রবিবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলার অবস্থা

 

কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলার অবস্থা

কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলার নেতা আবু সুফিয়ান অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পথ চলছিলেন। যাকেই পেতেন, তাকেই মদীনা বাহিনী সম্পর্কে জিজ্ঞেস করতেন। তিনি একটি সূত্রে জানতে পারলেন যে, কাফেলার উপরে হামলা করার জন্য মুহাম্মাদ নির্দেশ দিয়েছেন। এ সংবাদে ভীত হয়ে তিনি যামযাম বিন আমর আল-গিফারী(ضَمْضم بن عمرو) কে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন, যাতে দ্রুত সাহায্যকারী বাহিনী পৌঁছে যায়। এরপর বদর প্রান্তর অতিক্রম করার আগেই তিনি কাফেলা থামিয়ে দিয়ে নিজে অগ্রসর হন এবং মাজদী বিন আমর(مَجْدِى بن عمرو) এর কাছে মদীনা বাহিনীর খবর নেন। তার কাছে জানতে পারেন যে, দুজন উষ্ট্রারোহীকে তারা দেখেছিল, যারা টিলার পাশে তাদের উট বসিয়ে মশকে পানি ভরে নিয়ে চলে গেছে। সুচতুর আবু সুফিয়ান সঙ্গে সঙ্গে টিলার পাশে গিয়ে উটের গোবর থেকে খেজুরের অাঁটি খুঁজে বের করে বুঝে নেন যে, এটি মদীনার উটের গোবর। ব্যস! তখনই ফিরে এসে কাফেলাকে নিয়ে বদরকে বামে রেখে মূল রাস্তা ছেড়ে ডাইনে পশ্চিম দিকে উপকূলের পথ ধরে দ্রুত চলে গেলেন। এভাবে তিনি স্বীয় কাফেলাকে মদীনা বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে নিতে সক্ষম হলেন। অতঃপর তিনি নিরাপদে পার হয়ে আসার খবর মক্কায় পাঠিয়ে দিলেন। যাতে ইতিপূর্বে পাঠানো খবরের কারণে তারা অহেতুক যুদ্ধে বের না হয়।[1]


মাক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রা :
━━━━━━━━━━━━━━━
আবু সুফিয়ানের প্রথম পত্র পেয়ে বাণিজ্য কাফেলা উদ্ধারের জন্য ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য আবু জাহলের নেতৃত্বে ১৩০০ মাক্কী ফৌজ রওয়ানা হয়ে যায়। অতঃপর রাবেগ-এর পূর্ব দিকে জুহফা নামক স্থানে পৌঁছলে পত্রবাহকের মাধ্যমে আবু সুফিয়ানের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের খবর পেয়ে বাহিনীর সবাই মক্কায় ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু আবু জাহলের দম্ভের সামনে কারু মতামত গ্রাহ্য হল না। তবু তার আদেশ অমান্য করে আখনাস বিন শারীক্ব আছ-ছাক্বাফী(الْأَخْنَسُ بْنُ شَرِيق الثَّقَفِيُّ)-এর নেতৃত্বে বনু যোহরা(بَنُو زُهْرَة) গোত্রের ৩০০ লোক মক্কায় ফিরে গেল। আখনাস ছিলেন ত্বায়েফের ছাক্বীফ গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু তিনি ছিলেন বনু যোহরা গোত্রের মিত্র ও নেতা। তাঁর এই দূরদর্শিতার কারণে তিনি উক্ত গোত্রে আজীবন সম্মানিত নেতা হিসাবে বরিত ছিলেন। বনু হাশেমও ফিরে যেতে চাইল। কিন্তু মুহাম্মাদ-এর স্বগোত্র হওয়ায় তাদের উপরে আবু জাহলের কঠোরতা ছিল অন্যদের চেয়ে বেশী। ফলে তারা ক্ষান্ত হন।
উল্লেখ্য যে, আলী (রাঃ)-এর বড় ভাই ত্বালিব বিন আবু ত্বালিব বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলেও জনৈক কুরায়েশ নেতার সাথে বাদানুবাদের প্রেক্ষিতে প্রত্যাবর্তনকারীদের সাথে মক্কায় ফিরে যান (ইবনু হিশাম ১/৬১৯)।
অতঃপর আবু জাহল বদর অভিমুখে রওয়ানা হন এবং দর্পভরে বলেন, আল্লাহর কসম! আমরা বদরে যাব ও সেখানে তিনদিন থাকব ও আমোদ-ফূর্তি করে পান ভোজন করব। এর ফলে সমগ্র আরব জাতির উপরে আমাদের শক্তি প্রকাশিত হবে ও সকলে ভীত হবে। এই সময় সব মিলিয়ে মাক্কী বাহিনীতে এক হাযার ফৌজ ছিল। তন্মধ্যে দু’শো অশ্বারোহী, ছয়শো লৌহবর্ম ধারী এবং গায়িকা বাঁদী দল তাদের বাদ্যযন্ত্রাদি সহ ছিল। প্রতি মনযিলে খাদ্যের জন্য তারা ৯টি বা ১০টি করে উট যবেহ করত।
উল্লেখ্য যে, আবু সুফিয়ানের বাণিজ্য কাফেলায় সকল গোত্রের লোকদের মালামাল ছিল। তাছাড়া মাক্কী বাহিনীতে বনু ‘আদী ব্যতীত কুরায়েশদের সকল গোত্রের লোক বা তাদের প্রতিনিধি যোগদান করেছিল। অথবা যোগদানে বাধ্য করা হয়েছিল। যেমন রাসূল (সাঃ)-এর চাচা আববাস, হযরত আলীর দু’ভাই ত্বালেব ও ‘আক্বীল। রাসূল (সাঃ)-এর জামাতা আবুল ‘আছ সহ বনু হাশেমের লোকেরা। তারা আসতে অনিচ্ছুক ছিলেন। নেতাদের মধ্যে কেবল আবু লাহাব যাননি। তিনি তার বদলে তার কাছে ঋণগ্রস্ত একজন ব্যক্তিকে পাঠিয়েছিলেন।[ইবনু হিশাম ১/৬১৮-১৯; আল-বিদায়াহ ৩/২৬০]


রওয়ানাকালে আবু জাহল :
━━━━━━━━━━━━━━━━
আবু জাহল মক্কা থেকে রওয়ানার সময় দলবল নিয়ে কা‘বাগৃহের গেলাফ ধরে কেঁদে কেঁদে প্রার্থনা করেছিল, اللَّهُمَّ انْصُرْ أَقْرَانَا لِلضَّيْفِ وَأَوْصَلَنَا لِلرَّحِمِ وَأَفَكَّنَا لِلْعَانِيْ، إِنْ كَانَ مُحَمَّدٌ عَلَى حَقٍّ فَانْصُرْهُ وَاِنْ كُنَّا عَلَى حَقٍّ فَانْصُرْنَا، وَرُوِي اَنَّهُمْ قَالُوْا : اللهُمَّ انْصُرْ أَعْلَى الْجُنْدَيْنِ وَأَهْدَى الْفِئَتَيْنِ وَاَكْرَمَ الْحِزْبَيْنِ ‘হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর আমাদের মধ্যেকার সর্বাধিক অতিথি আপ্যায়নকারী, সর্বাধিক আত্মীয়তা রক্ষাকারী ও বন্দী মুক্তি দানকারী দলকে’। ‘হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ যদি সত্যের উপরে থাকে, তবে তুমি তাকে সাহায্য কর। আর যদি আমরা সত্যের উপর থাকি, তবে আমাদেরকে সাহায্য কর’। ‘হে আল্লাহ! তুমি সাহায্য কর আমাদের দু’দলের মধ্যকার সেরা সেনাদলকে, সেরা হেদায়াতপ্রাপ্ত ও সেরা সম্মানিত দলকে’।[ইবনু হিশাম ১/৬৬৮; যাদুল মা‘আদ ৩/১৬০; আল-বিদায়াহ ৩/২৮২]
এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, আবু জাহল আল্লাহকে সর্বশক্তিমান হিসাবে বিশ্বাস করত। যাকে ‘তওহীদে রুবূবিয়াত’ বলা হয়। এর ফলে কেউ মুসলমান হতে পারে না। কেননা মুসলিম হওয়ার জন্য ‘তওহীদে ইবাদত’-এর উপর ঈমান আনা যরূরী। যার মাধ্যমে মানুষ সার্বিক জীবনে আল্লাহর দাসত্ব করতে স্বীকৃত হয়। সেই সাথে শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর উপর ঈমান ও তাঁর আনীত শরী‘আতের বিধানসমূহ পালন করা অপরিহার্য।
অতঃপর রওয়ানা হওয়ার সময় তাদের মনে পড়ল বনু বকর গোত্রের কথা। যাদের সঙ্গে তাদের শত্রুতা ছিল। পথিমধ্যে তারা হামলা করতে পারে। ফলে মাক্কী বাহিনী দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে গেল। কিন্তু শয়তানী প্ররোচনায় গর্বোদ্ধত হয়ে তারা বেরিয়ে পড়ল। উক্ত প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, وَلاَ تَكُونُوا كَالَّذِينَ خَرَجُوا مِنْ دِيَارِهِمْ بَطَرًا وَرِئَاءَ النَّاسِ وَيَصُدُّونَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ وَاللهُ بِمَا يَعْمَلُونَ مُحِيطٌ ‘আর তোমরা তাদের মত হয়ো না যারা তাদের ঘর (মক্কা) থেকে বের হয়েছিল দর্পভরে ও লোক দেখিয়ে এবং যারা আল্লাহর পথ থেকে লোকদের বাধা দিত। অথচ আল্লাহ তাদের সকল কাজ পরিবেষ্টন করে আছেন’ (আনফাল ৮/৪৭)। এভাবে শয়তান মানুষের অন্তরে ধোঁকা সৃষ্টি করে। যাতে তার স্বাভাবিক বোধশক্তি লুপ্ত হয় এবং সে পথভ্রষ্ট হয়। যেমন বদরের যুদ্ধে শয়তানের ভূমিকা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, وَإِذْ زَيَّنَ لَهُمُ الشَّيْطَانُ أَعْمَالَهُمْ وَقَالَ لاَ غَالِبَ لَكُمُ الْيَوْمَ مِنَ النَّاسِ وَإِنِّي جَارٌ لَكُمْ فَلَمَّا تَرَاءَتِ الْفِئَتَانِ نَكَصَ عَلَى عَقِبَيْهِ وَقَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكُمْ إِنِّي أَرَى مَا لاَ تَرَوْنَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ وَاللهُ شَدِيدُ الْعِقَابِ ‘আর যখন শয়তান (বদরের দিন) কাফেরদের নিকট তাদের কাজগুলিকে শোভনীয় করে দেখিয়েছিল এবং বলেছিল আজ লোকদের মধ্যে তোমাদের উপর বিজয়ী হবার মত কেউ নেই। আর আমি তোমাদের সাথে আছি। কিন্তু যখন দু’দল মুখোমুখী হল, তখন সে পিছন ফিরে পালালো এবং বলল, আমি তোমাদের থেকে মুক্ত। আমি যা দেখেছি তোমরা তা দেখোনি। আমি আল্লাহকে ভয় করি। আর আল্লাহ কঠিন শাস্তিদাতা’ (আনফাল ৮/৪৮)।
শয়তানের দোসর মুনাফিকদের সম্পর্কেও আল্লাহ অনুরূপ বলেন,إِذْ يَقُولُ الْمُنَافِقُونَ وَالَّذِينَ فِي قُلُوبِهِمْ مَرَضٌ غَرَّ هَؤُلاَءِ دِينُهُمْ وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللهِ فَإِنَّ اللهَ عَزِيزٌ حَكِيمٌ ‘যেদিন মুনাফিকরা এবং যাদের অন্তরে রোগ ছিল, তারা বলেছিল, এদের দ্বীন এদেরকে (মুসলমানদেরকে) প্রতারিত করেছে (অর্থাৎ ধর্মান্ধ করেছে)। অথচ যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর ভরসা করে (আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট)। কেননা আল্লাহ মহা পরাক্রান্ত ও প্রজ্ঞাময়’ (আনফাল ৮/৪৯)। অতঃপর মানুষের বিরুদ্ধে শয়তানের চিরন্তন রীতি সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
كَمَثَلِ الشَّيْطَانِ إِذْ قَالَ لِلْإِنْسَانِ اكْفُرْ فَلَمَّا كَفَرَ قَالَ إِنِّي بَرِيءٌ مِنْكَ إِنِّي أَخَافُ اللهَ رَبَّ الْعَالَمِينَ- فَكَانَ عَاقِبَتَهُمَا أَنَّهُمَا فِي النَّارِ خَالِدَيْنِ فِيهَا وَذَلِكَ جَزَاءُ الظَّالِمِينَ
‘(মুনাফিকরা) শয়তানের মত। যে মানুষকে কাফের হতে বলে। অতঃপর যখন সে কাফের হয়, তখন শয়তান বলে, আমি তোমার থেকে মুক্ত। আমি বিশ্বপালক আল্লাহকে ভয় করি’। ‘অতঃপর উভয়ের পরিণতি হয় এই যে, তারা জাহান্নামে যাবে এবং সেখানে চিরকাল বসবাস করবে। আর এটাই হল যালেমদের শাস্তি’ (হাশর ৫৯/১৬-১৭)।[2] বস্ত্ততঃ আবু জাহল শয়তানের ধোঁকায় পড়েই রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে যুদ্ধে রওয়ানা হয়েছিল। অতঃপর কুরায়েশ বাহিনী যথারীতি দ্রুতবেগে এসে বদর উপত্যকার শেষপ্রান্তে টিলার অপর পার্শ্বে শিবির সন্নিবেশ করে।




[1]. আর-রাহীক্ব ২০৭ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬১৮। এখানে রাসূল (সাঃ)-এর ফুফু আতেকাহ বিনতে আব্দুল মুত্ত্বালিব ও জুহাইম বিন সালতের দু’টি স্বপ্ন সম্পর্কে বিভিন্ন ইতিহাস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে বদর যুদ্ধে কুরায়েশ বাহিনীর সাক্ষাৎ পরাজয় ও তাদের নেতাদের নিহত হওয়া সম্পর্কে বলা হয়েছে। আবু জাহল এগুলিকে বনু মুত্ত্বালিবের মিথ্যা রটনা বলে উড়িয়ে দেন। ঘটনা দু’টি বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয় (মা শা-‘আ ১০৪ পৃঃ)।
[2]. প্রসিদ্ধ আছে যে, ইবলীস এ সময় বনু কিনানাহ গোত্রের নেতা সুরাক্বাহ বিন মালেক বিন জু‘শুম আল-মুদলিজীর রূপ ধারণ করে এসে বলল, ‘আমি তোমাদের বন্ধু’ (أَنَا لَكُمْ جَارٌ)। আমি তোমাদের নিরাপত্তার দায়িত্ব নিচ্ছি। এই আশ্বাস পাওয়ার পর কুরায়েশগণ মদীনা অভিমুখে খুব দ্রুতবেগে বদর প্রান্তরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায় (আর-রাহীক্ব ২০৬ পৃঃ; ইবনু হিশাম ১/৬১২)। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১০৮ পৃঃ)।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...