খন্দক যুদ্ধ
৫ম হিজরীর শাওয়াল ও যুলক্বা‘দাহ (মার্চ ৬২৬ খৃ.)
‘খন্দক’ অর্থ পরিখা। এই যুদ্ধে মদীনার প্রবেশপথে দীর্ঘ পরিখা খনন করা হয়েছিল বলে একে খন্দকের যুদ্ধ বলা হয়। ‘আহযাব’ অর্থ দলসমূহ। মদীনা রাষ্ট্রকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য কুরায়েশদের মিত্র দলসমূহ এক হয়েছিল বিধায় একে ‘আহযাবের যুদ্ধ’ বলা হয়।
মদীনা থেকে বনু নাযীর ইহূদী গোত্রটিকে খায়বরে নির্বাসনের মাত্র ৭ মাসের মাথায় খন্দকের যুদ্ধ সংঘটিত হয়। খন্দকের এই যুদ্ধ ছিল মদীনার উপরে পুরা হিজাযব্যাপী শত্রু দলগুলির এক সর্বব্যাপী হামলা। যা ছিল প্রায় মাসব্যাপী কষ্টকর অবরোধের এক দুঃসহ অভিজ্ঞতাপূর্ণ অভিযান। এই যুদ্ধে শত্রু সৈন্যের সংখ্যা ছিল ১০,০০০। যা ছিল মদীনার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা মিলে মোট জনসংখ্যার চাইতে বেশী। মুসলিম বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩০০০। কিন্তু তারা যে অভিনব যুদ্ধকৌশল অবলম্বন করেন, তা পুরা আরব সম্প্রদায়ের নিকটে ছিল অজ্ঞাত। ফলে তারা হতাশাগ্রস্ত ও পর্যুদস্ত হয়ে অবশেষে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধের নেপথ্যচারী ছিল মদীনা থেকে বিতাড়িত বনু নাযীর ইহূদী গোত্রের নেতারা। মদীনার শনৈঃশনৈঃ উন্নতি দেখে হিংসায় জর্জরিত খায়বরে বিতাড়িত বনু নাযীরের ইহূদী নেতারা ২০ জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিকে মক্কার কুরায়েশ নেতৃবৃন্দ এবং নাজদের বেদুঈন গোত্র বনু গাত্বফান ও অন্যান্য বড় বড় গোত্রের কাছে প্রেরণ করে। তারা সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সকলের সাধারণ শত্রু মুসলিম শক্তিকে নির্মূল করার জন্য প্ররোচিত করে। ফলে সমস্ত আরবে মদীনার বিরুদ্ধে সাজ সাজ রব পড়ে যায়। অতঃপর আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে কেনানা ও তেহামা গোত্রের মিত্রবাহিনী মিলে ৪,০০০ এবং বনু সুলায়েম ও বনু গাত্বফানের বিভিন্ন গোত্রের ৬,০০০ মোট দশ হাযার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী সমুদ্র তরঙ্গের মত গিয়ে মদীনায় আপতিত হয়’ (আর-রাহীক্ব ৩০১-০৩, ৩০৬ পৃঃ)।
অপরপক্ষে মদীনার হুঁশিয়ার নেতৃত্ব গোয়েন্দা রিপোর্টের মাধ্যমে আগেই সাবধান হয়ে যান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বিরোধীদের খবর জানার জন্য যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ)-কে নিয়োগ করেন। তিনি বলেন,مَنْ يَأْتِينِى بِخَبَرِ الْقَوْمِ؟ قَالَ الزُّبَيْرُ أَنَا. فَقَالَ النَّبِىُّ– صلى الله عليه وسلم– إِنَّ لِكُلِّ نَبِىٍّ حَوَارِيًّا، وَحَوَارِىَّ الزُّبَيْرُ ‘শত্রুপক্ষের খবর আনার জন্য কে আছ? যুবায়ের বললেন, আমি। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, প্রত্যেক নবীর জন্য একজন ‘হাওয়ারী’ (নিকট সহচর) থাকে। আমার হাওয়ারী হল যুবায়ের’ (বুখারী হা/২৮৪৬)। শত্রুপক্ষ বলতে এখানে বনু কুরাইজাকে বুঝানো হয়েছে। তারা কুরায়েশদের সাথে চুক্তি ভঙ্গ করেছে কি না, তার খবর সংগ্রহের জন্য যুবায়েরকে পাঠানো হয়। অতঃপর যুদ্ধ শেষে কুরায়েশ শিবিরের অবস্থা জানার জন্য হুযায়ফাকে পাঠানো হয় (ফাৎহুল বারী হা/৪১১৩-এর আলোচনা)।
অতঃপর অভিজ্ঞ সাহাবীগণের সাথে পরামর্শ মোতাবেক রাসূল (সাঃ) মদীনার উত্তর মুখে ওহুদের দিকে দীর্ঘ পরিখা খনন করেন এবং তার পিছনে ৩,০০০ সুদক্ষ সৈন্য মোতায়েন করেন।[আর-রাহীক্ব ৩০৫-০৬ পৃঃ] এর কারণ ছিল এই যে, তিনদিকে পাহাড় ও খেজুর বাগিচা বেষ্টিত মদীনা নগরী প্রাকৃতিক ভাবে সুরক্ষিত দুর্গের মত ছিল। কেবল উত্তর দিকেই মাত্র খোলা ছিল। যেদিক দিয়ে শত্রুদের হামলার আশংকা ছিল। এখানে পরিখা খনন করা হয়। যার দৈর্ঘ্য ছিল ৫০০০ হাত, প্রস্থ ৯ হাত ও গভীরতা ৭ থেকে ১০ হাত। প্রতি ১০ জনকে ৪০ হাত করে খননের দায়িত্ব দেওয়া হয়’ (সীরাহ সহীহাহ ২/৪২০-২১)। রাসূল (সাঃ) মদীনার অভ্যন্তর ভাগের সালা‘ (سَلْع) পাহাড়কে পিছনে রেখে তাঁর সেনাবাহিনীকে খন্দকমুখী করে সন্নিবেশ করেন এবং নারী ও শিশুদেরকে বনু হারেছার ফারে‘ (فَارِع) দুর্গে রেখে দেন। যা ছিল মুসলমানদের সবচেয়ে মযবুত দুর্গ’ (সীরাহ সহীহাহ ২/৪২৫)।
মুসলিম বাহিনী তীর-ধনুক নিয়ে সদাপ্রস্তুত থাকেন, যাতে শত্রুরা পরিখা টপকে বা ভরাট করে কোনভাবেই মদীনায় ঢুকতে না পারে। মুসলিম বাহিনীর এই নতুন কৌশল দেখে কাফের বাহিনী হতচকিত হয়ে যায়। ফলে তারা যুদ্ধ করতে না পেরে যেমন ভিতরে ভিতরে ফুঁসতে থাকে, তেমনি রসদ ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে আতংকিত হতে থাকে। মাঝে-মধ্যে পরিখা অতিক্রমের চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের ১০ জন নিহত হয়। অমনিভাবে তাদের তীরের আঘাতে মুসলিম পক্ষে ৬ জন শহীদ হন’।[1] উক্ত ৬জন হলেন, আউস গোত্রের বনু আব্দিল আশহাল থেকে গোত্রনেতা সা‘দ বিন মু‘আয, আনাস বিন আউস ও আব্দুল্লাহ বিন সাহল। খাযরাজ গোত্রের বনু জুশাম থেকে তুফায়েল বিন নু‘মান ও ছা‘লাবাহ বিন গানমাহ। বনু নাজ্জার থেকে কা‘ব বিন যায়েদ। যিনি একটি অজ্ঞাত তীরের মাধ্যমে শহীদ হন (ইবনু হিশাম ২/২৫২-৫৩)। এঁদের মধ্যে আহত সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) বনু কুরাইজা যুদ্ধের শেষে মারা যান (ইবনু হিশাম ২/২২৭)।
অতঃপর আল্লাহর সাহায্য নেমে আসে। একদিন রাতে হঠাৎ প্রচন্ড ঝঞ্ঝাবায়ু এসে কাফেরদের সবকিছুকে লন্ডভন্ড করে দেয়। অতঃপর তারা ময়দান ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ বিষয়ে আল্লাহ বলেন, يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا اذْكُرُوا نِعْمَةَ اللهِ عَلَيْكُمْ إِذْ جَاءَتْكُمْ جُنُودٌ فَأَرْسَلْنَا عَلَيْهِمْ رِيحًا وَجُنُودًا لَمْ تَرَوْهَا وَكَانَ اللهُ بِمَا تَعْمَلُونَ بَصِيرًا ‘হে বিশ্বাসীগণ! তোমাদের উপর আল্লাহর অনুগ্রহকে স্মরণ কর, যখন তোমাদের নিকট এসেছিল সেনাদল সমূহ। অতঃপর আমি তাদের উপরে প্রেরণ করলাম তীব্র ঝঞ্ঝাবায়ু এবং এমন সেনাবাহিনী যাদেরকে তোমরা দেখনি। আর আল্লাহ তোমরা যা কর তা দেখেন’ (আহযাব ৩৩/৯)।
এভাবে ফেরেশতা পাঠিয়ে আল্লাহ সরাসরি সাহায্য করেছেন হিজরতকালে যখন রাসূল (সাঃ) ও আবুবকর (রাঃ) দু’জনে ছওর গিরিগুহায় আত্মগোপন করেছিলেন’ (তওবা ৯/৪০), অতঃপর বদর যুদ্ধে (আলে ইমরান ৩/১২৩-২৬), অতঃপর হোনায়েন যুদ্ধে (তওবা ৯/২৫-২৬)। এতদ্ব্যতীত তিনি ও সাহাবায়ে কেরাম এবং যুগে যুগে তাঁর সনিষ্ঠ অনুসারী মুমিনগণ সর্বদা সাহায্য পেয়েছেন ও পাবেন ইনশাআল্লাহ।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, খন্দকের দীর্ঘায়িত যুদ্ধের অসহনীয় কষ্টের সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে আল্লাহর নিকট দো‘আ করতে বলেছিলেন,اللَّهُمَّ اسْتُرْ عَوْرَاتِنَا، وَآمِنْ رَوْعَاتِنَا ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাদের সংকট দূরীভূত কর এবং আমাদের ভীতি দূর কর’ (সিলসিলা সহীহাহ হা/২০১৮)। আব্দুল্লাহ ইবনু আবী ‘আওফা (রাঃ) বলেন, এদিন রাসূল (সাঃ) মুশরিকদের বিরুদ্ধে দো‘আ করে বলেছিলেন,اللَّهُمَّ مُنْزِلَ الْكِتَابِ سَرِيْعَ الْحِسَابِ اهْزِمِ الْأَحْزَابَ اللَّهُمَّ اهْزِمْهُمْ وَزَلْزِلْهُمْ ‘হে আল্লাহ! হে কিতাব নাযিলকারী, দ্রুত হিসাব গ্রহণকারী! সম্মিলিত সেনাদলকে তুমি পরাভূত কর। হে আল্লাহ! তুমি ওদের পরাজিত কর ও ভীত-কম্পিত কর’।[বুখারী হা/২৯৩৩; মুসলিম হা/১৭৪২; মিশকাত হা/২৪২৬] তাছাড়া নবীগণের বিজয় সাধারণতঃ এরূপ চূড়ান্ত পরীক্ষার পরেই এসেছে। যেমন আল্লাহ বলেন, أَمْ حَسِبْتُمْ أَنْ تَدْخُلُوا الْجَنَّةَ وَلَمَّا يَأْتِكُمْ مَثَلُ الَّذِينَ خَلَوْا مِنْ قَبْلِكُمْ مَسَّتْهُمُ الْبَأْسَاءُ وَالضَّرَّاءُ وَزُلْزِلُوا حَتَّى يَقُولَ الرَّسُولُ وَالَّذِينَ آمَنُوا مَعَهُ مَتَى نَصْرُ اللهِ أَلاَ إِنَّ نَصْرَ اللهِ قَرِيبٌ ‘তোমরা কি ধারণা করেছ জান্নাতে প্রবেশ করবে? অথচ তোমাদের উপর এখনও তাদের মত অবস্থা আসেনি, যারা তোমাদের পূর্বে গত হয়েছে। নানাবিধ বিপদ ও দুঃখ-কষ্ট তাদেরকে স্পর্শ করেছিল ও তারা ভীত-কম্পিত হয়েছিল। এমনকি রাসূল ও তার সাথী মুমিনগণ বলতে বাধ্য হয়েছিল যে, কখন আল্লাহর সাহায্য আসবে? জেনে রাখ, নিশ্চয়ই আল্লাহর সাহায্য অতীব নিকটবর্তী’ (বাক্বারাহ ২/২১৪)। কুরতুবী বলেন, অধিকাংশ মুফাসসির বলেছেন যে, অত্র আয়াতটি খন্দক যুদ্ধের সময় নাযিল হয়’ (কুরতুবী, তাফসীর উক্ত আয়াত)। অতএব এই বিজয় রাসূল (সাঃ)-এর দো‘আ কবুলের প্রমাণ বৈ কি!
হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (রাঃ) বলেন, খন্দক যুদ্ধের শেষ রাতে যখন প্রচন্ড ঝঞ্ঝাবায়ু আসে এবং সবদিকে ঠান্ডা হয়ে যায়, তখন রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে লক্ষ্য করে বলেন, কে আছ যে আমাকে শত্রু পক্ষের খবর এনে দিতে পারবে? সে আমার সঙ্গে জান্নাতে থাকবে’। কথাটি রাসূল (সাঃ) দু’বার বললেন। কিন্তু কেউ জবাব দিল না। অবশেষে তিনি আমার নাম ধরে বললেন, দাঁড়াও হে হুযায়ফা! আমাদের জন্য খবর নিয়ে এস এবং তাদেরকে যেন আমার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করো না। অতঃপর আমি উঠলাম এবং এমন আবহাওয়ার মধ্য দিয়ে চলতে থাকলাম যেন তা গরম (অর্থাৎ ঠান্ডা বাতাস ও ঝড়ের কোন প্রকোপ ছিল না)। আমি চলতে থাকলাম এবং পৌঁছে গিয়ে দেখলাম যে, আবু সুফিয়ান আগুন জ্বালিয়ে দেহ গরম করছেন। আমি তীর তাক করলাম। কিন্তু রাসূল (সাঃ)-এর নিষেধাজ্ঞা স্মরণ হওয়ায় বিরত হলাম। অতঃপর ফিরে এসে সব খবর জানালাম। তখন রাসূল (সাঃ) তাঁর মস্তকাবরণ ‘আবা’-র একটি অংশ আমার গায়ের উপর দিলেন। তাতে আমি ঘুমিয়ে গেলাম। কিছু পরে তিনি আমাকে ডাকলেন, قُمْ يَا نَوْمَانُ ‘উঠ হে ঘুমন্ত! (মুসলিম হা/১৭৮৮)।
উল্লেখ্য যে, কাফের পক্ষের পরাজয়ের কারণ হিসাবে দু’টি বিষয় বর্ণিত হয়েছে, যা প্রসিদ্ধ হলেও বিশুদ্ধ নয়। আমরা মনে করি, আহযাব যুদ্ধে বিজয়ের জন্য কোনরূপ ‘যঈফ ও সনদবিহীন’ বর্ণনার আশ্রয় নেওয়ার কোন প্রয়োজন নেই। বরং এ ব্যাপারে আল্লাহই পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছেন যে, তিনি তীব্র ঝঞ্ঝাবায়ু এবং তাঁর অদৃশ্য সেনাবাহিনী অর্থাৎ ফেরেশতাদের মাধ্যমে বিজয় দান করেছিলেন।
অতঃপর যুদ্ধ শেষে যুলক্বা‘দাহ মাসের সাত দিন বাকী থাকতে বুধবার পূর্বাহ্নে রাসূল (সাঃ) মদীনায় ফিরে আসেন’।[ইবনু সা‘দ ২/৫৪; আর-রাহীক্ব ৩১৩ পৃঃ]
ফলাফল :
━━━━━━
খন্দক যুদ্ধে ক্ষয়ক্ষতি তেমন না হলেও এটি ছিল একটি যুগান্তকারী যুদ্ধ। কেননা আরবদের সম্মিলিত বাহিনীর এই ন্যাক্কারজনক পরাজয়ে মদীনার উঠতি মুসলিম শক্তিকে তারা সমগ্র আরবে এক অদমনীয় ও অপ্রতিরোধ্য শক্তি হিসাবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এতবড় বিশাল বাহিনী সংগ্রহ করা বিরোধীদের পক্ষে আর কখনো সম্ভব হয়নি। সে দিকে ইঙ্গিত করেই শত্রুদের পলায়নের পর রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, الْآنَ نَغْزُوْهُمْ وَلاَ يَغْزُوْنَنَا نَحْنُ نَسِيْرُ إِلَيْهِمْ ‘এখন থেকে আমরা ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করব, ওরা আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে না। আমরাই ওদের দিকে সৈন্য পরিচালনা করব’।[বুখারী হা/৪১১০; মিশকাত হা/৫৮৭৯]
খন্দক যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয় সমূহ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
১. ধূলি-ধূসরিত রাসূল(اغبر الرسول صــ) :
খন্দক যুদ্ধে প্রতি ১০ জনের জন্য ৪০ হাত করে পরিখা খননের দায়িত্ব ছিল। সাহাবী বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে খন্দকের মাটি বহনরত অবস্থায় দেখেছি। যাতে তাঁর সারা দেহ বিশেষ করে পেটের চামড়া ধূলি-ধূসরিত হয়ে গিয়েছিল’ (বুখারী হা/৪১০৪)।
২. রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে কাজ করেন(إنشاد الرسولـــ عند العمل) :
বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) বলেন, খন্দকের মাটি বহনকালে আমি রাসূল (সাঃ)-কে টান দিয়ে দিয়ে আব্দুল্লাহ ইবনে রাওয়াহার কবিতার নিম্নোক্ত চরণগুলি আবৃত্তি করতে শুনেছি।-
اللَّهُمَّ لَوْلاَ أَنْتَ مَا اهْتَدَيْنَا + وَلاَ تَصَدَّقْنَا وَلاَ صَلَّيْنَا
فَأَنْزِلَنْ سَكِينَةً عَلَيْنَا + وَثَبِّتِ الْأَقْدَامَ إِنْ لاَقَيْنَا
إِنَّ الْأُوْلَى قَدْ بَغَوْا عَلَيْنَا + إِذَا أَرَادُوْا فِتْنَةً أَبَيْنَا-
‘হে আল্লাহ! যদি তোমার অনুগ্রহ না থাকত, তাহলে আমরা হেদায়াতপ্রাপ্ত হতাম না এবং আমরা ছাদাক্বাও দিতাম না, সালাতও আদায় করতাম না’। ‘অতএব আমাদের উপরে শান্তি বর্ষণ কর এবং কাফিরদের সঙ্গে যদি আমাদের মুকাবিলা হয়, তাহলে আমাদের পা গুলি দৃঢ় রাখ’। ‘নিশ্চয়ই প্রথম পক্ষ আমাদের উপরে বাড়াবাড়ি করেছে। যদি তারা ফিৎনা সৃষ্টি করতে চায়, তাহলে আমরা তা অস্বীকার করব’ (বুখারী হা/২৮৩৭)।
৩. কবিতা বলে প্রার্থনার সুরে উৎসাহ দিলেন রাসূল (সাঃ)(تشجيع الرسول صـ لإنشاد الدعائى) :
সাহাবী সাহল বিন সা‘দ (রাঃ) বলেন, আমরা খন্দকে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে ছিলাম। এ সময় আমরা পরিখা খনন করছিলাম ও কাঁধে করে মাটি বহন করছিলাম’। আনাস (রাঃ) বলেন, শীতের সকালে ক্ষুৎ-পিপাসায় কাতর সাহাবীগণ পরিখা খনন করছিলেন। এমন সময় রাসূল (সাঃ) সেখানে আগমন করেন ও তাদেরকে উৎসাহ দিয়ে প্রার্থনার সুরে গেয়ে ওঠেন,
اللَّهُمَّ لاَ عَيْشَ إِلاَّ عَيْشُ الْآخِرَهْ + فَاغْفِرِ الْأَنْصَارَ وَالْمُهَاجِرَهْ
‘হে আল্লাহ! নেই কোন আরাম পরকালের আরাম ব্যতীত। অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের ক্ষমা কর’।[2] জবাবে সাহাবীগণ গেয়ে ওঠেন,
نَحْنُ الَّذِينَ بَايَعُوا مُحَمَّدًا + عَلَى الْجِهَادِ مَا بَقِيْنَا أَبَدَا
‘আমরা তারাই, যারা মুহাম্মাদের হাতে জিহাদের বায়‘আত করেছি যতদিন আমরা বেঁচে থাকব’ (বুখারী হা/৪০৯৮-৯৯)।
৪. নেতা ও কর্মী সকলে ক্ষুধার্ত(الأمير والمأمورون كلهم جياع) :
আবু ত্বালহা, জাবের ও আবু হুরায়রাহ (রাঃ) প্রমুখ সাহাবীগণের বর্ণনায় প্রমাণিত হয় যে, খন্দকের যুদ্ধে রাসূল (সাঃ) ও সাহাবীগণ অধিকাংশ সময় ক্ষুধার্ত থাকতেন। এমনকি ক্ষুধার যন্ত্রণা হ্রাস করার জন্য তাঁরা পেটে পাথর বেঁধে রাখতেন’ (সহীহাহ হা/১৬১৫)।
৫. পরিখা খননকালে মু‘জিযাসমূহ(ظهور المعجزات عند حفر الخندق) :
(ক) হযরত জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, খননকালে একটি বড় ও শক্ত পাথর সামনে পড়ে। যা ভাঙ্গা অসম্ভব হয়। রাসূল (সাঃ)-কে বিষয়টি জানানো হলে তিনি এসে তাতে কোদাল দিয়ে আঘাত করলেন, যাতে তা ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে বালুর স্তূপের ন্যায় হয়ে গেল, যা হাতে ধরা যায় না। অথচ ঐসময় ক্ষুধার্ত রাসূল (সাঃ)-এর পেটে পাথর বাঁধা ছিল। আমরাও তিনদিন যাবৎ অভুক্ত ছিলাম’ (বুখারী হা/৪১০১)।
(খ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ক্ষুধার ব্যাপারটি অবগত হয়ে সাহাবী জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) একটি বকরীর বাচ্চা যবেহ করলেন এবং তাঁর স্ত্রী এক ছা‘ (আড়াই কেজি) যব পিষে আটা তৈরী করলেন। অতঃপর রান্না শেষে রাসূল (সাঃ)-কে কয়েকজন সাহাবী সহ গোপনে দাওয়াত দিলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন ঐ সময় পরিখা খননরত ১০০০ সাহাবীর সবাইকে সাথে নিয়ে এলেন। অতঃপর সকলে তৃপ্তির সাথে খাওয়ার পরেও আগের পরিমাণ আটা ও গোশত অবশিষ্ট রয়ে গেল।[বুখারী হা/৪১০২; মুসলিম হা/২০৩৯; মিশকাত হা/৫৮৭৭]
(গ) ‘আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) পরিখা খনন করছিলেন। এমন সময় রাসূল (সাঃ) তাকে সুসংবাদ দিয়ে বলেন,أَبْشِرْ عَمَّارُ تَقْتُلُكَ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ ‘হে ‘আম্মার! জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর। তোমাকে বিদ্রোহী দল হত্যা করবে’ (তিরমিযী হা/৩৮০০)। আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, পরিখা খননের সময় রাসূল (সাঃ) ‘আম্মার-এর মাথার ধূলি ঝেড়ে দিয়ে বলেন,بُؤْسَ ابْنِ سُمَيَّةَ تَقْتُلُكَ فِئَةٌ بَاغِيةٌ ‘হে সুমাইয়ার পরিশ্রমী সন্তান! তোমাকে একটি বিদ্রোহী দল হত্যা করবে’ (মুসলিম হা/২৯১৫ (৭০)। উক্ত রাবী থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, ইতিপূর্বে মসজিদে নববী নির্মাণের সময় অন্যদের ন্যায় মাথায় একটির বদলে দু’টি করে ইট বহন করছিলেন। এ দৃশ্য দেখে রাসূল (সাঃ) তার মাথার ধূলা ঝেড়ে দেন ও বলেন, তুমি অন্যদের মত না করে এভাবে করছ কেন? জবাবে তিনি বলেন,إِنِّى أُرِيدُ الأَجْرَ مِنَ اللهِ ‘আমি আল্লাহর নিকট থেকে অধিক নেকী কামনা করি’ (আহমাদ হা/১১৮৭৯)। তখন রাসূল (সাঃ) তার উদ্দেশ্যে বলেন,وَيْحَ عَمَّارٍ تَقْتُلُهُ الْفِئَةُ الْبَاغِيَةُ، يَدْعُوهُمْ إِلَى الْجَنَّةِ، وَيَدْعُونَهُ إِلَى النَّارِ ‘আম্মারের উপর আল্লাহর রহমত হৌক! তাকে একটি বিদ্রোহী দল হত্যা করবে। সে তাদেরকে জান্নাতের দিকে ডাকবে। আর তারা তাকে জাহান্নামের দিকে ডাকবে’। উত্তরে ‘আম্মার বলল, আমি ফিৎনা থেকে আল্লাহর আশ্রয় চাই’।[বুখারী হা/৪৪৭। ] আবু ওয়ায়েল (রাঃ) বলেন,لَمَّا بَعَثَ عَلِىٌّ عَمَّارًا وَالْحَسَنَ إِلَى الْكُوفَةِ لِيَسْتَنْفِرَهُمْ خَطَبَ عَمَّارٌ فَقَالَ إِنِّى لأَعْلَمُ أَنَّهَا زَوْجَتُهُ فِى الدُّنْيَا وَالآخِرَةِ ، وَلَكِنَّ اللهَ ابْتَلاَكُمْ لِتَتَّبِعُوهُ أَوْ إِيَّاهَا ‘(উটের যুদ্ধের প্রাক্কালে) যখন আলী (রাঃ) ‘আম্মার ও স্বীয় পুত্র হাসানকে কূফাবাসীদের নিকটে প্রেরণ করেন তাঁর পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করার জন্য, তখন সেখানে গিয়ে ‘আম্মার লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আমি জানি যে তিনি (আয়েশা) দুনিয়া ও আখেরাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর স্ত্রী। কিন্তু আল্লাহ তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলেছেন তোমরা (বর্তমান অবস্থায়) আলীর অনুসরণ করবে, না তাঁর অনুসরণ করবে? (বুখারী হা/৩৭৭২)। এ প্রসঙ্গে উম্মে সালামাহ (রাঃ) বলেন, উটের পিঠ আমাকে আন্দোলিত করেনি, যখন থেকে রাসূল (সাঃ)-এর উপর আহযাব ৩৩ আয়াতটি নাযিল হয়েছে। অতঃপর তিনি আয়েশা (রাঃ), ত্বালহা ও যুবায়ের (রাঃ)-এর ভূমিকা প্রসঙ্গে বলেন, আয়েশা (রাঃ) উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যা করেছিলেন। তারা চেয়েছিলেন পরস্পরের মধ্যে মীমাংসা করতে এবং উসমানের খুনীদের বদলা নিতে। অন্যদিকে আলী (রাঃ) চেয়েছিলেন সকলকে আনুগত্যের উপর একত্রিত করতে। পক্ষান্তরে নিহতের উত্তরাধিকারীগণ প্রকৃত হত্যাকারীদের নিকট থেকে ক্বিছাছ দাবী করছিলেন’ (ফাৎহুল বারী হা/৩৭৭২-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য)।
বস্ত্ততঃ ‘আমীর’ হিসাবে আলী (রাঃ)-এর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনই ছিল সকলের প্রথম কর্তব্য। কেননা শাসন ক্ষমতা সুসংহত না হওয়া পর্যন্ত ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ‘আম্মার বিন ইয়াসির (রাঃ) তাঁর ভাষণে সেদিকেই ইঙ্গিত করেছিলেন।
অতঃপর ‘আম্মার (রাঃ) ৩৭ হিজরীতে আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যে সংঘটিত ছিফফীন যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে যুদ্ধ করা অবস্থায় ৯৩ বছর বয়সে শহীদ হন’।[আল-ইছাবাহ, ‘আম্মার ক্রমিক ৫৭০৮; আল-ইস্তী‘আব, ‘আম্মার ক্রমিক ১৮৬৩]
(ঘ) বারা বিন ‘আযেব (রাঃ) বলেন, আমাদের সামনে বড় একটা পাথর পড়ল। যাতে কোদাল মারলে ফিরে আসতে থাকে। তখন আমরা রাসূল (সাঃ)-কে বিষয়টি জানালে তিনি এসে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে পাথরটিতে কোদাল দিয়ে আঘাত করেন। তাতে তার একাংশ ভেঙ্গে পড়ল। তখন তিনি বলে ওঠেন- আল্লাহু আকবর! আমাকে শামের চাবিসমূহ দান করা হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমি এখন তাদের লাল প্রাসাদগুলো দেখতে পাচ্ছি’। অতঃপর দ্বিতীয়বার আঘাত করেন এবং বলে ওঠেন, আল্লাহু আকবর! আমাকে পারস্যের সাম্রাজ্য দান করা হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমি এখন মাদায়েনের শ্বেত-শুভ্র প্রাসাদগুলো দেখতে পাচ্ছি। অতঃপর তৃতীয়বার ‘বিসমিল্লাহ’ বলে আঘাত করলেন এবং পাথরটির বাকী অংশ ভেঙ্গে পড়ল। তখন তিনি বলে উঠলেন, আল্লাহু আকবর! আমাকে ইয়ামন রাজ্যের চাবিসমূহ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমি এখান থেকে রাজধানী ছান‘আর দরজা সমূহ দেখতে পাচ্ছি’।[নাসাঈ হা/৩১৭৬, হাদীছ হাসান; সহীহাহ হা/৭৭২] বস্ত্ততঃ এগুলি ছিল ভবিষ্যৎ ইসলামী বিজয়ের অগ্রিম সুসংবাদ মাত্র। যা খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে বাস্তবায়িত হয়েছিল।
এ বিষয়ে আরও কয়েকটি মু‘জিযা বর্ণিত হয়েছে, যা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয়।[3]
৬. মুমিন ও মুনাফিকদের দ্বিবিধ প্রতিক্রিয়া(تأثران مضادان من المؤمنين والمنافقين) :
খন্দক যুদ্ধে বিশাল শত্রু সেনাদল দেখে মুনাফিক ও দুর্বলচেতা ভীরু মুসলমানরা বলে ওঠে, রাসূল (সাঃ)-এর দেওয়া ওয়াদা প্রতারণা বৈ কিছু নয়। এমনকি খাযরাজ গোত্রের বনু সালামারও পদস্খলন ঘটতে যাচ্ছিল, যেমন ইতিপূর্বে ওহুদ যুদ্ধের সময় তাদের অবস্থা হয়েছিল। এদের সম্পর্কে আল্লাহ বলেন,
وَإِذْ يَقُوْلُ الْمُنَافِقُوْنَ وَالَّذِيْنَ فِيْ قُلُوْبِهِمْ مَرَضٌ مَا وَعَدَنَا اللهُ وَرَسُوْلُهُ إِلاَّ غُرُوْرًا- وَإِذْ قَالَت طَّائِفَةٌ مِّنْهُمْ يَا أَهْلَ يَثْرِبَ لاَ مُقَامَ لَكُمْ فَارْجِعُوْا وَيَسْتَأْذِنُ فَرِيْقٌ مِّنْهُمُ النَّبِيَّ يَقُوْلُوْنَ إِنَّ بُيُوْتَنَا عَوْرَةٌ وَمَا هِيَ بِعَوْرَةٍ إِن يُرِيْدُوْنَ إِلاَّ فِرَاراً- (الأحزاب 12-13)-
‘আর মুনাফিক ও যাদের অন্তরে ব্যাধি ছিল, তারা বলল, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা প্রতারণা বৈ কিছু নয়’। ‘তাদের আরেক দল বলল, হে ইয়াছরিববাসীগণ! এখানে তোমাদের কোন স্থান নেই, তোমরা ফিরে চল। তাদের মধ্যে আরেক দল নবীর কাছে অনুমতি চেয়ে বলল, আমাদের বাড়ী-ঘর অরক্ষিত। অথচ সেগুলি অরক্ষিত ছিল না। মূলতঃ পালিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের উদ্দেশ্য’ (আহযাব ৩৩/১২-১৩)।
অপর পক্ষে মুমিনগণ এটাকে পরীক্ষা হিসাবে গ্রহণ করেন এবং তাদের ঈমান বৃদ্ধি পায়। যেমন আল্লাহর ভাষায়-
إِذْ جَاؤُوْكُمْ مِّنْ فَوْقِكُمْ وَمِنْ أَسْفَلَ مِنْكُمْ وَإِذْ زَاغَتِ الْأَبْصَارُ وَبَلَغَتِ الْقُلُوْبُ الْحَنَاجِرَ وَتَظُنُّوْنَ بِاللهِ الظُّنُوْنَا (১০) هُنَالِكَ ابْتُلِيَ الْمُؤْمِنُوْنَ وَزُلْزِلُوْا زِلْزَالاً شَدِيْداً (১১)... وَلَمَّا رَأَى الْمُؤْمِنُوْنَ الْأَحْزَابَ قَالُوْا هَذَا مَا وَعَدَنَا اللهُ وَرَسُوْلُهُ وَصَدَقَ اللهُ وَرَسُوْلُهُ وَمَا زَادَهُمْ إِلاَّ إِيْمَاناً وَتَسْلِيْمًا- (الأحزاب ১০-১১، ২২)-
‘যখন তারা তোমাদের উপর আপতিত হল উচ্চভূমি থেকে ও নিম্নভূমি থেকে এবং যখন (ভয়ে) তোমাদের চক্ষু ছনাবড়া হয়ে গিয়েছিল ও প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল। আর তোমরা আল্লাহ সম্পর্কে নানারূপ ধারণা করতে শুরু করেছিলে’ (১০)। ‘সে সময় মুমিনগণ পরীক্ষায় নিক্ষিপ্ত হয়েছিল এবং ভীষণভাবে ভীত-কম্পিত হয়েছিল’ (১১)। ...‘অতঃপর যখন মুমিনরা শত্রু বাহিনীকে প্রত্যক্ষ করল, তখন তারা বলল, এতো সেটাই, যার ওয়াদা আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে দিয়েছিলেন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সত্য বলেছেন। এমতাবস্থায় তাদের ঈমান ও আত্মসমর্পণ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হল’ (আহযাব ৩৩/১০-১১, ২২)।
৭. মুসলিম বাহিনীর প্রতীক চিহ্ন(شعار جيش المسلمين) : খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানদের প্রতীক চিহ্ন ছিল,حم- لاَ يُنْصَرُوْنَ হা-মীম। তারা সাহায্যপ্রাপ্ত হবে না’।[তিরমিযী হা/১৬৮২; আবুদাঊদ হা/২৫৯৭; মিশকাত হা/৩৯৪৮] এটি যেকোন যুদ্ধের জন্য হতে পারে।
৮. বর্শা ফেলে পালালেন কুরায়েশ সেনাপতি(فرَّ قائدُ قريش تاركا رمحه) : যুদ্ধ ছাড়াই অবরোধে অতিষ্ঠ হয়ে এক সময় আবু জাহল পুত্র ও কুরায়েশ বাহিনীর অন্যতম দুর্ধর্ষ সেনাপতি ইকরিমা বিন আবু জাহল দু’জন সাথীকে নিয়ে দুঃসাহসে ভর করে একস্থান দিয়ে খন্দক পার হলেন। অমনি হযরত আলীর প্রচন্ড হামলায় তার একজন সাথী নিহত হল। এমতাবস্থায় ইকরিমা ও তার সাথী ভয়ে পালিয়ে আসেন এবং তিনি এতই ভীত হয়ে পড়েন যে, নিজের বর্শাটাও ফেলে আসেন’ (আর-রাহীক্ব ৩০৬-০৭ পৃঃ)।
৯. সালাত ক্বাযা হল যখন(قضت الصلوات الراةبة) : খন্দক যুদ্ধের সময় শত্রু পক্ষের বিরুদ্ধে অব্যাহত নযরদারি ও মুকাবিলার কারণে কোন কোন দিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও সাহাবায়ে কেরামের সালাত ক্বাযা হয়ে যায়। একবার আছরের সালাত ক্বাযা হয়। যা তারা মাগরিবের পরে প্রথমে আছর অতঃপর মাগরিবের সালাত আদায় করেন’ (বুখারী হা/৫৯৬)। এ সময় রাসূল (সাঃ) মুশরিকদের বিরুদ্ধে বদদো‘আ করে বলেন,مَلَأَ اللهُ بُيُوْتَهُمْ وَقُبُوْرَهُمْ نَارًا ‘আল্লাহ ওদের বাড়ি ও কবরগুলিকে আগুন দ্বারা পূর্ণ করে দিন’।[বুখারী হা/৪১১১, ৪১১২; মুসলিম হা/৬২৭; মিশকাত হা/৬৩৩] একবার যোহর হতে এশা পর্যন্ত চার ওয়াক্ত সালাত ক্বাযা হয়’।[মুসলিম, শরহ নববী, হা/৬২৮] উল্লেখ্য যে, তখন পর্যন্ত ছালাতুল খাওফ-এর বিধান (নিসা ৪/১০১-১০২) নাযিল হয়নি। কেননা উক্ত বিধান নাযিল হয় ৬ষ্ঠ হিজরীর যিলক্বা‘দ মাসে হোদায়বিয়ার সফর কালে।
১০. খন্দক যুদ্ধের বিষয়ে কুরআন(القرآن فى غزوة الأحزاب) : খন্দক ও বনুকুরাইজার যুদ্ধ সম্পর্কে আল্লাহপাক সূরা আহযাবে ৯ থেকে ২৭ পর্যন্ত ১৯টি আয়াত নাযিল করেন। যাতে এই দুই যুদ্ধের বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে।
শিক্ষণীয় বিষয়সমূহ :
━━━━━━━━━━━━
(১) কুচক্রীদেরকে বিতাড়িত করার পরেও তাদের চক্রান্ত অব্যাহত থাকে।
(২) সম্মিলিত শক্তির সামনে বাহ্যতঃ দুর্বল অবস্থায় সর্বোচ্চ যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করা অতীব যরূরী।
(৩) ভিতরে-বাইরে প্রচন্ড বাধার মধ্যেও কেবলমাত্র প্রবল আত্মশক্তি ও আল্লাহর উপর দৃঢ় নির্ভরশীলতা মুসলমানদেরকে যেকোন পরিস্থিতিতে বিজয়ী করে থাকে।
(৪) বিজয়ের জন্য আল্লাহপাক মুমিনের চূড়ান্ত ঈমানী পরীক্ষা নিয়ে থাকেন।
(৫) অবশেষে আল্লাহর গায়েবী মদদে বিজয় এসে থাকে।
[1]. আর-রাহীক্ব ৩০৭ পৃঃ; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১৯১। লেখক মানছূরপুরী বলেন, এ যুদ্ধ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করে আল্লাহ বলেন, أَمْ يَقُوْلُوْنَ نَحْنُ جَمِيْعٌ مُنْتَصِرٌ، سَيُهْزَمُ الْجَمْعُ وَيُوَلُّوْنَ الدُّبُرَ- ‘কাফেররা বলে যে, আমরা আজ সবাই প্রতিশোধকামী’। ‘কিন্তু দেখবে যে সত্বর ঐ সম্মিলিত বাহিনী পরাজিত হবে এবং তারা পিছন ফিরে পালিয়ে যাবে’ (ক্বামার ৫৩/৪৪-৪৫)। উক্ত আয়াত নাযিলের ২৫ দিন পর যুদ্ধের শেষ দিকে হঠাৎ উত্তপ্ত বায়ুর প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় আল্লাহর গজব আকারে নেমে আসে। যা অবরোধকারী সেনাদলের তাঁবু সমূহ উড়িয়ে নিয়ে যায় এবং তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায়’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/৩১৪-১৫ পৃঃ)। উক্ত আয়াতটি মাক্কী সূরার অন্তর্ভুক্ত। যা রাসূল (সাঃ) ২য় হিজরীতে সংঘটিত বদর যুদ্ধের দিন পাঠ করেছিলেন (বুখারী হা/৩৯৫৩)। অতএব এটি ৪র্থ হিজরীতে সংঘটিত খন্দকের যুদ্ধে নাযিল হওয়ার প্রশ্নই আসেনা।
[2]. একই রাবী কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে, اللَّهُمَّ إِنَّ الْعَيْشَ عَيْشُ الْآخِرَهْ + فَاغْفِرِ الْأَنْصَارَ وَالْمُهَاجِرَه ‘হে আল্লাহ! নিশ্চয় আরাম হল পরকালের আরাম। অতএব তুমি আনছার ও মুহাজিরদের ক্ষমা কর’ (বুখারী হা/২৮৩৪)।
[3]. প্রসিদ্ধ আছে যে, (১) নু‘মান বিন বাশীর (রাঃ)-এর বোন তার পিতা ও মামুর খাওয়ার জন্য একটা পাত্রে কিছু খেজুর নিয়ে এলো। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার কাছ থেকে পাত্রটি নিয়ে খেজুরগুলি একটা কাপড়ের উপরে ছড়িয়ে দিলেন। অতঃপর পরিখা খননরত সাহাবীদের সবাইকে দাওয়াত দিলেন এবং তাতে বরকতের দো‘আ করলেন। অতঃপর সাহাবীগণ যতই খেতে থাকেন, ততই খেজুরের পরিমাণ বাড়তে থাকে। পূর্ণ তৃপ্তি সহকারে সকলের খাওয়ার পরেও কাপড়ের উপর আগের পরিমাণ খেজুর অবশিষ্ট রইল। এমনকি কাপড়ের বাইরেও কিছু পড়ে ছিল’ (আর-রাহীক্ব ৩০৫ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/২১৮)। বর্ণনাটির সনদ ‘মুনক্বাতি‘ বা যঈফ (মা শা-‘আ ১৬৩ পৃঃ)। (২) পরিখা খননের সময় একটি স্থানের মাটি অত্যন্ত শক্ত পাওয়া যায়। এ বিষয়ে রাসূল (সাঃ)-এর দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি এক পাত্র পানি আনতে বলেন এবং তাতে দো‘আ পড়ে ফুঁক দেন। অতঃপর তিনি উক্ত পানি ঐ শক্ত মাটির উপরে ছিটিয়ে দেন। তখন খননরত সাহাবীগণ বলেন, যে আল্লাহ তাঁকে সত্য নবী করে পাঠিয়েছেন, তাঁর কসম করে বলছি, ঐ মাটিগুলি বালুর ঢিবির মত সরল হয়ে যায়’ (ইবনু হিশাম ২/২১৭)। এটিরও সনদ ‘মুনক্বাতি‘।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন