জীবন রক্ষার্থে মৌলিক নির্দেশনা জারী করা হয়, وَقَاتِلُوهُمْ حَتَّى لاَ تَكُونَ فِتْنَةٌ وَيَكُونَ الدِّينُ لِلَّهِ فَإِنِ انْتَهَوْا فَلاَ عُدْوَانَ إِلاَّ عَلَى الظَّالِمِينَ ‘আর তোমরা তাদের সাথে লড়াই কর যে পর্যন্ত না ফেৎনার (কুফরীর) অবসান হয় এবং আনুগত্য স্রেফ আল্লাহর জন্য হয়। অতঃপর যদি তারা নিবৃত্ত হয়, তবে যালেমদের ব্যতীত অন্যদের প্রতি কোন প্রতিশোধ নেই’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩; আনফাল ৮/৩৯)।
(চ) সর্বক্ষেত্রে ও সর্বাবস্থায় ‘তাওহীদের ঝান্ডা উঁচু থাকবে ও শিরকের ঝান্ডা অবনমিত হবে’ মর্মে জিহাদের চিরন্তন নীতিমালা ঘোষণা করা হয়। যেমন আল্লাহ বলেন, وَجَعَلَ كَلِمَةَ الَّذِينَ كَفَرُوا السُّفْلَى وَكَلِمَةُ اللهِ هِيَ الْعُلْيَا وَاللهُ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘এবং তিনি কাফেরদের (শিরকের) ঝান্ডা অবনত করে দিলেন ও আল্লাহর (তাওহীদের) ঝান্ডা সমুন্নত রাখলেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মহা পরাক্রমশালী ও প্রজ্ঞাময়’ (তওবা ৯/৪০)।
(ছ) যারা আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে মানুষের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায় এবং আল্লাহর দ্বীনকে ফুৎকারে নিভিয়ে দিতে চায়, সেইসব কাফের অপশক্তির বিরুদ্ধে ইসলামকে বিজয়ী করাই ছিল যুগে যুগে নবী ও রাসূল প্রেরণের উদ্দেশ্য। শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-কে প্রেরণের উদ্দেশ্যও ছিল তাই। যেমন আল্লাহ বলেন, يُرِيدُونَ لِيُطْفِئُوا نُورَ اللهِ بِأَفْوَاهِهِمْ وَاللهُ مُتِمُّ نُورِهِ وَلَوْ كَرِهَ الْكَافِرُونَ- هُوَ الَّذِي أَرْسَلَ رَسُولَهُ بِالْهُدَى وَدِينِ الْحَقِّ لِيُظْهِرَهُ عَلَى الدِّينِ كُلِّهِ وَلَوْ كَرِهَ الْمُشْرِكُونَ‘তারা চায় তাদের মুখের ফুৎকারে আল্লাহর জ্যোতিকে নিভিয়ে দিতে। অথচ আল্লাহ স্বীয় জ্যোতিকে (ইসলামকে) পূর্ণতা দান করবেন। যদিও অবিশ্বাসীরা তা পসন্দ করে না’। ‘তিনিই তাঁর রাসূলকে প্রেরণ করেছেন হেদায়াত ও সত্য দ্বীন সহকারে। যাতে তিনি উক্ত দ্বীনকে সকল দ্বীনের উপরে বিজয়ী করতে পারেন। যদিও মুশরিকরা তা পসন্দ করে না’ (ছফ ৬১/৮-৯; তওবাহ ৯/৩২)।
(জ) কোন মুসলিম যদি কুফরী শক্তির দোসর হিসাবে কাজ করে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ‘কঠোর’ হবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا النَّبِيُّ جَاهِدِ الْكُفَّارَ وَالْمُنَافِقِينَ وَاغْلُظْ عَلَيْهِمْ وَمَأْوَاهُمْ جَهَنَّمُ وَبِئْسَ الْمَصِيرُ ‘হে নবী! তুমি জিহাদ কর কাফির ও মুনাফিকদের বিরুদ্ধে এবং তাদের উপরে কঠোর হও। ওদের ঠিকানা হল জাহান্নাম। আর কতইনা মন্দ ঠিকানা সেটি’ (তওবা ৯/৭৩; তাহরীম ৬৬/৯)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, কাফিরদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে অস্ত্রের দ্বারা এবং মুনাফিকদের বিরুদ্ধে জিহাদ হবে যবান দ্বারা এবং অন্যান্য পন্থায় কঠোরতা অবলম্বনের দ্বারা’।[ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা তওবা ৭৩ আয়াত] মুনাফিক সর্দার আব্দুল্লাহ ইবনে উবাইকে সকল নষ্টের মূল জেনেও রাসূল (সাঃ) তাকে হত্যার নির্দেশ দেননি তার বাহ্যিক ইসলামের কারণে।
(ঝ) মুসলমানদের পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ।[মুসলিম হা/২৫৬৪; বুখারী হা/৪৮; মিশকাত হা/৪৮১৪] কোন কারণে যুদ্ধ লাগলে অন্যদের দায়িত্ব হবে উভয় পক্ষকে থামানো এবং তাদের মধ্যে মীমাংসা করে দেওয়া’ (হুজুরাত ৪৯/৯)। নইলে বিরত থাকা। এ বিষয়ে আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) বলেন,يَمْنَعُنِى أَنَّ اللهَ حَرَّمَ دَمَ أَخِى ‘আমাকে যুদ্ধ থেকে বিরত রেখেছে এ বিষয়টি যে, আল্লাহ আমার উপর আমার ভাইয়ের রক্ত হারাম করেছেন’। লোকেরা বলল, আল্লাহ কি বলেননি, وَقَاتِلُوْهُمْ حَتَّى لاَ تَكُوْنَ فِتْنَةٌ وَيَكُوْنَ الدِّيْنُ ِللهِ ‘তোমরা তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, যতক্ষণ না ফিৎনা অবশিষ্ট থাকে এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়’ (বাক্বারাহ ২/১৯৩)। জবাবে তিনি বলেন,قَاتَلْنَا حَتَّى لَمْ تَكُنْ فِتْنَةٌ، وَكَانَ الدِّينُ ِللهِ، وَأَنْتُمْ تُرِيدُونَ أَنْ تُقَاتِلُوا حَتَّى تَكُونَ فِتْنَةٌ، وَيَكُونَ الدِّينُ لِغَيْرِ اللهِ ‘আমরা যুদ্ধ করেছি যাতে ফিৎনা (শিরক ও কুফর) না থাকে এবং দ্বীন সম্পূর্ণরূপে আল্লাহর জন্য হয়ে যায়। আর তোমরা যুদ্ধ করছ যাতে ফিৎনা (বিপর্যয়) সৃষ্টি হয় এবং দ্বীন আল্লাহ ব্যতীত অন্যের (শত্রুর) জন্য হয়ে যায়’ (বুখারী হা/৪৫১৩)। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, هَلْ تَدْرِى مَا الْفِتْنَةُ؟ كَانَ مُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم يُقَاتِلُ الْمُشْرِكِينَ، وَكَانَ الدُّخُولُ عَلَيْهِمْ فِتْنَةً، وَلَيْسَ كَقِتَالِكُمْ عَلَى الْمُلْكِ ‘তুমি কি জানো ফিৎনা কি? মুহাম্মাদ (সাঃ) যুদ্ধ করতেন মুশরিকদের বিরুদ্ধে। আর তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধটাই ছিল ফিৎনা। তোমাদের মত শাসন ক্ষমতা লাভের জন্য যুদ্ধ নয়’ (বুখারী হা/৪৬৫১, ৭০৯৫)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, سَتَكُونُ فِتَنٌ، الْقَاعِدُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ الْقَائِمِ، وَالْقَائِمُ فِيهَا خَيْرٌ مِنَ الْمَاشِى ... وَمَنْ وَجَدَ مَلْجَأً أَوْ مَعَاذًا فَلْيَعُذْ بِهِ ‘সত্বর তোমাদের মধ্যে ফিৎনাসমূহ সৃষ্টি হবে। তখন তোমাদের মধ্যেকার বসা ব্যক্তি দাঁড়ানো ব্যক্তির চাইতে উত্তম হবে এবং বসা ব্যক্তি হাঁটা ব্যক্তির চাইতে উত্তম হবে। আর হাঁটা ব্যক্তি দৌড়ানো ব্যক্তির চাইতে উত্তম হবে। যদি কেউ আশ্রয়স্থল বা বাঁচার কোন স্থান পায়, তবে সে যেন সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়’।[বুখারী হা/৩৬০১; মুসলিম হা/২৮৮৬ (১০); মিশকাত হা/৫৩৮৪] ফিৎনার সময় করণীয় প্রসঙ্গে হযরত সা‘দ ইবনু আবী ওয়াকক্বাছ (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-কে জিজ্ঞেস করেন, হে আল্লাহর রাসূল! যখন আমাকে হত্যার জন্য আমার ঘরে ঢুকে কেউ আমার দিকে হাত বাড়াবে, তখন আমি কি করব? জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, كُنْ كَابْنِ آدَمَ ‘তুমি আদমের পুত্রের মত হও’ (অর্থাৎ হাবীলের মত মৃত্যুকে বরণ কর)। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মায়েদাহ ২৮ আয়াতটি পাঠ করে শুনালেন’। যেখানে হত্যাকারী ক্বাবীলের বিরুদ্ধে হাবীলের উক্তি উদ্ধৃত করে আল্লাহ বলেন, لَئِنْ بَسَطْتَ إِلَيَّ يَدَكَ لِتَقْتُلَنِي مَا أَنَا بِبَاسِطٍ يَدِيَ إِلَيْكَ لِأَقْتُلَكَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ ‘যদি তুমি আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে তোমার হাত বাড়াও, তবুও আমি তোমাকে হত্যার জন্য আমার হাত বাড়াবো না। আমি বিশ্বপ্রভু আল্লাহকে ভয় করি’ (মায়েদাহ ৫/২৮)।[আহমাদ হা/১৬০৯; আবুদাঊদ হা/৪২৫৭] আবু মূসা আশ‘আরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, যখন তোমাদের কারু গৃহে ফেৎনা প্রবেশ করবে, তখন সে যেন আদমের দুই পুত্রের উত্তমটির মত হয়(فَلْيَكُنْ كَخَيْرِ ابْنَىْ آدَمَ)।[আবুদাঊদ হা/৪২৫৯; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৬১ সনদ সহীহ]
বিশ্বজয়ী লক্ষ্য :
━━━━━━━━━
বিশ্বব্যাপী কুফরী শক্তিকে অবনত করে তাওহীদকে সমুন্নত করা ও মানুষকে শয়তানী শাসন ও যুলুমের শৃংখলমুক্ত করে আল্লাহর বিধানের অনুগত করাই হল জিহাদের বিশ্বজয়ী লক্ষ্য। যদিও এটি কষ্টকর। কিন্তু এটি আল্লাহ মুসলমানের উপর ফরয করেছেন মানবতার মুক্তির জন্য এবং বিশ্বে শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য। আল্লাহ বলেন,قَاتِلُوا الَّذِينَ لاَ يُؤْمِنُونَ بِاللهِ وَلاَ بِالْيَوْمِ الْآخِرِ وَلاَ يُحَرِّمُونَ مَا حَرَّمَ اللهُ وَرَسُولُهُ وَلاَ يَدِينُونَ دِينَ الْحَقِّ مِنَ الَّذِينَ أُوتُوا الْكِتَابَ حَتَّى يُعْطُوا الْجِزْيَةَ عَنْ يَدٍ وَهُمْ صَاغِرُونَ ‘তোমরা যুদ্ধ কর আহলে কিতাবদের মধ্যকার ঐসব লোকের বিরুদ্ধে, যারা আল্লাহ ও বিচার দিবসের উপর ঈমান রাখে না এবং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা হারাম করেছেন তা হারাম করেনা ও সত্য দ্বীন (ইসলাম) কবুল করেনা, যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা বিনীত হয়ে করজোড়ে জিযিয়া প্রদান করে’ (বাক্বারাহ ২/২৪৬; তওবাহ ৯/২৯)।
অবশ্যই এ জিহাদ কেবল অস্ত্রশক্তি দিয়ে নয়। বরং তা হবে মূলতঃ দ্বীনের শক্তি দিয়ে। অর্থাৎ কুরআন-সুন্নাহ ও যুক্তিপূর্ণ দলীল দ্বারা আক্বীদা পরিবর্তনের মাধ্যমে। যাকে ‘চিন্তার যুদ্ধ’ (الْغَزْوُ الْفِكْرِىُّ) বলা হয়। আর এটাই হল দ্রুত ও স্থায়ীভাবে কার্যকর। আর এর মাধ্যমেই আসে সর্বাত্মক সমাজ বিপ্লব। ইসলামী জিহাদের এটাই হল চূড়ান্ত লক্ষ্য।
জিহাদ প্রত্যেক মুসলমানের উপর ফরয। জিহাদকে ইসলামের চূড়া (ذِرْوَةُ سَنَامِهِ الْجِهَادُ) বলা হয়েছে’।[তিরমিযী হা/২৬১৬; ইবনু মাজাহ হা/৩৯৭৩; মিশকাত হা/২৯] আর চূড়া না থাকলে ঘর থাকেনা। যে ব্যক্তি কুফরী আদর্শের সঙ্গে আপোষ করে এবং তাওহীদ প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদের আকাংখাও হৃদয়ে পোষণ করে না, সে ব্যক্তি মুনাফেকী হালতে মৃত্যুবরণ করে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, مَنْ مَاتَ وَلَمْ يَغْزُ وَلَمْ يُحَدِّثْ بِهِ نَفْسَهُ مَاتَ عَلَى شُعْبَةٍ مِنْ نِفَاقٍ ‘যে ব্যক্তি মারা গেল, অথচ জিহাদ করল না। এমনকি জিহাদের কথা মনেও আনলো না, সে ব্যক্তি মুনাফেকীর একটি শাখার উপর মৃত্যুবরণ করল’।[মুসলিম হা/১৯১০; মিশকাত হা/৩৮১৩] সেকারণ জিহাদের গুরুত্ব সর্বাধিক। এতে যুদ্ধের ময়দানে এমনকি বিছানায় মরলেও সে শহীদ হবে’।[মুসলিম হা/১৯১৫; মিশকাত হা/৩৮১১] জিহাদ ব্যতীত মুসলমান তার জান-মাল ও ইয্যত নিয়ে দুনিয়ায় সম্মানের সাথে বেঁচে থাকতে পারে না এবং আখেরাতেও মুক্তি পেতে পারে না।
বস্ত্ততঃ জিহাদ হয়ে থাকে সন্ত্রাস দমনের জন্য এবং সমাজে আল্লাহর বিধান কায়েমের মাধ্যমে শান্তি ও শৃংখলা প্রতিষ্ঠার জন্য। আল্লাহ বলেন, تِلْكَ الدَّارُ الْآخِرَةُ نَجْعَلُهَا لِلَّذِينَ لاَ يُرِيدُونَ عُلُوًّا فِي الْأَرْضِ وَلَا فَسَادًا وَالْعَاقِبَةُ لِلْمُتَّقِينَ ‘আখিরাতের ঐ গৃহ আমি প্রস্তুত করেছি তাদের জন্য, যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য ও বিশৃংখলা কামনা করেনা। আর শুভ পরিণাম হল আল্লাহভীরুদের জন্য’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)। বাস্তবিক পক্ষে জিহাদের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মুসলমানদের শ্রেষ্ঠ উম্মত হওয়ার চাবিকাঠি। যেখানে আল্লাহ বলেছেন, كُنْتُمْ خَيْرَ أُمَّةٍ أُخْرِجَتْ لِلنَّاسِ تَأْمُرُونَ بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَوْنَ عَنِ الْمُنْكَرِ وَتُؤْمِنُونَ بِاللهِ ‘তোমরাই হলে শ্রেষ্ঠ জাতি। যাদের উদ্ভব ঘটানো হয়েছে মানবজাতির কল্যাণের জন্য। তোমরা সৎকাজের আদেশ দিবে ও অন্যায় কাজে নিষেধ করবে এবং আল্লাহর উপর বিশ্বাস রাখবে’ (আলে-ইমরান ৩/১১০)।
বস্ত্ততঃ আমর বিল মা‘রূফ ও নাহি ‘আনিল মুনকার-এর দায়িত্ব পালনের মাধ্যমেই মুসলমান বিশ্বজয়ী শক্তিতে পরিণত হবে। যা তরবারীর জোরে নয় বরং প্রতিষ্ঠিত হবে তার অন্তর্নিহিত তাওহীদী চেতনার অজেয় শক্তির জোরে। একদিন যা পৃথিবীর সকল প্রান্তে মাটির ঘরে ও গরীবের পর্ণকুটিরেও প্রবেশ করবে। সম্মানিত ব্যক্তির ঘরে (ইসলাম কবুলের মাধ্যমে) সম্মানের সাথে অথবা অসম্মানিত ব্যক্তির ঘরে (জিযিয়া প্রদানের মাধ্যমে) অসম্মানের সাথে’।[আহমাদ হা/১৬৯৯৮; সহীহাহ হা/৩; মিশকাত হা/৪২] (বিস্তারিত পাঠ করুন ‘জিহাদ ও ক্বিতাল’ বই)।
অনুমতি দানের কারণ সমূহ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
মদীনায় হিজরতের পর সশস্ত্র জিহাদের অনুমতি দানের কারণ ছিল তিনটি।-
(১) মুসলমানেরা ছিল মযলূম এবং হামলাকারীরা ছিল যালেম।
(২) মুহাজিরগণ ছিলেন নিজেদের জন্মস্থান ও আবাসভূমি থেকে বিতাড়িত এবং তাদের মাল-সম্পদ ছিল লুণ্ঠিত। তারা ছিলেন অপমানিত ও লাঞ্ছিত, স্রেফ তাওহীদী আক্বীদার কারণে। দুনিয়াবী কোন স্বার্থের কারণে নয় (হজ্জ ২২/৪০)।
(৩) মদীনা ও আশপাশের গোত্রসমূহের সাথে রাসূল (সাঃ)-এর সন্ধি চুক্তি ছিল। যাতে পরস্পরের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছিল। এক্ষণে মুসলমান হওয়ার কারণে অথবা মুসলমানদের সহযোগী হওয়ার কারণে যদি তাদের উপরে হামলা করা হয়, তাহলে সন্ধিচুক্তি রক্ষার স্বার্থে তাদের জান-মালের হেফাযতের জন্য রাসূল (সাঃ)-কে যালেমদের হামলা প্রতিরোধে এগিয়ে যাওয়াটা নৈতিক বাধ্যবাধকতা ছিল।
জিহাদের অনুমতি লাভের পর ১ম হিজরীর রামাযান মাস থেকে কুরায়েশদের হামলা প্রতিরোধে মদীনার বাইরে নিয়মিত সশস্ত্র টহল অভিযান সমূহ প্রেরিত হতে থাকে। অতঃপর ২য় হিজরীর রজব মাসে নাখলা যুদ্ধের পর বদর যুদ্ধের প্রাক্কালে নিয়মিতভাবে জিহাদ ফরয করা হয় এবং উক্ত মর্মে সূরা বাক্বারাহ ১৯০-১৯৩ এবং সূরা মুহাম্মাদ ৪-৭ ও ২০ আয়াত সমূহ নাযিল হয়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন