সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

মাদানী বাহিনীর বদরে উপস্থিতি

 

মাদানী বাহিনীর বদরে উপস্থিতি

রাওহাতে অনুষ্ঠিত পরামর্শ সভায় সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ‘বদর’ অভিমুখে রওয়ানা হন। অতঃপর ‘ছাফরা’ টিলা সমূহ অতিক্রম করে বদর প্রান্তরের নিকটবর্তী স্থানে অবতরণ করেন। সেখান থেকে তিনি বাসবাস বিন আমর আল-জুহানী এবং ‘আদী বিন আবুয যাগবা আল-জুহানীকে বদরের খবরাখবর নেবার জন্য পাঠান’ (মুসলিম হা/১৯০১)।
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আলী, যুবায়ের ও সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছের নেতৃত্বে একটি গোয়েন্দা দল পাঠান শত্রুপক্ষের আরও তথ্যাদি সংগ্রহের জন্য। তারা গিয়ে দেখেন যে, দু’জন লোক বদরের ঝর্ণাধারা থেকে পানির মশক ভরছে। তাঁরা তাদের পাকড়াও করে নিয়ে এলেন। অতঃপর জিজ্ঞাসাবাদে ও সামান্য পিটুনী দেওয়ার পরে জানতে পারলেন যে, এরা আবু সুফিয়ানের লোক নয়। বরং তারা কুরায়েশ বাহিনীর লোক। কুরায়েশ বাহিনী উপত্যকার শেষপ্রান্তে টিলার অপর পার্শ্বে শিবির গেড়েছে। তাদের জন্য সে উটের পিঠে করে পানি বহন করে নিয়ে যাচ্ছে’।[ইবনু হিশাম ১/৬১৬; যাদুল মা‘আদ ৩/১৫৬] তারপর ওদের নেতৃবর্গের নাম জিজ্ঞেস করলে তিনি আবু জাহল, উৎবা, শায়বা, উমাইয়া বিন খালাফ প্রমুখ মক্কার সেরা ব্যক্তিবর্গের নামগুলি জানতে পারেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘এইটি অমুকের নিহত হওয়ার স্থান’। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, ‘তাদের নিহতদের কেউই উক্ত ইশারার স্থান থেকে দূরে যেতে পারেনি’।[মুসলিম হা/১৭৭৯; আবুদাঊদ হা/২৬৮১] তবে তারা সঠিক সংখ্যা বলতে পারল না। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, দৈনিক কয়টা উট যবহ করা হয়? তারা বলল, নয়টা অথবা দশটা। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তাহলে ওদের সংখ্যা নয়শত অথবা হাযার-এর মধ্যে হবে। কেননা একটি উট ১০০ জনের বা তার কাছাকাছিদের জন্য।[আহমাদ হা/৯৪৮, সনদ সহীহ; ইবনু হিশাম ১/৬১৬-১৭]
এরপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নির্দেশে মুসলিম বাহিনী দ্রুত গিয়ে এশার সময় বদরের উপরে দখল নিল, যা ছিল ঝর্ণাধারার পাশেই। অতঃপর আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-এর প্রস্তাবক্রমে যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তর-পূর্ব পার্শ্বে একটি উঁচু টিলার উপরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য তাঁবুর (عَرِيْشٌ) ব্যবস্থা করা হল। সেখানে তাঁর সাথে কেবল আবুবকর (রাঃ) রইলেন এবং পাহারায় রইলেন সা‘দ বিন মু‘আয-এর নেতৃত্বে একদল আনছার যুবক। সা‘দ সেখানে বিশেষ সওয়ারীও প্রস্তুত রাখলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বললেন, যদি আমরা যুদ্ধে পরাজিত হই, তাহলে আপনি এই সওয়ারীতে করে দ্রুত মদীনায় চলে যাবেন। কেননা فَقَدْ تَخَلَّفَ عَنْكَ أَقْوَامٌ، يَا نَبِيَّ اللهِ، مَا نَحْنُ بِأَشَدَّ لَكَ حُبًّا مِنْهُمْ ... يَمْنَعُكَ اللهُ بِهِمْ، يُنَاصِحُونَكَ وَيُجَاهِدُونَ مَعَكَ ‘সেখানে রয়েছে হে আল্লাহর নবী! আপনার জন্য আমাদের চাইতে অধিক জীবন উৎসর্গকারী একদল ভাই। আপনাকে ভালোবাসায় আমরা তাদের চাইতে অধিকতর অগ্রগামী নই। যারা যুদ্ধে কখনোই আপনার থেকে পিছনে থাকবে না। আল্লাহ তাদের মাধ্যমে আপনাকে হেফাযত করবেন। তারা আপনার শুভাকাংখী এবং তারা আপনার সঙ্গে থেকে জিহাদ করবে’। সা‘দের এ বীরত্বব্যঞ্জক কথায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত প্রীত হলেন ও তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন(دَعَا لَهُ بِخَيْرٍ)।[ইবনু হিশাম ১/৬২০-২১; আর-রাহীক্ব ২১১-১২ পৃঃ]
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যুদ্ধ কৌশল অনুযায়ী সেনাদলকে বিন্যস্ত করেন এবং সুষ্ঠুভাবে শিবির সন্নিবেশ করেন।


বর্ষাস্নাত রাত্রি ও গভীর নিদ্রা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
বদর যুদ্ধের পূর্বরাত। সৈন্যদের শ্রেণীবিন্যাস শেষ হয়েছে। সবাই ক্লান্ত-শ্রান্ত। হঠাৎ সামান্য বৃষ্টি এলো। মুসলিম বাহিনী কেউ গাছের নীচে কেউ ঢালের নীচে ঘুমে এলিয়ে পড়ল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন বাহিনীর সকল ক্লান্তি দূর হয়ে গেল এবং যুদ্ধের জন্য দেহমন প্রস্তুত হয়ে গেল। বালু-কংকর সব জমে দৃঢ় হয়ে গেল। ফলে চলাফেরায় স্বাচ্ছন্দ্য এল। সেই সাথে অধিকহারে বৃষ্টির পানি সঞ্চয়ের ব্যবস্থা হয়ে গেল।
এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন, إِذْ يُغَشِّيْكُمُ النُّعَاسَ أَمَنَةً مِّنْهُ وَيُنَزِّلُ عَلَيْكُم مِّنَ السَّمَاءِ مَاءً لِّيُطَهِّرَكُمْ بِهِ وَيُذْهِبَ عَنْكُمْ رِجْزَ الشَّيْطَانِ وَلِيَرْبِطَ عَلَى قُلُوبِكُمْ وَيُثَبِّتَ بِهِ الأَقْدَامَ ‘স্মরণ কর সে সময়ের কথা, যখন তিনি তাঁর পক্ষ থেকে প্রশান্তির জন্য তোমাদেরকে তন্দ্রায় আচ্ছন্ন করেন এবং তোমাদের উপরে আকাশ থেকে বৃষ্টি বর্ষণ করেন। এর মাধ্যমে তোমাদেরকে পবিত্র করার জন্য, তোমাদের থেকে শয়তানের কুমন্ত্রণা দূরীভূত করার জন্য, তোমাদের হৃদয়গুলি পরস্পরে আবদ্ধ করার জন্য এবং তোমাদের পাগুলিকে দৃঢ় রাখার জন্য’ (আনফাল ৮/১১)।
শয়তানের কুমন্ত্রণা এই যে, সে যেন দুর্বলচিত্ত মুসলমানদের মধ্যে এই প্রশ্ন ঢুকিয়ে দেবার সুযোগ না পায় যে, আমরা যদি ন্যায় ও সত্যের পথে থাকব এবং আমরা যদি আল্লাহর বন্ধু হই, তাহলে আমরা এই নিম্নভূমিতে ধূলি-কাদার মধ্যে কেন থাকব? এটি নিঃসন্দেহে আমাদের পরাজয়ের লক্ষণ। অথচ কুরায়েশরা কাফের হওয়া সত্ত্বেও উচ্চ ভূমিতে আছে। তারা উট যবেহ করে খাচ্ছে আর ফূর্তি করছে। এটা নিশ্চয়ই তাদের জন্য বিজয়ের লক্ষণ। সকালেই যেখানে যুদ্ধের সম্মুখীন হতে হবে, সেখানে রাতেই যদি সংখ্যালঘু মুসলিম বাহিনীর মধ্যে এ ধরনের বিভ্রান্তি ঢুকে যায়, তাহলে সেটা সমূহ ক্ষতির কারণ হবে। সেকারণ আল্লাহ বৃষ্টি বর্ষণের মাধ্যমে তাদেরকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে দিলেন। ফলে ঘুম থেকে উঠে প্রফুল্লচিত্তে সবাই যুদ্ধে জয়ের জন্য একাট্টা হয়ে দ্রুত প্রস্তুত হয়ে গেল।
আলী (রাঃ) বলেন যে, বদর যুদ্ধের রাতে এমন কেউ বাকী ছিল না যে, যিনি ঘুমাননি। কেবল রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ব্যতীত। তিনি সারা রাত জেগে সালাতে রত থাকেন। তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) বারবার স্বীয় প্রভুর নিকট দো‘আ করতে থাকেন, اللَّهُمَّ إِنَّكَ إِنْ تُهْلِكْ هَذِهِ الْعِصَابَةَ لاَ تُعْبَدْ فِى الأَرْضِ أَبَداً ‘হে আল্লাহ! যদি তুমি এই দলকে ধ্বংস করে দাও, তাহলে জনপদে তোমার ইবাদত করার আর কেউ থাকবে না’। অতঃপর সকাল হলে তিনি সবাইকে ডাকেন, الصَّلاَةَ عِبَادَ اللهِ ‘আল্লাহর বান্দারা! সালাত’। অতঃপর সবাই জমা হলে তিনি ফজরের জামা‘আত শেষে সবাইকে যুদ্ধের জন্য উৎসাহিত করেন’।[আহমাদ হা/২০৮, ৯৪৮; সীরাহ সহীহাহ ২/৩৬০ পৃঃ]
আলী (রাঃ) বলেন, لَقَدْ رَأَيْتُنَا يَوْمَ بَدْرٍ وَنَحْنُ نَلُوذُ بِرَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم- وَهُوَ أَقْرَبُنَا إِلَى الْعَدُوِّ وَكَانَ مِنْ أَشَدِّ النَّاسِ يَوْمَئِذٍ بَأْساً ‘বদরের যুদ্ধের দিন আমরা সকলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর নিকটে আশ্রয় নিয়েছিলাম। তিনি আমাদের মধ্যে শত্রুর সর্বাধিক নিকটবর্তী ছিলেন এবং আমাদের সকলের চাইতে সর্বাধিক বড় যোদ্ধা ছিলেন’ (আহমাদ হা/৬৫৪, সনদ সহীহ)।


মাক্কী বাহিনীর দিশাহারা অবস্থা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
প্রত্যুষে কুরায়েশ বাহিনী পাহাড় থেকে নীচে অবতরণ করে হতবাক হয়ে গেল। পানির উৎসের উপরে রাতারাতি মুসলিম বাহিনীর দখল কায়েম হয়ে গেছে। হাকীম বিন হেযাম সহ অতি উৎসাহী কয়েকজন কুরায়েশ সেনা সরাসরি রাসূল (সাঃ)-এর টিলার সম্মুখস্থ পানির হাউযের দিকে অগ্রসর হল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের ছেড়ে দেবার নির্দেশ দিলেন। ফলে যারা সেখান থেকে পানি পান করল, তারা সবাই পরে যুদ্ধে নিহত হল। একমাত্র হাকীম পান করেননি। তিনি বেঁচে যান। পরে তিনি পাক্কা মুসলিম হয়ে যান। এ ঘটনাকে স্মরণ করে হাকীম বিন হেযাম শপথ করার সময় সর্বদা বলতেন لاَ وَالَّذِي نَجَّانِي يَوْمَ بَدْرٍ ‘ঐ সত্তার কসম! যিনি আমাকে বদরের দিন রক্ষা করেছেন’। ঘটনাটি বহু পূর্বেকার তালূত বাহিনীর ঘটনার সাথে তুলনীয়। সেদিন যারা নদীর পানি পান করেছিল, তাদের কেউই তালূতের সাথে জালূতের বিরুদ্ধে জিহাদে শরীক হতে পারেনি’।[ইবনু হিশাম ১/৬২২; আল-বিদায়াহ ৩/২৬৮; সূরা বাক্বারাহ ২/২৪৯ আয়াত]
কুরায়েশ নেতারা অবস্থার ভয়াবহতা বুঝতে পারল এবং নিজেদের বোকামিতে দুঃখে-ক্ষোভে হাত-পা ছুঁড়তে লাগল। তারা মুসলিম বাহিনীর অবস্থা ও সংখ্যা নিরূপণের জন্য ওমায়ের বিন ওয়াহাব আল-জুমাহী নামক একজন অশ্বারোহীকে প্রেরণ করল। সে গিয়ে মুসলিম বাহিনীর চারদিক প্রদক্ষিণ করে এসে বলল, তিন শো বা তার কিছু কমবেশী হবে’। তবে আরেকটু সময় দাও, আমি দেখে আসি, ওদের পিছনে কোন সাহায্যকারী সেনাদল আছে কি-না। সে আবার ছুটলো এবং বহু দূর ঘুরে এসে বলল, ওদের পিছনে কাউকে দেখলাম না। তবে সে বলল,يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ: الْبَلاَيَا تَحْمِلُ الْمَنَايَا ... لَيْسَ مَعَهُمْ مَنَعَةٌ وَلاَ مَلْجَأٌ إلاَّ سُيُوفُهُمْ ‘হে কুরায়েশগণ, বিপদ এসেছে মৃত্যুকে সাথে নিয়ে। ... তাদের সাথে কোন শক্তি নেই বা কোন আশ্রয় নেই কেবল তাদের তরবারি ছাড়া’। অতএব واللهِ مَا أَرَى أَنْ يُقْتَلَ رَجُلٌ مِنْهُمْ حَتّى يَقْتُلَ رَجُلاً مِنْكُمْ ... فَرُوا رَأْيَكُمْ ‘আল্লাহর কসম, তোমাদের একজন নিহত না হওয়া পর্যন্ত তাদের একজন নিহত হবে না’। ... অতএব তোমরা চিন্তা-ভাবনা কর’।[ইবনু হিশাম ১/৬২২; সীরাহ সহীহাহ ২/৩৫৯ পৃঃ] তার এ রিপোর্ট শুনে হাকীম বিন হেযাম বয়োজ্যেষ্ঠ কুরায়েশ নেতা উৎবা বিন রাবী‘আহর কাছে এসে যুদ্ধ না করে ফিরে যাবার ব্যাপারে বুঝাতে লাগলেন। তিনি রাজি হলেন। এমনকি ইতিপূর্বে নাখলা যুদ্ধে মুসলমানদের হাতে রজবের শেষ দিনে হারাম মাসে নিহত আমর ইবনুল হাযরামীর রক্তমূল্য তিনি নিজ থেকে দিতে চাইলেন। উৎবা বললেন, সমস্যা হল ইবনুল হানযালিয়াহকে নিয়ে (আবু জাহলের মায়ের নাম ছিল হানযালিয়াহ)। তুমি তার কাছে যাও।
অতঃপর উৎবা দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, হে কুরায়েশগণ! মুহাম্মাদ ও তার সাথীদের সঙ্গে যুদ্ধ করায় তোমাদের কোন গৌরব নেই। কেননা তাতে তোমরা তোমাদের চাচাতো ভাই বা খালাতো ভাই বা মামাতো ভাইয়ের বা নিজ গোত্রের লোকদের রক্তাক্ত চেহারা দেখবে, যা তোমাদের কাছে মোটেই পসন্দনীয় হবে না।فَارْجِعُوا وَخَلُّوا بَيْنَ مُحَمَّدٍ وَبَيْنَ سَائِرِ الْعَرَبِ ‘অতএব তোমরা ফিরে চল এবং মুহাম্মাদ ও গোটা আরব দুনিয়াকে ছেড়ে দাও। যদি তারা তাকে মেরে ফেলে, তবে সেটা তাই-ই হবে, যা তোমরা চেয়েছিলে। আর যদি তা না হয়, তাহলে সে তোমাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকবে এজন্য যে, তোমরা তার সাথে সেরূপ ব্যবহার করোনি, যেরূপ তোমরা চেয়েছিলে’।
এদিকে হাকীম বিন হেযাম আবু জাহলের কাছে গিয়ে নিজের ও উৎবার মতামত ব্যক্ত করে মক্কায় ফিরে যাবার জন্য তাকে অনুরোধ করলেন। এতে আবু জাহল ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে বলে উঠলেন, انتفخَ واللهِ سَحْرُهُ ‘আল্লাহর কসম! উৎবার উপরে মুহাম্মাদের জাদু কার্যকর হয়েছে’।كَلاَّ واللهِ لاَ نَرْجِعُ حَتَّى يَحْكُمَ اللهُ بَيْنَنَا وَبَيْنَ مُحَمَّدٍ ‘কখনোই না। আল্লাহর কসম! আমরা ফিরে যাব না, যতক্ষণ না আল্লাহ আমাদের ও মুহাম্মাদের মাঝে একটা ফায়ছালা করে দেন’। তিনি বললেন, ‘এতক্ষণে বুঝলাম যে, উৎবার পুত্র আবু হুযায়ফা যে মুসলমান হয়ে হিজরত করে আগে থেকেই মুহাম্মাদের দলে রয়েছে এবং যুদ্ধ বাধলে সে নিহত হবে, সেই ভয়ে উৎবা যুদ্ধ না করেই ফিরে যেতে চাচ্ছে’।
হাকীমের কাছ থেকে আবু জাহলের এইসব কথা শুনে উৎবার বিচারবুদ্ধি লোপ পেল। তার সুপ্ত পৌরুষ জেগে উঠলো। ক্ষুব্ধ চিৎকারে তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের দিকে ছুটে চললেন। ওদিকে আবু জাহল ‘আমের ইবনুল হাযরামীকে গিয়ে বললেন, দেখছ কি! তোমার ভাই আমরের রক্তের প্রতিশোধ আর নেওয়া হল না। ঐ দেখ কাপুরুষ উৎবা পালাচ্ছে। শীঘ্র উঠে আর্তনাদ শুরু কর’। একথা শোনা মাত্র ‘আমের তার সারা দেহে ধুলো-বালি মাখতে মাখতে এবং গায়ের কাপড় ছিঁড়তে ছিঁড়তে নাখলা যুদ্ধে নিহত ভাই ‘আমর ইবনুল হাযরামীর নামে واعَمْراه واعَمْراه (হায় আমর! হায় আমর!) বলে আর্তনাদ করে বেড়াতে লাগল। আর যায় কোথায়। মুহূর্তের মধ্যে মুশরিক শিবিরে যুদ্ধের আগুন জ্বলে উঠল। রণোন্মত্ত কুরায়েশ বাহিনী যুদ্ধের ময়দানে ছুটে চলল।[ইবনু হিশাম ১/৬২৩; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৩/২৬৯] হাকীম বিন হেযামের সকল প্রচেষ্টা ভন্ডুল হয়ে গেল কেবলমাত্র আবু জাহলের হঠকারিতা ও ধূর্তামির কারণে।[তারীখু ত্বাবারী ২/৪৪৩, ৪২৪-২৫; সীরাহ সহীহাহ ২/৩৫৯ পৃঃ]
এ সময় রাসূল (সাঃ) লাল উটের উপরে সওয়ার উৎবা বিন রাবী‘আহর দিকে উদ্দেশ্য করে বললেন, إنْ يُطِيْعُوهُ يَرْشُدُوْا ‘যদি তার দল তার আনুগত্য করত, তাহলে তারা সঠিক পথে থাকতো’ (ইবনু হিশাম ১/৬২১)। অর্থাৎ যদি তারা উৎবাহর কথামত মক্কায় ফিরে যেত, তাহলে তাদের মঙ্গল হত। এর মধ্যে রাসূল (সাঃ)-এর শান্তিবাদী নীতি ফুটে ওঠে।


আবু জাহলের দো‘আ :
━━━━━━━━━━━━━━
মাক্কী বাহিনী যখন মাদানী বাহিনীর নিকটবর্তী হল, তখন আবু জাহল আল্লাহর নিকটে প্রার্থনা করে বললেন,اللَّهُمَّ أَقْطَعُنَا لِلرَّحِمِ وَآتَانَا بِمَا لاَ نَعْرِفُ فَأَحِنْهُ الْغَدَاةَ اي فأهلكه ‘হে আল্লাহ! আমাদের উভয়দলের মধ্যে যে দল অধিক আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্নকারী এবং আমাদের নিকট এমন বস্ত্ত (কুরআন) আনয়নকারী যা আমরা জানি না, তুমি তাকে ধ্বংস করে দাও’![হাকেম হা/৩২৬৪, ২/৩২৮; ইবনু হিশাম ১/৬২৮] অন্য বর্ণনায় এসেছে, যুদ্ধের শুরুতে তিনি বলেছিলেন, اللهُمَّ أَيَّنَا كَانَ أَحَبُّ إلَيْكَ وَأَرْضَى عِنْدَكَ فَانْصُرْهُ الْيَوْمَ اللَّهُمَّ اَوْلاَنَا بِالْحَقِّ فَانْصُرْهُ الْيَوْمَ ‘হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে তোমার নিকটে সর্বাধিক প্রিয় ও তুমি যার প্রতি সর্বাধিক সন্তুষ্ট, আজ তুমি তাকে সাহায্য কর। হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যে দল সর্বাধিক হক-এর উপরে আছে, তুমি আজ তাকে সাহায্য কর’।[যাদুল মা‘আদ ৩/১৬৫; আর-রাহীক্ব পৃঃ ২১৬]
এদিকে ইঙ্গিত করে আল্লাহ বলেন, إِنْ تَسْتَفْتِحُوا فَقَدْ جَاءَكُمُ الْفَتْحُ وَإِنْ تَنْتَهُوا فَهُوَ خَيْرٌ لَكُمْ وَإِنْ تَعُودُوا نَعُدْ وَلَنْ تُغْنِيَ عَنْكُمْ فِئَتُكُمْ شَيْئًا وَلَوْ كَثُرَتْ وَأَنَّ اللهَ مَعَ الْمُؤْمِنِينَ ‘যদি তোমরা ফায়ছালা চাও, তবে সেটাতো তোমাদের সামনে এসেই গেছে। আর যদি ক্ষান্ত হও, তবে সেটাই তোমাদের জন্য উত্তম। কিন্তু যদি তোমরা ফের আগে বাড়ো, তাহলে আমরাও ফিরে আসব। (মনে রেখ) তোমাদের দল যত বড়ই হৌক, তা তোমাদের কোন কাজে আসবেনা। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মুমিনদের সাথেই থাকেন’ (আনফাল ৮/১৯)।


মুসলিম বাহিনী সারিবদ্ধ হল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজের বাহিনীকে দ্রুত প্রস্তুত ও সারিবদ্ধ করে ফেললেন। এরি মধ্যে জনৈক সাউয়াদ ইবনু গাযিইয়াহ(سَوَّادُ بنُ غَزِيَّةَ) সারি থেকে কিছুটা আগে বেড়ে এল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার পেটে তীর দিয়ে টোকা মেরে পিছিয়ে যাবার ইঙ্গিত দিয়ে বললেন,اسْتَوِ يَا سَوَّادُ ‘সমান হয়ে যাও হে সাউয়াদ!’ সাথে সাথে সে বলে উঠলো, হে আল্লাহর রাসূল, আপনি আমাকে কষ্ট দিয়েছেন। বদলা দিন! রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন নিজের পেট আলগা করে দেন ও বদলা নিতে বলেন। তখন সে ছুটে এসে তাঁকে জড়িয়ে ধরে পেটে চুমু খেতে লাগলো’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে বললেন, কিজন্য তুমি এরূপ করলে? সে বলল, আমাদের সামনে যে অবস্থা আসছে তাতো আপনি দেখছেন। সেজন্য আমি চেয়েছিলাম যে, আপনার সাথে আমার শেষ আদান-প্রদান যেন এটাই হয় যে, আমার দেহচর্ম আপনার দেহচর্মকে স্পর্শ করুক’। তার এ মর্মস্পর্শী কথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার জন্য কল্যাণের দো‘আ করলেন(دَعَا لَهُ بِخَيْرٍ)।[ইবনু হিশাম ১/৬২৬; সিলসিলা সহীহাহ হা/২৮৩৫] রাসূল (সাঃ)-এর এ কাজের মধ্যে মানবিক সাম্যের এক উত্তম নমুনা রয়েছে, যা নিঃসন্দেহে এক ঈর্ষণীয় বিষয়।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে বললেন, চূড়ান্ত নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত কেউ যুদ্ধ শুরু করবে না। ব্যাপকহারে তীরবৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত কেউ তীর ছুঁড়বে না এবং তোমাদের উপরে তরবারি ছেয়ে না যাওয়া পর্যন্ত তরবারি চালাবে না’। তিনি আরও বলেন, বনু হাশেমকে জোর করে যুদ্ধে আনা হয়েছে। তাদের সাথে আমাদের কোন যুদ্ধ নয়। অতএব তাদের কোন ব্যক্তি সামনে পড়ে গেলে তাকে যেন কেউ আঘাত না করে। আববাসকে যেন হত্যা না করা হয়। অনুরূপভাবে আবুল বাখতারী বিন হেশামকেও হত্যা করো না। কেননা এরা মক্কায় আমাদের কোনরূপ কষ্ট দিত না। বরং সাহায্যকারী ছিল।
উল্লেখ্য যে, বনু হাশিমের বিরুদ্ধে কুরায়েশদের বয়কটনামা যারা ছিঁড়ে ফেলেছিল, তাদের একজন ছিলেন আবুল বাখতারী। কিন্তু যুদ্ধে আবুল বাখতারী নিহত হয়েছিলেন তার নিজস্ব হঠকারিতার জন্য। তিনি তার সঙ্গী কাফের বন্ধুকে ছাড়তে চাননি। ফলে যুদ্ধে তারা উভয়ে নিহত হয়।[ইবনু হিশাম ১/৬২৮-৩০; সীরাহ সহীহাহ ২/৩৬৭ পৃঃ] অতঃপর রাসূল (সাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) টিলার উপরে সামিয়ানার নীচে নিজ স্থানে চলে যান।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...