প্রতিনিধি দল পর্ব-২
১১. হামদান প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━
হামদান ইয়ামনের একটি গোত্রের নাম। যাদের প্রতিনিধি দল তাবূক অভিযানের পর অর্থাৎ ৯ম হিজরীর শেষ দিকে মদীনায় আসে। ইতিপূর্বে তাদেরকে ইসলামের দাওয়াত দেবার জন্য খালেদ বিন অলীদকে পাঠানো হয়। তিনি দীর্ঘ ছয় মাস সেখানে অবস্থান করা সত্ত্বেও কেউ ইসলাম গ্রহণ করেনি। তখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) একটি পত্রসহ আলী (রাঃ)-কে প্রেরণ করেন এবং খালেদকে প্রত্যাহার করে নেন। হযরত আলী (রাঃ) তাদের নিকটে রাসূল (সাঃ)-এর পত্রটি পড়ে শুনান এবং তাদেরকে ইসলামের প্রতি দাওয়াত দেন। ফলে তাঁর দাওয়াতে এক দিনেই গোত্রের সমস্ত লোক ইসলাম কবুল করে। এই সুসংবাদ জানিয়ে আলী (রাঃ)-এর প্রেরিত পত্র পাঠ করে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) খুশীতে ‘সিজদায়ে শুক্র’ আদায় করেন এবং সিজদা থেকে উঠে তাঁর যবান মুবারক থেকে বেরিয়ে যায়,السَّلاَمُ عَلَى هَمْدَانَ السَّلاَمُ عَلَى هَمْدَانَ ‘হামদানবাসীদের উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক, হামদানবাসীদের উপরে শান্তি বর্ষিত হৌক’!(যাদুল মা‘আদ ৩/৫৪৪; বুখারী হা/৪৩৪৯)
হযরত আলীর নিকটে ইসলাম কবুলের পর হামদান গোত্রের একটি প্রতিনিধি দল রাসূল (সাঃ)-এর দর্শন লাভের জন্য মালেক বিন নামাত্বের(مَالكُ بْنُ النَّمَطِ) নেতৃত্বে মদীনায় আসে। তিনি অত্যন্ত আগ্রহের সাথে রাসূল (সাঃ)-এর সম্মুখে কবিতা পাঠ করেন।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মালেক বিন নামাত্বকে উক্ত কওমের নেতা নিযুক্ত করেন ও তাদের নিকটে পত্র প্রেরণ করেন।[যাদুল মা‘আদ ৩/৫৪৪; ইবনু হিশাম ২/৫৯৭]
[শিক্ষণীয় : যারা বলেন, ইসলাম তরবারির জোরে প্রসার লাভ করেছে, তারা বিষয়টি লক্ষ্য করুন। হামদানের লোকদের ইসলামের পথে আনার জন্য খালেদের তরবারিই যথেষ্ট ছিল। কিন্তু ছয় মাসেও তিনি তা ব্যবহার করেননি। অবশেষে হযরত আলীর উপদেশ তাদের মনের মধ্যে পরিবর্তন এনে দেয়। প্রকৃত অর্থে দাওয়াতের মাধ্যমেই ইসলাম প্রসার লাভ করেছে এবং ভবিষ্যতেও করবে ইনশাআল্লাহ।]
১২. মুযায়নাহ প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
নু‘মান বিন মুক্বার্রিন বলেন, আমরা মুযায়নাহ গোত্রের ৪০০ লোক নিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হই। অতঃপর যখন আমরা ফিরে আসি, তখন রাসূল (সাঃ) বললেন,يَا عُمَرُ زَوِّدِ الْقَوْمَ ‘হে উমর! ওদেরকে পাথেয় দাও’। উমর বললেন, আমার কাছে খেজুর ব্যতীত কিছু্ই নেই। রাসূল (সাঃ) পুনরায় বললেন,انْطَلِقْ فَزَوّدْهُمْ ‘যাও ওদেরকে পাথেয় দাও’। তখন উমর গেলেন এবং তাদেরকে তার বাড়ীর ছাদে উঠালেন। দেখা গেল সেখানে উটের বোঝার ন্যায় বড় বড় খেজুরের স্তূপ রয়েছে। তারা সেখান থেকে তাদের প্রয়োজন মত নিয়ে নিল। নু‘মান বলেন, আমি সবশেষে বের হই এবং দেখি যে, পূর্বের একটি খেজুরও তার স্থান থেকে হারিয়ে যায়নি’।[যাদুল মা‘আদ ৩/৫৪৫; আহমাদ হা/২৩৭৯৭]
[শিক্ষণীয় : (১) মেহমানকে সর্বাবস্থায় সম্মান করতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে পাথেয় দিতে হবে। (২) সৎ নিয়ত থাকলে আল্লাহ বান্দাকে সাহায্য করে থাকেন। যেমন আল্লাহ উমরকে সাহায্য করলেন। (৩) এটি রাসূল (সাঃ)-এর দো‘আর বরকত এবং অপারগ হওয়া সত্ত্বেও আমীরের নির্দেশ মেনে নেওয়ার নগদ ইলাহী পুরস্কার। (৪) এটি রাসূল (সাঃ)-এর অন্যতম মু‘জিযা।]
১৩. দাউস প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━
ইয়ামনের পার্শ্ববর্তী এলাকায় ছিল এই গোত্রের বসবাস। প্রথমে ১০ম নববী বর্ষে দাউস গোত্রের নেতা ও বিখ্যাত কবি তোফায়েল বিন আমর মক্কায় যান। মক্কাবাসীরা শহরের বাইরে এসে তাকে অভ্যর্থনা জানায় এবং তাদের ধারণা মতে জাদুগ্রস্ত (?) মুহাম্মাদ-এর কাছে যেতে তাকে নিষেধ করে। কিন্তু তিনি একদিন খুব ভোরে কা‘বাগৃহে যান ও রাসূল (সাঃ)-কে পেয়ে যান। তিনি তাঁর মুখে কুরআন শুনে মুগ্ধ হন এবং ইসলাম কবুল করেন’। অতঃপর তিনি ফিরে গিয়ে তার কওমকে দ্বীনের দাওয়াত দিতে থাকেন। কিন্তু তার কওমে যেনা-ব্যভিচার বৃদ্ধি পাওয়ায় দীর্ঘদিন দাওয়াত দিয়ে কোন ফল না পেয়ে এক পর্যায়ে তিনি নিরাশ হয়ে পড়েন এবং রাসূল (সাঃ)-কে তার কওমের বিরুদ্ধে বদ দো‘আ করার আবেদন জানান। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের জন্য হেদায়াতের দো‘আ করে বলেন,اللهُمَّ اهْدِ دَوْسًا وَائْتِ بِهِمْ ‘হে আল্লাহ! তুমি দাউস কওমকে সুপথ প্রদর্শন কর এবং তাদেরকে (মুসলমান করে) নিয়ে এসো’।[বুখারী হা/২৯৩৭; মুসলিম হা/২৫২৪]
অতঃপর আমাকে বলেন, তুমি তোমার কওমের নিকট ফিরে যাও এবং তাদেরকে আল্লাহর পথে আহবান কর ও তাদের সাথে নম্র ব্যবহার কর। আমি তাই করলাম। ফলে সত্বর আমার গোত্রের লোকেরা ইসলাম কবুল করল এবং ৭০ অথবা ৮০ জনের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ৭ম হিজরীর প্রথম দিকে আমি মদীনায় এলাম। কিন্তু ঐ সময়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) খায়বর অভিযানে থাকায় আমরা খায়বরে চলে যাই এবং রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করি’ (ইবনু হিশাম ১/৩৮৪-৮৫; যাদুল মা‘আদ ৩/৫৪৬)। এই দলেই ছিলেন পরবর্তীতে শ্রেষ্ঠতম হাদীছজ্ঞ সাহাবী আবু হুরায়রা (রাঃ)। যদি সেদিন রাসূল (সাঃ) বদ দো‘আ করতেন, আর দাউস কওম ধ্বংস হয়ে যেত, তাহলে আবু হুরায়রার মত সাহাবীর খিদমত থেকে মুসলিম উম্মাহ বঞ্চিত হয়ে যেত। অতএব ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য’ আলহামদুলিল্লাহ।
[শিক্ষণীয় : দ্বীনের দাওয়াতে দ্রুত ফল লাভের আশা করা যাবে না বা নিরাশ হওয়া যাবে না। ধৈর্য ধারণ করতে হবে। বদ দো‘আ না করে বরং সর্বদা লোকদের হেদায়াতের জন্য দো‘আ করা উচিত]
১৪. নাজরানের খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
নাজরান ৭৩টি পল্লী সমৃদ্ধ খ্রিষ্টানদের একটি বিরাট নগরীর নাম। বর্তমানে সড়কপথে এটি মদীনা থেকে দক্ষিণে ১২০৫ কি.মি. দূরে ইয়ামন সীমান্তে অবস্থিত। সেসময় একটি দ্রুতগামী ঘোড়ার পক্ষে উক্ত নগরী একদিনে পরিভ্রমণ করা সম্ভবপর ছিল না। উক্ত নগরীতে এক লক্ষ দক্ষ যোদ্ধা পুরুষ ছিলেন। নগরীটি মক্কা হতে ইয়ামনের দিকে সাত মনযিল দূরত্বে অবস্থিত ছিল। রাষ্ট্রনেতা, ধর্মনেতা, রাজনৈতিক নেতা, অর্থনৈতিক নেতা প্রভৃতি পদবীধারী দায়িত্বশীল নেতৃবৃন্দ দ্বারা নগরীটি পুরোদস্ত্তর একটি সুশৃংখল নগর-রাষ্ট্ররূপে সারা আরবে সুপরিচিত ছিল।
নাজরান প্রতিনিধি দলের মদীনায় আগমন সম্পর্কে হাদীছ সমূহে যেসকল বিবরণ এসেছে, তাতে মানছূরপুরীর বক্তব্য মতে দু’বার এই প্রতিনিধি দলের আগমন ঘটেছিল। প্রথমবার তিন জনের এবং পরের বার ৬০ জনের। দু’টি দলই সম্ভবতঃ অল্পদিনের ব্যবধানে ৯ম হিজরীতে মদীনায় এসেছিল এবং ইসলাম কবুল করা ছাড়াও রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সঙ্গে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছিল।
বায়হাক্বী দালায়েল-এর বর্ণনা মতে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নাজরানবাসীকে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে পত্র লেখেন।
مِنْ مُحَمَّدٍ رَسْوُلِ اللهِ إِلَى أَسْقُف نَجْرَان: إِنْ أَسْلَمْتُمْ فَإِنِّي أَحْمَدُ إِلَيْكُمْ إِلَهَ إِبْرَاهِيْمَ وَإِسْحَاقَ وَيَعْقُوبَ، أَمَّا بَعْدُ فَإِنِّي أَدْعُوكُمْ إِلَى عِبَادَةِ اللهِ مِنْ عِبَادَةِ الْعِبَادِ، وَأَدْعُوكُمْ إِلَى وِلَايَةِ اللهِ مِنْ وِلَايَةِ الْعِبَادِ، فَإِنْ أَبَيْتُمْ فَالْجِزْيَةُ، فَإِنْ أَبَيْتُمْ آذَنْتُكُمْ بِحَرْبٍ وَالسَّلاَمُ
‘আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ-এর পক্ষ হতে নাজরানের বিশপ-এর প্রতি- ‘যদি তোমরা ইসলাম কবুল কর, তাহলে আমি তোমাদের নিকট আল্লাহর প্রশংসা বর্ণনা করব, যিনি ইবরাহীম, ইসহাক ও ইয়াকূব-এর উপাস্য। অতঃপর আমি তোমাদেরকে মানুষের দাসত্ব হতে আল্লাহর দাসত্বের প্রতি এবং মানুষের বন্ধুত্ব হতে আল্লাহর বন্ধুত্বের প্রতি আহবান জানাচ্ছি। যদি তোমরা অস্বীকার কর, তাহলে জিযিয়া দিবে। যদি সেটাও অস্বীকার কর, তাহলে আমি তোমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দিচ্ছি। ওয়াসসালাম।[যাদুল মা‘আদ ৩/৫৪৯; আল-বিদায়াহ ৫/৫৩]
‘মুবাহালা’ (الْمُبَاهَلَةُ) :
‘মুবাহালা’ অর্থ পরস্পরকে ধ্বংসের অভিশাপ দিয়ে আল্লাহর নিকট বিনীতভাবে প্রার্থনা করা’। উপরে বর্ণিত পত্র পাওয়ার পর নাজরানদের ধর্মনেতা ‘বিশপ’ (الأُسْقُف) সকলের সঙ্গে আলোচনা করে তিনজন প্রতিনিধিকে রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে প্রেরণ করেন। তারা হলেন হামদান গোত্রের শুরাহবীল বিন ওয়াদা‘আহ হামদানী(شُرَحْبِيلُ بْنُ وَدَاعَة) হিমইয়ার গোত্রের আব্দুল্লাহ বিন শুরাহবীল আছবাহী এবং বনু হারেছ গোত্রের জাববার বিন ফায়েয হারেছী(جَبَّارُ بْنُ فَيْضٍ)। তারা মদীনায় গিয়ে কয়েকদিন অবস্থান করেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে হযরত ঈসা (আঃ) সম্পর্কে আলোচনা করেন। তারা পূর্ব থেকেই ত্রিত্ববাদে বিশ্বাসী ছিলেন এবং ঈসা ও মারিয়ামকে আল্লাহর বেটা ও স্ত্রী হিসাবে আল্লাহর সাথে শরীক করতেন। তাদের ধারণা ছিল মুহাম্মাদ (সাঃ) সত্যিকারের নবী হলে উক্ত ধারণায় বিশ্বাসী হবেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমরা কাল এসো। পরদিন সকালে নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়-
إِنَّ مَثَلَ عِيْسَى عِنْدَ اللهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِنْ تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُنْ فَيَكُوْنُ- الْحَقُّ مِنْ رَبِّكَ فَلاَ تَكُنْ مِّنَ الْمُمْتَرِيْنَ- فَمَنْ حَاجَّكَ فِيْهِ مِنْ بَعْدِ مَا جَاءَكَ مِنَ الْعِلْمِ فَقُلْ تَعَالَوْا نَدْعُ أَبْنَاءَنَا وَأَبْنَاءَكُمْ وَنِسَاءَنَا وَنِسَاءَكُمْ وَأَنْفُسَنَا وَأَنْفُسَكُمْ ثُمَّ نَبْتَهِلْ فَنَجْعَلْ لَّعْنَتَ اللهِ عَلَى الْكَاذِبِيْنَ- (آل عمران ৫৯-৬১)-
‘নিশ্চয়ই ঈসার দৃষ্টান্ত আল্লাহর নিকটে আদমের ন্যায়। তাকে তিনি সৃষ্টি করেন মাটি দিয়ে। অতঃপর বলেন, হয়ে যাও, তখন হয়ে গেল’ (৫৯)। ‘সত্য আসে তোমার প্রভুর পক্ষ হতে। অতএব তুমি সন্দেহবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না’ (৬০)। ‘অতঃপর যে ব্যক্তি তোমার সাথে তার (ঈসা) সম্পর্কে ঝগড়া করে তোমার নিকটে সঠিক জ্ঞান এসে যাওয়ার পরেও, তাকে তুমি বলে দাও, এসো আমরা ডাকি আমাদের সন্তানদের ও তোমাদের সন্তানদের, আমাদের স্ত্রীদের ও তোমাদের স্ত্রীদের এবং আমাদের নিজেদের ও তোমাদের নিজেদের। তারপর চল আমরা সবাই মিলে আল্লাহর নিকটে মিনতি ভরে প্রার্থনা করি। অতঃপর মিথ্যাবাদীদের প্রতি আমরা আল্লাহর অভিসম্পাত কামনা করি’ (আলে ইমরান ৩/৫৯-৬১)।
উক্ত আয়াতগুলি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) প্রতিনিধি দলকে শুনিয়ে দিলেন। অতঃপর তিনি হাসান, হোসায়েন ও তাদের মা ফাতেমাকে নিয়ে মুবাহালার জন্য বেরিয়ে এলেন। কোন কোন বর্ণনায় হযরত আলীর কথাও এসেছে। এর দ্বারা তিনি তাদের জানিয়ে দিতে চাইলেন যে, মুবাহালার জন্য তিনি এখুনি প্রস্তুত। যদিও প্রতিনিধি দলের পরিবার তাদের সাথে ছিল না।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এই দৃঢ় প্রত্যয় দেখে প্রতিনিধি দলের মধ্যে ভাবান্তর সৃষ্টি হল। তারা প্রথমদিন অস্বীকার করলেও পরের দিন রাতের বেলা একান্তে পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হল যে, মুবাহালা করে নিজেদের ধ্বংস ডেকে আনার চাইতে তাঁর অধীনতা স্বীকার করার মধ্যেই আমাদের জন্য মঙ্গল রয়েছে। অতএব সকালে এসে তারা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করে এবং সন্ধিচুক্তির আগ্রহ ব্যক্ত করে। অতঃপর নির্দিষ্ট পরিমাণ জিযিয়া কর দেবার শর্তে রাসূল (সাঃ) তাদের সাথে সন্ধিচুক্তি সম্পাদন করেন।
চুক্তিপত্রটি লেখেন হযরত মুগীরাহ বিন শো‘বা (রাঃ) এবং তাতে সাক্ষী হিসাবে নাম স্বাক্ষর করেন আবু সুফিয়ান ইবনু হারব (সাবেক কুরায়েশ নেতা), গায়লান বিন আমর, মালেক বিন ‘আওফ ও আক্বরা বিন হাবেস (রাঃ)।[1]
অতঃপর প্রতিনিধি দলটি নিজ গোত্রে ফিরে আসে। তাদেরকে অভ্যর্থনার জন্য বিশপের নেতৃত্বে একটি দল আগেই নগরীর বাইরে এসে গিয়েছিল। চুক্তিনামাটি বিশপের হাতে সমর্পণ করলে তা পড়ার জন্য তার চাচাতো ভাই আবু আলক্বামা বিশর বিন মু‘আবিয়া তার প্রতি ঝুঁকে পড়েন। তাতে তিনি উটের পিঠ থেকে নীচে পড়ে যান ও রাসূল (সাঃ)-কে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘ঐ ব্যক্তির মন্দ হৌক যিনি আমাকে এই কষ্ট দিলেন’। তখন বিশপ তাকে ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, তুমি কি বলছ হিসাব করে বলো। وَاللهِ إِنَّهُ نَبِيٌّ مُرْسَلٌ ‘আল্লাহর কসম! ইনি আল্লাহর প্রেরিত নবী’। واللهِ إِنَّهُ لَلنَّبِىُّ الذى كُنَّا نَنْتَظِرُ ‘আল্লাহর কসম! ইনি অবশ্যই সেই নবী, আমরা যার প্রতীক্ষা করে আসছি’। একথা শোনার সাথে সাথে আবু আলক্বামা তার উটের মুখ মদীনার দিকে ঘুরিয়ে দিলেন এবং ঐ অবস্থাতেই রওয়ানা করলেন। বিশপ তাকে বারবার অনুরোধ করেও ফিরাতে ব্যর্থ হলেন। আবু আলক্বামা সোজা মদীনায় গিয়ে ইসলাম কবুল করেন ও সেখানেই থেকে যান ও পরে শহীদ হন (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৫৫)।
অতঃপর প্রতিনিধিদল গোত্রের গীর্জায় পৌঁছে গেলে সেখানকার পাদ্রী সবকিছু শুনে ইসলাম কবুলের জন্য তখনই মদীনায় রওয়ানা হতে চাইলেন। তিনি গীর্জার দোতলায় তার কক্ষ হতে চীৎকার দিয়ে বলতে থাকেন, আমাকে এখুনি নামতে দাও। নইলে আমি এখান থেকে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে জীবন বিসর্জন দেব। পরে লোকেরা তাকে নামতে দিল। তিনি একটি পেয়ালা, একটি লাঠি ও একটি চাদর রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর জন্য হাদিয়া স্বরূপ নিয়ে তখনই মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে গেলেন। তিনি ইসলাম কবুল করার পর বেশ কিছু দিন মদীনায় অবস্থান করেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ)-এর অনুমতি নিয়ে নাজরান ফিরে আসেন। তাঁর দেওয়া উপঢৌকন আববাসী খলীফাদের সময় পর্যন্ত রক্ষিত ছিল।
প্রথম প্রতিনিধিদলটি ফিরে আসার অল্প দিনের মধ্যেই ৬০ জন আরোহীর একটি বিরাট প্রতিনিধিদল নিয়ে স্বয়ং বিশপ আবুল হারেছ অথবা আবু হারেছাহ বিন আলক্বামা রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হন। তার সঙ্গে ১৪ জন নেতার মধ্যে সর্বোচ্চ তিনি সহ আরও দু’জন ছিলেন। যাদের একজন হলেন নাজরানের শাসক (عَاقِبٌ) আব্দুল মাসীহ এবং প্রধান বিচারপতি ও প্রশাসক (سَيّدُ) আইহাম (الْأَيْهَم) অথবা শুরাহবীল। ইনি সামাজিক ও আর্থিক বিষয়াদিও দেখাশোনা করতেন।
সম্ভবতঃ এটা রবিবার ছিল। আছরের সময় মদীনায় পৌঁছলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে মসজিদে নববীতে সালাত আদায়ের অনুমতি দেন। তারা সেখানে প্রবেশ করে বায়তুল মুক্বাদ্দাসের দিকে ফিরে সালাত আদায় করেন। কিছু মুসলমান তাদেরকে বাধা দিতে চাইলে রাসূল (সাঃ) নিষেধ করেন (ইবনু হিশাম ১/৫৭৪-৭৫)।
খ্রিষ্টানদের এই বিরাট দলটি মদীনায় উপস্থিত হওয়ায় কিছু ইহূদী এসে তাদের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে বচসায় লিপ্ত হত। একদিন তারা এসে বলল, ইবরাহীম (আঃ) ইহূদী ছিলেন। জওয়াবে খ্রিষ্টান নেতারা বললেন, ইবরাহীম (আঃ) নাছারা ছিলেন। তখন সূরা আলে ইমরান ৬৫-৬৮ আয়াতগুলি নাযিল হয়। যেখানে বলা হয় যে,مَا كَانَ إِبْرَاهِيْمُ يَهُوْدِيًّا وَلاَ نَصْرَانِيًّا وَلَكِنْ كَانَ حَنِيْفًا مُّسْلِمًا ‘ইবরাহীম না ইহূদী ছিলেন, না নাছারা ছিলেন। বরং তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মুসলিম’ (আলে ইমরান ৩/৬৭)।[যাদুল মা‘আদ ৩/৫৫১]
আরেকদিন তারা এসে খ্রিষ্টান ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে বলল, তোমাদের এই নবী কি চান যে, আমরা তার ইবাদত করি, যেমন খ্রিষ্টানরা ঈসার পূজা করে থাকে? তখন এর প্রতিবাদে সূরা আলে ইমরানের ৭৯ ও ৮০ আয়াত দু’টি নাযিল হয়’।-
مَا كَانَ لِبَشَرٍ أَن يُؤْتِيَهُ اللهُ الْكِتَابَ وَالْحُكْمَ وَالنُّبُوَّةَ ثُمَّ يَقُولَ لِلنَّاسِ كُونُواْ عِبَاداً لِّي مِن دُونِ اللهِ وَلَـكِن كُونُواْ رَبَّانِيِّينَ بِمَا كُنتُمْ تُعَلِّمُونَ الْكِتَابَ وَبِمَا كُنتُمْ تَدْرُسُونَ، وَلاَ يَأْمُرَكُمْ أَن تَتَّخِذُوا الْمَلاَئِكَةَ وَالنِّبِيِّيْنَ أَرْبَاباً أَيَأْمُرُكُم بِالْكُفْرِ بَعْدَ إِذْ أَنتُم مُّسْلِمُونَ- (آل عمران 79-80)-
‘এটা কোন মানুষের জন্য বিধেয় নয় যে, তাকে আল্লাহ কিতাব, হিকমত ও নবুঅত প্রদান করেন, অতঃপর সে লোকদের বলে যে, তোমরা সবাই আল্লাহকে ছেড়ে আমার গোলাম হয়ে যাও। বরং একথা বলবে যে, তোমরা সবাই আল্লাহওয়ালা হয়ে যাও। এটা এজন্য যে, তোমরা মানুষকে কিতাব শিক্ষা দিয়ে থাক এবং তোমরা তা পাঠ করে থাক’ (৭৯)। ‘আর তিনি তোমাদের এটা আদেশ করেন না যে, তোমরা ফেরেশতা ও নবীগণকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ কর। মুসলিম হওয়ার পরে কি তিনি তোমাদের কুফরীর নির্দেশ দিবেন? (অর্থাৎ আল্লাহ ব্যতীত অন্যকে ‘রব’ হিসাবে গ্রহণ করতে বলবেন?)। (আলে ইমরান ৩/৭৯-৮০)।[ইবনু কাছীর, তাফসীর সূরা আলে ইমরান ৭৯-৮০ আয়াত]
মুহাম্মাদ বিন ইসহাক-এর বর্ণনায় এসেছে যে, এই প্রতিনিধিদল মদীনায় অবস্থান কালীন সময়ে তাদের সম্পর্কে সূরা আলে ইমরানের শুরু থেকে ৮০-এর অধিক আয়াত সমূহ নাযিল হয় (ইবনু হিশাম ১/৫৭৬)।
অতঃপর প্রতিনিধিদল বিদায় গ্রহণকালে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে আরয করেন যে, তাদের নিকট থেকে চুক্তির মালামাল আদায়ের জন্য একজন আমানতদার ব্যক্তিকে প্রেরণ করা হউক। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ)-কে উক্ত গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেন এবং বলেন,هَذَا أَمِيْنُ هَذِهِ الْأُمَّة ‘ইনি হলেন এই উম্মতের আমীন’ অর্থাৎ সবচেয়ে বড় আমানতদার ব্যক্তি’ (বুখারী হা/৪৩৮০)। পরে আবু ওবায়দাহর সর্বোত্তম আমানতদারী, অনুপম চরিত্র ও অমায়িক ব্যবহারে মুগ্ধ হয়ে নাজরানবাসী দলে দলে মুসলমান হতে থাকেন। স্বয়ং ‘আক্বেব’ (শাসক) ও ‘সাইয়েদ’ (প্রধান বিচারপতি) মুসলমান হয়ে যান। পরে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আলী (রাঃ)-কে পাঠান জিযিয়া ও ছাদাক্বা সংগ্রহের জন্য। অর্থাৎ মুসলমানদের নিকট থেকে যাকাত এবং অমুসলমানদের নিকট থেকে জিযিয়া কর। ক্রমে সমস্ত নাজরানবাসী মুসলমান হয়ে যায়।[ইবনু হিশাম ২/৬০০; আর-রাহীক্ব ৪৫০-৫১ পৃঃ]
[শিক্ষণীয় : এক ফোঁটা রক্তপাত না ঘটিয়ে স্রেফ ইসলামের আদর্শে মুগ্ধ হয়ে নাজরানের খ্রিষ্টানরা দলে দলে মুসলমান হয়েছিল। আজও তা সম্ভব। যদি আমরা ইসলামকে সঠিকভাবে মানবজাতির কাছে তুলে ধরতে পারি এবং তারাও ইসলামের সত্যতায় বিশ্বাসী হয়।]
১৫. ফারওয়া বিন ‘আমর আল-জুযামীর দূতের আগমন :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
রোমক সাম্রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের আরব গবর্ণর ফারওয়া বিন ‘আমর-এর রাজধানী ছিল মা‘আন (مَعَان)। জর্ডান, সিরিয়া ও ফিলিস্তীনের সংশ্লিষ্ট এলাকা তাঁর শাসনাধীনে ছিল। মুবারকপুরী বলেন, ৮ম হিজরীর জুমাদাল ঊলা মাসে সংঘটিত মুতার যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর অপূর্ব বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তিনি ইসলামের সত্যতার উপরে বিশ্বাসী হন এবং ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর উপঢৌকন হিসাবে একটি সাদা খচ্চর সহ রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে একজন দূত প্রেরণ করেন।
এ খবর জানতে পেরে রোম সম্রাট তাকে ডেকে পাঠান। অতঃপর তাকে ইসলাম ত্যাগ অথবা মৃত্যু দু’টির একটা বেছে নেওয়ার এখতিয়ার দেন। সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দানের জন্য তাকে কারাগারে প্রেরণ করেন। কিন্তু খাঁটি মুমিন ফারওয়া বিন ‘আমর (রাঃ) ইসলাম ত্যাগের বদলে মৃত্যুকেই বেছে নেন। অতঃপর তাঁকে যেরুযালেম নগরীর ‘আফরা’ (عَفْراء) নামক ঝর্ণার পাড়ে শূলে বিদ্ধ করে হত্যা করা হয়।
শূলের মঞ্চে পৌঁছে ফারওয়া (রাঃ) নিম্নোক্ত কবিতা পাঠ করেন,
أَلاَ هَلْ أَتَى سَلْمَى بِأَنَّ حَلِيلَهَا * عَلَى مَاءِ عَفْرَا فَوْقَ إحْدَى الرَّوَاحِلِ
عَلَى نَاقَةٍ لَمْ يَضْرِبِ الْفَحْلُ أُمَّهَا * مُشَّذَّبَةٌ أَطْرَافُهَا بِالْمَنَاجِلِ
‘ওহে! আমার স্ত্রী সালমা কি আসবে এমন উটে সওয়ার হয়ে, যে এখনো গর্ভবতী হয়নি? একারণে যে তার স্বামী ‘আফরা ঝর্ণার তীরে তীক্ষ্ণধার শূলের একটি কাঠের উপরে অবস্থান করছে’।
অতঃপর হত্যার উদ্দেশ্যে আগত লোকদের উদ্দেশ্যে তিনি নিম্নের কবিতাটি পড়েন,
بَلِّغْ سَرَاةَ الْمُسْلِمِينَ بِأَنَّنِي * سَلْمٌ لِرَبِّي أَعْظُمِي وَمَقَامِي
‘মুসলিম নেতাদের কাছে তোমরা খবর পৌঁছে দিয়ো যে, আমি আমার অস্থিসমূহ ও মেরুদন্ডসহ আমার প্রতিপালকের প্রতি অনুগত’।[ইবনু হিশাম ২/৫৯২; যাদুল মা‘আদ ৩/৫৬৪-৬৫; আর-রাহীক্ব ৪৪৫ পৃঃ]
ফারওয়া বিন ‘আমর ও অন্যান্য নও মুসলিমদের বিরুদ্ধে রোমক সম্রাটের এহেন নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিবাদে এবং রোমকদের ভীত করার জন্য আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মৃত্যুর মাত্র দু’দিন পূর্বে উসামা বিন যায়েদ (রাঃ)-এর নেতৃত্বে শামের তুখূম, বালক্বা, দারূম প্রভৃতি এলাকা ঘোড়ার পায়ে পিষ্ট করার নির্দেশ দেন। যার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল ঐ অঞ্চলের আরব ও নও মুসলিমদের সাহস দেওয়া। মদীনা থেকে বেরিয়ে তিন মাইল যেতেই রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যু আসন্ন সংবাদ পেয়ে অগ্রগমন স্থগিত হয়ে যায়। পরে আবুবকরের খেলাফতের শুরুতে তারা পুনরায় গমন করেন এবং অভিযান শেষে বিজয়ীর বেশে ফিরে আসেন’।[আর-রাহীক্ব ৪৬৩ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৬৪১-৪২]
[শিক্ষণীয় : মুসলমান সবকিছু ত্যাগ করতে পারে। কিন্তু ঈমান ত্যাগ করতে পারেনা]
১৬. বনু সা‘দ বিন বকর প্রতিনিধি :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
বনু সা‘দ বিন বকর-এর একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে তাদের নেতা যেমাম বিন ছা‘লাবাহ(ضِمَامُ بنُ ثَعْلَبَةَ) রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে আসেন। অতঃপর বাহিরে উট বেঁধে রেখে তিনি মসজিদে প্রবেশ করেন ও বলেন, তোমাদের মধ্যে ইবনু আব্দিল মুত্ত্বালিব কে? জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, আমি’। তিনি বললেন, মুহাম্মাদ? রাসূল (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বললেন, আমি আপনাকে কিছু কঠিন বিষয়ে প্রশ্ন করব। মনে কিছু নিবেন না। জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, আমি কিছুই মনে করি না। তুমি যা খুশী প্রশ্ন কর। অতঃপর তিনি আল্লাহর কসম দিয়ে তাঁকে বাপ-দাদাদের উপাস্য দেব-দেবী সম্পর্কে প্রশ্ন করেন। জবাবে রাসূল (সাঃ) বলেন, এসবই শিরক। আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। অতঃপর তিনি ইসলামের ফরয সমূহের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। জবাবে রাসূল (সাঃ) কালেমা, সালাত, সিয়াম, যাকাত ও হজ্জ সহ ইসলামের পাঁচটি বুনিয়াদী ফরয ব্যাখ্যা করেন। তখন তিনি কালেমা শাহাদাৎ পাঠ করে ইসলাম কবুল করেন। অতঃপর বেরিয়ে যাওয়ার সময় বলেন,وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ لاَ أَزِيدُ عَلَى هَذَا وَلاَ أَنْقُصُ ‘যার হাতে আমার জীবন তাঁর কসম করে বলছি, আমি এর চাইতে কিছু বাড়াবো না, কিছু কমাবোও না’। রাসূল (সাঃ) বললেন, إنْ يَصْدُقْ ذُو الْعَقِيصَتَيْنِ يَدْخُلْ الْجَنّةَ ‘দুই ঝুটিওয়ালা ব্যক্তি যদি সত্য বলে থাকে, তবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে’। অতঃপর তিনি তার কওমের নিকট ফিরে যান এবং তাদের নিকটে রাসূল (সাঃ)-এর আদেশ ও নিষেধ সমূহ বর্ণনা করেন। অতঃপর তার উপস্থিতিতে সন্ধ্যার মধ্যেই সকল নারী-পুরুষ ইসলাম কবুল করে’ (হাকেম হা/৪৩৮০, হাদীছ সহীহ)।
উক্ত ঘটনাটি আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর বর্ণনায় সহীহ বুখারীতে একটু ভিন্নভাবে এসেছে (বুখারী হা/৬৩)। মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে,وَالَّذِى بَعَثَكَ بِالْحَقِّ لاَ أَزِيدُ عَلَيْهِنَّ وَلاَ أَنْقُصُ مِنْهُنَّ. فَقَالَ النَّبِىُّ -صلى الله عليه وسلم- لَئِنْ صَدَقَ لَيَدْخُلَنَّ الْجَنَّةَ ‘যিনি আপনাকে সত্য সহকারে প্রেরণ করেছেন, তাঁর কসম করে বলছি, এগুলির চাইতে আমি একটুও বাড়াবো না, একটুও কমাবো না। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, যদি সে সত্য বলে থাকে, তবে সে অবশ্যই জান্নাতে প্রবেশ করবে’ (মুসলিম হা/১২)।
ইবনু ইসহাক বলেন, যিমাম বিন ছা‘লাবাহ তার কওমের নিকট এসে বলেন,بِئْسَتِ اللاَّتُ وَالْعُزَّى فَقَالُوا : مَهْ يَا ضِمَامَ اتَّقِ الْبَرَصَ وَالْجُنُونَ وَالْجُذَامَ . قَالَ وَيْلَكُمْ إنّهُمَا مَا يَضُرَّانِ وَلاَ يَنْفَعَانِ ‘লাত-‘উযযার মন্দ হৌক! লোকেরা বলল, থাম হে যিমাম! শ্বেতী রোগ, উন্মাদ ও কুষ্ঠ রোগ হওয়াকে ভয় কর। তিনি বললেন, তোমাদের ধ্বংস হৌক! লাত-‘উযযা কারু কোন ক্ষতি করতে পারে না বা কারু কোন উপকার করতে পারে না’। আল্লাহ একজন রাসূলকে প্রেরণ করেছেন এবং তাঁর উপরে কিতাব নাযিল করেছেন। তাঁর মাধ্যমে আমি তোমাদেরকে তোমাদের পূর্বের কৃতকর্ম সমূহ থেকে বাঁচাতে চাই। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও রাসূল। আমি তাঁর নিকট থেকে তোমাদের নিকট নিয়ে এসেছি, যা তিনি তোমাদের প্রতি আদেশ করেছেন ও নিষেধ করেছেন। অতঃপর তাঁর উপস্থিতিতে সন্ধ্যার মধ্যেই তাঁর সম্প্রদায়ের সবাই ইসলাম কবুল করেন। নারী বা পুরুষের একজনও বাকী ছিলনা’। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, فَمَا سَمِعْنَا بِوَافِدِ قَوْمٍ كَانَ أَفْضَلَ مِنْ ضِمَامِ ابْن ثَعْلَبَةَ ‘যিমাম বিন ছা‘লাবাহর ন্যায় কোন সম্প্রদায়ের উত্তম প্রতিনিধি সম্পর্কে আমরা শুনিনি’।[ইবনু হিশাম ২/৫৭৩-৭৫; আবুদাঊদ হা/৪৮৭; আহমাদ হা/২২৫৪] উমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) বলেন,ما رأيت أحدا أحسن مسألة ولا أوجز من ضمام بن ثعلبة ‘আমি যিমাম বিন ছা‘লাবাহর চাইতে সুন্দর ও সারগর্ভ প্রশ্নকারী হিসাবে কাউকে দেখিনি’ (আল-ইছাবাহ, যিমাম ক্রমিক ৪১৮২)।
[শিক্ষণীয় : (১) অনেক সময় একজন সাহসী নেতাই একটি সম্প্রদায়ের হেদায়াতের জন্য যথেষ্ট হন। (২) সংক্ষেপে সারগর্ভ কথা বলাই জ্ঞানী নেতার কর্তব্য। (৩) ছবি-মূর্তির ক্ষমতার প্রতি মানুষের যে একটা অন্ধ বিশ্বাস রয়েছে, উক্ত ঘটনায় তার প্রমাণ পাওয়া যায়। (৪) হক জানতে পারার সাথে সাথে বাতিল থেকে তওবা করে হক কবুল করতে হবে। এ ব্যাপারে গড়িমসি করাটা শয়তানী ধোঁকার শামিল। (৫) নেতার প্রতি কর্মীদের অটুট বিশ্বাস ও নিখাদ আনুগত্যের প্রমাণ রয়েছে যেমাম ও তার সম্প্রদায়ের কর্মকান্ডে।
১৭. তারেক বিন আব্দুল্লাহর প্রতিনিধিদল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
তারেক বিন আব্দুল্লাহ ছিলেন ‘রাবাযাহ’ (الرَّبَذَة) এলাকার বাসিন্দা। তাঁর ইসলাম গ্রহণ বিষয়ে তিনি বর্ণনা করেন যে, একদা আমি মক্কার ‘যুল-মাজায’ বাজারে (سوق المجاز) দাঁড়িয়ে ছিলাম। এমন সময় একজন লোক সেখানে এসে বলতে থাকেন,يَا أَيُّهَا النَّاسُ قُوْلُوْا لآ إلَهَ إلاَّ اللهُ تُفْلِحُوْا ‘হে জনগণ! তোমরা বল, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নেই, তাহলে তোমরা সফলকাম হবে’। কিন্তু সেখানেই তার পিছে পিছে তাকে পাথর ছুঁড়ে মারতে মারতে একজন লোককে বলতে শুনলাম,يَا أَيُّهَا النَّاسُ لاَ تُطِيعُوهُ فَإِنَّهُ كَذَّابٌ ‘হে জনগণ! তোমরা এ ব্যক্তির আনুগত্য করো না। কেননা সে মহা মিথ্যাবাদী’ (হাকেম হা/৪২১৯, সনদ সহীহ)। পরে লোকদের কাছে জানতে পারলাম যে, দু’জনেই বনু হাশেমের লোক। প্রথম জন ‘মুহাম্মাদ’ যিনি নিজেকে আল্লাহর নবী বলে দাবী করেন এবং দ্বিতীয়জন তার চাচা আব্দুল ‘উযযা, যিনি তাকে অস্বীকার করেন’। আবু লাহাবের প্রকৃত নাম ছিল আব্দুল ‘উযযা।[2]
তারেক বিন আব্দুল্লাহ বলেন, তারপর কয়েক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রাসূল (সাঃ) মদীনায় হিজরত করে চলে গেছেন। এক সময় আমি ও আমার সাথীগণ ব্যবসা উপলক্ষে মদীনায় গেলাম খেজুর ক্রয়ের জন্য। মদীনার উপকণ্ঠে পৌঁছে আমরা অবতরণ করলাম এজন্য যে, সফরের পোষাক পরিবর্তন করে ভাল পোষাক পরে মদীনায় প্রবেশ করব। এমন সময় পুরানো কাপড় পরিহিত একজন ব্যক্তি এসে আমাদের সালাম দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কোথা থেকে এসেছেন এবং কোথায় যাবেন? আমরা বললাম, রাবাযাহ থেকে এসেছি এবং মদীনাই আমাদের গন্তব্যস্থল’। তিনি বললেন, কি উদ্দেশ্যে? আমরা বললাম, খেজুর ক্রয়ের উদ্দেশ্যে’। ঐ সময় লাগাম দেওয়া অবস্থায় আমাদের লাল উটটি দাঁড়ানো ছিল। তিনি বললেন, উটটি বিক্রি করবেন কি? আমরা বললাম, হ্যাঁ। বললেন, দাম কত? বললাম, এত পরিমাণ খেজুরের বিনিময়ে দিতে পারি’। অতঃপর তিনি মূল্য কমানোর কোনরূপ চেষ্টা না করেই উটের লাগাম ধরে নিয়ে গেলেন। উনি শহরে পৌঁছে গেলে আমাদের হুঁশ হল যে, অচেনা লোকটি আমাদের উট নিয়ে গেল, অথচ মূল্য পরিশোধের বিষয়ে কোন কথা হল না। আমরা এ নিয়ে বেশ দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। তখন আমাদের গোত্রনেতার স্ত্রী যিনি আমাদের সাথে হাওদানশীন ছিলেন, তিনি বললেন, আমি লোকটির চেহারা দেখেছি, যা পূর্ণিমার চাঁদের মত। এমন একজন ব্যক্তি যদি উটের মূল্য না দেন, তবে আমিই তোমাদের মূল্য দিয়ে দেব’।
ইতিমধ্যে একজন ব্যক্তি এসে বললেন, আমাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পাঠিয়েছেন। এই নিন আপনাদের উটের মূল্য বাবদ খেজুর এবং বাকী এগুলি তিনি পাঠিয়েছেন আপনাদের আপ্যায়নের জন্য। আপনারা খেতে থাকুন এবং খেজুরগুলি মেপে নিন’।
অতঃপর আমরা খেয়ে তৃপ্ত হয়ে শহরে প্রবেশ করলাম। যেয়ে দেখি যে, উটের খরিদ্দার সেই ব্যক্তিই মসজিদে মিম্বরে দাঁড়িয়ে লোকদের উপদেশ দিচ্ছেন-
تَصَدَّقُوا، فَإِنَّ الصَّدَقَةَ خَيْرٌ لَكُمْ. وَالْيَدُ الْعُلْيَا خَيْرٌ مِنَ الْيَدِ السُّفْلَى، وَابْدَأْ بِمَنْ تَعُولُ: أَبَاكَ وَأُمَّكَ، وَأُخْتَكَ وَأَخَاكَ، وَأَدْنَاكَ فَأَدْنَاكَ -
‘তোমরা ছাদাক্বা কর। কেননা ছাদাক্বা তোমাদের জন্য কল্যাণকর। জেনে রাখো উপরের হাত নীচের হাতের চাইতে উত্তম। যাদেরকে তুমি লালন-পালন কর তাদের দিয়ে শুরু কর। তোমার পিতাকে, তোমার মাকে, বোনকে, তোমার ভাইকে এবং তোমার নিকটতম তারপর তোমার নিকটতম ব্যক্তিকে দান কর’।[হাকেম হা/৪২১৯; বায়হাক্বী ১১০৯৬]
তারেক বিন আব্দুল্লাহ তাওহীদের দাওয়াত পেয়েছিলেন মক্কার বাজারে। অতঃপর মদীনায় তার বাস্তবতা দেখে গোত্রসমেত সবাই মুসলমান হয়ে যান।
[শিক্ষণীয় : বিশুদ্ধ আক্বীদার সাথে উত্তম আচরণ যুক্ত হলেই কেবল তা অন্যের হৃদয়ে প্রভাব বিস্তার করে এবং পরকালে মুক্তির কারণ হয়ে থাকে।]
একই মর্মে হাদীছ এসেছে রাবী‘আহ বিন ‘ইবাদ আদ-দু’আলী(رَبِيعَةُ بْنُ عِبَادٍ الدُّؤَلِيُّ) থেকে। তিনি বলেন, আমি হিজরতের পূর্বে রাসূল (সাঃ)-কে হজ্জের মওসুমে মিনায় তাঁবুতে তাঁবুতে গিয়ে দাওয়াত দিতে শুনেছি যে,يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ اللهَ يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَعْبُدُوهُ وَلاََ تُشْرِكُوا بِهِ شَيْئًا ‘হে জনগণ! আল্লাহ তোমাদের নির্দেশ দিয়েছেন যে, তোমরা তাঁর ইবাদত কর এবং তাঁর সাথে কাউকে শরীক করো না’। এ সময় তাঁর পিছনে একজন লোককে বলতে শুনেছি, يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ هَذَا يَأْمُرُكُمْ أَنْ تَتْرُكُوا دِيْنَ آبَائِكُمْ ‘হে জনগণ! এই ব্যক্তি তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছে যে, তোমরা তোমাদের বাপ-দাদাদের দ্বীন পরিত্যাগ কর’। তখন আমি এই ব্যক্তি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে বলা হল, ইনি আবু লাহাব’ (হাকেম হা/৩৮, হাদীছ সহীহ)।
[শিক্ষণীয় : চাচা ও ভাতিজা দু’জনেই জনগণকে দাওয়াত দিচ্ছেন। একজন আল্লাহর দিকে, অন্যজন বাপ-দাদাদের রীতি-নীতির দিকে। একজন আল্লাহর সার্বভৌমত্বের দিকে। অন্যজন জনগণের সার্বভৌমত্বের দিকে। একটি জান্নাতের পথ, অন্যটি জাহান্নামের পথ। যুগে যুগে সত্য-মিথ্যার এ দ্বন্দ্ব অব্যাহত রয়েছে। আগামীতেও থাকবে। জান্নাতীগণ আল্লাহর পথ বেছে নিবে আল্লাহর বিশেষ রহমতে। আর এটাই হল চিরন্তন রীতি।]
১৮. তুজীব প্রতিনিধিদল :
━━━━━━━━━━━━━━━
ইয়ামনের কিন্দা গোত্রের তুজীব শাখার লোকেরা আগেই মুসলমান হয়েছিল। তাদের ১৩ জনের এই প্রতিনিধি দল নিজ গোত্রের মাল-সম্পদ ও গবাদিপশুর যাকাতসমূহ সাথে করে এনেছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমরা এগুলি ফেরৎ নিয়ে যাও এবং নিজ কওমের ফকীর-মিসকীনদের মধ্যে বিতরণ করে দাও। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! তাদেরকে বণ্টন করার পর উদ্বৃত্তগুলিই কেবল এখানে এনেছি’।
আবুবকর (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এদের চেয়ে উত্তম কোন প্রতিনিধিদল এযাবত আসেনি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,إنّ الْهُدَى بِيَدِ اللهِ عَزَّ وَجَلَّ فَمَنْ أَرَادَ بِهِ خَيْرًا شَرَحَ صَدْرَهُ لِلْإِيمَانِ ‘হেদায়াত আল্লাহর হাতেই নিহিত। তিনি যার কল্যাণ চান, তার বক্ষকে ঈমানের জন্য উন্মুক্ত করে দেন’।
তারা দ্বীনের বিধি-বিধান শেখার জন্য খুবই উদগ্রীব ছিল। সেকারণ রাসূল (সাঃ) তাদের তা‘লীমের জন্য বেলাল (রাঃ)-কে নিযুক্ত করেন। অতঃপর তারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে কয়েকটি বিষয়ে প্রশ্ন করে। তিনি সেগুলির জওয়াব তাদেরকে লিখিয়ে দেন। তারা ফিরে যাবার জন্য ব্যস্ত হলে সাহাবায়ে কেরাম তাদের বললেন, এত তাড়া কিসের? তারা বলল, রাসূল (সাঃ)-এর দরবার থেকে আমরা যেসব কল্যাণ লাভ করেছি, দ্রুত ফিরে গিয়ে আমরা সেগুলি আমাদের সম্প্রদায়কে জানাতে চাই।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে বহুমূল্য উপঢৌকনাদি প্রদান করেন। অতঃপর বিদায়ের সময় জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের দলের কেউ বাকী আছে কি? তারা বলল, হ্যাঁ একজন নওজোয়ান বাকী আছে। যাকে আমরা আমাদের মাল-সামানের পাহারায় রেখে এসেছি। রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমরা গিয়ে তাকে পাঠিয়ে দাও। তারপর নওজোয়ানটি এসে রাসূল (সাঃ)-কে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি বনু আবযার সন্তান(يَا رَسُولَ اللهِ إنّي امْرُؤٌ مِنْ بَنِي أَبْذَى)। ইতিপূর্বে যারা আপনার কাছে এসেছিল, আমি তাদের সম্প্রদায়ভুক্ত। তারা আপনার নিকট থেকে তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে গেছে। এক্ষণে আপনি আমার প্রয়োজন মিটিয়ে দিন। আমি আপনার নিকটে কেবল একটা উদ্দেশ্য নিয়েই এসেছি যে, আপনি আমার জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করবেন যেন তিনি আমাকে ক্ষমা করেন ও আমার উপরে রহম করেন এবং আমার অন্তরকে মুখাপেক্ষীহীন করেন’। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তার জন্য অনুরূপ দো‘আ করেন।
অতঃপর ১০ম হিজরীতে রাসূল (সাঃ) বিদায় হজ্জে গেলে উক্ত গোত্রের লোকেরাও হজ্জে গমন করে ও রাসূল (সাঃ)-এর সাথে মিনায় সাক্ষাৎ করে। তিনি তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, বনু আবযার ঐ নওজোয়ানের খবর কি? তারা বলল, ছেলেটির অবস্থা এমন হয়েছে যে, দুনিয়ার সম্পদ তার সামনে ঢেলে দিলেও সে চোখ তুলে সেদিকে তাকায় না’। সে সর্বদা অল্পে তুষ্ট থাকে। রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পরে যখন লোকদের মধ্যে ধর্মত্যাগের হিড়িক পড়ে, তখন উক্ত যুবক তার কওমকে নছীহত করে। যার ফলে তারা ইসলামের উপরে দৃঢ় থাকে’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৬৮-৬৯)।
[শিক্ষণীয় : (ক) প্রত্যেক জনপদে যাকাত ঠিকমত আদায় ও বণ্টন করা হলে মুসলিম সমাজে গরীবের অস্তিত্ব থাকবে না। (খ) অল্পে তুষ্ট থাকাই সচ্ছলতার মাপকাঠি। (গ) অত্র ঘটনায় রাসূল (সাঃ)-এর যামানায় হাদীছ লিখনের দলীল পাওয়া যায়।]
১৯. বনু সা‘দ হুযায়েম প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুযা‘আহ (قُضَاعَة) গোত্রের শাখা বনু সা‘দ হুযায়েম প্রতিনিধি দল আবু নু‘মানের নেতৃত্বে রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে আসে। আবু নু‘মান বলেন, এ সময় মানুষ দু’দলে বিভক্ত ছিল। একদল আগ্রহের সাথে ইসলামে প্রবেশকারী ছিল। অন্যদল তরবারীর ভয়ে ভীত ছিল। অতঃপর আমরা মদীনায় প্রবেশ করলাম। তখন রাসূল (সাঃ) মসজিদে একটি জানাযার সালাত পড়াচ্ছিলেন। আমরা তাতে যোগ দিলাম না। সালাত শেষে রাসূল (সাঃ) আমাদেরকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কারা? বললাম, বনু সা‘দ হুযায়েমের লোক। তিনি বললেন, তোমরা কি মুসলমান? বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেন, তাহলে তোমরা কেন তোমাদের ভাইয়ের জানাযার সালাতে যোগ দিলে না? বললাম, আমরা ধারণা করেছিলাম, যতক্ষণ আমরা আপনার হাতে বায়‘আত না করব, ততক্ষণ উক্ত সালাত আদায় করা আমাদের জন্য জায়েয হবে না। তিনি বললেন, যেখানেই তোমরা মুসলমান হও না কেন, তোমরা মুসলমান’। অতঃপর আমরা রাসূল (সাঃ)-এর হাতে ইসলামের বায়‘আত করলাম। বায়‘আত শেষে আমরা আমাদের মাল-সামানের কাছে ফিরে এলাম। যেগুলি আমাদের কাফেলার সর্বকনিষ্ঠ একটি ছেলের দায়িত্বে ছিল। ইতিমধ্যে রাসূল (সাঃ) আমাদের সন্ধানে লোক পাঠালেন। অতঃপর আমাদেরকে তাঁর নিকটে নিয়ে যাওয়া হল। তখন আমাদের ঐ ছেলেটি তাঁর দিকে এগিয়ে গেল ও বায়‘আত করল। আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! ছেলেটি আমাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ এবং আমাদের খাদেম। জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন,أَصْغَرُ الْقَوْمِ خَادِمُهُمْ بَارَكَ اللهُ عَلَيْهِ ‘ছোটরাই কওমের খাদেম হয়। আল্লাহ তার উপরে বরকত দান করুন’!
আবু নু‘মান বলেন, আল্লাহর কসম! সে আমাদের মধ্যে উত্তম ছিল এবং রাসূল (সাঃ)-এর দো‘আর বরকতে সে আমাদের মধ্যে কুরআনের সর্বোত্তম পাঠক ছিল। অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাকে আমাদের উপর ‘আমীর’ নিযুক্ত করলেন। অতঃপর যখন আমরা ফিরে আসতে চাইলাম, তখন রাসূল (সাঃ) বেলালকে নির্দেশ দিলেন এবং আমাদের প্রত্যেককে বহু মূল্য রৌপ্যমুদ্রা উপহার দিলেন। আমরা ফিরে এসে আমাদের কওমকে দাওয়াত দিলাম। ফলে আল্লাহপাক তাদের সবাইকে ইসলাম কবুলের তাওফীক দিলেন’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৬৯-৭০)।
[শিক্ষণীয় : (১) নিখাদ আনুগত্য থাকলে আমীরের হাতে বায়‘আত না করলেও চলবে। পরে সুযোগ মত বায়‘আত করবে। (২) কুরআনের পাঠক ও জ্ঞানী হওয়াই ইসলামী নেতৃত্বের মাপকাঠি। (৩) ছোটরা বড়দের উপর আমীর হতে পারে। (৪) দাওয়াতের মাধ্যমেই ইসলামের প্রসার ঘটে থাকে।]
২০. বনু ফাযারাহ প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
তাবূক অভিযানের পর ১০/১৫ জনের এই দলটি মদীনায় আসে। বিখ্যাত গোত্র ক্বায়সে ‘আয়লান(قَيْسُ عَيْلاَنَ) এর অন্তর্ভুক্ত এই লোকেরা আগেই ইসলাম কবুল করেছিল। তাদের বাহন ও চেহারাসমূহ দুর্দশাগ্রস্ত ছিল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের এলাকার অবস্থা জিজ্ঞেস করলে তারা চরম দুর্ভিক্ষের কথা জানালো। তারা তাদের এলাকায় বৃষ্টি বর্ষণের জন্য রাসূল (সাঃ)-কে আল্লাহর নিকটে দো‘আ করার আবেদন জানালো। তখন তিনি মিম্বরে দাঁড়িয়ে দু’হাত উঁচু করে (সম্ভবতঃ জুম‘আর খুৎবায়) নিম্নোক্ত দো‘আ করলেন, যে দো‘আটি পরবর্তীকালে ইস্তিসক্বার সালাতে সচরাচর পড়া হয়ে থাকে।-
اللهُمَّ اسْقِ عِبَادَكَ وَبَهَائِمَك وَانْشُرْ رَحْمَتَك وَأَحْيِ بَلَدَكَ الْمَيِّتَ- اللهُمَّ اسْقِنَا غَيْثًا مُغِيْثًا مَرِيْئًا مَرِيْعًا نَافِعًا، طَبَقًا وَاسِعًا نَافِعًا غَيْرَ ضَارٍّ عَاجِلاً غَيْرَ آجِلٍ-
‘হে আল্লাহ! তোমার বান্দাদের ও তোমার গবাদিপশুদের বৃষ্টি দ্বারা পরিতৃপ্ত কর। তোমার রহমতকে বিস্তৃত করো ও তোমার মৃত জনপদকে জীবিত কর’। হে আল্লাহ! আমাদেরকে এমন বৃষ্টি বর্ষণ কর, যা শান্তিদায়ক, কল্যাণকর, সমতল বিস্তৃত এবং যা উপকারী, ক্ষতিকর নয়। যা দ্রুত, দেরীতে নয়।[আবুদাঊদ হা/১১৭৬, ১১৬৯; মিশকাত হা/১৫০৬।]
[শিক্ষণীয় : বৃষ্টি বর্ষণ ও অভাব দূরীকরণের মালিক আল্লাহ। তাই সবকিছুর জন্য কেবল তাঁর কাছেই প্রার্থনা করতে হবে।]
২১. বনু আসাদ প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━
ইয়ামামা থেকে ১০ জনের এই প্রতিনিধি দলটি মদীনায় আসে। যাদের মধ্যে যিরার বিন আযওয়ার(ضِرَارُ بنُ الْأَزْوَرِ) ওয়াবেছাহ বিন মা‘বাদ এবং তুলায়হা বিন খুওয়াইলিদ আসাদী ছিলেন। ঐ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মসজিদে ছিলেন। তারা এসে নিজেরা কালেমা শাহাদাত পাঠ করেন। অতঃপর তাদের নেতা হাযরামী বিন ‘আমের বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমরা নিজেরা এসে ইসলাম কবুল করেছি। আপনি আমাদের নিকটে কোন সেনাদল বা মুবাল্লিগ দল পাঠাননি। তখন নিম্নোক্ত আয়াতটি নাযিল হয়-
يَمُنُّوْنَ عَلَيْكَ أَنْ أَسْلَمُوْا قُلْ لاَ تَمُنُّوْا عَلَيَّ إِسْلاَمَكُمْ بَلِ اللهُ يَمُنُّ عَلَيْكُمْ أَنْ هَدَاكُمْ لِلْإِيْمَانِ إِنْ كُنْتُمْ صَادِقِيْنَ- (الحجرات 17)-
‘তারা মুসলমান হয়ে তোমাকে ধন্য করেছে বলে মনে করে। বলে দাও, তোমরা মুসলমান হয়ে আমাকে ধন্য করোনি। বরং আল্লাহ ঈমানের পথ প্রদর্শন করে তোমাদেরকে ধন্য করেছেন, যদি তোমরা (ঈমানের দাবীতে) সত্যবাদী হয়ে থাক’ (হুজুরাত ৪৯/১৭)।
অতঃপর তারা কিছু বিষয়ে প্রশ্ন করল। যেমন পাখির বোল ও ডাইনে-বামে উড়ে যাওয়া থেকে শুভাশুভ নির্ধারণ করা যাবে কি না, গনৎকারের ভবিষ্যদ্বাণী গ্রহণ করা যাবে কি না ইত্যাদি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে এসব থেকে নিষেধ করলেন।
উল্লেখ্য যে, উক্ত প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য তুলায়হা আসাদী রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর ‘মুরতাদ’ হয়ে যান ও নিজে নবুঅত দাবী করেন। আবুবকর (রাঃ)-এর সময় রিদ্দার যুদ্ধে পরাজিত হয়ে শামে পালিয়ে যান। সেখানে গিয়ে পুনরায় মুসলমান হন এবং শেষ পর্যন্ত তার ইসলাম সুন্দর ছিল।[3]
[শিক্ষণীয় : (১) আল্লাহর রহমত ব্যতীত কেউ হেদায়াত লাভ করতে পারে না। তাই কোন বিষয়ে হেদায়াত লাভের পর পথ প্রদর্শকের প্রতি শুকরিয়া আদায় করতে হবে। সাথে সাথে অধিকহারে আল্লাহর দরবারে বিনম্রচিত্তে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে হবে। (২) আমীরের নিকট আল্লাহর নামে বায়‘আত করার পরেও মুসলমান তা ভঙ্গ করতে পারে। এমনকি নিজেই আমীর দাবী করতে পারে। যেমন রাসূল (সাঃ)-এর নিকট বায়‘আত করার পরেও তুলায়হা আসাদী নিজে নবুঅতের দাবী করে। তাছাড়া রাসূল (সাঃ)-এর পিছনে পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করেও ইবনু উবাই মুনাফিকদের সর্দার ছিলেন। তাই বলে একারণে রাসূল (সাঃ) বায়‘আতের সুন্নাত বাতিল করেননি।]
২২. বাহরা প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━
ইয়ামন থেকে আগত ১৩ জনের এই প্রতিনিধি দলটি মদীনায় এসে খ্যাতনামা সাহাবী মিক্বদাদ বিন ‘আমর (রাঃ)-এর বাসার সম্মুখে তাদের উট বসিয়ে দেয়। মিক্বদাদ (রাঃ) বাসায় তাদের জন্য আপ্যায়নের ব্যবস্থা করার কথা বলে বেরিয়ে গিয়ে তাদের অভ্যর্থনা জানান। অতঃপর তাদের ঘরে এনে বসান এবং ‘হাইস’ (حَيْس) নামক উন্নত মানের খানা পরিবেশন করেন। ‘হাইস’ হল খেজুর, ছাতু ও ঘি মিশ্রিত অত্যন্ত সুস্বাদু একপ্রকার খাদ্য। হযরত মিক্বদাদ (রাঃ) একটি পাত্রে করে উক্ত খাদ্যের কিছু অংশ রাসূল (সাঃ)-এর জন্য হাদিয়া পাঠান। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তা থেকে কিছুটা খেয়ে পাত্রটি ফেরৎ পাঠিয়ে দেন। মিক্বদাদ (রাঃ) দু’বেলা ঐ পাত্রে করে মেহমানদের জন্য খানা পরিবেশন করেন। মেহমানগণ অত্যন্ত তৃপ্তির সাথে উক্ত খাদ্য খেতে থাকেন। একদিন আশ্চর্য হয়ে তারা মেযবানকে বললেন, আমরা শুনেছিলাম মদীনাবাসীর খাদ্য হল ছাতু, যব ইত্যাদি। কিন্তু এখন দেখছি তার উল্টা। সবচাইতে মূল্যবান ও সুস্বাদু খাদ্য আমরা দু’বেলা খাচ্ছি। এরকম খাদ্য তো আমরা কখনো খাইনি’।
জওয়াবে মিক্বদাদ (রাঃ) বললেন, প্রিয় ভাইয়েরা! এসবই আমাদের প্রিয় রাসূল (সাঃ)-এর বরকত। তিনি ঐ পাত্র থেকে কিছু খেয়ে ফেরত দিয়েছিলেন। আর তাতেই বরকত হয়ে তা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, শেষ হচ্ছে না। একথা শুনে প্রতিনিধি দল বলে উঠল, ‘নিশ্চয়ই তিনি আল্লাহর রাসূল’। অতঃপর তারা মুসলমান হয়ে যান ও মদীনায় কিছু দিন অবস্থান করেন এবং পবিত্র কুরআন ও ইসলামের হুকুম-আহকাম শিখে ফিরে যান’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৭৩)।
[শিক্ষণীয় : অনেক সময় আল্লাহ পাক নবীগণের মু‘জেযার মাধ্যমে অথবা কোন প্রিয় বান্দার প্রতি কারামত প্রদর্শনের মাধ্যমে অন্য বান্দাকে হেদায়াত দান করে থাকেন। এটা স্রেফ আল্লাহর এখতিয়ারাধীন বিষয়। তিনি যাকে খুশী তাকে দিয়ে এটা করাতে পারেন। এতে ব্যক্তির নিজস্ব কোন এখতিয়ার নেই। সেকারণ এটি শরী‘আতের কোন দলীল নয়।]
২৩. ‘উযরাহ প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
ইয়ামনের কুযা‘আহ (قُضَاعَة) গোত্রের উযরাহ শাখার ১২ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলটি জামরাহ বিন নু‘মান(جَمْرَةُ بْنُ النُّعْمَانِ) এর নেতৃত্বে ৯ম হিজরীর ছফর মাসে মদীনায় আসে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের পরিচয় জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, আমরা বনু ‘উযরাহর লোক এবং মায়ের দিক থেকে (কুরায়েশ নেতা) কুছাইয়ের ভাই। যারা কুছাইকে সাহায্য করেছিলেন এবং বনু খোযা‘আহ ও বনু বকরকে মক্কার নেতৃত্ব থেকে বিতাড়িত করতে সহযোগিতা করেছিলেন। আমাদের সঙ্গে আপনার আত্মীয়তা ও বংশীয় সম্পর্ক রয়েছে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে ‘মারহাবা’ জানালেন এবং সুসংবাদ দিলেন যে, সত্বর শাম বিজিত হবে এবং রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস ঐ অঞ্চল থেকে বিতাড়িত হবে। বস্ত্ততঃ রাসূল (সাঃ)-এর এই ভবিষ্যদ্বাণীর পাঁচ মাসের মধ্যেই ৯ম হিজরীর রজব মাসে তাবূক অভিযানে বিনা যুদ্ধে শাম বিজিত হয় এবং রোমকরা এলাকা ছেড়ে চলে যায়। তবে পূর্ণ বিজয় সম্পন্ন হয় হযরত উমরের খেলাফতকালে হযরত আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহর যুদ্ধাভিযানের মাধ্যমে।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে গণৎকারদের নিকটে যেতে এবং বেদীর নিকটে তারা যেসব যবেহ করে থাকে, তা থেকে নিষেধ করেন। অতঃপর বলেন যে, আগামী থেকে কেবল ঈদুল আযহার কুরবানী বাকী থাকবে। এরপর তারা ইসলাম কবুল করল এবং কয়েকদিন অবস্থান করে ফিরে গেল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে উত্তম উপঢৌকনাদিসহ বিদায় দেন’।[4]
[শিক্ষণীয় : (১) রক্ত সম্পর্কীয় আত্মীয় যত দূরেরই হৌক, তাকে সম্মান করা ইসলামের নীতি। (২) ঈদুল আযহার কুরবানী ব্যতীত আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য ইসলামে অন্য কোন কুরবানী নেই। অবশ্য আল্লাহর নামে যেকোন যবহে নেকী লাভ হয়।]
২৪. বালী প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━
৯ম হিজরীর রবীউল আউয়াল মাসে আবুয যুবাইব(أبو الضُّبَيْبِ) এর নেতৃত্বে শাম থেকে ‘বালী’ গোত্রের এই প্রতিনিধি দল মদীনায় আসেন এবং রুওয়াইফি‘ বিন সাবিত(رُوَيْفِعُ بْنُ ثَابِتٍ الْبَلَوِيّ) এর বাড়ীতে মেহমান হন। তিনি তাদেরকে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট নিয়ে আসেন এবং বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এরা আমার কওমের লোক। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে ও তার কওমের প্রতিনিধি দলকে ‘মারহাবা’ জানান। অতঃপর তারা ইসলাম কবুল করেন। তখন তাদের উদ্দেশ্যে রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি তোমাদেরকে ইসলামের প্রতি হেদায়াত দান করেছেন। কেননা যে ব্যক্তি ইসলাম ব্যতীত অন্য কিছুর উপরে মৃত্যুবরণ করে, সে জাহান্নামী হবে’। তখন দলনেতা আবুয যুবাইব বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! মেহমানদারীর প্রতি আমার আসক্তি রয়েছে। এতে কি আমার জন্য কোন পুরস্কার আছে? জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ। প্রত্যেক সৎকর্ম ধনী বা গরীব যার প্রতিই তুমি করবে, সেটি ছাদাক্বা হবে’। তিনি বললেন, ‘হে আল্লাহর রাসূল! মেহমানদারীর মেয়াদ কত দিন? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তিনদিন’। অতঃপর প্রশ্ন করলেন, হারানো বকরীর হুকুম কি? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ওটা তোমার বা তোমার ভাইয়ের অথবা নেকড়ের’। তাদের শেষ প্রশ্ন ছিল, হারানো উটের হুকুম কি? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, ‘ওটাকে ছেড়ে দাও, যতক্ষণ না ওর মালিক ওকে পেয়ে যায়’। (উপরে বর্ণিত হাদীছ সমূহ সনদে ও মতনে সরাসরি প্রমাণিত না হলেও উক্ত মর্মের সহীহ হাদীছ সমূহ রয়েছে। -লেখক)।
ইসলাম কবুলের পর তারা মেযবানের বাড়ীতে তিন দিন অবস্থান করেন। অতঃপর বিদায়ের সময় রাসূল (সাঃ) তাদেরকে উপযুক্ত উপঢৌকনাদি প্রদান করেন (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৭৪)।
উল্লেখ্য যে, হযরত আমর ইবনুল ‘আছ-এর দাদী ছিলেন এই গোত্রের মহিলা। সেই সুবাদে মুতা যুদ্ধের পর ৮ম হিজরীর জুমাদাল আখেরাতে উক্ত অঞ্চলে তাঁর নেতৃত্বে ৩০০ সৈন্যের একটি বাহিনী পাঠানো হয়। যাতে তারা মুসলমানদের বিরুদ্ধে রোমকদের সঙ্গে একজোট না হয়। যেটি ‘সারিইয়া যাতুস সালাসেল’ নামে পরিচিত (যুদ্ধ সমূহ ক্রমিক ৭০)।
[শিক্ষণীয় : কেবলমাত্র বিশ্বাস নয় বরং বিধি-বিধান সমূহ পালনের নাম হল ইসলাম।]
২৫. বনু মুর্রাহ প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
হারেছ বিন ‘আওফের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যের বনু মুর্রাহ প্রতিনিধি দল ৯ম হিজরীতে তাবূক থেকে ফেরার পর রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে আগমন করে। তারা এসে বলে, আমরা আপনার কওমের এবং আপনার বংশের। আমরা বনু লুওয়াই বিন গালিব-এর বংশধর। একথা শুনে রাসূল (সাঃ) মুচকি হাসলেন। অতঃপর তিনি হারেছকে বললেন, তোমার পরিবারকে কোথায় ছেড়ে এসেছ? তিনি বললেন, ‘অস্ত্র ও অস্ত্রধারীদের নিকট’। তোমাদের এলাকাকে কেমন ছেড়ে এসেছ? বললেন, আমরা দুর্ভিক্ষ পীড়িত। মাল-সম্পদের কিছুই নেই। আপনি আমাদের জন্য আল্লাহর নিকট দো‘আ করুন! তখন রাসূল (সাঃ) দো‘আ করলেন,اللَّهُمَّ اسْقِهِمُ الْغَيْثَ ‘হে আল্লাহ! তুমি এদেরকে বৃষ্টি দ্বারা পরিতৃপ্ত কর’। অতঃপর তারা কয়েকদিন অবস্থান করল। তারপর দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য রাসূল (সাঃ)-এর নিকট বিদায় নিতে এল। তখন তিনি বেলালকে নির্দেশ দিলেন তাদেরকে পুরস্কৃত করার জন্য। বেলাল তাদের প্রত্যেককে ১০ উক্বিয়া (রৌপ্যমুদ্রা) করে এবং নেতা হারেছকে ১২ উক্বিয়া হাদিয়া দিলেন। অতঃপর তারা নিজ এলাকায় ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, কবে বৃষ্টি হয়েছিল? দেখা গেল, সেটা ছিল ঐদিন, যেদিন রাসূল (সাঃ) তাদের জন্য দো‘আ করেছিলেন। এরপর থেকে তাদের অঞ্চল শস্য-শ্যামল থাকে’।[5]
[শিক্ষণীয় : (১) সর্বদা আত্মীয়তার সম্পর্ককে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। (২) দুর্ভিক্ষের জন্য আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করতে হবে। (৩) মেহমানকে হাদিয়া দেওয়া এবং নেতাকে কিছু বেশী দেওয়া কর্তব্য। (৪) নেককার মুমিনের দো‘আ দ্রুত কবুল হয়।]
[1]. পূর্ণ চুক্তিপত্রটি দ্রষ্টব্য : বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত (বৈরূতঃ ১৪০৫/১৯৮৫) ৫/৩৮৯ ‘নাজরান প্রতিনিধি দল’ অনুচ্ছেদ; বালাযুরী, ফুতূহুল বুলদান ৭৫-৭৭ পৃঃ।
[2]. যারা মনে করেন, তরবারির জোরে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে, তারা এই দাওয়াতের বিষয়টি লক্ষ্য করুন। সাথে সাথে এটাও জেনে রাখুন যে, সত্য প্রথম বাধাপ্রাপ্ত হয় নিজের ঘর থেকেই।
[3]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৭২; শারহুল মাওয়াহেব ৫/২১১-১২; আল-বিদায়াহ ৫/৮৮। যাদুল মা‘আদে তুলায়হাকে ত্বালহা বলা হয়েছে। সম্ভবতঃ এটি মুদ্রণ জনিত ভুল।
[4]. যাদুল মা‘আদ ৩/৫৭৪। আর-রাহীক্বে (৪৪৭ পৃঃ) জামরাহ (جَمْرَة)-এর বদলে হামযাহ (حَمْزَة) লেখা হয়েছে। সম্ভবতঃ এটি মুদ্রণ জনিত ভুল।
[5]. শারহুল মাওয়াহেব ৫/২১৭, ২৫তম প্রতিনিধি দল; যাদুল মা‘আদ ৩/৫৭৭-৭৮। এখানে যাদুল মা‘আদে যু-মুর্রাহ প্রতিনিধি দল (وَفْدُ ذِىْ مُرَّةَ) বলা হয়েছে। সম্ভবতঃ এটি মুদ্রণ জনিত ভুল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন