শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ পর্ব-১

 

কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ পর্ব-১

১. কুরআনের অপরিবর্তনীয়তা (عدم تغيير القرآن) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআন তার অবতরণকাল থেকে এযাবত একইভাবে অপরিবর্তিত অবস্থায় রয়েছে। দেড় হাযার বছর পূর্বে যে কুরআন পাঠ করা হত, এখনো সেই কুরআনই পাঠ করা হয়। যার একটি শব্দ ও বর্ণ পরিবর্তিত হয়নি বা মুছে যায়নি। অথচ তাওরাত, যবূর, ইনজীল প্রভৃতির মূল গ্রন্থের অস্তিত্ব দুনিয়াতে নেই।


২. বিশ্বময়তা (عالمية القرآن) :
━━━━━━━━━━━━━━━━
যে রাতে নুযূলে কুরআনের সূচনা হয়, সে রাতে একজনই মাত্র শ্রোতা ছিলেন সৌভাগ্যবতী নারী হযরত খাদীজাতুল কুবরা (রাঃ)। অথচ সেই কুরআন ক্রমে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে। আজ পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে কোটি কোটি মানবসন্তান পাঁচ ওয়াক্ত সালাতে ও সালাতের বাইরে কুরআনের কিছু না কিছু অংশ হরহামেশা পাঠ করে থাকে। কুরআন বর্তমান বিশ্বের সর্বাধিক পঠিত গ্রন্থ হিসাবে সমাদৃত। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে যে, সূরা ফাতিহা প্রতিদিন যতবার পাঠ করা হয়, বিশ্বের কোন ভাষার কোন পাঠ্যাংশের সেই সৌভাগ্য আজ পর্যন্ত হয়নি’। অনেক খ্রিষ্টান দার্শনিকের মতে ২০৫০ সালের মধ্যেই ইসলাম বিশ্বের বৃহত্তম ধর্ম হিসাবে আত্মপ্রকাশ করবে’। কুরআনই যে তার প্রধান কারণ তা বলাই বাহুল্য।


৩. নিজ ভাষাতেই পঠিত (متلو فى لغته) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
যে আরবী ভাষাতে কুরআন নাযিল হয়েছে, সেই ভাষাতেই কুরআন সর্বত্র পঠিত হয়। খ্রিষ্টানরা বাইবেলের কথিত অনুবাদ পাঠ করে থাকে। তাও পাঠকারীর সংখ্যা অতি নগণ্য। যেকারণে বিশিষ্ট ইভানজেলিষ্ট জর্জ গ্যালাপের মতে, ‘আমেরিকানরা হল বাইবেল অন্ধ জাতি’ (দৈনিক আমার দেশ)। অর্থাৎ আসল বাইবেল সম্পর্কে তারা অন্ধ। যা কখনোই তারা দেখেনি। বস্ত্ততঃ তওরাত, যবূর, ইনজীল প্রভৃতি ইলাহী গ্রন্থ যে ভাষায় নাযিল হয়েছিল, সেই ভাষা বা বর্ণমালা এমনকি বেদ, যিন্দাবেস্তা প্রভৃতির ভাষা ও বর্ণমালা এবং সেসবের ভাষাভাষী কোন মানুষের অস্তিত্ব বর্তমান পৃথিবীতে নেই। পক্ষান্তরে আরবী ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা পৃথিবীতে কোটি কোটি এবং তা ক্রমবর্ধমান। আরবী বর্তমানে জাতিসংঘের ৬ষ্ঠ আন্তর্জাতিক ভাষা হিসাবে বরিত।
উল্লেখ্য যে, হিব্রু (الْعِبْرَانِى) যা তওরাতের ভাষা ছিল, খালেদী (خَالِدِي) যা মসীহ ঈসার ভাষা ছিল, দুররাই (دُرَّي) যা যিন্দাবিস্তার ভাষা ছিল, সংস্কৃত (سَنْسكِرِت) যা বেদ-এর ভাষা ছিল, তা পৃথিবীর কোন দেশ এমনকি কোন যেলা বা মহল্লাতেও জনগণের মুখের ভাষা হিসাবে এখন চালু নেই। আল্লাহর পক্ষ থেকেই ঐসব ভাষা উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু রেখে দেওয়া হয়েছে আরবী ভাষাকে। যা কুরআন-হাদীছের স্বার্থে ক্বিয়ামত পর্যন্ত জীবন্ত থাকবে। উল্লেখ্য যে, বাইবেলের যে ‘নতুন নিয়ম’ (New Testament) পাওয়া যায়, তাতে লেখা আছে Translated out of the original Greek known as the authorised version (মূল গ্রীক থেকে অনূদিত। যা অনুমোদিত ভাষান্তর হিসাবে পরিচিত)। এতে বুঝা যায় যে, বাইবেলের আরও version আছে। যা কোন কারণ বশতঃ অনুমোদিত হয়নি। দ্বিতীয়তঃ বর্তমান বাইবেল গ্রীক ভাষা থেকে অনূদিত। কিন্তু প্রশ্ন হল ঈসা (আঃ) তো গ্রীসের বাসিন্দা ছিলেন না। তার মাতৃভাষাও গ্রীক ছিল না। তিনি ফিলিস্তীনে জন্ম গ্রহণ করেন ও নিজ এলাকায় প্রচলিত খালেদী ভাষায় তিন বছর ধর্ম প্রচার করেন। তাহলে ইনজীলের মূল ভাষা গ্রীক হল কিভাবে?
আধুনিক সেক্যুলারিজমের কুপ্রভাব কুরআনের প্রতি মানুষের তীব্র আকর্ষণ বিন্দুমাত্র কমাতে পারেনি। কেননা কুরআনের ভাষা সরাসরি আল্লাহর ভাষা। এটি হল জান্নাতের ভাষা। কুরআনের প্রতিটি বাক্য, শব্দ ও বর্ণ আল্লাহর নূরে আলোকিত। যা বিশ্বাসী মুসলমানের হৃদয় জগতকে আলোকিত করে। জাহেলিয়াতের গাঢ় অন্ধকার দূরীভূত করে। বিষাদিত অন্তরকে আমোদিত করে। জর্জরিত অন্তরকে সুশীতল করে। মুমিনের হৃদয়ে কুরআনের প্রভাব তাই অতুলনীয় ও অনির্বচনীয়। যার প্রতি হরফে মুসলমান কমপক্ষে দশটি করে নেকী পায়। যা তার পরকালকে সমৃদ্ধ করে। মানছূরপুরীর হিসাব মতে কুরআনের সর্বমোট হরফের সংখ্যা ৩,৪৬,৯৯৮টি (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/২৭৬)। বিশিষ্ট কুরআন গবেষক কনস্ট্যান্স প্যাডউইক তাই বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, ‘কুরআন তার অনুসারীদের অন্তরে জাগ্রত। তাদের কাছে এটি নিছক কিছু শব্দ বা কথামালা নয়। এগুলি আল্লাহর নূরে প্রজ্জ্বলিত অগ্নিশিখার জ্বালানী’ (দৈনিক আমার দেশ)। তুরস্কের প্রথম ধর্মনিরপেক্ষ শাসক কামাল পাশা অতি উৎসাহী হয়ে আরবী আযান বাতিল করে তুর্কী আযান চালু করেন। পরে জনরোষে পড়ে পুনরায় আরবী আযান চালু করতে বাধ্য হন।


৪. কুরআনের হেফাযতকারী আল্লাহ (الله حافظ للقرآن) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআন একমাত্র ইলাহী গ্রন্থ যার হেফাযতের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ নিয়েছেন। তিনি বলেন, إِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَإِنَّا لَهُ لَحَافِظُوْنَ ‘আমি কুরআন নাযিল করেছি এবং আমিই এর হেফাযতকারী (হিজর ১৫/৯)। তিনি বলেন, إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ، فَإِذَا قَرَأْنَاهُ فَاتَّبِعْ قُرْآنَهُ، ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ ‘এর সংরক্ষণ ও পঠন-পাঠন আমাদেরই দায়িত্বে’। ‘সুতরাং যখন আমি তা (জিব্রীলের মাধ্যমে) পাঠ করাই, তখন তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কর’। ‘অতঃপর এর ব্যাখ্যা করা (হাদীছ) আমাদেরই দায়িত্বে’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৭-১৯)। অতএব আল্লাহ কেবল কুরআন ও হাদীছের হেফাযতের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাই তা ক্বিয়ামত অবধি টিকে থাকবে। কিন্তু অন্যান্য এলাহী গ্রন্থের দায়িত্ব আল্লাহ নেননি। তাই সেসব হারিয়ে গেছে এবং যেতে বাধ্য।


৫. কুরআন সকল জ্ঞানের উৎস (مصدر كل علم) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআন যারা মানেন এবং যারা মানেন না, সকলে কুরআনের বিভিন্নমুখী হেদায়াত থেকেই আলো নিয়েছেন। বরং আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের মূল উৎসই হল কুরআন। অন্য কোন ধর্মগ্রন্থের এই বৈশিষ্ট্য নেই। বিজ্ঞানীদের মতে কুরআনের প্রতি ১১টি আয়াত বিজ্ঞান বহন করে। এর দ্বারা তারা হয়ত কেবল বস্ত্তগত বিজ্ঞান সমূহের হিসাব করেছেন। কিন্তু এছাড়াও সেখানে রয়েছে সমাজ বিজ্ঞান, অধ্যাত্ম বিজ্ঞান, ভাষা বিজ্ঞান, সমর বিজ্ঞান, ভূতত্ত্ব ও নভো বিজ্ঞান প্রভৃতি। তাছাড়া রয়েছে জীবনের বিভিন্ন শাখা ও প্রশাখাগত বিষয়ক বিজ্ঞান। সে হিসাবে কুরআনের প্রতিটি আয়াতই বিজ্ঞান বহন করে। কুরআনী বিজ্ঞানের চর্চা করেই মুসলমানেরা কয়েক শতাব্দীব্যাপী বিশ্ব বিজ্ঞানের অগ্রনায়ক ছিল। অতঃপর বাগদাদ ও স্পেনের রাজনৈতিক পতনের ফলে বিজ্ঞানেরও পতন ঘটে এবং তাদেরই রেখে যাওয়া বিজ্ঞানের অনুসরণ করে বস্ত্তবাদী ইউরোপ আজ ক্রমে মুসলমানদের শূন্যস্থান পূরণ করে চলেছে।
মনুষ্য বিজ্ঞানের উৎস হল অনুমিতি। যা যেকোন সময় ভুল প্রমাণিত হয়। যেমন বিজ্ঞানীরা বলেন, Science gives us but a partial knowledge of reality ‘বিজ্ঞান আমাদেরকে কেবল আংশিক সত্যের সন্ধান দেয়’। তারা স্রেফ অনুমানের ভিত্তিতে কাজ শুরু করে থাকেন। তারা বলেন, ‘আমরা কতিপয় বাহ্য প্রকাশকে দেখি মাত্র, মূল বস্ত্তকে দেখিনা’। যেমন ধোঁয়া দেখে মানুষ আগুনের সন্ধানে ছুটে থাকে। কিন্তু কুরআনী বিজ্ঞানের উৎস হল আল্লাহর অহী। যেখানে ভুলের কোন অবকাশ নেই। যেমন আল্লাহ বলেন, لاَ يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ ‘সম্মুখ থেকে বা পিছন থেকে এর মধ্যে মিথ্যার কোন প্রবেশাধিকার নেই। এটি ক্রমান্বয়ে অবতীর্ণ হয়েছে প্রজ্ঞাময় ও প্রশংসিত সত্তার পক্ষ হতে’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৪২)। আজকের যেসব বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার আমরা দেখছি তার প্রায় সবেরই উৎস রয়েছে কুরআনে। যা সর্বপ্রথম উচ্চারিত হয়েছিল চৌদ্দশ’ বছর পূর্বে একজন মরুচারী নিরক্ষর নবীর মুখ দিয়ে- যা ছিল আল্লাহর কালাম। উদাহরণ স্বরূপ-
(১) জগত সৃষ্টির বৈজ্ঞানিক তথ্য হিসাবে বলা হয়, ‘কোটি কোটি বছর পূর্বে বিশ্বজগত একটি অখন্ড জড়বস্ত্ত রূপে বিদ্যমান ছিল। পরে তার কেন্দ্রে একটি মহাবিস্ফোরণ ঘটে, যাকে Big-Bang বলা হয়। সেই মহা বিস্ফোরণের ফলে আমাদের সৌরজগত, ছায়াপথ, তারকারাজি ইত্যাদি সৃষ্টি হল এবং বিনা বাধায় সর্বত্র সন্তরণ করে চলল’। অথচ কুরআন বহু পূর্বেই এ তথ্য প্রদান করেছে। আল্লাহ বলেন, أَوَلَمْ يَرَ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا أَنَّ السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضَ كَانَتَا رَتْقاً فَفَتَقْنَاهُمَا ‘অবিশ্বাসীরা কি দেখে না যে, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী পরস্পরে মিলিত ছিল। অতঃপর আমরা উভয়কে পৃথক করে দিলাম’ (আম্বিয়া ২১/৩০)। প্রশ্ন হল, বিস্ফোরণ ঘটালো কে? সেখানে প্রাণের সঞ্চার হল কিভাবে? অতঃপর বিশাল সৃষ্টি সমূহ অস্তিত্বে আনল কে? যদি কেউ বলে যে, প্রেস মেশিনে বিস্ফোরণ ঘটেছে এবং তা ধ্বংস হয়ে টুকরা টুকরা হয়ে গেছে। অতঃপর সেখানে তৈরী হয়েছে বড় বড় গবেষণাগ্রন্থ। একথা কেউ বিশ্বাস করবে কি?
(২) প্রাণের উৎস কি? এ বিষয়ে বিজ্ঞানীরা বলছেন, পানি থেকেই প্রাণীজগতের উদ্ভব। অথচ কুরআন একথা আগেই বলেছে, وَجَعَلْنَا مِنَ الْمَاءِ كُلَّ شَيْءٍ حَيٍّ أَفَلاَ يُؤْمِنُونَ ‘আমি প্রাণবান সবকিছু সৃষ্টি করেছি পানি হতে। তবুও কি তারা বিশ্বাস স্থাপন করবে না?’ (আম্বিয়া ২১/৩০; নূর ২৪/৪৫)। প্রশ্ন হল, পানি সৃষ্টি করল কে? অতঃপর তার মধ্যে প্রাণ শক্তি এনে দিল কে?
(৩) বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রতিটি প্রাণসত্তার মধ্যে রয়েছে বিপরীতধর্মী দু’টি শক্তির জোড়। যার একটি পজেটিভ বা প্রোটন এবং অপরটি নেগেটিভ বা ইলেকট্রন। এমনকি বিদ্যুতের ন্যায় প্রাণহীন বস্ত্তর মধ্যেও রয়েছে এই জোড়ার সম্পর্ক। অথচ কুরআন বহু পূর্বেই এর তথ্য দিয়েছে, سُبْحَانَ الَّذِيْ خَلَقَ الْأَزْوَاجَ كُلَّهَا مِمَّا تُنبِتُ الْأَرْضُ وَمِنْ أَنفُسِهِمْ وَمِمَّا لاَ يَعْلَمُوْنَ ‘মহাপবিত্র সেই সত্তা, যিনি ভূ-উৎপন্ন সকল বস্ত্ত এবং মানুষ ও তাদের অজানা সবকিছুকে জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছেন’ (ইয়াসীন ৩৬/৩৬)। (৪) উদ্ভিদের জীবন আছে, একথা বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু (১৮৫৮-১৯৩৭ খৃ.) মাত্র সেদিন আবিষ্কার করলেন। অথচ বহু পূর্বেই একথা কুরআন বলে দিয়েছে। وَالنَّجْمُ وَالشَّجَرُ يَسْجُدَانِ ‘নক্ষত্ররাজি ও উদ্ভিদরাজি আল্লাহকে সিজদা করে’ (রহমান ৫৫/৬; ইসরা ১৭/৪৪; নূর ২৪/৪১ প্রভৃতি)। স্বয়ং রাসূল (সাঃ)-এর সম্মানে পাথর ও বৃক্ষসমূহ ঝুঁকে পড়ে তাঁকে সম্মান জানিয়েছে। আকাশের মেঘমালা তাঁকে ছায়া করেছে।[তিরমিযী হা/৩৬২০; মিশকাত হা/৫৯১৮] এমনকি তাঁর হুকুমে ছায়াদার বৃক্ষ নিজের স্থান থেকে উঠে এসে তার নিকটে দাঁড়িয়ে তাঁকে ছায়া করেছে। আবার তাঁর হুকুমে স্বস্থানে ফিরে গেছে।[মুসলিম হা/৩০১২; মিশকাত, ঐ, হা/৫৮৮৫, ৫৯২৪।] এগুলো সবই উদ্ভিদের যে প্রাণ আছে, তার প্রমাণ বহন করে। (৫) এমনকি এর চাইতে বড় তথ্য কুরআন প্রকাশ করেছে, বিজ্ঞানীরা আজও যা প্রমাণ করতে পারেনি। আর তা হল, আকাশমন্ডলী ও পৃথিবীর প্রাণ আছে এবং আছে বোধশক্তি। যেমন আল্লাহ বলেন, ثُمَّ اسْتَوَى إِلَى السَّمَاء وَهِيَ دُخَانٌ فَقَالَ لَهَا وَلِلْأَرْضِ اِئْتِيَا طَوْعاً أَوْ كَرْهاً قَالَتَا أَتَيْنَا طَائِعِيْنَ ‘অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনোনিবেশ করেন, যা ছিল ধূম্রবিশেষ। অনন্তর তিনি ওটাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে এসো ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। তারা বলল, আমরা এলাম অনুগত হয়ে’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/১১)।
(৬) নভোমন্ডল ও ভূমন্ডল ও তন্মধ্যকার সবকিছু সর্বদা আল্লাহর গুণগান করে। কিন্তু মানুষ তা বুঝতে পারে না। যেমন আল্লাহ বলেন, تُسَبِّحُ لَهُ السَّمَاوَاتُ السَّبْعُ وَالأَرْضُ وَمَن فِيهِنَّ وَإِن مِّن شَيْءٍ إِلاَّ يُسَبِّحُ بِحَمْدَهِ وَلَـكِن لاَّ تَفْقَهُونَ تَسْبِيْحَهُمْ إِنَّهُ كَانَ حَلِيْماً غَفُوْراً ‘সপ্ত আকাশ ও পৃথিবী এবং ওদের মধ্যকার সবকিছু তাঁরই গুণগান করে। আর এমন কিছু নেই যা তাঁর প্রশংসা সহ পবিত্রতা বর্ণনা করে না। কিন্তু ওদের গুণগান তোমরা বুঝতে পারো না। নিশ্চয়ই তিনি সহনশীল ও ক্ষমাপরায়ণ’ (ইসরা ১৭/৪৪)। এগুলি সবই আল্লাহর আয়াত বা নিদর্শন সমূহের অন্তর্ভুক্ত। যে তথ্য কেবলমাত্র কুরআনই আমাদেরকে প্রদান করেছে। ফালিল্লাহিল হাম্দ।


৬. বিশ্বমানবতার জন্য ইসলাম প্রেরণের সুসংবাদদাতা (مبشر إرسال الإسلام للإنسانية العالمية) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআনই একমাত্র ইলাহী গ্রন্থ, যা মানবজাতিকে আল্লাহর মনোনীত দ্বীন ও পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান হিসাবে ইসলামকে প্রেরণের সুসংবাদ দিয়েছে। যেমন বিদায় হজ্জের দিন আয়াত নাযিল করে আল্লাহ বলেন, الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلاَمَ دِينًا ‘আজকের দিনে আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের উপর আমার নে‘মতকে সম্পূর্ণ করলাম। আর তোমাদের জন্য ইসলামকে দ্বীন হিসাবে মনোনীত করলাম’ (মায়েদাহ ৫/৩)। অন্যান্য ধর্মগ্রন্থ তার অনুসারীদের এরূপ কথা শুনাতে ব্যর্থ হয়েছে।


৭. অনন্য প্রভাবশালী গ্রন্থ (الكتاب المؤثر الوحيد) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআনের অপূর্ব সাহিত্যিক মান, তুলনাহীন আলংকরিক বৈশিষ্ট্য, অনন্য সাধারণ বর্ণনাভঙ্গি এবং এর অলৌকিক প্রভাব যেকোন মানুষকে মুহূর্তের মধ্যে মোহিত করে ফেলে। পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থে এমন প্রভাবের কোন নযীর নেই।
(১) আবু জাহল, আবু সুফিয়ান, আখনাস বিন শারীক্ব-এর মত নেতারাও রাতের বেলা একে অপরকে লুকিয়ে গোপনে এসে রাসূল (সাঃ)-এর তাহাজ্জুদে পঠিত কুরআন মুগ্ধ মনে শ্রবণ করত। পরপর তিনদিন একই ঘটনার পর আখনাস বিন শারীক্ব লাঠি হাতে হাঁটতে হাঁটতে আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে এসে বললেন, হে আবু হানযালা! মুহাম্মাদের মুখ দিয়ে যা শুনলাম, সে বিষয়ে আপনার মতামত কি? তিনি বললেন, আমি ঐ কালাম বুঝতে পেরেছি এবং সেখানে যা চাওয়া হয়েছে, তাও বুঝেছি’। আখনাস বললেন, আমিও আপনার সাথে একমত। এবার তিনি হাঁটতে হাঁটতে আবু জাহলের বাড়ীতে গেলেন ও তাকে একই প্রশ্ন করলেন। জবাবে আবু জাহল বললেন, আসল কথা হল, تَنَازَعْنَا نَحْنُ وَبَنُو عَبْدِ مَنَافٍ الشَّرَفَ... مِنَّا نَبِيٌّ يَأْتِيهِ الْوَحْيُ مِنَ السَّمَاءِ، فَمَتَى نُدْرِكُ مِثْلَ هَذِهِ؟ وَاللهِ لاَ نُؤْمِنُ بِهِ أَبَدًا وَلاَ نُصَدِّقُهُ ‘বনু ‘আব্দে মানাফের সাথে আমাদের বংশ মর্যাদাগত ঝগড়া আছে।... তারা বলে, আমাদের বংশে একজন নবী আছেন, যার নিকটে আসমান থেকে ‘অহি’ আসে। কবে আমরা এই মর্যাদা পাব? অতএব আল্লাহর কসম! আমরা কখনোই তার উপরে ঈমান আনব না এবং তাকে সত্য বলে বিশ্বাস করব না’। একথা শুনে আখনাস চলে এলেন’।[ইবনু হিশাম ১/৩১৫-১৬; আল-বিদায়াহ ৩/৬৪] এতে বুঝা যায় যে, অতি বড় দুশমনও কুরআন দ্বারা প্রভাবিত হয়। কিন্তু যিদ ও হঠকারিতা বশে তারা পথভ্রষ্ট হয়।
(২) প্রসিদ্ধ কুরায়েশ নেতা উৎবা বিন রাবী‘আহ একদিন আবু জাহল ও অন্য নেতাদের পরামর্শ মতে রাসূল (সাঃ)-এর কাছে এলেন। ইনি একই সাথে জাদুবিদ্যা, ভবিষ্যদ্বাণী ও কবিতায় পারদর্শী ছিলেন। তিনি এসে রাসূল (সাঃ)-এর অনেক প্রশংসা করলেন। অতঃপর তাকে তাওহীদ প্রচার বন্ধের বিনিময়ে নেতৃত্ব, দশজন সুন্দরী স্ত্রী ও বিপুল ধন-সম্পদ দানের লোভনীয় প্রস্তাব দিলেন। রাসূল (সাঃ) সবকিছু শোনার পর তাকে সূরা হা-মীম সাজদাহ ১-১৩ আয়াত পর্যন্ত শুনালেন। এ সময় ওৎবা আত্মীয়তার দোহাই দিয়ে তার মুখে হাত দিয়ে কুরআন পাঠ বন্ধ করতে বললেন। ফিরে আসার পর তিনি নেতাদের কাছে বলেন, আল্লাহর কসম! আমি এমন কথা শুনেছি, যা আমার দু’টি কান কখনো শোনেনি। আল্লাহর কসম! এটি জাদু নয়, এটি কবিতা নয়, এটি কোন ভবিষ্যৎ কথন নয়। হে কুরায়েশগণ! তোমরা আমার কথা শোন! তোমরা এ মানুষটিকে ছেড়ে দাও। যদি তিনি আরবদের উপর বিজয়ী হন, তাহলে তার রাজত্ব তোমাদের রাজত্ব। তার সম্মান তোমাদের সম্মান। তার মাধ্যমে তোমরা হবে সৌভাগ্যবান। তোমরা জানো মুহাম্মাদ কখনো মিথ্যা বলেন না। আমি ভয় পাচ্ছি তোমাদের উপর আল্লাহর গজব নাযিল না হয়’। জবাবে আবু জাহল বলল, আল্লাহর কসম! আপনাকে সে তার কথা দিয়ে জাদু করেছে’।[ইবনু হিশাম ১/২৯৪; আল-বিদায়াহ ৩/৬৩-৬৪]
(৩) একদিন কা‘বা চত্বরে উপস্থিত মক্কার মুশরিকদের একজন বাদে সকলে রাসূল (সাঃ)-এর মুখে সূরা নাজম শুনতে শুনতে বিভোর হয়ে সূরার শেষ ৬২তম সিজদার আয়াত শুনে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সিজদায় পড়ে যায়। রাবী ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, একজন বৃদ্ধ কেবল সিজদা করেনি। সে এক মুষ্টি মাটি তুলে নিজের কপালে ঠেকিয়ে বলেছিল, এটাই আমার জন্য যথেষ্ট। পরে তাকে আমি (বদরের যুদ্ধে) কাফের অবস্থায় নিহত হতে দেখেছি।’ ঐ বৃদ্ধটি ছিল মক্কার অন্যতম নেতা উমাইয়া বিন খালাফ।[বুখারী হা/৪৮৬৩; মুসলিম হা/৫৭৬; মিশকাত হা/১০৩৭]
(৪) রাসূল (সাঃ)-এর দো‘আর বরকতে এবং কুরআনী সূরার অতুলনীয় প্রভাবে রাসূল (সাঃ)-কে হত্যার উদ্দেশ্যে আগত উমর নিমেষে কুরআনের খাদেমে পরিণত হয়ে যান’ (ইবনু হিশাম ১/৩৪২-৪৬)।
(৫) জা‘ফর বিন আবু ত্বালিবের মুখে সূরা মারিয়ামের সংশ্লিষ্ট আয়াতগুলি শুনে হাবশার বাদশাহ আছহামা নাজাশী ও তাঁর সভাসদ খ্রিষ্টান নেতাদের চক্ষু দিয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হয়েছিল। অতঃপর মদীনায় নাজাশী প্রেরিত পন্ডিতগণের সত্তুর জনের এক শাহী প্রতিনিধিদল রাসূল (সাঃ)-এর মুখে সূরা ইয়াসীন শুনে কেঁদে আত্মহারা হয়ে পড়েন ও সেখানেই মুসলমান হয়ে যান। পরে বাদশাহ নাজাশীও মুসলমান হন।(ইবনু হিশাম ১/৩৩৬)
(৬) কুরায়েশ-এর সবচেয়ে বড় ধনী ও বড় কবি অলীদ বিন মুগীরাহ একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে কুরআন শুনতে চাইলেন। তখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে সূরা নাহলের ৯০ আয়াতটি শুনিয়ে দেন।[1] অলীদ বিন মুগীরাহ আবার শুনতে চাইলেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পুনরায় পড়লেন। আয়াতটি শুনে হয়রান হয়ে তিনি বলে ওঠেন وَاللهِ إِنَّ لَهُ لَحَلاَوَةً، وَإِنَّ عَلَيْهِ لَطَلاَوَةً، وَإِنَّ أَعْلاَهُ لَمُثْمِرٌ، وَإِنَّ أَسْفَلَهُ لَمُغْدِقٌ وَمَا يَقُوْلُ هَذَا بَشَرٌ ‘আল্লাহর কসম! এর রয়েছে এক বিশেষ মাধুর্য, এর মধ্যে রয়েছে বিশেষ সজীবতা, এর শাখা-প্রশাখা সমূহ ফলবন্ত। এর জড়দেশ সদা সরস। আর মানুষ কখনো এরূপ বলতে পারে না’ (আল-ইস্তী‘আব)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَإِنَّهُ لَيَعْلُوَ وَلاَ يُعْلَى، وَإِنَّهُ لَيَحْطِمُ مَا تَحْتَه ‘নিশ্চয় এটি বিজয়ী হবে, বিজিত হবে না। আর নিশ্চয় এটি তার নীচের সবকিছুকে চূর্ণ করে দিবে’। তার এরূপ প্রশংসাগীতি শুনে আবু জাহল বলল, আপনি যতক্ষণ মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে কিছু না বলবেন, ততক্ষণ আপনার কওম আপনার উপর খুশী হবে না। তখন তিনি বললেন, ছাড়! আমাকে একটু ভাবতে দাও। অতঃপর ভেবে-চিন্তে তিনি বললেন, هَذَا سِحْرٌ يُؤْثَرُ يَأْثُرُهُ عَنْ غَيْرِهِ ‘এটি অন্য থেকে প্রাপ্ত জাদু! (আল-বিদায়াহ ৩/৬১)। বস্ত্ততঃ অলীদের প্রথম কথাগুলি ছিল তার মনের কথা। আর শেষের কথাগুলি ছিল রাজনৈতিক। এ প্রসঙ্গে সূরা মুদ্দাছছির ১১-২৬ আয়াতগুলি নাযিল হয়।[বায়হাক্বী, দালায়েলুন নবুঅত ২/১৯৮-৯৯]
(৭) এর প্রভাব এত বেশী যে, ৩৬০টি দেবদেবীর পূজারী নিমেষে সবকিছু ছেড়ে এক আল্লাহর ইবাদতকারী বনে যান। কোন আইন মানতে যারা কখনোই বাধ্য ছিল না, সেই অবাধ্য মরু আরব নিমেষে আল্লাহর আইনের সামনে এসে মাথা পেতে দেয়। পুলিশ বা কোন বাহিনীর প্রয়োজন হয়নি, নিজেরা এসে মৃত্যুদন্ড গ্রহণের জন্য রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে এসে পীড়াপীড়ি করে। মা‘এয আসলামী, গামেদী মহিলা প্রমুখদের ঘটনা যার জাজ্বল্যমান প্রমাণ।[মুসলিম হা/১৬৯৫; মিশকাত হা/৩৫৬২]
(৮) বদরের যুদ্ধে বন্দীদের মুক্তির ব্যাপারে আলোচনার জন্য কুরায়েশ নেতা জুবায়ের বিন মুত্ব‘ইম মদীনায় উপনীত হয়ে মাগরিবের জামা‘আতে রাসূল (সাঃ)-এর মুখে সূরা তূরের আয়াতগুলি শুনে দারুণভাবে প্রভাবিত হন। তিনি বলেন, এর দ্বারা আমার হৃদয়ে প্রথম ঈমান প্রবেশ করে’ (আল-ইছাবাহ, জুবায়ের ক্রমিক ১০৯৩)।
(৯) জাহেলী যুগের মু‘আল্লাক্বা খ্যাত কবি লাবীদ বিন রাবী‘আহ ‘আমেরী ইসলাম কবুল করার পর কবিতা লেখা বন্ধ করে দিলেন। খলীফা উমর (রাঃ) কূফার গবর্ণরের মাধ্যমে তাকে এর কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, مَا كُنْتُ لِأَقُولَ بَيْتًا مِنَ الشِّعْرِ بَعْدَ إِذْ عَلَّمَنِي اللهُ الْبَقَرَةَ وَآلَ عِمْرَانَ ‘আমি এক লাইন কবিতাও আর বলতে চাই না যখন থেকে আল্লাহ আমাকে সূরা বাক্বারাহ ও আলে ইমরান শিক্ষা দিয়েছেন’। এ কথা শুনে উমর (রাঃ) তার বার্ষিক ভাতা বৃদ্ধি করে দেন।[2]
(১০) আবু ত্বালহা আনছারী যখন কুরআনের আয়াত لَنْ تَنَالُوا الْبِرَّ حَتَّى تُنْفِقُوْا مِمَّا تُحِبُّوْنَ ‘তোমরা কখনই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমাদের প্রিয় বস্ত্ত তোমরা দান করবে’ (আলে ইমরান ৩/৯২) শোনার পর রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে এসে নিজের সর্বাপেক্ষা মূল্যবান খেজুর বাগিচাটি আল্লাহর রাহে দান করে দিলেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ)-এর হুকুমে উক্ত বাগিচা আবু ত্বালহার নিকটাত্মীয় এবং চাচাতো ভাইদের মধ্যে বণ্টন করে দেওয়া হল (বুখারী হা/২৩১৮; মুসলিম হা/৯৯৮)।
(১১) শায়খ আব্দুল ক্বাহির জুরজানী (মৃ. ৪৭৪ হি./১০৭৮ খৃ.) বলেন, আরবরা কুরআনের সর্বোচ্চ আলংকরিক বৈশিষ্ট্য ছাড়াও তারা এর গভীর তাৎপর্যপূর্ণ আয়াত সমূহের কারণে প্রভাবান্বিত হয়েছিল। যেমন وَلَكُمْ فِي الْقِصَاصِ حَيَاةٌ يَا أُولِي الأَلْبَابِ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ ‘সম পরিমাণ শাস্তি দানের মধ্যে তোমাদের জীবন নিহিত রয়েছে হে জ্ঞানীগণ! যাতে তোমরা সতর্ক হতে পারো’ (বাক্বারাহ ২/১৭৯)।


৮. কুরআনের আহবান সমগ্র মানব জাতির প্রতি (دعوة القرآن إلى الإنسان عاما) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
তওরাত, যবূর, ইনজীল প্রভৃতি কিতাবের আহবান ছিল কেবল বনু ইস্রাঈল গোত্রের প্রতি। কিন্তু কুরআনের আহবান জিন-ইনসান তথা সকল সৃষ্টিজগতের প্রতি। আল্লাহ বলেন, إِنْ هُوَ إِلاَّ ذِكْرٌ وَقُرْآنٌ مُبِيْنٌ، لِيُنْذِرَ مَنْ كَانَ حَيًّا وَيَحِقَّ الْقَوْلُ عَلَى الْكَافِرِينَ ‘এটা তো উপদেশ ও প্রকাশ্য কুরআন’। ‘যাতে তিনি সতর্ক করেন জীবিতদেরকে এবং যাতে অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়’ (ইয়াসীন ৩৬/৬৯-৭০)।


৯. কুরআন সকল শিক্ষা ও কল্যাণের সার-নির্যাস (القرآن زبدة كل تعليم وخير) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
তওরাতে রয়েছে আখবার ও আহকাম, যবূরে কেবল প্রার্থনা, ইনজীলে রয়েছে দৃষ্টান্ত এবং কিছু আহকাম ও উপদেশ। অথচ কুরআনে রয়েছে ঐগুলি ছাড়াও বিগত জাতি সমূহের ইতিহাস, বিজ্ঞান ও সৃষ্টিতত্ত্ব, দ্বীনী ও দুনিয়াবী জীবন পরিচালনার নীতিমালা ও বিধান সমূহ, জান্নাতের বিবরণ ও তার সুসংবাদ এবং জাহান্নামের বিবরণ ও তার ভয় প্রদর্শন, রয়েছে আল্লাহ ও আখেরাতের পরিচয় এবং রয়েছে আধ্যাত্মিক ও জাগতিক উন্নতির সকল প্রকার হেদায়াতের সমষ্টি ও কল্যাণের চাবিকাঠি।


১০. কুরআন যাবতীয় ত্রুটি ও স্ববিরোধিতা হতে মুক্ত(القرآن سالم من جميع العيوب والتنافض الذاتى) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
আল্লাহ বলেন, أَفَلاَ يَتَدَبَّرُونَ الْقُرْآنَ وَلَوْ كَانَ مِنْ عِندِ غَيْرِ اللهِ لَوَجَدُواْ فِيهِ اخْتِلاَفاً كَثِيراً ‘তারা কেন কুরআন নিয়ে গবেষণা করে না? যদি ওটা আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারু নিকট থেকে আসত, তাহলে ওরা তাতে অনেক গরমিল দেখতে পেত’ (নিসা ৪/৮২)। কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যা শুরুতেই নিজেকে لاَ رَيْبَ فِيْهِ ‘সকল প্রকার ত্রুটি ও সন্দেহমুক্ত’ বলে ঘোষণা করেছে (বাক্বারাহ ২/২)।


১১. কুরআন ভবিষ্যদ্বাণী, অতীত ইতিহাস ও ঘটনা সমূহের বর্ণনা সমৃদ্ধ এক জ্বলন্ত মু‘জেযা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
বিগত দেড় হাযার বছরে পৃথিবীতে বহু কিছু ওলট-পালট হয়েছে। কিন্তু কুরআনের কোন বক্তব্য, অতীত ইতিহাস বা কোন ভবিষ্যদ্বাণী মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়নি। যেমন, (১) পারসিকরা রোমকদের উপর বিজয়ী হল। রোম সম্রাট হেরাক্লিয়াস সিরিয়া ছেড়ে রাজধানী কনস্টান্টিনোপলে যেতে বাধ্য হলেন। এতে মক্কার মুশরিকরা খুশী হল। কেননা পারসিকরা অগ্নি উপাসক ও মূর্তিপূজারী ছিল। পক্ষান্তরে মুসলমানেরা এতে দুঃখিত হল। কেননা রোমকরা ছিল আহলে কিতাব। বিষয়টি আবুবকর (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-কে বললেন। জবাবে তিনি বললেন, রোমকরা সত্বর বিজয়ী হবে। এ বিষয়ে সূরা রূম ১-৬ আয়াত নাযিল হল। এর বিরুদ্ধে কাফের নেতা উবাই বিন খালাফ আবুবকর (রাঃ)-এর সঙ্গে ১০০ উটের বাজি ধরলেন। দেখা গেল ৯ বছর পর বদর যুদ্ধের দিন রোমকরা বিজয়ী হল। এভাবে কুরআনের ভবিষ্যদ্বাণী কার্যকর হল। তাতে বহু লোক মুসলমান হয়ে গেল।[তিরমিযী হা/৩১৯৩; আহমাদ হা/২৪৯৫] (২) অতীত ইতিহাস হিসাবে কওমে ছামূদ-এর ধ্বংসস্থল সঊদী আরবের হিজর এলাকা, যা এখন ‘মাদায়েনে সালেহ’ নামে পরিচিত। সমতলভূমিতে বিশালকায় অট্টালিকা নির্মাণ ছাড়াও পর্বতগাত্র খোদাই করে তারা উন্নতমানের প্রকোষ্ঠসমূহ তৈরী করত। এগুলির গায়ে ইরামী ও ছামূদী বর্ণমালার শিলালিপি আজও অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। ২০০৮ সালে ইউনেস্কো এ স্থানটিকে World heritage বা ‘বিশ্ব ঐতিহ্য ’ হিসাবে ঘোষণা করেছে।
৯ম হিজরীতে তাবূক অভিযানে যাওয়ার পথে মুসলিম বাহিনী এখানে অবতরণ করলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদেরকে সেখানে প্রবেশ করতে নিষেধ করে বলেন, তোমরা ঐ অভিশপ্ত এলাকায় প্রবেশ করোনা ক্রন্দনরত অবস্থায় ব্যতীত। নইলে তোমাদের উপর ঐ গজব আসতে পারে, যা তাদের উপর এসেছিল’ (বুখারী হা/৪৩৩)। (৩) লূতের কওমের ধ্বংসের ঘটনা, যা কুরআনে বিধৃত হয়েছে (হিজর ১৫/৭৫, ৭৭; আনকাবূত ২৩/৩৫)। বর্তমান ফিলিস্তীন ও জর্ডান নদীর মধ্যবর্তী ৭৭ * ১২ ব. কি. এলাকা ব্যাপী ৪০০ মিটার গভীরতার ‘মৃত সাগর’ যার বাস্তব প্রমাণ বহন করছে।[নবীদের কাহিনী ১/১৬০, টীকা-১১৬] (৪) মূসার বিরুদ্ধে ফেরাঊনের সাগরডুবির পর তার লাশ অক্ষত থাকবে বলে কুরআন যে ঘোষণা দিয়েছিল (ইউনুস ১০/৯২), তার মমিকৃত লাশ ১৯০৭ সালে সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিম তীরে ‘জাবালে ফেরাঊন’ নামক পাহাড় থেকে উদ্ধার হওয়ার পর এখন তা দিবালোকের ন্যায় সত্যে পরিণত হয়েছে। যা এখন কায়রোতে পিরামিডে রক্ষিত আছে’ (নবীদের কাহিনী ২/১১ পৃঃ)। এটি কুরআনের অকাট্য ও অভ্রান্ত সত্য হওয়ার জ্বলন্ত প্রমাণ বহন করে।


১২. শাশ্বত সত্য বাণী (الكلام الصادق الخالد) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
বিজ্ঞান ও দর্শনের বহু তত্ত্ব ও তথ্য যুগে যুগে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু কুরআনের কোন তত্ত্ব ও তথ্যের মধ্যে বৈপরীত্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। কুরআনের শত্রুরা শত চেষ্টা করেও এ ব্যাপারে ব্যর্থ হয়েছে।
যেমন (১) সূর্য ঘোরে, না পৃথিবী ঘোরে, এ নিয়ে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক সময় ছিল বিস্তর মতভেদ। খৃষ্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতাব্দীতে গ্রীক বিজ্ঞানী পিথাগোরাস (খৃঃ পূঃ ৫৭০-৪৯৫) বলেন, পৃথিবী ঘোরে, সূর্য স্থির। তার প্রায় সাতশ’ বছর পর মিসরীয় বিজ্ঞানী টলেমী (৯০-১৬৮ খৃ.) বলেন, সূর্য ঘোরে পৃথিবী স্থির। তার প্রায় চৌদ্দশ’ বছর পর পোলিশ বিজ্ঞানী কোপারনিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩ খৃ.) বলেন, টলেমীর ধারণা ভুল। বরং পৃথিবীই ঘোরে, সূর্য স্থির। কিন্তু এখন সবাই বলছেন, আকাশে সবকিছুই ঘোরে। অথচ আজ থেকে প্রায় দেড় হাযার বছর পূর্বে খৃষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে কুরআন ঘোষণা করেছে, كُلٌّ فِي فَلَكٍ يَّسْبَحُوْنَ ‘নভোমন্ডলে যা কিছু আছে, সবই সন্তরণশীল’ (আম্বিয়া ২১/৩৩; ইয়াসীন ৩৬/৪০)। (২) সমাজ বিজ্ঞানীদের অনেকে বলেন, নারী ও পুরুষ সবক্ষেত্রে সমান। এজন্য চলছে বিশ্বব্যাপী অনেক রাজনৈতিক হৈ চৈ। অথচ জীব বিজ্ঞান বলছে নারী ও পুরুষের মধ্যে আদপেই কোন সমতা নেই। দু’টি সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী সত্তা। উভয়ের ইচ্ছা-আকাংখা-কর্মক্ষেত্র সবই পৃথক। কুরআন বহু পূর্বেই এ সত্য বর্ণনা করেছে (নিসা ৪/১ ও অন্যান্য)। যা নিতান্তই বাস্তব ও বিজ্ঞান সম্মত। (৩) কার্ল মার্কস তার ‘গতিতত্ত্ব’ বলে পরিচিত বিপ্লবের দর্শনে বলেছেন, সদা গতিশীল প্রাকৃতিক বিধান সামাজিক ক্ষেত্রে পরিবর্তন ঘটায়। যার ফলে মানবজীবনেও বিপ্লব ও পরিবর্তন অনিবার্য হয়ে থাকে। এ দর্শন প্রচারের সাথে সাথে তিনি ‘দুনিয়ার মযদুর এক হও’ বলে ডাক দিলেন। যা ছিল তার দর্শনের সাথে সাংঘর্ষিক।[মুহাম্মাদ আব্দুর রহীম, মহাসত্যের সন্ধানে (ঢাকা : ১৯৯৮) ৩৭ পৃঃ] কেননা সামাজিক বিপ্লব যদি ঐতিহাসিক কার্যকারণের অনিবার্য পরিণতি হয়, তাহলে সেজন্য রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রয়োজন হবে কেন? আর রাজনৈতিক সংগ্রামের ফলেই যদি বিপ্লব আনতে হয়, তাহলে ঐতিহাসিক কার্যকারণের অনিবার্য দর্শন নিতান্তই অমূলক গণ্য হয়। অথচ কুরআন বহু পূর্বেই মানুষকে কর্মদর্শন প্রদান করে বলেছে, إِنَّ اللهَ لاَ يُغَيِّرُ مَا بِقَوْمٍ حَتَّى يُغَيِّرُواْ مَا بِأَنْفُسِهِمْ ‘আল্লাহ কোন জাতির অবস্থার পরিবর্তন করেন না, যে পর্যন্ত না তারা তাদের নিজেদের অবস্থা পরিবর্তন করে’ (রা‘দ ১৩/১১)।
এভাবে কুরআন প্রদত্ত দর্শনের সাথে বিভিন্ন দার্শনিক মতবাদের তুলনামূলক আলোচনা করলে বৈপরিত্য ও স্ববিরোধিতার প্রচুর দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে। অথচ কুরআন এসব থেকে মুক্ত।
অতএব যুগে যুগে বিজ্ঞান যত অগ্রগতি লাভ করবে, কুরআনের বিভিন্ন অলৌকিক বিষয় তেমনি মানুষের সামনে খুলে যাবে। তবে সাবধান থাকতে হবে, এর দ্বারা যেন কোন ভ্রান্ত আক্বীদা জন্ম না নেয়। কেননা বিশুদ্ধ আক্বীদা কেবল সেটাই, যা সাহাবায়ে কেরামের যুগে ছিল। তাঁদের যুগে যেটি দ্বীন ছিল না, এখন সেটি দ্বীন হিসাবে গৃহীত হবে না।


১৩. কুরআনের বাহক ও প্রচারক মাত্র একজন (حامل القرآن ومبلغه واحد فقط) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআনই একমাত্র ইলাহী গ্রন্থ, যার বাহক ও প্রচারক মাত্র একজন। যিনি হলেন শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম। মানছূরপুরী বলেন, অথচ হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ বেদ-এর পেশকারী ঋষিদের সংখ্যা শতাধিক এবং তাদের পরস্পরের মধ্যে সময়ের ব্যবধান শতাধিক বছরের। বাইবেলের অবস্থাও তথৈবচ। এ কিতাবের পেশকারী হিসাবে তিনি ত্রিশজনের নামের তালিকা দিয়েছেন। যাদের মধ্যে হযরত মূসা, দাঊদ, সুলায়মান, যাকারিয়া (আঃ) প্রমুখ আম্বিয়ায়ে কেরাম ছাড়াও রয়েছে অন্যান্যদের নাম। যারা যুগে যুগে বাইবেল পেশ করেছেন। অথচ কোনটার সাথে কোনটার পুরোপুরি মিল নেই। এমনকি হযরত মূসা (আঃ) যে দশটি ফলকে (عَشَرَةُ أَلْوَاحٍ) লিখিত তওরাত নিয়ে এসেছিলেন, তার উম্মত তাতে প্রথমেই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল (বাক্বারাহ ২/৫৫-৫৬, ৯৩)। অনুরূপভাবে ইনজীলের অবস্থা। সেখানে হযরত ঈসা (আঃ)-এর শাগরিদদের রচিত বিভিন্ন গ্রন্থ পাওয়া যায়। যার কোনটির সঙ্গে কোনটির পুরোপুরি মিল নেই। বরং প্রায় সবটাই কথিত সেন্ট (Saint) তথা সাধুদের কপোলকল্পিত। যাকে আল্লাহর কেতাব বলে চালানো হচ্ছে। যেদিকে আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইঙ্গিত করেছেন (বাক্বারাহ ২/৭৯)।
উল্লেখ্য যে, মসীহ ঈসা নিজের জন্য ১২ জন শাগরিদ বাছাই করেছিলেন, যারা বনু ইস্রাঈলের বারোটি গোত্রের সামনে তাঁর দ্বীনের প্রচার করবে। কিন্তু এতবড় একজন কামেল উস্তাদের সঙ্গে থেকেও তারা এমন অযোগ্য প্রমাণিত হন যে, মসীহকে তাদের উদ্দেশ্যে একাধিকবার একথা বলতে হয়েছিল যে, তোমাদের মধ্যে এক সরিষাদানা পরিমাণ ঈমান থাকলেও তোমরা এরূপ করতে পারতে না’। মসীহ তাদেরকে বারবার তিরষ্কার করতেন এজন্য যে, তাঁর সঙ্গে জেগে থেকেও তারা কখনো দো‘আ-ইস্তেগফারে শরীক হত না। মসীহের আসমানে উঠে যাবার পর উক্ত বারো জন শাগরিদের মধ্যে আক্বীদা ও আমলগত বিষয়ে তীব্র মতভেদ দেখা দেয়। যেমন (১) শরী‘আতের (তাওরাতের) বিধান সমূহ মান্য করা যরূরী কি-না (২) অন্য জাতির নিকটে ঈসায়ী ধর্মের প্রচার সিদ্ধ হবে কি-না (৩) খাৎনা করা কেবল ইসরাঈলীদের জন্য না ঈসায়ী ধর্মে আগত সকলের জন্য আবশ্যক ইত্যাদি। এরপর তাদের মধ্যে আল্লাহ, মারিয়াম ও ঈসার নামে ত্রিত্ববাদের প্রসার ঘটে। যাতে অনেকে ভিন্নমত পোষণ করেন। ঈসা (আঃ) ৩০ বছর বয়সে দাওয়াত শুরু করেন এবং ৩৩ বছর বয়সে তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নেওয়া হয়। তিন বছরে মাত্র ১২ জন শাগরিদ হয়। যার মধ্যে একজন গাদ্দার প্রমাণিত হয়। অবশ্য ‘কিতাবুল আ‘মাল-এর লেখক সাধু লূক-এর মতে তাঁর সমর্থকের সংখ্যা ছিল ১২৪ জন।[মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/১১২।]
পক্ষান্তরে কুরআন শুরু হয়েছে যাঁর মাধ্যমে, শেষও হয়েছে তাঁর মাধ্যমে। এর একটি শব্দ ও বর্ণেও অন্য কোন ব্যক্তি যুক্ত নন। কুরআন বুঝার জন্য অন্য কোন সহায়ক কুরআনও নাযিল হয়নি। যেমন হিন্দুদের ঋগ্বেদ বুঝতে গেলে সাম বেদ, অথবর্ব বেদ ইত্যাদির মুখাপেক্ষী হতে হয়। অনুরূপভাবে ইহূদী-খৃষ্টানদের নিউ টেষ্টামেন্ট পূর্ণতা পায় না ওল্ড টেষ্টামেন্ট ব্যতীত। আবার চারটি ইনজীল (أَنَاجِيلُ أَرْبعَة) অপূর্ণ থাকে সেন্ট লূক-এর কিতাবুল আ‘মাল ব্যতীত। অথচ কুরআন নিজেই সবকিছুর ব্যাখ্যা تِبْيَانًا لِكُلِّ شَيْءٍ (নাহল ১৬/৮৯)। এরপরেও প্রয়োজনীয় ও বিস্তৃত ব্যাখ্যার জন্য কুরআনের বাহক রাসূল (সাঃ)-এর হাদীছ সমূহ মওজুদ রয়েছে। যা আল্লাহ কর্তৃক প্রত্যাদিষ্ট (নাজম ৫৩/৩-৪; ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৯)।
উল্লেখ্য যে, হিন্দুরা চারটি বেদ-এর কথা বললেও মনু তিনটি বেদ-এর কথা বলেন, যাতে অথবর্ব বেদ নেই। সংস্কৃতের কোন কোন প্রাচীন গ্রন্থে প্রায় ৩২টি বইয়ের উপরে বেদ-এর নাম ব্যবহার করা হয়েছে। তাছাড়া সাধারণ হিন্দুরা বেদকে ‘ঈশ্বরের বাণী’ মনে করলেও তাদের বহু বিদ্বান একে ‘মানুষের কথা’ বলে থাকেন এবং প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ লোক বর্তমান বেদ-কে আসল বেদ মনে করেন না।[মানছূরপুরী, রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/২৭৪-৭৫] পক্ষান্তরে কুরআনের অনুসারী হৌন বা না হৌন সকলেই কুরআনকে আল্লাহর কালাম এবং তাকে অবিকৃত বলে বিশ্বাস করে থাকেন।


১৪. অত্যন্ত উঁচু মান ও মার্জিত রুচিসম্পন্ন (ذو المستوى الأعلى وحسن الذوق المهذب) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআনের ভাষা অত্যন্ত উঁচুমানের এবং মার্জিত রুচি সম্পন্ন। এতে কোনরূপ লজ্জাকর ভাষা ও ঘটনার স্পর্শ নেই। অথচ বেদ ও প্রচলিত বাইবেল নানা যৌন রসাত্মক উপমা ও রচনায় ভরা। যা ধর্মীয় পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্যের সম্পূর্ণ বিপরীত। এর মৌলিক কারণ হল এই যে, ঐসব গ্রন্থাবলীর রচয়িতা হল মানুষ। আর কুরআনের ভাষা হল সরাসরি আল্লাহর। তাই বান্দার ভাষা কখনোই আল্লাহর ভাষার ধারে-কাছে যেতে পারে না। এজন্যই বলা হয়ে থাকে كلامُ الملوكِ ملوكُ الكلامِ ‘বাদশাহদের ভাষা হয় শাহী ভাষা’। কুরআনের ভাষা তাই যাবতীয় মানবীয় দুর্বলতা ও আবিলতার ঊর্ধ্বে এক অতুলনীয় সৌকর্যমন্ডিত ভাষা। সেই সাথে কুরআনের ভাষা অতুলনীয় এবং সর্বোচ্চ অলংকার সমৃদ্ধ। কুরআন নাযিলের সময়কালের বরেণ্য আরবী কবিগণ যেমন কুরআনী বালাগাত-ফাছাহাত ও অলংকারের কাছে অসহায় ছিলেন, আধুনিক যুগের কবি-সাহিত্যিকগণ একইভাবে রয়েছেন অসহায়।
মিসরের খ্যাতনামা মুফাসসির তানতাভী জাওহারী বলেন, ১৯৩২ সালের ১৩ই জুন তারিখে মিসরীয় অধ্যাপক কামেল কীলানী আমাকে একটি বিষ্ময়কর ঘটনা শুনিয়ে বলেন যে, আমার খ্যাতনামা আমেরিকান প্রাচ্যবিদ ফিনকেল একদিন আমাকে বলেন, কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার ব্যাপারে তোমার রায় বর্ণনা কর। তখন আমি বললাম, তাহলে আসুন আমরা জাহান্নামের প্রশস্ততার ব্যাপারে অন্ততঃ বিশটি বাক্য তৈরী করি। অতঃপর আমরা উক্ত মর্মে বাক্যগুলি তৈরী করলাম। যেমন, إنَّ جَهَنَّمَ وَاسِعَةٌ جِدًّا، إنَّ جَهَنَّمَ لَأَوْسَعُ مِمَّا تَظُنُّونَ، إنَّ سِعَةَ جَهَنَّمَ لاَ يَتَصَوَّرُهَا عَقْلُ إِنْسَانٍ ইত্যাদি। অতঃপর তিনি বললেন, কুরআন কি উক্ত মর্মে এর চাইতে উন্নত অলংকারবিশিষ্ট কোন বাক্য প্রয়োগ করতে পেরেছে? জবাবে আমি বললাম, আমরা কুরআনের সাহিত্যের কাছে শিশু মাত্র। শুনে তিনি হতবাক হয়ে বললেন, সেটা কি? আমি তখন সূরা ক্বাফ-এর ৩০ আয়াতটি পাঠ করলাম, يَوْمَ نَقُوْلُ لِجَهَنَّمَ هَلِ امْتَلَأْتِ وَتَقُوْلُ هَلْ مِنْ مَزِيْدٍ ‘যেদিন আমরা জাহান্নামকে বলব, ভরে গেছ কি? সে বলবে, আরো আছে কি?’ (ক্বাফ ৫০/৩০)। আয়াতটি শুনে তিনি হতভম্ব হয়ে বললেন, তুমি সত্য বলেছ, হ্যাঁ।[3] আমরা মনে করি এর পরবর্তী আয়াতে জান্নাতীদের পুরস্কার সম্পর্কে যে বর্ণনা এসেছে তা একইভাবে অনন্য ও অসাধারণ। যেমন বলা হয়েছে لَهُمْ مَا يَشَاءُوْنَ فِيْهَا وَلَدَيْنَا مَزِيْدٌ ‘সেখানে তারা যা চাইবে তাই পাবে এবং আমাদের কাছে রয়েছে আরও অধিক’ (ক্বাফ ৫০/৩৫)। অমনিভাবে জাহান্নামীদের শাস্তি সম্পর্কে আল্লাহ অন্যত্র বলেন, فَذُوقُوا فَلَنْ نَزِيدَكُمْ إِلاَّ عَذَابًا ‘অতএব তোমরা স্বাদ আস্বাদন করো। এখন আমি তোমাদের কিছুই বৃদ্ধি করব না শাস্তি ব্যতীত’ (নাবা ৭৮/৩০)।
বস্ত্ততঃ অল্প কথায় সুন্দরতম আঙ্গিকে এমন আকর্ষণীয় বাক্যশৈলী আল্লাহ ব্যতীত কারু পক্ষে সম্ভব নয়। আর এভাবেই আরবদের উপরে কুরআনের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যারা ছিল সেযুগে শুদ্ধভাষিতায় বিশ্বসেরা। সেজন্য তারা নিজেদেরকে ‘আরব’ (عَرَب) অর্থাৎ শুদ্ধভাষী বলত এবং অনারবদেরকে ‘আজম’ (عَجَم) অর্থাৎ ‘বোবা’ বলে অভিহিত করত।
আল্লাহ পাক তাঁর নবীদেরকে স্ব স্ব যুগের উপরে এভাবেই শ্রেষ্ঠত্ব দান করেন। যেমন জাদুবিদ্যায় সেরা মিসরীয়দের পরাস্ত করার জন্য আল্লাহ নবী মূসাকে লাঠি ও প্রদীপ্ত হস্ততালুর মো‘জেযা দান করেন। চিকিৎসা বিদ্যায় সেরা শাম দেশের অহংকারী নেতাদের পরাস্ত করার জন্য আল্লাহ নবী ঈসাকে অন্ধকে চক্ষু দান, কুষ্ঠ রোগীকে আরোগ্য দান, এমনকি মৃতকে জীবিত করার মো‘জেযা প্রদান করেন। অনুরূপভাবে ভাষাগর্বী আরবদের কাছে শেষনবীকে মো‘জেযা স্বরূপ অলংকারময় কুরআন দান করেন। যার সামনে আরব পন্ডিতেরা কুরআন নাযিলের যুগে ও পরে সর্বদা মাথা নোয়াতে বাধ্য হয়। ফালিল্লাহিল হাম্দ।


১৫. একজন উম্মী নবীর মুখনিঃসৃত বাণী (الكلام المخرج من فم نبى أمى) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআনই একমাত্র ইলাহী গ্রন্থ, যা তাওরাত ইত্যাদির ন্যায় ফলকে লিপিবদ্ধ আকারে দুনিয়াতে আসেনি। বরং সরাসরি উম্মী নবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। সাথে সাথে মুহাম্মাদ (সাঃ)-ই একমাত্র নবী, যিনি النَّبِيُّ الْأُمِّيُّ বা ‘নিরক্ষর নবী’ হিসাবে অভিহিত হয়েছেন (আ‘রাফ ৭/১৫৭, ১৫৮)। কুরআন আল্লাহর কালাম হওয়ার এটাও একটি বড় প্রমাণ যে, যার মুখ দিয়ে দুনিয়াবাসী বিজ্ঞানময় কুরআন শুনেছে, তিনি নিজে ছিলেন ‘উম্মী’ অর্থাৎ নিরক্ষর ব্যক্তি এবং মানুষ হয়েছিলেন নিরক্ষর সমাজে (জুম‘আ ৬২/২)। এমনকি আল্লাহ বলেন, وَمَا كُنْتَ تَتْلُو مِنْ قَبْلِهِ مِنْ كِتَابٍ وَلاَ تَخُطُّهُ بِيَمِيْنِكَ إِذًا لاَرْتَابَ الْمُبْطِلُوْنَ ‘আর তুমি তো এর আগে কোন বই পড়োনি এবং স্বহস্তে কোন লেখাও লেখোনি, যাতে বাতিলপন্থীরা সন্দেহ করতে পারে’ (আনকাবূত ২৯/৪৮)। তিনি অন্যত্র বলেন, مَا كُنْتَ تَدْرِيْ مَا الْكِتَابُ وَلاَ الْإِيْمَانُ ‘তুমি জানতে না কিতাব কি বা ঈমান কি?’ (শূরা ৪২/৫২)। তাই কুরআনের ভাষা ও বক্তব্যে নিজের থেকে যোগ-বিয়োগ করার সকল প্রকার সন্দেহের তিনি ঊর্ধ্বে ছিলেন।
বস্ত্ততঃ মুহাম্মাদ (সাঃ) ব্যতীত দুনিয়াতে এমন কোন নবী আসেননি, যার পবিত্র যবান দিয়ে সরাসরি আল্লাহর কালাম বের হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর শ্রেষ্ঠত্বের একটি বড় দলীল ও একটি বড় মু‘জেযা। মানছূরপুরী বলেন, খ্রিষ্টানদের সকলে এ বিষয়ে একমত যে, তাদের চারটি ইনজীলের একটিও মসীহ ঈসার উপরে আল্লাহর পক্ষ হতে সরাসরি নাযিল হয়নি। বরং এগুলি স্ব স্ব লেখকদের দিকে সম্পর্কিত। উক্ত প্রসিদ্ধ চারটি ইনজীল হল, মথি (إِنْجِيلُ مَتَّى), মুরকুস (مُرْقُس), লূক (لُوقَا) এবং ইউহান্না (يُوحَنَّا)। এগুলির পবিত্রতার পক্ষে খ্রিষ্টানদের যুক্তি হল এই যে, এগুলি পবিত্র রূহ মসীহ ঈসা (আঃ)-এর সাহায্য নিয়ে লেখা হয়েছে’। তাদের এ দাবী যদি সত্য হয়ে থাকে, তাহলে চারটি ইনজীলের পরস্পরের মধ্যে এত গরমিল কেন? যেগুলির বক্তব্যের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করতে খৃষ্টান পন্ডিতগণ চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। এমনকি আদম ক্লার্ক, নূরটিন ও হারূণ প্রমুখ খ্রিষ্টান বিদ্বানগণের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত এই যে, ইনজীলগুলির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানের কোন সুযোগ নেই। পাদ্রী ফ্রেঞ্চ স্বীকার করেছেন যে, ইনজীলগুলির মধ্যে ছোট-বড় ৩০ হাযার ভুল রয়েছে। কথা হল, চারটি ইনজীলের মিলিত পৃষ্ঠা সংখ্যা একশ’-এর বেশী হবে না’ (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ৩/২৭৩)। অথচ তার মধ্যেই যদি ত্রিশ হাযার ভুল থাকে, তাহলে বিশুদ্ধ কতটুকু আছে? আর ঐসব বইয়ের গ্রহণযোগ্যতাই বা কি? একেই তো বলে ‘সাত নকলে আসল খাস্তা’।
খ্রিষ্টান ধর্মনেতাদের এইসব দুষ্কৃতির প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ বলেন,
فَوَيْلٌ لِلَّذِينَ يَكْتُبُونَ الْكِتَابَ بِأَيْدِيهِمْ ثُمَّ يَقُولُونَ هَذَا مِنْ عِنْدِ اللهِ لِيَشْتَرُوا بِهِ ثَمَنًا قَلِيلاً فَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا كَتَبَتْ أَيْدِيهِمْ وَوَيْلٌ لَهُمْ مِمَّا يَكْسِبُونَ- ‘ধ্বংস ঐসব লোকদের জন্য, যারা স্বহস্তে পুস্তক রচনা করে। অতঃপর বলে যে, এটি আল্লাহর নিকট থেকে আগত। যাতে তারা এর মাধ্যমে সামান্য অর্থ উপার্জন করতে পারে। অতএব ধ্বংস হৌক তারা যা স্বহস্তে লেখে এবং ধ্বংস হৌক তারা যা কিছু উপার্জন করে’ (বাক্বারাহ ২/৭৯)।




[1]. إِنَّ اللهَ يَأْمُرُ بِالْعَدْلِ وَالْإِحْسَانِ وَإِيتَاءِ ذِي الْقُرْبَى وَيَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ وَالْبَغْيِ يَعِظُكُمْ لَعَلَّكُمْ تَذَكَّرُونَ- ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণ এবং আত্মীয়-স্বজনকে দান করার নির্দেশ দেন এবং অশ্লীলতা, অন্যায় কাজ ও অবাধ্যতা হতে নিষেধ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন যাতে তোমরা শিক্ষা গ্রহণ কর’ (নাহল ১৬/৯০)।
[2]. আল-ইছাবাহ, লাবীদ বিন রাবি‘আহ ক্রমিক ৭৫৪৭; আল-ইস্তী‘আব।
[3]. ত্বানত্বাভী জাওহারী (১৮৫৯-১৯৪০ খৃ.), আল-জাওয়াহের ফী তাফসীরিল কুরআনিল কারীম (বৈরূত : দারুল ফিকর, তাবি) তাফসীর সূরা ক্বাফ ৩০ আয়াত, ১২/১০৭-০৮।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...