বৃহস্পতিবার, ৯ অক্টোবর, ২০২৫

আনছারগণের বিমর্ষতা ও রাসূল (সাঃ)-এর ভাষণ

 

আনছারগণের বিমর্ষতা ও রাসূল (সাঃ)-এর ভাষণ

মক্কার নওমুসলিমদের মধ্যে গণীমতের বৃহদাংশ বণ্টন করে দেওয়ায় আনছারদের মধ্যে কিছুটা বিমর্ষভাব দেখা দেয়। কেউ কেউ বলে ফেলেন,لَقِيَوَاللهِ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَوْمَهُ ‘আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর কওমের সাথে মিশে গেছেন’। কেউ বলেন,إِذَا كَانَتْ شَدِيْدَةٌ فَنَحْنُ نُدْعَى وَيُعْطَى الْغَنِيْمَةَ غَيْرُنَا ‘যখন কঠিন সময় আসে, তখন আমাদের ডাকা হয়। আর গণীমত দেওয়া হয় অন্যদের’ (বুখারী হা/৪৩৩৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে,يُعْطِى قُرَيْشًا وَيَتْرُكُنَا، وَسُيُوفُنَا تَقْطُرُ مِنْ دِمَائِهِمْ ‘তিনি কুরায়েশদের দিচ্ছেন ও আমাদেরকে পরিত্যাগ করছেন। অথচ আমাদের তরবারী থেকে তাদের রক্ত টপকাচ্ছে’ (বুখারী হা/৪৩৩১)।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহর মাধ্যমে এ খবর জানতে পেরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দ্রুত তাদের কাছে গমন করেন এবং সমবেত আনছারদের উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে হামদ ও ছানার পরে বলেন,يَا مَعْشَرَ الْأَنْصَارِ مَقَالَةٌ بَلَغَتْنِيْ عَنْكُمْ وَجِدَةٌ وَجَدْتُمُوْهَا عَلَيَّ فِيْ أَنْفُسِكُمْ ‘হে আনছারগণ! তোমাদের কিছু কথা আমার নিকট পৌঁছেছে। তোমাদের অন্তরে আমার বিরুদ্ধে কিছু অসন্তুষ্টি দানা বেঁধেছে’ (আহমাদ হা/১১৭৪৮)।يَا مَعْشَرَ الأَنْصَارِ أَلَمْ أَجِدْكُمْ ضُلاَّلاً فَهَدَاكُمُ اللهُ بِى، وَكُنْتُمْ مُتَفَرِّقِينَ فَأَلَّفَكُمُ اللهُ بِى، وَعَالَةً فَأَغْنَاكُمُ اللهُ بِى؟ ‘হে আনছারগণ! আমি কি তোমাদের নিকটে এমন অবস্থায় আসিনি যখন তোমরা পথভ্রষ্ট ছিলে? অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে সুপথ প্রদর্শন করেন। তোমরা ছিলে বিভক্ত, অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদের মধ্যে ভালবাসা সৃষ্টি করে দেন। তোমরা ছিলে অভাবগ্রস্ত, অতঃপর আল্লাহ আমার মাধ্যমে তোমাদেরকে সচ্ছলতা দান করেন’ (বুখারী হা/৪৩৩০)।

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় আরও এসেছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেন, যখন তোমরা পরস্পরে শত্রু ছিলে, অতঃপর আল্লাহ তোমাদের মাঝে ভালোবাসা সৃষ্টি করে দেন’? তারা বললেন, হ্যাঁ। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, হে আনছারগণ! তোমরা কি জবাব দিবে না? তারা বললেন, আমরা আর কি জবাব দেব হে আল্লাহর রাসূল! এসবই তো আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুগ্রহ। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, দেখ তোমরা ইচ্ছা করলে একথাও বলতে পার এবং সেটা বললে তোমরা অবশ্য সত্য কথাই বলবে- সেটা এই যে,أَتَيْتَنَا مُكَذَّباً فَصَدَّقْنَاكَ وَمَخْذُولاً فَنَصَرْنَاكَ وَطَرِيداً فَآوَيْنَاكَ وَعَائِلاً فَآسَيْنَاكَ ‘আপনি আমাদের কাছে এসেছিলেন এমন সময় যখন আপনাকে মিথ্যাবাদী বলা হচ্ছিল। অতঃপর আমরা আপনাকে সত্য বলে জেনেছি। যখন আপনি ছিলেন অপদস্থ, তখন আমরা আপনাকে সাহায্য করেছি। যখন আপনি ছিলেন বিতাড়িত, তখন আমরা আপনাকে আশ্রয় দিয়েছি। যখন আপনি ছিলেন অভাবগ্রস্ত, তখন আমরা আপনার প্রতি সহানুভূতি দেখিয়েছি’।
অতঃপর তিনি বলেন,أَوَجَدْتُمْ يَا مَعْشَرَ الْأَنْصَارِ فِيْ أَنْفُسِكُمْ فِيْ لُعَاعَةٍ مِنَ الدُّنْيَا تَأَلَّفْتُ بِهَا قَوْمًا لِيُسْلِمُوْا، وَوَكَلْتُكُمْ إلَى إسْلاَمِكُمْ ‘হে আনছারগণ! দুনিয়ার এক গোছা ঘাসের জন্য তোমরা মনে কষ্ট নিয়েছ, যার মাধ্যমে আমি লোকদের হৃদয়ে আকর্ষণ সৃষ্টি করতে চেয়েছি, যাতে তারা অনুগত হয়। আর তোমাদেরকে সোপর্দ করেছি তোমাদের ইসলামের নিকট (অর্থাৎ তোমাদের জন্য ইসলামই যথেষ্ট)।أَلاَ تَرْضَوْنَ يَا مَعْشَرَ الْأَنْصَارِ أَنْ يَذْهَبَ النّاسُ بِالشّاةِ وَالْبَعِيْرِ وَتَرْجِعُوْا بِرَسُوْلِ اللهِ إلَى رِحَالِكُمْ؟ ‘হে আনছারগণ! তোমরা কি এতে রাজি নও যে, লোকেরা বকরী ও উট নিয়ে চলে যাক, আর তোমরা আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে তোমাদের কাফেলায় ফিরে যাও?أَلاَ تَرْضَوْنَ أَنْ يَذْهَبَ النّاسُ بِالدُّنْيَا، وَتَذْهَبُوْنَ بِرَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ وَتَحُوْزُوْنَهُ إِلَى بُيُوْتِكُمْ؟ ‘তোমরা কি এতে খুশী নও যে, লোকেরা দুনিয়া নিয়ে চলে যাক। আর তোমরা আল্লাহর রাসূলকে নিয়ে চলে যাও ও তাঁকে তোমাদের বাড়ীতে আশ্রয় দাও?’ ‘অতএব সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে রয়েছে মুহাম্মাদের জীবন, যদি হিজরত না থাকত, তাহলে আমি হতাম আনছারদের একজন। যদি লোকেরা বিভিন্ন গোত্র বেছে নেয়, তবে আমি আনছারদের গোত্রে প্রবেশ করব’।اللَّهُمَّ ارْحَمِ الْأَنْصَارَ، وَأَبْنَاءَ الْأَنْصَارِ، وَأَبْنَاءَ أَبْنَاءِ الْأَنْصَارِ ‘হে আল্লাহ! তুমি আনছারদের উপরে রহম কর। আনছারদের সন্তানদের উপর রহম কর এবং তাদের সন্তানদের সন্তানগণের উপর রহম কর’।
রাসূল (সাঃ)-এর উক্ত হৃদয়স্পর্শী ভাষণ শুনে কাঁদতে কাঁদতে সকলের দাড়ি ভিজে গেল এবং তারা সবাই বলে উঠল, رَضِيْنَا بِرَسُوْلِ اللهِ قَسْمًا وَحَظًّا ‘আমরা সবাই আল্লাহর রাসূলের ভাগ-বণ্টনে সন্তুষ্ট’ (আহমাদ হা/১১৭৪৮ সনদ হাসান)।


গণীমত বণ্টনে অসন্তুষ্ট ব্যক্তিগণ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(১) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন, এ সময় বনু তামীম গোত্রের নওমুসলিম বেদুঈন হুরকূছ বিন যুহায়ের যুল-খুইয়াইছিরাহ(حُرقُوصُ بنُ زُهَيْر ذُو الْخُوَيْصِرَةِ) নামক জনৈক ন্যাড়ামুন্ড ঘন দাড়িওয়ালা ব্যক্তি বলে উঠে, يَا مُحَمَّدُ اعْدِلْ. قَالَ: وَيْلَكَ وَمَنْ يَعْدِلُ إِذَا لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ، لَقَدْ خِبْتَ وَخَسِرْتَ إِنْ لَمْ أَكُنْ أَعْدِلُ ‘হে মুহাম্মাদ! ন্যায় বিচার করুন! জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমার ধ্বংস হৌক! যদি আমি ন্যায় বিচার না করি, তবে কে ন্যায় বিচার করবে? যদি আমি ন্যায় বিচার না করি, তাহলে তুমি নিরাশ হবে ও ক্ষতিগ্রস্ত হবে’। তখন উমর (রাঃ) দাঁড়িয়ে বললেন,دَعْنِى يَا رَسُولَ اللهِ فَأَقْتُلَ هَذَا الْمُنَافِقَ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে ছেড়ে দিন, এই মুনাফিকটার গর্দান উড়িয়ে দিই। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন,مَعَاذَ اللهِ أَنْ يَتَحَدَّثَ النَّاسُ أَنِّى أَقْتُلُ أَصْحَابِى إِنَّ هَذَا وَأَصْحَابَهُ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ يَمْرُقُونَ مِنْهُ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ ‘আল্লাহর নিকট পানাহ চাই! লোকেরা বলবে, আমি আমার সাথীদের হত্যা করছি। নিশ্চয় এই ব্যক্তি ও তার সাথীরা কুরআন তেলাওয়াত করে। যা তাদের কণ্ঠনালি অতিক্রম করে না। তারা সেখান থেকে বেরিয়ে যায়, যেমন ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে যায়’ (মুসলিম হা/১০৬৩ (১৪২)।
ইবনু হাজার বলেন, ঐ ব্যক্তি দু’বার এরূপ কথা বলে। একবার হোনায়েনের গণীমত বণ্টনের সময়। দ্বিতীয়বার হোনায়েনের পর ইয়ামন থেকে আলী (রাঃ) প্রেরিত স্বর্ণ বণ্টনের সময়’।[ফাৎহুল বারী হা/৪৩৫১; সীরাহ সহীহাহ ২/৫১৪-টীকা]

(২) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, ইয়ামন থেকে আলী (রাঃ) প্রেরিত অপরিশোধিত স্বর্ণ টুকরাটি রাসূল (সাঃ) নাজদের চার নেতার মধ্যে ভাগ করে দেন। তারা হলেন, আক্বরা‘ বিন হাবেস আল-হানযালী, উয়ায়না বিন হিছন আল-ফাযারী, আলক্বামা বিন উলাছাহ আল-‘আমেরী এবং যায়েদ আল-খায়ের আত-ত্বাঈ। এতে কুরায়েশরা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, আপনি নাজদের নেতাদের দিচ্ছেন, আর আমাদের বঞ্চিত করছেন। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন,إِنِّى إِنَّمَا فَعَلْتُ ذَلِكَ لِأَتَأَلَّفَهُمْ ‘আমি এটা করছি তাদেরকে আকৃষ্ট করার জন্য’। এসময় একজন ন্যাড়ামুন্ডু ঘন দাড়িওয়ালা ব্যক্তি এসে বলল,اِتَّقِ اللهَ يَا مُحَمَّدُ ‘হে মুহাম্মাদ! আল্লাহকে ভয় কর’।... রাসূল (সাঃ) বললেন,إِنَّ مِنْ ضِئْضِئِ هَذَا قَوْمًا يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ يَقْتُلُونَ أَهْلَ الإِسْلاَمِ وَيَدَعُونَ أَهْلَ الأَوْثَانِ يَمْرُقُونَ مِنَ الإِسْلاَمِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ لَئِنْ أَدْرَكْتُهُمْ لأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ عَادٍ ‘এ ব্যক্তির ঔরস থেকে একদল লোক বের হবে, যারা কুরআন তেলাওয়াত করবে। যা তাদের কণ্ঠনালি অতিক্রম করবে না। তারা মুসলমানদের হত্যা করবে এবং মূর্তিপূজারীদের ছেড়ে দিবে। তারা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে এমনভাবে, যেমন ধনুক থেকে তীর বেরিয়ে যায়। যদি আমি তাদের পাই, তাহলে আমি অবশ্যই তাদের হত্যা করব, ‘আদ কওমকে হত্যা করার ন্যায়’ (মুসলিম হা/১০৬৪)। একই রাবী থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে,يَتْلُونَ كِتَابَ اللهِ رَطْبًا،... لَئِنْ أَدْرَكْتُهُمْ لأَقْتُلَنَّهُمْ قَتْلَ ثَمُودَ ‘যারা সুন্দরভাবে কুরআন তেলাওয়াত করবে।... যদি আমি তাদের পাই, তাহলে আমি অবশ্যই তাদের হত্যা করব, ছামূদ কওমকে হত্যা করার ন্যায়’ (বুখারী হা/৪৩৫১)।
ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, আক্বরা বিন হাবেস ও অন্যান্য নেতাদের বেশী বেশী উট দেওয়ায় আনছারের জনৈক (মুনাফিক) ব্যক্তি রাসূল (সাঃ)-কে ইঙ্গিত করে বলে,مَا أَرَادَ بِهَا وَجْهَ اللهِ ‘এর দ্বারা তিনি আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করেননি’। একথা জানতে পেরে রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। যাতে তাঁর চেহারা পরিবর্তিত হয়ে যায়। অতঃপর তিনি বলেন,رَحِمَ اللهُ مُوسَى قَدْ أُوذِىَ بِأَكْثَرَ مِنْ هَذَا فَصَبَرَ ‘আল্লাহ মূসার প্রতি রহম করুন! এর চাইতে তাঁকে বেশী কষ্ট দেওয়া হয়েছিল। এরপরেও তিনি ছবর করেছিলেন’ (বুখারী হা/৩১৫০, ৪৩৩৫)।

(৩) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) আরও বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি যে,يَخْرُجُ فِى هَذِهِ الأُمَّةِ- وَلَمْ يَقُلْ مِنْهَا- قَوْمٌ تَحْقِرُونَ صَلاَتَكُمْ مَعَ صَلاَتِهِمْ، و فى رواية : يَحْقِرُ أَحَدُكُمْ صَلاَتَهُ مَعَ صَلاَتِهِمْ وَصِيَامَهُ مَعَ صِيَامِهِمْ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ تَرَاقِيَهُمْ يَمْرُقُونَ مِنَ الْإِسْلاَمِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ ‘এই উম্মতের মধ্যে (তিনি বলেননি, মধ্য হতে। অর্থাৎ তারা মুসলিম নামেই থাকবে) এমন এক দল লোক বের হবে, তাদের সালাতের সাথে তোমরা নিজেদের সালাতকে হীন মনে করবে। ‘তোমাদের কেউ নিজেদের সালাতকে তাদের সালাতের সঙ্গে এবং তোমাদের সিয়ামকে তাদের সিয়ামের সঙ্গে তুলনা করলে তোমাদের নিজেদের সিয়াম ও সালাতকে তুচ্ছ জ্ঞান করবে। তারা কুরআন তেলাওয়াত করবে। কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা ইসলাম থেকে এমনভাবে বের হয়ে যাবে, যেমন ধনুক হতে তীর বের হয়ে যায়’ (মুসলিম হা/১০৬৪ (১৪৭-৪৮)।

(৪) আলী (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সাঃ) বলেন,سَيَخْرُجُ فِى آخِرِ الزَّمَانِ قَوْمٌ أَحْدَاثُ الْأَسْنَانِ سُفَهَاءُ الْأَحْلاَمِ يَقُولُونَ مِنْ خَيْرِ قَوْلِ الْبَرِيَّةِ يَقْرَءُونَ الْقُرْآنَ لاَ يُجَاوِزُ حَنَاجِرَهُمْ، يَمْرُقُونَ مِنَ الدِّينِ كَمَا يَمْرُقُ السَّهْمُ مِنَ الرَّمِيَّةِ فَإِذَا لَقِيتُمُوهُمْ فَاقْتُلُوهُمْ فَإِنَّ فِى قَتْلِهِمْ أَجْرًا لِمَنْ قَتَلَهُمْ عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘আখেরী যামানায় একদল তরুণ বয়সী বোকা লোক বের হবে, যারা পৃথিবীর সবচাইতে সুন্দর কথা বলবে। তারা কুরআন তেলাওয়াত করবে, কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা কুরআন তেলাওয়াত করবে। কিন্তু তা তাদের কণ্ঠনালী অতিক্রম করবে না। তারা দ্বীন থেকে দ্রুত বেরিয়ে যাবে, যেমন ধনুক হতে তীর বের হয়ে যায়। যখন তোমরা তাদের পাবে, তখন তাদের হত্যা করবে। কেননা এদের হত্যাকারীর জন্য আল্লাহর নিকটে ক্বিয়ামতের দিন বিশেষ পুরস্কার রয়েছে’ (মুসলিম হা/১০৬৬ (১৫৪)। এই হত্যা সরকারী আদালতের মাধ্যমে হতে হবে (ঐ, শরহ নববী, মর্মার্থ)।
যুল-খুইয়াইছিরাকে পরবর্তীতে আলী (রাঃ)-এর খেলাফতকালে (৩৫-৪১ হিঃ) সৃষ্ট চরমপন্থী দল ‘খারেজীদের মূল’(أَصْلُ الْخَوَارِجِ) বলা হয় (কুরতুবী, সূরা তওবা ৫৮ আয়াতের ব্যাখ্যা)।
এসব মুনাফিকদের সম্পর্কে নাযিল হয়,وَمِنْهُمْ مَنْ يَلْمِزُكَ فِي الصَّدَقَاتِ فَإِنْ أُعْطُوا مِنْهَا رَضُوا وَإِنْ لَمْ يُعْطَوْا مِنْهَا إِذَا هُمْ يَسْخَطُونَ- وَلَوْ أَنَّهُمْ رَضُوا مَا آتَاهُمُ اللهُ وَرَسُولُهُ وَقَالُوا حَسْبُنَا اللهُ سَيُؤْتِينَا اللهُ مِنْ فَضْلِهِ وَرَسُولُهُ إِنَّا إِلَى اللهِ رَاغِبُونَ ‘আর তাদের মধ্যে এমন কিছু লোক আছে, যারা ছাদাক্বা বণ্টনের ব্যাপারে তোমার প্রতি দোষারোপ করে। যদি তাদেরকে ছাদাক্বা থেকে কিছু দেওয়া হয়, তাহলে খুশী হয়। আর যদি না দেওয়া হয়, তাহলে তারা ক্রুদ্ধ হয়’। ‘কতই না ভাল হত যদি তারা সন্তুষ্ট হত আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তাদেরকে যা দিয়েছেন তার উপরে এবং বলত, আল্লাহ আমাদের জন্য যথেষ্ট। সত্বর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল আমাদেরকে তাঁর অনুগ্রহ থেকে দান করবেন। আর আমরা আমাদের পালনকর্তার প্রতি নিরত হলাম’ (তওবা ৯/৫৮-৫৯)। যুগে যুগে ইসলামের নামে সরকার বিরোধী যত সশস্ত্র চরমপন্থী দলের উদ্ভব ঘটেছে, সবগুলিই হল সেদিনকার রাসূল বিরোধী ও পরে আলী বিরোধী চরমপন্থীদের উত্তরসূরী।


হাওয়াযেন প্রতিনিধি দলের আগমন ও বন্দীদের ফেরৎ দান :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
গণীমত বণ্টন সম্পন্ন হবার পর যোহায়ের বিন ছুরাদ(زُهَيْرُ بْنُ صُرَدٍ) এর নেতৃত্বে হাওয়াযেন গোত্রের ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল মুসলমান অবস্থায় আগমন করে। এই দলে রাসূল (সাঃ)-এর দুধ চাচা আবু বুরক্বান(أبو بُرْقَان) ছিলেন। তাঁরা অনুরোধ করলেন যে, অনুগ্রহ পূর্বক তাদের বন্দীদের ও মাল-সম্পদাদি ফেরৎ দেওয়া হৌক’। তাদের কথা-বার্তায় এতই কাকুতি-মিনতি ছিল যে, হৃদয় গলে যায়। তাদের বক্তব্য মতে বন্দীনীদের মধ্যে রাসূল (সাঃ)-এর দুগ্ধ সম্পর্কিত খালা-ফুফুরাও ছিলেন। যাদের বন্দী রাখা ছিল নিতান্ত অবমাননাকর বিষয়।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কার ও অন্যান্য গোত্রের নও মুসলিমদের প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন,إِنَّ مَعِى مَنْ تَرَوْنَ،... فَأَبْنَاؤُكُمْ وَنِسَاؤُكُمْ أَحَبُّ إِلَيْكُمْ أَمْ أَمْوَالُكُمْ؟ ‘আমার সঙ্গে যারা আছে, তোমরা তো তাদের দেখতেই পাচ্ছ’ (অর্থাৎ মাল-সম্পদ তারা ফেরৎ দিবে না)।... এক্ষণে তোমাদের সন্তানাদি ও নারীগণ তোমাদের নিকটে অধিক প্রিয়, না তোমাদের ধন-সম্পদ’? জবাবে তারা বললেন,مَا كُنّا نَعْدِلُ بِالْأَحْسَابِ شَيْئًا ‘আমরা কোন কিছুকেই আমাদের বংশ মর্যাদার তুলনীয় মনে করি না’। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের বললেন, যোহরের জামা‘আত শেষে তোমরা দাঁড়িয়ে বলবে, ‘আমরা রাসূল (সাঃ)-কে মুমিনদের নিকটে এবং মুমিনদেরকে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে সুফারিশকারী বানাচ্ছি আমাদের বন্দীদের আমাদের নিকটে ফিরিয়ে দেবার জন্য’।
রাসূল (সাঃ)-এর কথামত তারা যোহরের সালাত শেষে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে উক্ত অনুরোধ পেশ করল। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, আমার ও বনু আব্দুল মুত্ত্বালিবের অংশে যা আছে, সবই তোমাদের। এক্ষণে আমি তোমাদের জন্য লোকদের নিকটে সওয়াল করছি (سَأَسْأَلُ لَكُمُ النَّاسَ)। তখন মুহাজির ও আনছারগণ বললেন, আমাদের অংশের সবকিছু আমরা রাসূলকে দিয়ে দিলাম’। এবার আক্বরা বিন হাবিস বললেন, আমার ও বনু তামীমের অংশ দিলাম না’। একইভাবে উয়ায়না বিন হিছ্ন বললেন, আমার ও বনু ফাযারাহর অংশও নয়’। আববাস বিন মিরদাস বললেন, আমার ও বনু সুলায়েম-এর অংশও নয়’। কিন্তু তার গোত্র বনু সোলায়েম বলে উঠল, না আমাদের অংশের সবটুকু আমরা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে দিয়ে দিলাম’। মিরদাস তখন তার গোত্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন,وَهَنْتُمُوْنِيْ ‘তোমরা আমাকে অপদস্থ করলে’?
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সকলের উদ্দেশ্যে বললেন, ‘দেখ এই লোকগুলি মুসলমান হয়ে এখানে এসেছে। উক্ত উদ্দেশ্যেই আমি তাদের বন্দী বণ্টনে দেরী করেছিলাম। আমি তাদেরকে এখতিয়ার দিয়েছিলাম। কিন্তু তারা কোন কিছুকেই তাদের বন্দীদের সমতুল্য মনে করেনি। অতএব যার নিকটে বন্দীদের কেউ রয়েছে সন্তুষ্টচিত্তে তাকে ফেরত দিলে সেটাই উত্তম পন্থা হবে। আর যদি কেউ আটকে রাখে, তবে সেটা তার এখতিয়ার। তবে যদি সে ফেরৎ দেয়, তবে আগামীতে অর্জিত প্রথম গণীমতে তাকে একটির বিনিময়ে ছয়টি অংশ দেওয়া হবে’ (আবুদাঊদ হা/২৬৯৪)। একথা শুনে লোকেরা সমস্বরে বলে উঠলো, قَدْ طَيِّبْنَا ذَلِكَ لِرَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ ‘আমরা রাসূল (সাঃ)-এর জন্য সবকিছুই হৃষ্টচিত্তে ফেরত দিতে প্রস্তুত আছি’। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমরা কে কে রাজি ও কে কে রাজি নও, সেটা আমি ঠিক বুঝতে পারছি না। অতএব তোমরা ফিরে যাও এবং তোমাদের দলনেতাদের মাধ্যমে আমাদেরকে জানিয়ে দাও’ (বুখারী হা/২৩০৭; আবুদাঊদ হা/২৬৯৩)। তখন সবাই তাদের বন্দী নারী-শিশুদের ফেরত দিল। কেবল বনু ফাযারাহ নেতা উয়ায়না বিন হিছ্ন বাকী রইল। তার অংশে একজন বৃদ্ধা মহিলা ছিল। পরে তিনি তাকে ফিরিয়ে দেন। এইভাবে ৬,০০০ যুদ্ধবন্দীর সবাই মুক্তি পেয়ে যায়। মুক্তি দানের সময় প্রত্যেক বন্দীকে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) একটি করে মূল্যবান ক্বিবতী চাদর উপহার দেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৪১৮; আর-রাহীক্ব ৪২২ পৃঃ)। রাসূল (সাঃ)-এর এই উদারনীতি ছিল তৎকালীন সময়ে একটি অনন্য সাধারণ ঘটনা এবং সে সময়ের যুদ্ধনীতিতে একটি মৌলিক পরিবর্তনের সূচনা।


ওমরাহ পালন ও মদীনায় প্রত্যাবর্তন :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
জি‘ইর্রানাহতে গণীমত বণ্টন সম্পন্ন হওয়ার পর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ওমরাহ পালনের জন্য ইহরাম বাঁধেন (যা মক্কা থেকে ২০ কি.মি. উত্তর-পূর্বে অবস্থিত)। অতঃপর মক্কা গমন করে ওমরাহ পালন করেন। অতঃপর আত্তাব বিন আসীদকে মক্কার প্রশাসক হিসাবে বহাল রেখে তিনি মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। এ সময় ছাক্বীফ নেতা ওরওয়া বিন মাসঊদ পথিমধ্যে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে ইসলাম কবুল করেন’ (সীরাহ সহীহাহ ২/৫১৭)।
এভাবে ৮ম হিজরীর ১০ই রামাযান মদীনা থেকে মক্কা বিজয়ের উদ্দেশ্যে বের হয়ে মক্কা, হোনায়েন ও ত্বায়েফ বিজয় শেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দীর্ঘ ২ মাস ১৪ দিন পর ২৪শে যুলক্বা‘দাহ মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন। ফালিল্লাহিল হাম্দ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...