শুক্রবার, ১৭ অক্টোবর, ২০২৫

প্রতিনিধি দল পর্ব-৩

 

প্রতিনিধি দল পর্ব-৩

২৬. খাওলান প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
ইয়ামন থেকে ১০ম হিজরীর শা‘বান মাসে দশ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলটি মদীনায় আসে। তারা এসে বলেন, আমরা ইতিপূর্বে ঈমান এনেছি। কিন্তু দীর্ঘ পথ সফর করে আমাদের মদীনায় আসার একটাই কারণ প্রিয় রাসূল (সাঃ)-এর সাক্ষাৎ লাভ করা।
অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাদের পূর্বের দেব-প্রতিমা ‘আম্মু আনাস’(عَمُّ أَنَسٍ) সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। তারা বলল, আল্লাহর হাযার শোকর! আপনার শিক্ষা আমাদেরকে ঐ ফিৎনা থেকে রক্ষা করেছে। কিছু বুড়া-বুড়ীই কেবল এখনো ঐ মূর্তির পূজা করে থাকে। এবার ফিরে গিয়ে ইনশাআল্লাহ আমরা মূর্তিটা গুঁড়িয়ে দেব। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমরা ঐ মূর্তিপূজার দু’একটি ঘটনা শোনাও তো’। তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! একদিন আমরা একশ’ বলদ একত্রিত করি এবং সবগুলি একই দিনে ‘আম্মে আনাসের নামে কুরবানী করি। অতঃপর সেগুলি সব জন্তু-জানোয়ারে খেয়ে যায়। অথচ আমরা নিজেরাই ছিলাম অভাবী এবং গোশতের মুখাপেক্ষী’।
তারা বলল, হে আল্লাহর রাসূল! গবাদিপশু এবং উৎপাদিত খাদ্যশস্য হতে আমরা ‘আম্মে আনাসের জন্য নির্ধারিত অংশ বের করে রাখতাম। উৎকৃষ্ট ফসলের অংশটি ‘আম্মে আনাসের জন্য এবং নিকৃষ্ট অংশটি আল্লাহর জন্য নির্ধারণ করতাম। আর ফসল খারাপ হলে আল্লাহর অংশ দিতাম না। বরং আল্লাহর অংশটা ‘আম্মে আনাসের নামে উৎসর্গ করতাম। কিন্তু ‘আম্মে আনাসের অংশ কখনোই বাদ যেত না’।
অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে দ্বীনের ফরয-ওয়াজিবাত শিক্ষা দিলেন এবং বিশেষ করে তাদেরকে নিম্নের বিষয়গুলি শিখালেন।-
(১) অঙ্গীকার পূর্ণ করা (২) আমানত রক্ষা করা (৩) প্রতিবেশীদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা (৪) কারু প্রতি যুলুম না করা। কেননা যুলুম ক্বিয়ামতের দিন ঘন অন্ধকার হয়ে দেখা দিবে(الظُّلْمُ ظُلُمَاتٌ يَوْمَ الْقِيَامَةِ)।[বুখারী হা/২৪৪৭; মুসলিম হা/২৫৭৯; মিশকাত হা/৫১২৩]
[শিক্ষণীয় : শিরকী আক্বীদা দুনিয়া ও আখেরাত দু’টিই ধ্বংস করে। এযুগের কবরপূজারী ও অন্যান্য পূজারীদের দিকে তাকালেই এর দৃষ্টান্ত মিলবে। যারা ছবি-মূর্তি-স্মৃতিসৌধ শহীদ মিনার ও কবরে লাখ লাখ টাকা ঢালে। কিন্তু একজন অসহায় মানুষকে কিছুই দিতে চায় না।]


২৭. মুহারিব প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━
দশ সদস্যের এই প্রতিনিধিদল ১০ম হিজরী সনে বিদায় হজ্জের বছরে মদীনায় আসে। এরা ছিল রাসূল (সাঃ)-এর বিরুদ্ধে আরবদের মধ্যে সর্বাধিক বিদ্বেষী ও কঠোর হৃদয়ের। তাদেরকে রামলাহ বিনতুল হারেছ-এর গৃহে রাখা হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের মেহমানদারীর জন্য বেলাল (রাঃ)-কে নিযুক্ত করেন। সকাল-সন্ধ্যা তিনি তাদের খাবার পরিবেশন করতেন। একদিন রাসূল (সাঃ) যোহর থেকে আছর পর্যন্ত তাদের জন্য সময় দিলেন। এ সময় তিনি এক ব্যক্তির প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিয়ে বলেন, তোমাকে আমি যেন ইতিপূর্বে কোথায় দেখেছি? লোকটি বলল, আল্লাহর কসম! আপনি আমাকে দেখেছেন এবং আমার সাথে কথাও বলেছেন। আর সেটা হল মক্কার ‘ওকায’ (عُكَاظ) বাজারে যখন আপনি লোকদেরকে তাওহীদের দাওয়াত দিচ্ছিলেন। অথচ আমি আপনার বক্তব্যের কঠোর প্রতিবাদ করি এবং নিকৃষ্ট বাক্য সমূহ প্রয়োগ করি’। রাসূল (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ। ঠিক’। ঐ ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! ঐদিন আমার সাথীদের মধ্যে আমার চাইতে বেশী আপনাকে কেউ গালি দেয়নি এবং আমার চাইতে বেশী ইসলামের বিরোধিতাকারী সেদিন কেউ ছিল না। আমার সেই সব সাথীরা সকলেই স্ব স্ব পিতৃধর্মে মৃত্যুবরণ করেছে। অথচ তারা আপনার ব্যাপারে আমার চাইতে বেশী কঠোর ছিল না। অতএবفَأَحْمَدُ اللهَ الَّذِي أَبْقَانِي حَتَّى صَدَّقْتُ بِكَ ‘আমি আল্লাহর প্রশংসা করছি, যিনি আজও আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন আপনাকে সত্য বলে বিশ্বাস করার জন্য’। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন,إِنَّ الْقُلُوبَ بَيْنَ أَصْبُعَيْنِ مِنْ أَصَابِعِ اللهِ يُقَلِّبُهَا كَيْفَ يَشَاءُ ‘নিশ্চয় মানুষের অন্তরসমূহ আল্লাহর দু’আঙ্গুলের মাঝে রয়েছে। তিনি যেভাবে খুশী সেটাকে পরিচালিত করেন’ (তিরমিযী হা/২১৪০)। অতঃপর ঐ ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমার বিগত গোনাহ সমূহ মাফের জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করুন’। জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,إنَّ الْإِسْلاَمَ يَجُبُّ مَا كَانَ قَبْلَهُ مِنَ الكُفْر ‘ইসলাম তার পূর্বেকার সকল কুফরী দূর করে দেয়’। অতঃপর তিনি খুযায়মা বিন সুওয়া’(خُزَيْمَةُ بْنُ سُوَاء) এর মুখমন্ডলে হাত বুলিয়ে দেন। তাতে তার চেহারা উজ্জ্বল হয়ে যায়।[যাদুল মা‘আদ ৩/৫৭৯; ত্বাবাক্বাত ইবনু সা‘দ ১/২২৭]
একই ধরনের বক্তব্য এসেছে, যখন আমর ইবনুল ‘আছ ইসলাম কবুল করার জন্য মদীনায় আসেন, তখন বায়‘আতের জন্য হাত বাড়িয়ে দিয়ে আবার টেনে নেন। কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ইসলাম কবুল করার পর আমার বিগত গোনাহ সমূহ মাফ হবে কি? তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, ইসলাম(يَهْدِمُ مَا كَانَ قَبْلَهُ) বিগত সকল গোনাহ ধ্বসিয়ে দেয় এবং হিজরত বিগত সকল গোনাহ ধ্বসিয়ে দেয়’ (মুসলিম হা/১২১; মিশকাত হা/২৮)। অন্য বর্ণনায় এসেছে,إنَّ الْإِسْلاَمَ يَجُبُّ مَا كَانَ قَبْلَهُ مِنَ الذُّنُوبِ ‘নিশ্চয় ইসলাম তার বিগত সকল গোনাহ দূরীভূত করে দেয়’ (আহমাদ হা/১৭৮৬১, সনদ সহীহ)।
[শিক্ষণীয় : প্রকৃত তওবা ও বায়‘আত মানুষকে নতুন জীবন দান করে।]


২৮. ছুদা প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━
৮ম হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে এই প্রতিনিধি দল আগমন করে। হোনায়েন যুদ্ধের পর জি‘ইর্রানাহ থেকে মদীনায় ফেরার পথে রাসূল (সাঃ) ক্বায়েস বিন সা‘দ বিন ওবাদাহ-এর নেতৃত্বে ৪০০ সৈন্যের একটি দলকে ইয়ামন সীমান্তবর্তী ছুদা অঞ্চলে প্রেরণ করেন। তখন তাদের নেতা যিয়াদ ইবনুল হারেছ ছুদাঈ রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে হাযির হন এবং অনুরোধ করে বলেন, আপনি সৈন্যদলকে ফিরিয়ে নিন। আমি আমার সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে দায়িত্ব নিচ্ছি’। তখন রাসূল (সাঃ) সেনাদল ফেরত নিলেন। অতঃপর যিয়াদ ফিরে গিয়ে নিজ কওমকে ইসলামের প্রতি উৎসাহ প্রদান করেন এবং নেতৃস্থানীয় ১৫ জনকে নিয়ে বছরের শেষদিকে দ্বিতীয়বার মদীনায় আসেন। তারা রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে হাযির হয়ে তাঁর নিকটে বায়‘আত করে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর ফিরে গিয়ে নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসলামের দাওয়াত ছড়িয়ে দেন। ফলে ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের সময় এই সম্প্রদায়ের ১০০ জন লোক রাসূল (সাঃ)-এর সাথী হন’।[আর-রাহীক্ব ৪৪৬ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮০]
[শিক্ষণীয় : (১) দাওয়াতের মাধ্যমে ইসলামের প্রসার ঘটেছে, এটি তার অন্যতম প্রমাণ। (২) খবরে ওয়াহেদ অর্থাৎ একজনের সাক্ষ্য যে গ্রহণযোগ্য, যিয়াদের ঘটনায় তার প্রমাণ রয়েছে।]


২৯. গাসসান খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
সিরিয়া এলাকা হতে তিন সদস্যের এই খ্রিষ্টান প্রতিনিধি দলটি ১০ম হিজরীর রামাযান মাসে মদীনায় এসে ইসলাম কবুল করে। রাসূল (সাঃ) তাদেরকে বহু উপঢৌকন প্রদান করেন। অতঃপর তাঁরা নিজ গোত্রে ফিরে গিয়ে ইসলামের প্রচার ও প্রসারে নিয়োজিত হন। কিন্তু কেউ তাদের দাওয়াত কবুল করেনি। তখন তারা তাদের ইসলাম গোপন রাখেন এবং সেভাবেই দু’জন মৃত্যুবরণ করেন। উমর (রাঃ)-এর খেলাফতকালে সেনাপতি আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহর নেতৃত্বে সিরিয়া বিজয়ের সময়েও ঐ তিন জনের একজন জীবিত ছিলেন। তিনি তাঁকে উচ্চ সম্মান প্রদান করেন’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮৪)।
[শিক্ষণীয় : অমুসলিমদের কখনোই জোর করে মুসলমান করা হয়নি, এটি তার অন্যতম প্রমাণ।]


৩০. সালামান প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
হাবীব বিন ‘আমরের নেতৃত্বে ১০ম হিজরীর শাওয়াল মাসে ৭ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলটি রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতে এসে ইসলাম কবুল করে। তারা প্রশ্ন করে, হে আল্লাহর রাসূল!أَىُّ الأَعْمَالِ أَفْضَلُ ‘সর্বোত্তম আমল কোনটি? রাসূল (সাঃ) বললেন,الصَّلاَةُ لِوَقْتِهَا ‘ওয়াক্ত মোতাবেক সালাত আদায় করা’।[বুখারী হা/৭৫৩৪; মিশকাত হা/৫৬৮]
তারা তাদের এলাকায় খরা ও অনাবৃষ্টির অভিযোগ করল এবং দো‘আর আবেদন করল। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) দো‘আ করে বললেন, ‘হে আল্লাহ! এদেরকে তাদের এলাকায় বৃষ্টি দ্বারা পরিতৃপ্ত কর’। দলনেতা হাবীব আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার হাত দু’খানা উঠিয়ে একটু দো‘আ করুন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুচকি হেসে হাত উঠিয়ে দো‘আ করলেন। প্রতিনিধি দল তিনদিন অবস্থান করে। তাদেরকে বহুমূল্য উপঢৌকনাদি দেওয়া হয়। অতঃপর তারা নিজ এলাকায় ফেরৎ গিয়ে দেখল যে, ঠিক যেদিন দো‘আ করা হয়েছিল, সেদিনই তাদের এলাকায় বৃষ্টি হয়েছে’।[যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮৫; আল-বিদায়াহ ৫/৮৯]
[শিক্ষণীয় : অন্য হাদীছে এসেছে, খালেছ অন্তরে দো‘আ করলে তার জন্য আল্লাহ পাক তিনটি কল্যাণের যেকোন একটি দান করে থাকেন : (১) তার দো‘আ দ্রুত কবুল করেন অথবা (২) তার প্রতিদান আখেরাতের জন্য রেখে দেন অথবা (৩) তার থেকে অনুরূপ আরেকটি কষ্ট দূর করে দেন’।[আহমাদ হা/১১১৪৯; মিশকাত হা/২২৫৯] অতএব নেককার মুমিনের খালেছ দো‘আ সর্বদা সকলের জন্য ফলপ্রদ।]


৩১. বনু ‘আব্স প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মৃত্যুর চার মাস পূর্বে ৯ সদস্যের এই প্রতিনিধি দলের আগমন ঘটে। এরা ছিল নাজরান এলাকার খ্রিষ্টান বাসিন্দা এবং তারা মুসলমান হয়েই মদীনায় আসে।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে তারা জিজ্ঞেস করল, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের বিদ্বানগণ (قُرَّاؤُنَا) আগেই এসেছিলেন। অতঃপর তারা আমাদের খবর দিয়েছেন যে, আপনি বলেছেন, لاَ إسْلاَمَ لِمَنْ لاَ هِجْرَةَ لَهُ ‘যার হিজরত নেই, তার ইসলাম নেই’। সেকারণ আমরা চাই যে, আমাদের মাল-সম্পদ, গবাদি পশু সব বিক্রি করে দিয়ে পরিবার-পরিজন সহ মদীনায় হিজরত করে আসি এবং আপনার সাহচর্যে জীবন কাটিয়ে দিই’। রাসূল (সাঃ) বললেন,اتَّقُوا اللهَ حَيْثُ كُنْتُمْ فَلَنْ يَلِتَكُمْ مِنْ أَعْمَالِكُمْ شَيْئًا ‘যেখানে তোমরা আছ, সেখানে থেকেই আল্লাহকে ভয় কর। তোমাদের নেক আমলের ছওয়াবে কোনই কমতি হবে না’।[1]
[শিক্ষণীয় : মুসলমান যেখানেই থাকে, সেখানেই আল্লাহর বিধান মেনে চলে। বিশেষ কোন স্থানে বসবাস করা আবশ্যিক নয়। অবশ্য দ্বীনের স্বার্থে হিজরত ক্বিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে (বুখারী হা/২৭৮৩)।]


৩২. গামেদ প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━
ইয়ামনের ‘আযদ’ (الأزد) গোত্রের অন্তর্ভুক্ত ১০ সদস্যের এই প্রতিনিধি দল ১০ম হিজরীতে মদীনায় আসে। তারা মদীনার বাইরে তাদের সরঞ্জামাদি একটি বালকের যিম্মায় রেখে রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের জিজ্ঞেস করেন, মাল-সামান কার কাছে রেখে এসেছ? তারা বলল, একটি বালকের যিম্মায়’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমরা আসার পরে সে ঘুমিয়ে গিয়েছিল। একজন এসে তোমাদের কাপড়ের বাক্স চুরি করে নিয়ে গেছে। প্রতিনিধি দলের জনৈক সদস্য বলে উঠল, হে আল্লাহর রাসূল! ওটা তো আমার। রাসূল (সাঃ) বললেন, ভয় পেয়ো না। বাচ্চাটা উঠেছে এবং চোরের পিছে পিছে ছুটেছে ও তাকে পাকড়াও করেছে। তোমাদের সব মালামাল নিরাপদ আছে’। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ফিরে গিয়ে ছেলেটির কাছে যা শুনলো, তা সবকিছু রাসূল (সাঃ)-এর বক্তব্যের সাথে মিলে গেল। ফলে এতেই তারা মুসলমান হয়ে গেল। রাসূল (সাঃ) উবাই বিন কা‘বকে তাদের জন্য নিযুক্ত করেন। যাতে তিনি তাদের কুরআন মুখস্থ করান এবং ইসলামের বিধি-বিধান সমূহ শিক্ষা দেন। ফিরে যাবার সময় তাদেরকে উপঢৌকন দেন। যেমন অন্যান্য প্রতিনিধি দলকেও তিনি দিয়েছেন’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮৬)। অতঃপর উক্ত বিধি-বিধান সমূহ একটি কাগজে লিখে দেওয়া হয়’ (শারহুল মাওয়াহেব ৫/২২৫)।
[শিক্ষণীয় : এর মধ্যে রাসূল (সাঃ)-এর যুগে হাদীছ লিখনের দলীল পাওয়া যায়।]


৩৩. আযদ প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━
রাসূল (সাঃ)-এর প্রেরিত মুবাল্লিগগণের দ্বারা এঁরা পূর্বেই মুসলমান হন। অতঃপর তাদের গোত্রের পক্ষ হতে ৭ সদস্যের এই প্রতিনিধি দল রাসূল (সাঃ)-এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য মদীনায় আসেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কারা? তারা বললেন, আমরা মুসলমান। রাসূল (সাঃ) বললেন, প্রত্যেক বস্ত্তরই কিছু সারবত্তা (حَقِيقَةٌ) থাকে। তোমাদের বক্তব্যের সারবস্ত্ত কি? তারা বললেন, আমাদের মধ্যে ১৫টি বিষয় রয়েছে। ৫টি আক্বীদা বিষয়ক এবং ৫টি আমল বিষয়ক, যা আপনার প্রেরিত মুবাল্লিগগণ আমাদের শিখিয়েছেন। আর তা হল :
বিশ্বাস স্থাপন করা আল্লাহর উপরে, ফেরেশতাগণের উপরে, আল্লাহর কিতাবসমূহের উপরে, তাঁর প্রেরিত রাসূলগণের উপরে এবং মৃত্যুর পর পুনরুত্থানের উপরে।
অতঃপর আমল বিষয়ক পাঁচটি বস্ত্ত হল : লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ কালেমা মুখে স্বীকৃতি দেওয়া, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত আদায় করা, যাকাত দেওয়া, রামাযানের সিয়াম পালন করা এবং বায়তুল্লাহর হজ্জ করা, যদি সামর্থ্য থাকে।
এছাড়া যে পাঁচটি বিষয় আমাদের মধ্যে আগে থেকেই ছিল, তা হল: সচ্ছলতার সময় আল্লাহর শুকরগুযারী করা, বিপদের সময় ছবর করা, আল্লাহর ফায়ছালার উপর সন্তুষ্ট থাকা, পরীক্ষার সময় সত্যের উপর দৃঢ় থাকা এবং শত্রুকে গালি না দেওয়া।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, যারা তোমাদেরকে কথাগুলি শিখিয়েছেন, নিশ্চয়ই তারা অত্যন্ত জ্ঞানী মানুষ। সম্ভবতঃ তারা নবীগণের মধ্যেকার কেউ হবেন। আচ্ছা আমি তোমাদেরকে আরও পাঁচটি বিষয়ে শিক্ষা দিচ্ছি।-
(১) ঐ বস্ত্ত জমা করো না, যা খাওয়া হয় না (২) ঐ ঘর তৈরী করো না, যাতে বাস করা হয় না (৩) এমন কথার মুকাবিলা করো না, যা কালকে পরিত্যাগ করতে হবে (৪) আল্লাহর ভয় বজায় রাখো, যার কাছে ফিরে যেতে হবে ও যার কাছে উপস্থিত হতে হবে (৫) ঐসব বস্ত্তর প্রতি আকর্ষণ রাখো, যা তোমার জন্য আখেরাতে কাজ দিবে, যেখানে তুমি চিরস্থায়ীভাবে থাকবে’।
প্রতিনিধিদল কথাগুলি মুখস্থ করে নিল এবং তারা এর উপরে সর্বদা আমলকারী ছিল।[যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮৭; আল-বিদায়াহ ৫/৯৪]
[শিক্ষণীয় : সৌভাগ্যবান সেই ব্যক্তি, যে অন্যের সদুপদেশ গ্রহণ করে।]


৩৪. বনুল মুনতাফিক্ব প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
নাজদের ‘আমের বিন ছা‘ছা‘আহ গোত্রের অন্যতম নেতা লাক্বীত্ব বিন ‘আমের তার সাথী নাহীক বিন ‘আছেম ইবনুল মুনতাফিক্ব-কে সাথে নিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে আগমন করেন। তখন তিনি ফজর সালাতের পর লোকদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছিলেন। লাক্বীত্ব বলেন, ভাষণ শেষে আমি ও আমার সাথী দাঁড়িয়ে গেলাম। যাতে আমরা তাঁর দৃষ্টিতে পড়ি। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি গায়েব জানেন? তিনি বললেন, অদৃশ্য পাঁচটি বিষয়ের চাবিকাঠি কেবলমাত্র আল্লাহর নিকটে। তিনি ব্যতীত কেউ তা জানেনা। (১) কোথায় তোমার মৃত্যু হবে। (২) তোমার স্ত্রীর জরায়ুতে কি সন্তান আছে। (৩) আগামীকাল তুমি কি খাবে। (৪) কোথায় বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং (৫) কখন ক্বিয়ামত হবে’। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার নিকট কিসের উপর বায়‘আত করব? তখন রাসূল (সাঃ) হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, সালাত ও যাকাতের উপর এবং আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করবে না ও মুশরিকদের সাথে শত্রুতা করবে, একথার উপর। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! পূর্ব ও পশ্চিমে সর্বত্র আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হৌক। তখন তিনি তাঁর হাত টেনে নিলেন। তিনি ধারণা করলেন যে, আমরা তাঁকে এমন শর্ত দিচ্ছি, যা তাঁর পক্ষে পূরণ করা সম্ভব নয়। তখন আমি বললাম, আমরা যেখানে খুশী বসবাস করতে চাই এবং একজন ব্যক্তি নিজের অপরাধেই কেবল দোষী সাব্যস্ত হবে। তখন তিনি হাত বাড়িয়ে দিলেন এবং বললেন, তোমরা এটা পাবে। অতঃপর আমরা বায়‘আত করে ফিরে এলাম।
এসময় তাঁকে বনু বকর বিন কিলাবের জনৈক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! এরা কারা? তিনি বললেন, বনুল মুনতাফিক্ব গোত্রের। কথাটি তিনি তিনবার বললেন। অতঃপর আমরা ফিরে এসে তাঁকে প্রশ্ন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! জাহেলী হালতে যারা মারা গেছেন, অথচ তারা ভাবতেন যে, তারা সঠিক পথের উপরে আছেন, তাদের অবস্থা কি হবে? জবাবে একজন লোক বলে উঠল, আল্লাহর কসম! তোমার পিতা মুনতাফিক্ব অবশ্যই জাহান্নামের অধিবাসী। এতে আমার সমস্ত দেহমন জ্বলে উঠল। মনে হল আমি জিজ্ঞেস করি, হে আল্লাহর রাসূল! আপনার পিতার অবস্থা কি?... (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮৮-৯১ সনদ যঈফ)।
[শিক্ষণীয় : (১) আল্লাহ ব্যতীত গায়েবের খবর কেউ জানেনা। (২) মুশরিকদের সাথে আন্তরিক বন্ধুত্ব রাখা যাবে না এবং কোন অবস্থায় আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করা যাবে না। (৩) রাজনৈতিক ক্ষমতা বা দুনিয়াবী কোন কিছু পাওয়ার শর্তে আমীরের নিকট বায়‘আত করা যাবে না। (৪) সত্য হলেও কারু সামনে তার পিতা-মাতার বিষয়ে মন্দ কিছু বলা যাবে না।]


৩৫. কা‘ব বিন যুহায়ের বিন আবী সুলমার আগমন :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কা‘ব বিন যুহায়ের (হিঃ পূঃ ১৩-২৬ হিঃ/৬০৯-৬৪৬ খৃঃ) ‘মুখাযরামূন’ (الْمُخَضْرَمون) কবিদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। যিনি জাহেলী ও ইসলামী উভয় যুগ পেয়েছিলেন।
৮ম হিজরীর শেষে হোনায়েন ও ত্বায়েফ যুদ্ধ থেকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর মু‘আল্লাক্বা খ্যাত কবি যুহায়ের বিন আবী সুলমার জ্যেষ্ঠ পুত্র এবং আরবের শ্রেষ্ঠ কবিদের অন্যতম এই স্বল্পায়ু কবি রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে আগমন করেন ও ইসলাম কবুল করেন। তার ছোট ভাই বুহায়েরও কবি ছিলেন এবং তিনি পিতার অছিয়ত মোতাবেক মুসলমান হয়েছিলেন। কিন্তু বড় ভাই কা‘ব পিতার অছিয়ত অমান্য করে রাসূল (সাঃ)-এর কুৎসা রটনায় কবিতা লিখতে থাকেন। ফলে মক্কা বিজয়ের সময় যাদের রক্ত বৃথা ঘোষণা করা হয়, ইমাম হাকেমের মতে কা‘ব ছিলেন তাদের মধ্যকার অন্যতম। ৮ম হিজরীর শেষে হোনায়েন ও ত্বায়েফ যুদ্ধ থেকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় প্রত্যাবর্তনের পর কা‘বের ছোট ভাই বুহায়ের (অথবা বুজায়ের) তাকে পত্র লিখলেন যে, মক্কা বিজয়ের সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কয়েকজন কুৎসা রটনাকারীকে হত্যা করেছেন। তবে কেউ তওবা করে ক্ষমা প্রার্থনা করলে তিনি তাকে ক্ষমা করে থাকেন। অতএব বাঁচতে চাইলে তুমি সত্বর মদীনায় গিয়ে তওবা করে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা কর। দু’ভাইয়ের মধ্যে এভাবে পত্রালাপ চলতে থাকে এবং কা‘ব ক্রমেই ভীত হয়ে পড়তে থাকেন। অবশেষে তিনি একদিন মদীনায় এলেন এবং জোহায়না গোত্রের জনৈক ব্যক্তির বাড়ীতে আশ্রয় নিলেন। অতঃপর তিনি জোহানী ব্যক্তির সাথে গিয়ে মসজিদে নববীতে ফজরের সালাত আদায় করেন। সালাত শেষে জোহানীর ইশারায় তিনি রাসূল (সাঃ)-এর সামনে গিয়ে বসেন এবং তাঁর হাতে হাত রেখে বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! কা‘ব বিন যুহায়ের তওবা করে মুসলমান হয়ে এসেছে আপনার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনার জন্য। আমি যদি তাকে আপনার কাছে নিয়ে আসি, তাহলে আপনি কি তার প্রার্থনা কবুল করবেন? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন তিনি বলে উঠলেন, আমিই কা‘ব বিন যুহায়ের’।
উল্লেখ্য, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কা‘বকে চিনতেন না। এ সময় জনৈক আনছার লাফিয়ে উঠে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাকে অনুমতি দিন, ওর গর্দান উড়িয়ে দেই’। রাসূল (সাঃ) বললেন, ছাড় ওকে। সে তওবা করে এসেছে এবং সব কালিমা থেকে মুক্ত হয়েছে’। এই সময় কা‘ব রাসূল (সাঃ)-এর প্রশংসায় তার বিখ্যাত ক্বাছীদা (দীর্ঘ কবিতা) পাঠ করেন, যা ‘ক্বাছীদা বুরদাহ’ নামে খ্যাত। যার শুরু হল নিম্নোক্ত চরণ দিয়ে-
بَانَتْ سُعَادُ فَقَلْبِي الْيَوْمَ مَتْبُوْلُ * مُتَيِّمٌ إثْرَهَا لَمْ يُفْدَ مَكْبُوْلُ
‘প্রেমিকা সু‘আদ চলে গেছে। বিরহ ব্যথায় আমার হৃদয় আজ বিদীর্ণ। তার ভালোবাসার শৃংখলে আমি আবদ্ধ। আমার মুক্তিপণ দেওয়া হয়নি। আমি বন্দী’।
সে যুগের বিখ্যাত কবিরা এভাবে বিগত প্রেমিকার প্রতি বিরহ বেদনা প্রকাশ করেই তাদের দীর্ঘ কবিতাসমূহ শুরু করতেন।
অতঃপর ৩৯ লাইনে গিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর প্রশংসা এবং নিজের ক্ষমা প্রার্থনা করে তিনি বলেন,
نُبِّئْتُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ أَوْعَدَنِي * وَالْعَفْوُ عِنْدَ رَسُوْلِ اللهِ مَأْمُوْلُ
‘আমি জানতে পেরেছি যে, আল্লাহর রাসূল আমাকে হুমকি দিয়েছেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল-এর নিকটে সর্বদা ক্ষমাই কাম্য’।
مَهْلاً هَدَاكَ الَّذِيْ أَعْطَاكَ نَافِلَةَ الْ * قُرْآنِ فِيْهَا مَوَاعِيْظُ وَتَفْصِيْلُ
‘থামুন! আল্লাহ আপনাকে সুপথ প্রদর্শন করুন! যিনি আপনাকে বিশেষ পুরস্কার হিসাবে কুরআন দান করেছেন। যার মধ্যে রয়েছে উপদেশ সমূহ এবং সকল বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা সমূহ’।
لاَ تَأْخُذَنِّيْ بِأَقْوَالِ الْوُشَاةِ وَلَمْ * أُذْنِبْ وَلَوْ كَثُرَتْ فِيَّ الْأَقَاوِيْلُ
‘নিন্দুকদের কথায় আমাকে পাকড়াও করবেন না। আমি কোন অপরাধ করিনি। যদিও আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে।
لَقَدْ أَقُوْمُ مَقَامًا لَوْ يَقُوْمُ بِهِ * أَرَى وَأَسْمَعُ مَا لَوْ يَسْمَعُ الْفِيَلُ
‘আমি এমন এক স্থানে দাঁড়িয়েছি এবং দেখছি ও শুনছি, যদি কোন হাতি সেখানে দাঁড়াতো ও সেকথা শুনতো-
لَظَلَّ يَرْعَدُ إلاَّ أَنْ يَكُوْنَ لَهُ * مِنْ الرَّسُوْلِ بِإِذْنِ اللهِ تَنْوِيْلُ
‘তাহলে সে অবশ্যই কাঁপতে থাকত। তবে যদি আল্লাহর অনুমতিক্রমে রাসূলের পক্ষ হতে তার জন্য অনুকম্পা হয়’।
حَتَّى وَضَعْتُ يَمِيْنِيْ مَا أُنَازِعُهُ * فِي كَفِّ ذِيْ نَقِمَاتٍ قِيْلُهُ الْقِيْلُ
‘অবশেষে আমি আমার ডান হাত রেখেছি যা আমি ছাড়িয়ে নেইনি, এমন এক হাতের তালুতে, যিনি প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতাশালী এবং যাঁর কথাই চূড়ান্ত কথা’।
فَلَهُوَ أَخْوَفُ عِنْدِيْ إذْ أُكَلِّمُهُ * وَقِيْلَ إنَّكَ مَنْسُوْبٌ وَمَسْئُوْلُ
‘অতঃপর নিশ্চয়ই তিনি আমার নিকটে অধিক ভীতিকর ব্যক্তি, যখন আমি তাঁর সাথে কথা বলি, এমন অবস্থায় যে আমার সম্পর্কে বলা হয়েছে, তুমি (অমুক অমুক ব্যঙ্গ কবিতার দিকে) সম্পর্কিত এবং সেগুলি সম্পর্কে তুমি জিজ্ঞাসিত হবে’।
مِنْ ضَيْغَمٍ بِضَرَّاءِ الْأَرْضِ مُخْدَرُهُ * فِيْ بَطْنِ عَثَّرَ غَيْلٌ دُوْنَهُ غَيْلُ
‘(তিনি আমার নিকট অধিক ভীতিকর) যমীনের কঠিনতম স্থানের ঐ সিংহের চাইতে, যার অবস্থানস্থল এমন উপত্যকায়, যেখানে পৌঁছার আগেই ঘাতক নিহত হয়ে যায়’।
অতঃপর ৫১ লাইনে পৌঁছে তিনি রাসূল (সাঃ)-এর প্রশংসায় বলেন,
إنَّ الرَّسُوْلَ لَنُوْرٌ يُسْتَضَاءُ بِهِ * مُهَنَّدٌ مِنْ سُيُوْفِ اللهِ مَسْلُوْلُ
‘নিশ্চয়ই রাসূল আলোকস্তম্ভ স্বরূপ, যা থেকে আলো গ্রহণ করা হয়। তিনি আল্লাহর তরবারি সমূহের মধ্যে কোষমুক্ত হিন্দুস্থানী তরবারি সদৃশ’ (ইবনু হিশাম ২/৫১২)।
এ সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) খুশী হয়ে নিজের চাদর কবির গায়ে জড়িয়ে দেন (আল-ইছাবাহ, কা‘ব ক্রমিক ৭৪১৬)। এজন্য কবির এ দীর্ঘ কবিতাটি ‘ক্বাছীদাতুল বুরদাহ’(قَصِيْدَةُ الْبُرْدَةِ) বা চাদরের ক্বাছীদা নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে। যা কবির ছেলের নিকট থেকে মু‘আবিয়া (রাঃ) খরীদ করে নেন। অতঃপর তা খলীফাগণ ঈদের দিন সমূহে পরিধান করতেন (আল-ইছাবাহ)।[2] কবিতা শেষে রাসূল (সাঃ) তাকে জিজ্ঞেস করেন, সু‘আদ কে? তিনি বললেন, আমার স্ত্রী (আল-বিদায়াহ ৪/৩৭৩)। এরপর রাসূল (সাঃ) তাকে বলেন, যদি তুমি আনছারদের প্রশংসায় কিছু বলতে! কেননা তারাই এর উপযুক্ত। তখন তিনি রাসূল (সাঃ)-এর জন্য আনছারদের অপূর্ব ত্যাগের প্রশংসায় ১৩ লাইন কবিতা বলেন (ইবনু হিশাম ২/৫১৪-১৫)। ক্বাছীদাহ বুরদার কবিতা সংখ্যা বায়হাক্বী ৪৮ বলেছেন (বায়হাক্বী কুবরা হা/২০৯৩১)। পক্ষান্তরে ইবনু হিশাম ৫৮ লাইন উদ্ধৃত করেছেন (ইবনু হিশাম ২/৫০৩-১৩)।
ইবনু কাছীর বলেন, উপরের কথাগুলি প্রসিদ্ধ হলেও আমি এমন কোন বিশুদ্ধ সূত্র পাইনি, যাতে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি (আল-বিদায়াহ ৪/৩৭৩)। শাওকানী বলেন, হাফেয ইরাক্বী বলেন যে, উক্ত ক্বাছীদাটি আমরা বিভিন্ন সূত্রে বর্ণনা করেছি। যার একটিও বিশুদ্ধ নয় (নায়লুল আওত্বার ২/১৮৬)।
উল্লেখ্য যে, ‘ক্বাছীদাতুল বুরদাহ’ নামে প্রসিদ্ধ আরেকটি ক্বাছীদা হল, রাসূল (সাঃ)-এর প্রশংসায় মিসরের কবি মুহাম্মাদ বিন সাঈদ আল-বূছীরী (৬০৮-৬৯৬ হি./১২১২-১২৯৬ খৃ.) লিখিত ১৬৫ লাইনের দীর্ঘ কবিতা। যা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। উক্ত দীর্ঘ কবিতাটি একটি অলৌকিক কবিতা হিসাবে পরিচিত। যেখানে পক্ষাঘাতগ্রস্ত কবি স্বপ্নে রাসূল (সাঃ)-এর দর্শন লাভ করেন এবং স্বপ্নের মধ্যেই তাঁকে তাঁর প্রশংসায় লিখিত উক্ত ক্বাছীদাটি শুনান। তাতে খুশী হয়ে রাসূল (সাঃ) কবির গায়ে তাঁর চাদরটি জড়িয়ে দেন। অতঃপর ঘুম থেকে উঠে কবি দেখেন যে, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ। তখন থেকে এটি রোগ নিরাময়ের বরকতময় কবিতা হিসাবে প্রসিদ্ধি অর্জন করে।
বলা হয়ে থাকে যে, উক্ত ক্বাছীদা পাঠের ৮টি পূর্বশর্ত রয়েছে। যেমন প্রথমে ওযূ করতে হবে, ক্বিবলামুখী হতে হবে, বিশুদ্ধ উচ্চারণসহ অর্থ বুঝে ছন্দ মিলিয়ে মিলিয়ে মুখস্থ পড়তে হবে, পাঠককে অনুমতিপ্রাপ্ত কোন ব্যক্তির নিকট থেকে অনুমতিপ্রাপ্ত হতে হবে এবং কবি মনোনীত বিশেষ দরূদ সহ পাঠ করতে হবে। দরূদটি হল, مَولايَ صَلِّ وسلِّمْ دَائِمًا أبدًا عَلَى حَبِيبكَ خَيرِ الْخَلْقِ كُلِّهِمْ। বলা বাহুল্য এগুলির কোন শারঈ ভিত্তি নেই। তাছাড়া উক্ত ক্বাছীদার কিছু কিছু লাইনে তাওহীদ পরিপন্থী কুফরী বক্তব্য রয়েছে। ইমাম ইবনু তায়মিয়াহ সহ বিশ্ববিখ্যাত বিদ্বানগণ এই ক্বাছীদার বরকত সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা সমূহের তীব্র প্রতিবাদ করেন।[3]
[শিক্ষণীয় : মিথ্যা অপবাদ ও কুৎসা রটনা করা জঘন্যতম অপরাধ। এ থেকে তওবা করার পথ হল পুনরায় প্রশংসা করা। এর মাধ্যমেই কেবল তাকে ক্ষমা করা যেতে পারে। গণমাধ্যম কর্মীদের উপরোক্ত ঘটনা থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা উচিত।]


৩৬. ইয়ামনের শাসকদের দূতের আগমন :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
তাবূক অভিযান থেকে মদীনায় ফেরার পর ৯ম হিজরীর রামাযান মাসে ইয়ামনের হিমইয়ার শাসকদের পত্র নিয়ে তাদের দূত মালেক বিন মুররাহ আর-রাহাভী(مَالِكُ بنُ مُرَّةَ الرَّهَاوِيُّ) রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতে আগমন করেন। পত্রে তাদের শাসকদের ইসলাম কবুলের এবং শিরক ও শিরককারীদের সাথে সম্পর্কচ্যুতির খবর ছিল। ঐ শাসকগণের নাম ছিল হারেছ বিন ‘আব্দে কুলাল(الْحَارِثُ بنُ عَبْدِ كُلاَل) তার ভাই নু‘আইম বিন ‘আব্দে কুলাল ও নু‘মান। যারা ছিলেন যু-রু‘আইন, মা‘আফির ও হামদান এলাকার শাসক।
জওয়াবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একটি পত্র সহ মু‘আয বিন জাবালের নেতৃত্বে একদল সাহাবীকে সেখানে শিক্ষা দানের জন্য প্রেরণ করেন। পত্রে তিনি মুমিনদের করণীয় বিষয়সমূহ এবং জিযিয়া প্রদানের বিষয়াদি উল্লেখ করেন’।[4]
[শিক্ষণীয় : শিরক ও তাওহীদ কখনো একত্রে চলতে পারে না। শাসকদের ক্ষেত্রেও সেকথা প্রযোজ্য। মুসলমান নামধারী ধর্মনিরপেক্ষ এবং তথাকথিত মডারেট বা শৈথিল্যবাদী লোকদের জন্য উপরের ঘটনায় শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।]


৩৭. নাখ‘ঈ প্রতিনিধি দল :
━━━━━━━━━━━━━━━━
এটাই ছিল সর্বশেষ আগত প্রতিনিধি দল। যারা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মৃত্যুর দু’মাস পূর্বে ১১ হিজরীর মুহাররম মাসের মাঝামাঝি সময়ে মদীনায় আগমন করে। এদের পরে আর কোন প্রতিনিধি দল আসেনি। ইয়ামন থেকে আগত ২০০ জনের এই বিরাট প্রতিনিধি দলটি আগেই মু‘আয বিন জাবাল (রাঃ)-এর হাতে মুসলমান হয়েছিল। তাদেরকে কেন্দ্রীয় মেহমানখানায়(دَارُ الضِّيَافَةِ) রাখা হয়। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন যুরারাহ বিন ‘আমর(زُرَارَةُ بْنُ عَمْرٍو)। তিনি বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আসার সময় রাস্তায় আমি কয়েকটি আজব স্বপ্ন দেখেছি। এর ব্যাখ্যা কি হবে? রাসূল (সাঃ) বললেন, শুনাও দেখি’।-
১ম স্বপ্ন : যুরারাহ বললেন, আমি দেখলাম যে, বকরী বাচ্চা দিয়েছে, যা সাদা ও কালো রংয়ের ডোরাকাটা (أَبْلَق)।
ব্যাখ্যা : রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমার স্ত্রীর ছেলে হয়েছে এবং সেটা তোমারই ছেলে।
যুরারাহ বললেন, কিন্তু সাদা-কালো ডোরাকাটা কেন হল? রাসূল (সাঃ) তাকে কাছে ডেকে গোপনে আস্তে আস্তে বললেন, তোমার দেহে শ্বেতকুষ্ট ব্যাধি রয়েছে, যা তুমি লোকদের থেকে লুকিয়ে রাখো। তোমার সন্তানের মধ্যে সেটারই প্রভাব পড়েছে। যুরারাহ বলে উঠলেন, কসম আল্লাহর, যিনি আপনাকে সত্য রাসূল হিসাবে প্রেরণ করেছেন, আমার এই গোপন রোগের খবর এ যাবত কারুরই জানা ছিল না।
২য় স্বপ্ন : যুরারাহ বললেন, আমি আরবের বাদশাহ নু‘মান বিন মুনযিরকে হাতে বাযুবন্দ, কোমরে কংকন ইত্যাদি অলংকারাদি পরিহিত অবস্থায় দেখলাম (সীরাহ হালাবিইয়াহ ৩/২৭৯)।
ব্যাখ্যা : রাসূল (সাঃ) বললেন, এর দ্বারা আরব দেশকে বুঝানো হয়েছে। যা এখন শান্তি ও সচ্ছলতা লাভ করেছে।
৩য় স্বপ্ন : আমি একটা বুড়ীকে দেখলাম মাটি থেকে বেরিয়ে আসছে এবং যার চুলের কিছু অংশ সাদা ও কিছু অংশ কালো।
ব্যাখ্যা : রাসূল (সাঃ) বললেন, এর দ্বারা ‘দুনিয়া’ বুঝানো হয়েছে। যার (ধ্বংসের) বাকী সময়টুকু এখনো অবশিষ্ট রয়েছে।
৪র্থ স্বপ্ন : আমি দেখলাম যে, একটা দাবানল মাটি থেকে উত্থিত হল। যা আমার ও আমার ছেলের মধ্যবর্তী স্থানে এসে গেল। আগুনটি বলছে, পোড়াও পোড়াও চক্ষুষ্মান হৌক বা অন্ধ হৌক। হে লোকেরা! তোমাদের খাদ্য, তোমাদের বংশ, তোমাদের মাল-সম্পদ সব আমাকে খাবার জন্য দাও’।
ব্যাখ্যা : রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, এটা হল ফাসাদ, যা আখেরী যামানায় বের হবে। যুরারাহ বললেন, সেটা কেমন ফিৎনা হবে? রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, লোকেরা তাদের খলীফাকে (إمام) হত্যা করবে। তারা আপোষে এমন লড়াইয়ে মত্ত হবে, যেমন দু’হাতের পাঞ্জার আঙ্গুলগুলি পরস্পরে জড়িয়ে যায়। বদকার লোকেরা ঐ সময় নিজেদের নেককার মনে করবে। ঈমানদারগণের রক্ত পানির মত সস্তা মনে করা হবে। যদি তোমার ছেলে মারা যায়, তবে তুমি দেখবে। আর তুমি মারা গেলে তোমার ছেলে এই ফেৎনা দেখবে’।
যুরারাহ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! দো‘আ করুন যেন আমি এই ফেৎনা না দেখি। রাসূল (সাঃ) তার জন্য দো‘আ করলেন, ‘হে আল্লাহ! সে যেন এই ফেৎনার যামানা না পায়’। পরে দেখা গেল যে, যুরারাহ মারা গেলেন। তার ছেলে বেঁচে থাকল। যে হযরত উছমান (রাঃ)-এর বায়‘আত ছিন্ন করেছিল’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৫৯৯-৬০০)।
[শিক্ষণীয় : দুনিয়াবী স্বার্থ মানুষকে অন্ধ করে দেয়। মুসলমানেরা তা থেকে নিরাপদ থাকবে না। আখেরাত পিয়াসীগণ হবেন উক্ত হামলার প্রধান টার্গেট। অতএব ঈমানদারগণ সাবধান!]




[1]. রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১৮১; শারহুল মাওয়াহেব ৫/২২৪; যাদুল মা‘আদ ৩/৫৮৫। মানছূরপুরী এখানে বনু ‘আব্স (بَنُو عَبْس)-এর বদলে বনু ‘আয়েশ (بنو عيش) লিখেছেন। সম্ভবতঃ এটি মুদ্রণ জনিত ভুল।
[2]. ইবনু হিশাম ২/৫০৩-০৮, সনদ ‘মুরসাল’ (তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৮৫৪); হাকেম হা/৬৪৭৯; যাদুল মা‘আদ ৩/৪৫৫-৬০; আর-রাহীক্ব ৪৪৬ পৃঃ বর্ণনাটির সনদ সহীহ নয় (ঐ, তা‘লীক্ব ১৭৮ পৃঃ)।
[3]. গৃহীত : ক্বাছীদাতুল বুরদাহ (কাব্যানুবাদ) ড. মুহাম্মাদ ফজলুর রহমান (প্রফেসর আরবী বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)। প্রকাশক : রিয়াদ প্রকাশনী (ঢাকা, পশ্চিম নাখালপাড়া, জানুয়ারী ২০০১) ৯-১০ পৃঃ।
[4]. ইবনু সা‘দ ১/২৬৭; ইবনু হিশাম ২/৫৮৮, বর্ণনাটির সনদ ‘মুরসাল’ তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১৯৭৫; আর-রাহীক্ব ৪৪৯ পৃঃ। মুবারকপুরী এখানে নু‘মান বিন ক্বীল যী-রাঈন লিখেছেন, যা ভুল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...