বনু কুরাইজা যুদ্ধ
৫ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ ও যুলহিজ্জাহ (মার্চ ও এপ্রিল ৬২৬ খৃ.)
খন্দক যুদ্ধ থেকে ফিরে এসে উম্মে সালামার ঘরে যোহরের সময় যখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) গোসল করছিলেন, তখন জিব্রীল এসে বললেন, আপনি অস্ত্র নামিয়ে ফেলেছেন, অথচ ফেরেশতারা এখনো অস্ত্র নামায়নি। দ্রুত তাদের দিকে ধাবিত হউন! রাসূল (সাঃ) বললেন, কোন দিকে? জবাবে তিনি বনু কুরাইজার দিকে ইশারা করলেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ) সেদিকে বেরিয়ে গেলেন’ (বুখারী হা/৪১১৭)। বনু কুরাইজার দুর্গ ছিল মসজিদে নববী থেকে ৬ মাইল বা প্রায় ১০ কি. মি. দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাৎক্ষণিকভাবে ঘোষণা প্রচার করে দিলেন, لاَ يُصَلِّيَنَّ أَحَدٌ الْعَصْرَ إِلاَّ فِى بَنِى قُرَيْظَةَ ‘কেউ যেন বনু কুরাইজায় পৌঁছানোর আগে আছর না পড়ে’ (বুখারী হা/৯৪৬)। অতঃপর আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমের উপরে মদীনার প্রশাসন ভার অর্পণ করে ৩,০০০ সৈন্য নিয়ে তিনি বনু কুরাইজা অভিমুখে রওয়ানা হলেন। অবশ্য সাহাবীদের কেউ রাস্তাতেই আছর পড়ে নেন। কেউ পৌঁছে গিয়ে আছর পড়েন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এজন্য কাউকে কিছু বলেননি (ঐ)। কেননা এর দ্বারা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সকলের দ্রুত বের হওয়া। অতঃপর যথারীতি বনু কুরাইজার দুর্গ অবরোধ করা হয়, যা ২৫ দিন স্থায়ী হয়। অবশেষে তারা আত্মসমর্পণ করে এবং তাদের সাবালক ও সক্ষম পুরুষদের বন্দী করা হয়। এদের সম্পর্কে ফায়ছালার দায়িত্ব তাদের দাবী অনুযায়ী তাদের মিত্র আওস গোত্রের নেতা সা‘দ বিন মু‘আযকে অর্পণ করা হয়। তিনি তাদের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি স্বরূপ সবাইকে হত্যা করার নির্দেশ দেন। সেমতে তাদের নেতা হুয়াই বিন আখত্বাব সহ সবাইকে হত্যা করা হয়’ (বুখারী হা/৪১২১)।
নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বিদ্বানগণ মতভেদ করেছেন। ইবনু ইসহাক ৬০০, ক্বাতাদাহ ৭০০ ও সুহায়লী ৮০০ থেকে ৯০০-এর মধ্যে বলেছেন। পক্ষান্তরে জাবের (রাঃ) বর্ণিত সহীহ হাদীছ সমূহে ৪০০ বর্ণিত হয়েছে (তিরমিযী হা/১৫৮২ ও অন্যান্য)। এর সমন্বয় করতে গিয়ে ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, সম্ভবতঃ ৪০০ জন ছিল যোদ্ধা। বাকীরা ছিল তাদের সহযোগী’ (বুখারী, ফাৎহুল বারী হা/৪১২২-এর আলোচনা)।
যদি তারা ফায়ছালার দায়িত্ব রাসূল (সাঃ)-কে দিত, তাহলে হয়ত পূর্বেকার দুই গোত্রের ন্যায় তাদেরও নির্বাসন দন্ড হত। অতঃপর তাদের কয়েদী ও শিশুদের নাজদে নিয়ে বিক্রি করে তার বিনিময়ে ঘোড়া ও অস্ত্র-শস্ত্র খরীদ করা হয়। অবরোধ কালে মুসলিম পক্ষে খাল্লাদ বিন সুওয়াইদ (خَلاَّد بن سُوَيْد) শহীদ হন এবং উক্কাশার ভাই আবু সিনান বিন মিহছান(أبو سنان بن مِحْصَن) স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেন। তাঁকে বনু কুরাইজার গোরস্থানে দাফন করা হয়। উপর থেকে চাক্কি ফেলে খাল্লাদকে হত্যা করার অপরাধে বনু কুরাইজার একজন মহিলাকে হত্যা করা হয়। উক্ত মহিলা ব্যতীত কোন নারী বা শিশুকে হত্যা করা হয়নি।[ইবনু হিশাম ২/২৪২; সনদ সহীহ]
সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-এর ফায়ছালা অনুযায়ী বনু নাজ্জার-এর বিনতুল হারেছ-এর বাগানে কয়েকটি গর্ত খুঁড়ে সেখানে খন্ড খন্ড দলে নিয়ে বনু কুরাইজার বিশ্বাসঘাতকদের হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়। যার উপরে এখন মদীনার মার্কেট তৈরী হয়েছে (ইবনু হিশাম ২/২৪০-৪১)।
বনু কুরাইজার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের পূর্বেই তাদের কিছু লোক ইসলাম কবুল করেছিল। কেউ কেউ দুর্গ থেকে বেরিয়েও এসেছিল। তাদের জীবন ও সম্পদ নিরাপদ থাকে। এতদ্ব্যতীত ‘আত্বিয়া কুরাযীর (عَطِيَّةُ الْقُرَظِيُّ) নাভির নিম্নদেশের লোম না গজানোর কারণে তিনি বেঁচে যান ও পরে সাহাবী হবার সৌভাগ্য লাভ করেন। এভাবে কাছীর বিন সায়েবও বেঁচে যান।[1]
সাবেত বিন ক্বায়েস (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর নিকট বৃদ্ধ ইহূদী নেতা যুবায়ের বিন বাত্বা আল-কুরাযী(الزُّبَيرُ بنُ بَاطَا الْقُرَظِيُّ) এবং তার পরিবার ও মাল-সম্পদ তাকে ‘হেবা’ করার জন্য আবেদন করেন। কারণ যুবায়ের সাবেতের উপর জাহেলী যুগে কিছু অনুগ্রহ করেছিল। তখন সাবেত বিন ক্বায়েস যুবায়েরকে বললেন, রাসূল (সাঃ) তোমাকে তোমার পরিবার ও মাল-সম্পদসহ আমার জন্য ‘হেবা’ করেছেন। এখন এগুলি সবই তোমার। অতঃপর যখন যুবায়ের জানতে পারল যে, তার সম্প্রদায়ের সবাইকে হত্যা করা হয়েছে। তখন সে বলল, হে সাবেত! তুমি আমাকে আমার বন্ধুদের সাথে মিলিয়ে দাও। তখন তাকে হত্যা করা হল এবং তার নিহত ইহূদী বন্ধুদের সাথে তাকে মিলিয়ে দেওয়া হল।[আর-রাহীক্ব ৩১৭ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/২৪২-৪৩] যুবায়ের-পুত্র আব্দুর রহমান নাবালক হওয়ার কারণে বেঁচে যান। অতঃপর তিনি ইসলাম কবুল করেন ও সাহাবী হন।
অনুরূপভাবে বনু নাজ্জারের জনৈকা মহিলা উম্মুল মুনযির সালমা বিনতে ক্বায়েস-এর আবেদনক্রমে রেফা‘আহ বিন সামাওয়াল(رِفَاعَةُ بْنُ سَمَوْأَلَ) কুরাযীকে তার জন্য ‘হেবা’ করা হয়। পরে রেফা‘আহ ইসলাম কবুল করেন ও সাহাবী হন।
এদিন রাসূল (সাঃ) বনু কুরাইজার গণীমতের মাল এক পঞ্চমাংশ বের করে নিয়ে বাকীটা বণ্টন করে দেন। তিনি অশ্বারোহীদের তিন অংশ ও পদাতিকদের এক অংশ করে দেন। বন্দীদের সা‘দ বিন যায়েদ আনছারীর নেতৃত্বে নাজদের বাজারে পাঠিয়ে দেন। সেখানে তাদের বিক্রি করে ঘোড়া ও অস্ত্র-শস্ত্র খরীদ করেন। বন্দীনীদের মধ্যে রায়হানা বিনতে ‘আমর বিন খানাক্বাহকে(رَيْحَانَةُ بِنْتِ عَمْرِو بْنِ خَنَاقَةَ) রাসূল (সাঃ) নিজের জন্য মনোনীত করেন। কালবীর বর্ণনা মতে ৬ষ্ঠ হিজরীতে তাকে মুক্তি দিয়ে রাসূল (সাঃ) তার সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। বিদায় হজ্জ শেষে রাসূল (সাঃ) যখন মদীনায় ফিরে আসেন, তখন তাঁর মৃত্যু হয় এবং রাসূল (সাঃ) তাকে বাক্বী‘ গোরস্থানে দাফন করেন’।[আর-রাহীক্ব ৩১৭ পৃঃ; বায়হাক্বী হা/১৭৮৮৮; ইবনু হিশাম ২/২৪৫]
যুদ্ধের কারণ :
━━━━━━━━
মদীনায় অবস্থিত তিনটি ইহূদী গোত্রের সর্বশেষ গোত্রটি ছিল বনু কুরাইজা। তারা ছিল আউস গোত্রের মিত্র। এদের সঙ্গে রাসূল (সাঃ)-এর চুক্তি ছিল যে, তারা বহিঃশত্রুর আক্রমণ কালে সর্বদা রাসূল (সাঃ)-কে সাহায্য করবে। গোত্রনেতা কা‘ব বিন আসাদ আল-ক্বোরাযী নিজে উক্ত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তাদের বাসস্থান ছিল মুসলিম আবাসিক এলাকার পিছনে। মাসব্যাপী খন্দক যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারা মুসলিম বাহিনীকে কোনরূপ সাহায্য করেনি। মুনাফিকদের ন্যায় তারাও যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করছিল। ইতিমধ্যে বিতাড়িত বনু নাযীর ইহূদী গোত্রের নেতা হুয়াই বিন আখত্বাব খায়বর থেকে অতি সঙ্গোপনে বনু কুরাইজার দুর্গে আগমন করে এবং তাদেরকে নানাভাবে মুসলিম বাহিনীর বিরুদ্ধে ফুসলাতে থাকে। সে তাদেরকে বুঝায় যে, কুরাইশের নেতৃত্বে সমস্ত আরবের দুর্ধর্ষ সেনাদল সাগরের জোয়ারের মত মদীনার উপকণ্ঠে সমবেত হয়েছে। তারা সবাই এই মর্মে আমার সাথে ওয়াদাবদ্ধ হয়েছে যে,قَدْ عَاهَدُونِي وَعَاقَدُونِي عَلَى أَنْ لاَ يَبْرَحُوا حَتَّى نَسْتَأْصِلَ مُحَمَّدًا وَمَنْ مَعَهُ ‘মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদের উৎখাত না করা পর্যন্ত তারা ফিরে যাবে না’। কা‘ব বিন আসাদ দুর্গের দরজা বন্ধ করে দেন ও বারবার তাকে ফিরে যেতে বলেন এবং মুহাম্মাদের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করবেন না বলে স্পষ্ট জানিয়ে দেন। কিন্তু ধুরন্ধর হুয়াইয়ের অব্যাহত চাপ ও তোষামোদীতে অবশেষে তিনি কাবু হয়ে পড়েন। তখন একটি শর্তে তিনি রাজি হন যে, যদি কুরায়েশ ও গাত্বফানীরা ফিরে যায় এবং মুহাম্মাদকে কাবু করতে না পারে, তাহলে হুয়াই তাদের সঙ্গে তাদের দুর্গে থেকে যাবেন। হুয়াই এ শর্ত মেনে নেন এবং বনু কুরাইজা চুক্তিভঙ্গের সিদ্ধান্ত নেয়। এখবর রাসূল (সাঃ)-এর কর্ণগোচর হলে তিনি আউস ও খাযরাজ গোত্রের দু’নেতা সা‘দ বিন মু‘আয ও সা‘দ বিন ওবাদাহ এবং আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা ও খাউয়াত বিন জুবায়েরকে(خَوَّاتُ بنُ جُبَير) পাঠান সঠিক তথ্য অনুসন্ধানের জন্য। তিনি তাদেরকে বলে দেন যে, চুক্তিভঙ্গের খবর সঠিক হলে তারা যেন তাকে এসে ইঙ্গিতে জানিয়ে দেয় এবং অন্যের নিকটে প্রকাশ না করে। তারা সন্ধান নিয়ে এসে রাসূল (সাঃ)-কে বললেন,عَضَلٌ وَالْقَارَّةُ অর্থাৎ রাজী‘-এর আযাল ও ক্বাররাহ গোত্রদ্বয়ের ন্যায় বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা ঘটেছে’।[আর-রাহীকব ৩০৯ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/২২১-২২]
প্রথমে ২য় হিজরীর রামাযান মাসে বনু ক্বায়নুক্বা, অতঃপর ৪র্থ হিজরীর রবীউল আউয়ালে বনু নাযীর এবং সর্বশেষ ৫ম হিজরীর যিলহাজ্জ মাসে তৃতীয় ও সর্বশেষ ইহূদী গোত্র বনু কুরাইজার নির্মূলের ফলে মদীনা ইহূদীমুক্ত হয় এবং মুসলিম শক্তি প্রতিবেশী কুচক্রীদের হাত থেকে রেহাই পায়। এক্ষণে আমরা বনু কুরাইজা যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ বিবৃত করব।
বনু কুরাইজা যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
১. ইহূদী মহিলার হাতে শহীদ হলেন যিনি(اسةشهاد المسلم بيد يهودية) :
অবরোধকালে বনু কুরাইজার জনৈকা মহিলা যাঁতার পাট নিক্ষেপ করে সাহাবী খাল্লাদ বিন সুওয়াইদকে হত্যা করে। এর বদলা স্বরূপ পরে উক্ত মহিলাকে হত্যা করা হয়। খাল্লাদ ছিলেন এই যুদ্ধে একমাত্র শহীদ। তিনি বদর, ওহুদ, খন্দক ও বনু কুরাইজার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তার মাথা কঠিনভাবে চূর্ণ হওয়ার কারণে লোকেরা ধারণা করত যে, রাসূল (সাঃ) তার সম্পর্কে বলেন,إنَّ لَهُ لَأَجْرَ شَهِيدَيْنِ ‘তিনি দুই শহীদের সমান নেকী পাবেন’।[ইবনু হিশাম ২/২৫৪; বায়হাক্বী হা/১৭৮৮৮]
২. আহত সা‘দ বিন মু‘আযের প্রার্থনা(دعاء سعد بن معاذ الجريح) :
উভয় পক্ষে তীর নিক্ষেপের এক পর্যায়ে আউস নেতা সা‘দ ইবনু মু‘আয (রাঃ) তীর বিদ্ধ হন। এতে তাঁর হাতের মূল শিরা কর্তিত হয়। যাতে প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে তিনি মৃত্যুর আশংকা করেন। ফলে তিনি আল্লাহর নিকটে দো‘আ করেন এই মর্মে যে,
اللَّهُمَّ .. فَإِنْ كَانَ بَقِىَ مِنْ حَرْبِ قُرَيْشٍ شَىْءٌ، فَأَبْقِنِى لَهُ حَتَّى أُجَاهِدَهُمْ فِيكَ، وَإِنْ كُنْتَ وَضَعْتَ الْحَرْبَ فَافْجُرْهَا، وَاجْعَلْ مَوْتَتِى فِيهَا
‘হে আল্লাহ!... যদি কুরায়েশদের সঙ্গে যুদ্ধ এখনো বাকী থাকে, তাহলে তুমি আমাকে সে পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখো, যাতে আমি তোমার জন্য তাদের সাথে জিহাদ করতে পারি। আর যদি তুমি যুদ্ধ চালু রাখ, তা’হলে আমার এই যখম প্রবাহিত করে দাও এবং এতেই আমার মৃত্যু ঘটিয়ে দাও’ (বুখারী হা/৪১২২)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, দো‘আর শেষাংশে তিনি বলেন,
اللَّهُمَّ لاَ تُخْرِجْ نَفْسِى حَتَّى تُقِرَّ عَيْنِى مِنْ بَنِى قُرَيْظَةَ. فَاسْتَمْسَكَ عِرْقُهُ فَمَا قَطَرَ قَطْرَةً حَتَّى نَزَلُوا عَلَى حُكْمِ سَعْدِ بْنِ مُعَاذٍ فَأَرْسَلَ إِلَيْهِ فَحَكَمَ أَنْ يُقْتَلَ رِجَالُهُمْ وَيُسْتَحْيَى نِسَاؤُهُمْ يَسْتَعِينُ بِهِنَّ الْمُسْلِمُونَ. فَقَالَ رَسُولُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- «أَصَبْتَ حُكْمَ اللهِ فِيهِمْ». وَكَانُوا أَرْبَعَمِائَةٍ فَلَمَّا فَرَغَ مِنْ قَتْلِهِمُ انْفَتَقَ عِرْقُهُ فَمَاتَ
‘হে আল্লাহ! তুমি আমার জান বের করো না, যে পর্যন্ত না বনু কুরাইজার ব্যাপারে আমার চক্ষু শীতল হয়। ফলে তার রক্তস্রোত বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর একটি ফোঁটাও আর পড়েনি, যতক্ষণ না তারা সা‘দ-এর ফায়ছালার উপরে রাজি হয়ে যায়। তখন রাসূল (সাঃ) তার নিকটে এই খবর পাঠান। অতঃপর তিনি (এসে) সিদ্ধান্ত দেন যে, তাদের পুরুষদের হত্যা করা হবে এবং নারীদের বাঁচিয়ে রাখা হবে। যাদেরকে মুসলমানরা ব্যবহার করবে। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি তাদের মধ্যে আল্লাহর ফায়ছালা অনুযায়ী সঠিক ফায়ছালা করেছ। তারা ছিল ৪০০ জন। অতঃপর যখন তাদের হত্যা করা শেষ হয়ে গেল, তখন তার রক্তস্রোত প্রবাহিত হল এবং তিনি মৃত্যুবরণ করলেন’।[তিরমিযী হা/১৫৮২; আহমাদ হা/১৪৮১৫ সনদ সহীহ]
৩. ‘তোমরা তোমাদের (অসুস্থ) নেতাকে এগিয়ে আনো’(قوموا إلى سيدكم) :
বন্দী বনু কুরাইজার মিত্র আউস গোত্রের নেতারা রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে বারবার অনুরোধ করতে লাগল যেন তাদের প্রতি বনু ক্বায়নুক্বার ইহূদীদের ন্যায় সদাচরণ করা হয়। অর্থাৎ সবকিছু নিয়ে মদীনা থেকে জীবিত বের হয়ে যাবার সুযোগ দেওয়া হয়। বনু ক্বায়নুক্বা ছিল খাযরাজ গোত্রের মিত্র। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমরা কি এতে সন্তুষ্ট নও যে, তোমাদেরই এক ব্যক্তি এ বিষয়ে ফায়ছালা করুন। তারা রাজি হল। তখন তিনি আউস গোত্রের নেতা সা‘দ বিন মু‘আযের উপরে এর দায়িত্ব দিলেন। তাতে তারা খুব খুশী হল। অতঃপর সা‘দ বিন মু‘আযকে মদীনা থেকে গাধার পিঠে বসিয়ে সেখানে আনা হল। তিনি খন্দকের যুদ্ধে আহত হয়ে শয্যাশায়ী ছিলেন। সেকারণ তিনি বনু কুরাইজার যুদ্ধে আসতে পারেননি। সা‘দ কাছে এসে পৌঁছলে রাসূল (সাঃ) বললেন,قُومُوا إلَى سَيِّدِكُمْ ‘তোমরা তোমাদের (অসুস্থ) নেতাকে এগিয়ে আনো’। অতঃপর তাঁকে গাধার পিঠ থেকে নামিয়ে আনা হল। রাসূল (সাঃ) তাকে বললেন, হে সা‘দ!إنَّ هَؤُلاَءِ الْقَوْمَ قَدْ نَزَلُوْا عَلَى حُكْمِكَ ‘ঐসব লোকেরা তোমার ফায়ছালার উপরে নিজেদেরকে সমর্পণ করেছে’। সা‘দ বললেন,وَحُكْمِي نَافِذٌ عَلَيْهِمْ؟ ‘আমার ফায়ছালা কি তাদের উপরে প্রযোজ্য হবে? তারা বলল, হ্যাঁ। অতঃপর তিনি রাসূল (সাঃ)-এর দিকে তাকালেন। তখন তিনিও বললেন, হ্যাঁ। অতঃপর তিনি ফায়ছালা দেন এই মর্মে যে, এদের পুরুষদের হত্যা করা হবে, নারী ও শিশুদের বন্দী করা হবে এবং মাল-সম্পদ সব বন্টিত হবে’।[বুখারী হা/৩০৪৩; মুসলিম হা/১৭৬৮; মিশকাত হা/৩৯৬৩, ৪৬৯৫] এ ফায়ছালা শুনে রাসূল (সাঃ) বলে ওঠেন,لَقَدْ حَكَمْتَ فِيْهِمْ بِحُكْمِ اللهِ أَوْ بِحُكْمِ الْمَلِكِ ‘নিশ্চয় তুমি আল্লাহর ফায়ছালা অনুযায়ী অথবা ফেরেশতার ফায়ছালা অনুযায়ী ফায়ছালা করেছ’।[বুখারী হা/৩৮০৪; মুসলিম হা/১৭৬৮; হাকেম হা/২৫৭০] এই ফায়ছালা যে কত বাস্তব সম্মত ছিল, তা পরে প্রমাণিত হয়। মদীনা থেকে মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য তারা গোপনে তাদের দুর্গে ১৫০০ তরবারি, ২০০০ বর্শা, ৩০০ বর্ম, ৫০০ ঢাল মওজুদ করেছিল। যার সবটাই মুসলমানদের হস্তগত হয়’ (আর-রাহীক্ব ৩১৬ পৃঃ)।
অতঃপর উক্ত বিষয়ে সূরা আনফালের ৫৫-৫৮ এবং সূরা আহযাবের ২৬ ও ২৭ আয়াত নাযিল হয় (তাফসীর কুরতুবী)। দুর্ভাগ্য একদল বিদ‘আতী লোকقُومُوا إلَى سَيِّدِكُمْ বাক্যটিকে মীলাদের মজলিসে রাসূল (সাঃ)-এর রূহের আগমন কল্পনা করে তাঁর সম্মানে উঠে দাঁড়িয়ে ক্বিয়াম করার পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করে থাকে। এমনকি অনেকে রূহের বসার জন্য একটা খালি চোখ রেখে দেন।
৪. যাঁর মৃত্যুতে আরশ কেঁপে ওঠে(الذى يهتزّ له العرش) :
বনু কুরাইজার ব্যাপারে ফায়ছালা শেষে আহত নেতা সা‘দ বিন মু‘আযের যখম বিদীর্ণ হয়ে যায়। তখন তিনি মসজিদে নববীতে অবস্থান করছিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মসজিদেই তার চিকিৎসার জন্য তাঁবু স্থাপন করেন। অতঃপর ক্ষত স্থান দিয়ে রক্তস্রোত প্রবাহিত হওয়া অবস্থায় তিনি সেখানে মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে খন্দক যুদ্ধকালে করা তাঁর পূর্বেকার শাহাদাত নছীব হওয়ার দো‘আ কবুল হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,اِهْتَزَّ عَرْشُ الرَّحْمَنِ لِمَوْتِ سَعْدِ بْنِ مُعَاذٍ ‘সা‘দ বিন মু‘আযের মৃত্যুতে আল্লাহর আরশ কেঁপে ওঠে’।[বুখারী হা/৩৮০৩; মুসলিম হা/২৪৬৬] ফেরেশতাগণ তার লাশ উত্তোলন করে কবরে নিয়ে যান।[তিরমিযী হা/৩৮৪৯; মিশকাত হা/৬২২৮, সনদ সহীহ] অর্থাৎ কবরে নিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর লাশ হালকা অনুভূত হওয়ায় মুনাফিকরা তাচ্ছিল্য করে বলে, তার লাশটি কতই না হালকা! এর দ্বারা তারা বনু কুরাইজার ব্যাপারে সা‘দের কঠিন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে যুলুম করার প্রতি ইঙ্গিত করে। এ খবর রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে পৌঁছে গেলে তিনি উপরোক্ত কথা বলেন (তুহফাতুল আহওয়াযী শরহ তিরমিযী)।
শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ :
━━━━━━━━━━━━
(১) কপট লোকদের পরামর্শ ও তাদের সংস্রব হতে দূরে থাকতে হবে। মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই এবং বিতাড়িত বনু নাযীর নেতা হুয়াই বিন আখত্বাবের কুপরামর্শ গ্রহণ করার ফলেই বনু কুরাইজাকে মর্মান্তিক পরিণতি বরণ করতে হয়।
(২) চুক্তি রক্ষা করা সবচেয়ে যরূরী বিষয়। চুক্তি ভঙ্গের কারণে ব্যক্তি ও জাতি ধ্বংস হয়।
(৩) নেতৃত্বের আমানত রক্ষা করা খুবই কঠিন বিষয়। বনু কুরাইজা নেতা কা‘ব বিন আসাদ সেটা করতে ব্যর্থ হওয়ার ফলেই গোটা সম্প্রদায়ের উপর নেমে আসে লোমহর্ষক পরিণতি।
[1]. আর-রাহীক্ব ৩১৭ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/২৪২-৪৩। বর্ণনাটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ। বরং এটাই প্রমাণিত যে, বনু কুরাইজার ঐ সমস্ত পুরুষই কেবল হত্যাকান্ড থেকে বেঁচে যায়, যাদের গুপ্তাঙ্গে লোম গজায়নি (ইবনু হিশাম ২/২৪৪; সনদ সহীহ (ঐ, তাহকীক ক্রমিক ১৩৯৫)। তাদের মধ্যে অনেকেই ইসলাম কবুল করেন। যেমন কা‘ব আল-কুরাযী, কাছীর বিন সায়েব, ‘আত্বিয়া আল-কুরাযী, আব্দুর রহমান বিন যুবায়ের বিন বাত্বা প্রমুখ (মা শা-‘আ ১৭৫ পৃঃ)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন