মঙ্গলবার, ২১ অক্টোবর, ২০২৫

নবী জীবনের শেষ অধ্যায়

 

নবী জীবনের শেষ অধ্যায়

হজ্জ থেকে ফিরে যিলহজ্জের বাকী দিনগুলিসহ ১১ হিজরীর মুহাররম ও ছফর পুরা দু’মাস রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় অবস্থান করেন।
বিদায় হজ্জের সময় আরাফাতের ময়দানে ইসলাম পরিপূর্ণ হওয়ার বিখ্যাত আয়াতটি (মায়েদাহ ৫/৩) নাযিল হয়। যা ছিল রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর ৮১ দিন পূর্বের ঘটনা। ইবনু উমর (রাঃ) বলেন, অতঃপর আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী দিনে মিনায় ‘সূরা নছর’ নাযিল হয়। মৃত্যুর ৫০দিন পূর্বে নাযিল হয় কালালাহর বিখ্যাত আয়াতটি (নিসা ৪/১৭৬)। অতঃপর মৃত্যুর ৩৫ দিন পূর্বে নাযিল হয় সূরা তওবার সর্বশেষ দু’টি আয়াত-
لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُوْلٌ مِّنْ أَنْفُسِكُمْ عَزِيْزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُّمْ حَرِيْصٌ عَلَيْكُمْ بِالْمُؤْمِنِيْنَ رَؤُوْفٌ رَّحِيْمٌ، فَإِن تَوَلَّوْاْ فَقُلْ حَسْبِيَ اللهُ لاَ إِلَـهَ إِلاَّ هُوَ عَلَيْهِ تَوَكَّلْتُ وَهُوَ رَبُّ الْعَرْشِ الْعَظِيْمِ-
‘নিশ্চয় তোমাদের কাছে এসেছেন তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল, তোমাদের দুঃখ-কষ্ট যার উপরে কষ্টদায়ক। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল ও দয়ালু’। ‘এসত্ত্বেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলে দাও যে, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। তিনি ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তাঁর উপরেই আমি ভরসা করি। তিনি মহান আরশের অধিপতি’ (তওবা ৯/১২৮-১২৯)। অতঃপর মৃত্যুর ২১ দিন মতান্তরে ৭ দিন পূর্বে নাযিল হয় কুরআনের সর্বশেষ আয়াতটি-
وَاتَّقُواْ يَوْماً تُرْجَعُوْنَ فِيْهِ إِلَى اللهِ ثُمَّ تُوَفَّى كُلُّ نَفْسٍ مَّا كَسَبَتْ وَهُمْ لاَ يُظْلَمُوْنَ-
‘আর তোমরা ভয় কর সেই দিনকে, যেদিন তোমরা পুনরায় ফিরে যাবে আল্লাহর কাছে। অতঃপর প্রত্যেকেই তার কর্মফল পুরোপুরি পাবে। আর তাদের প্রতি কোনরূপ অবিচার করা হবে না’ (বাক্বারাহ ২/২৮১; কুরতুবী, তাফসীর সূরা নছর)।


বিদায়ের পূর্বলক্ষণ সমূহ :
━━━━━━━━━━━━━━━
মূলতঃ সূরা নছর নাযিলের পরেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বুঝতে পারেন যে, সত্বর তাঁকে আখেরাতে পাড়ি দিতে হবে। তখন থেকেই যেন তার অদৃশ্য প্রস্তুততি শুরু হয়ে যায়। যেমন-
(১) আয়েশা (রাঃ) বলেন, সূরা নছর নাযিল হওয়ার পর থেকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এমন কোন সালাত আদায় করেননি, যেখানে রুকূ ও সিজদায় নিম্নের দো‘আটি পাঠ করতেন না।سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ رَبَّنَا وَبِحَمْدِكَ اللَّهُمَّ اغْفِرْلِىْ ‘মহাপবিত্র তুমি হে আল্লাহ! আমাদের পালনকর্তা! তোমার জন্যই সকল প্রশংসা। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর’।[বুখারী হা/৭৯৪, মুসলিম/৪৮৪]
ইমাম কুরতুবী বলেন,وقيل: الاستغفارُ تَعَبُّدٌ يَجِبُ إتْيَانَهُ، لاَ لِلْمَغْفِرَةِ، بَلْ تَعَبُّدًا ‘ক্ষমা প্রার্থনা হল দাসত্ব প্রকাশ করা, যা আল্লাহর নিকটে পেশ করা ওয়াজিব। এটি ক্ষমার জন্য নয় বরং অধিক দাসত্ব প্রকাশের জন্য’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা নছর)।
(২) অন্যান্য বছর রামাযানের শেষে দশদিন ই‘তিকাফে থাকলেও ১০ম হিজরীর রামাযানে তিনি ২০ দিন ই‘তিকাফে থাকেন।[বুখারী হা/৪৯৯৮; মিশকাত হা/২০৯৯]
(৩) অন্যান্য বছর জিব্রীল (আঃ) রামাযানে একবার সমস্ত কুরআন পেশ করলেও এ বছর সেটা দু’বার করেন। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি প্রিয় কন্যা ফাতেমাকে বলেন, আমার মৃত্যু খুব নিকটে মনে হচ্ছে’।[বুখারী হা/৬২৮৫; মুসলিম হা/২৪৫০]
(৪) ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের ভাষণের শুরুতেই তিনি বলেছিলেন, ‘আল্লাহর কসম! আমি জানি না এ বছরের পর এই স্থানে তোমাদের সঙ্গে আর মিলিত হতে পারব কি-না’ (নাসাঈ হা/৩০৬২)।
(৫) পরদিন মিনায় কুরবানীর দিনের ভাষণে জামরা আক্বাবায়ে কুবরায় তিনি বলেন, ‘আমার নিকট থেকে তোমরা হজ্জ ও কুরবানীর(خُذُوا عَنِّى مَنَاسِكَكُمْ) নিয়ম-কানূনগুলি শিখে নাও। কারণ এ বছরের পর হয়তবা আমার পক্ষে আর হজ্জ করা সম্ভব হবে না।[মুসলিম হা/১২৯৭ (৩১০); মিশকাত হা/২৬১৮]
(৬) মৃত্যু সন্নিকটে বুঝতে পেরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) একদিন ওহুদ প্রান্তে ‘শোহাদা কবরস্থানে’ গমন করেন এবং তাদের জন্য এমনভাবে দো‘আ করেন যেন তিনি জীবিত ও মৃত সকলের নিকট থেকে চির বিদায় গ্রহণ করছেন। রাবী ওক্ববা বিন ‘আমের (রাঃ) বলেন, আট বছর পরে রাসূল (সাঃ) এই যিয়ারত করেন মৃতদের নিকট থেকে জীবিতদের বিদায় গ্রহণকারীর ন্যায়(كَالْمُوَدِّعِ لِلأَحْيَاءِ وَالأَمْوَاتِ)।[বুখারী হা/৪০৪২; মুসলিম হা/২২৯৬]
(৭) শোহাদা কবরস্থান যিয়ারত শেষে মদীনায় ফিরে তিনি মসজিদে নববীর মিম্বরে বসে সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে বলেন,
إِنِّى فَرَطٌ لَكُمْ، وَأَنَا شَهِيدٌ عَلَيْكُمْ، إنَّ مَوْعِدَكُمُ الْحَوْضُ وَإِنِّىْ وَاللهِ لأَنْظُرُ إِلَى حَوْضِى الآنَ، وَإِنِّىْ أُعْطِيْتُ مَفَاتِيْحَ خَزَائِنِ الأَرْضِ، أَوْ مَفَاتِيْحَ الأَرْضِ، وَإِنِّىْ وَاللهِ مَا أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تُشْرِكُوْا بَعْدِى، وَلَكِنِّى أَخَافُ عَلَيْكُمْ أَنْ تَنَافَسُوْا فِيْهَا وزاد بعضهم: فَتَقْتَتَلُوْا فَتُهْلِكُوْا كَمَا هَلَكَ مَنْ كَانَ قَبلَكُمْ
‘আমি তোমাদের আগেই চলে যাচ্ছি এবং আমি তোমাদের উপরে সাক্ষ্য দানকারী হব। তোমাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হবে হাউয কাওছারে। আমি এখুনি আমার ‘হাউয কাওছার’ দেখতে পাচ্ছি। আমাকে পৃথিবীর সম্পদরাজির চাবিসমূহ প্রদান করা হয়েছে। আল্লাহর কসম! আমার এ ভয় নেই যে, আমার পরে তোমরা শিরকে লিপ্ত হবে। কিন্তু আমার আশংকা হয় যে, তোমরা দুনিয়া অর্জনে পরস্পরে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হবে’। অন্য বর্ণনায় এসেছে, অতঃপর তোমরা পরস্পরে লড়াই করবে এবং ধ্বংস হয়ে যাবে, যেমন তোমাদের পূর্বের লোকেরা ধ্বংস হয়ে গেছে’।[বুখারী ফাৎহুল বারী হা/৪০৪২; মুসলিম হা/২২৯৬; মিশকাত হা/৫৯৫৮]


অসুখের সূচনা :
━━━━━━━━━
ইবনু কাছীর বলেন, ছফর মাসের দু’একদিন বাকী থাকতে অথবা রবীউল আউয়াল মাসের প্রথম দিন অসুখের সূচনা হয় (আল-বিদায়াহ ৫/২২৪)। এদিন মধ্যরাতে রাসূল (সাঃ) স্বীয় গোলাম আবু মুওয়াইহিবাহ(أَبُو مُوَيْهِبَةَ) কে সাথে নিয়ে বাক্বী‘ গোরস্থানে গমন করেন ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। সেখান থেকে ফিরে আসার পর প্রচন্ড মাথাব্যথার মাধ্যমে অসুখের সূচনা হয়। যা মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল’ (আহমাদ হা/১৬০৪০)।[1] আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) আমার কক্ষে প্রবেশ করলেন যেদিন তাঁর অসুখ শুরু হয়। তখন আমি বললাম, হায় মাথাব্যথা!... তিনি বললেন, আমারও প্রচন্ড মাথাব্যথা। অতঃপর তিনি বললেন, ادْعُو إِلَىَّ أَبَاكِ وَأَخَاكِ حَتَّى أَكْتُبَ لأَبِى بَكْرٍ كِتَاباً فَإِنِّى أَخَافُ أَنْ يَقُولَ قَائِلٌ وَيَتَمَنَّى مُتَمَنِّى أَنَا أَوْلَى. وَيَأْبَى اللهُ عَزَّ وَجَلَّ وَالْمُؤْمِنُونَ إِلاَّ أَبَا بَكْرٍ ‘তুমি তোমার পিতা ও ভাইকে আমার নিকটে ডেকে আনো। যাতে আমি আবুবকরের জন্য একটি কাগজ লিখে দিতে পারি। কেননা আমি ভয় পাচ্ছি যে, কোন ব্যক্তি বলবে বা কোন উচ্চাভিলাষী আকাংখা করবে যে, আমিই যোগ্য। অথচ আল্লাহ ও মুমিনগণ আবুবকর ব্যতীত অন্য সবাইকে প্রত্যাখ্যান করে’।[আহমাদ হা/২৫১৫৬; মুসলিম হা/২৩৮৭] অত্র হাদীছ দ্বারা বুঝা যায় যে, আয়েশা (রাঃ)-এর ঘরে থাকা অবস্থাতেই মাথাব্যথা শুরু হয় এবং একথাও প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (সাঃ) অসুখের শুরুর দিনেই আবুবকর (রাঃ)-এর নামে খিলাফত লিখে দিতে চেয়েছিলেন।
আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)-এর গৃহে প্রবেশ করলাম। অতঃপর তাঁর দেহের উপর হাত রাখলাম। তখন তাঁর লেপের উপরেও তাপ অনুভূত হচ্ছিল। শরীর এত গরম ছিল যে, হাত পুড়ে যাচ্ছিল। এতে আমি বিস্ময়বোধ করলে রাসূল (সাঃ) বলেন,
إِنَّا كَذَلِكَ يُضَعَّفُ لَنَا الْبَلاَءُ وَيُضَعَّفُ لَنَا الأَجْرُ. قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ أَىُّ النَّاسِ أَشَدُّ بَلاَءً قَالَ : الأَنْبِيَاءُ. قُلْتُ يَا رَسُولَ اللهِ ثُمَّ مَنْ؟ قَالَ : ثُمَّ الصَّالِحُونَ، إِنْ كَانَ أَحَدُهُمْ لَيُبْتَلَى بِالْفَقْرِ حَتَّى مَا يَجِدُ أَحَدُهُمْ إِلاَّ الْعَبَاءَةَ يُحَوِّيهَا، وَإِنْ كَانَ أَحَدُهُمْ لَيَفْرَحُ بِالْبَلاَءِ كَمَا يَفْرَحُ أَحَدُكُمْ بِالرَّخَاءِ- رواه إبن ماجه-
‘এভাবে আমাদের কষ্ট দ্বিগুণ হয় এবং আমাদের পুরস্কারও দ্বিগুণ হয়। অতঃপর আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! দুনিয়াতে সবচেয়ে বিপদগ্রস্ত কারা? তিনি বললেন, নবীগণ। আমি বললাম, তারপর কারা? তিনি বললেন, নেককার ব্যক্তিগণ। এমনকি তাদের কেউ দারিদ্রে্যর কষাঘাতে এমনভাবে জর্জরিত হবে যে, পোষাক হিসাবে মাথার ‘আবা’ (الْعَبَاءَةُ) ছাড়া কিছুই পাবে না। তাদের কেউ বিপদে পড়লে এমন খুশী হবে, যেমন তোমাদের কেউ প্রাচুর্য পেলে খুশী হয়ে থাক’।[ইবনু মাজাহ হা/৪০২৪; সহীহাহ হা/১৪৪]
তাঁর মোট অসুখের সময়কাল ছিল ১৩ অথবা ১৪ দিন। যার মধ্যে অধিকাংশ দিন তিনি মসজিদে এসে জামা‘আতে ইমামতি করেন। শেষের দিকে বৃহস্পতিবার এশা থেকে সোমবার ফজর পর্যন্ত ১৭ ওয়াক্ত সালাতে আবুবকর (রাঃ) ইমামতি করেন।


জীবনের শেষ সপ্তাহ :
━━━━━━━━━━━━━
রাসূল (সাঃ)-এর শারীরিক অবস্থার ক্রমেই অবনতি হতে থাকে। এ সময় তিনি বারবার স্ত্রীদের জিজ্ঞেস করতে থাকেন,أَيْنَ أَنَا غَدًا أَيْنَ أَنَا غَدًا ‘আগামীকাল আমি কোথায় থাকব? আগামীকাল আমি কোথায় থাকব’? তারা এর অর্থ বুঝতে পেরে বললেন, ‘আপনি যেখানে খুশী থাকতে পারেন’। তখন তিনি আয়েশার গৃহে গমন করেন।[বুখারী হা/৪৪৫০; মিশকাত হা/৩২৩১] এ সময় তাঁর মাথায় পট্টি বাঁধা ছিল। ফযল বিন আববাস ও আলী ইবনু আবী ত্বালেবের কাঁধে ভর করে অতি কষ্টে তিনি পা টিপে টিপে হাঁটছিলেন(تَخُطُّ قَدَمَاهُ)। অতঃপর তিনি আয়েশার কক্ষে প্রবেশ করেন এবং জীবনের শেষ সপ্তাহটি সেখানেই অতিবাহিত করেন।
অন্য সময় আয়েশা (রাঃ) সূরা ফালাক্ব ও নাস এবং অন্যান্য দো‘আ, যা তিনি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট থেকে শিখেছিলেন, সেগুলি পাঠ করে ফুঁক দিয়ে বরকতের আশায় রাসূল (সাঃ)-এর হাত তাঁর দেহে বুলিয়ে দিতেন। এ সময় তিনি সেটাই করতে চাইলেন। কিন্তু নিজের হাত টেনে নিয়ে রাসূল (সাঃ) বললেন,اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِىْ وَارْحَمْنِىْ وَأَلْحِقْنِىْ بِالرَّفِيْقِ الأَعْلَى ‘হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর, আমাকে দয়া কর এবং আমাকে সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত কর’ (বুখারী হা/৫৬৭৪)।


মৃত্যুর পাঁচদিন পূর্বে :
━━━━━━━━━━━━━
জীবনের শেষ বুধবার। এদিন তাঁর দেহের উত্তাপ ও মাথাব্যথা খুব বৃদ্ধি পায়। তাতে তিনি বারবার বেহুঁশ হয়ে পড়তে থাকেন।
হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, এ সময় তিনি ঘরের মধ্যে মিসরীয় খ্রিষ্টান দাসী মারিয়া ক্বিবত্বিয়াহ এবং হিজরতে থাকা অবস্থায় স্ত্রী উম্মে সালামাহ ও উম্মে হাবীবাহ হাবশাতে তাদের দেখা খ্রিষ্টান ধর্মনেতাদের কবর সমূহে তাদের প্রতিকৃতি আঁকিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে আলোচনা করলে রাসূল (সাঃ) মুখের চাদর ফেলে দিয়ে মাথা উঁচু করে বলেন, إِنَّ أُولَئِكَ إِذَا كَانَ فِيهِمُ الرَّجُلُ الصَّالِحُ فَمَاتَ بَنَوْا عَلَى قَبْرِهِ مَسْجِدًا، وَصَوَّرُوا فِيهِ تِلْكَ الصُّوَرَ، فَأُولَئِكَ شِرَارُ الْخَلْقِ عِنْدَ اللهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ- لَعَنَ اللهُ الْيَهُودَ وَالنَّصَارَى، اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسْجِدًا ‘ওদের মধ্যে কোন নেককার মানুষ মারা গেলে তারা তার কবরের উপর মসজিদ বানাতো এবং তার মধ্যে তাদের ছবি আঁকতো। ওরা হল ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর নিকটে সৃষ্টিজগতের নিকৃষ্টতম জীব। আল্লাহ ইহূদী-নাছারাদের উপরে লা‘নত করুন! তারা তাদের নবীগণের কবর সমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছে’ (মুসলিম হা/৫২৯-৩০; মিশকাত হা/৭১২)।
সুলায়মান বিন ইয়াসার ও আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, তিনি আরও বলেন,اللَّهُمَّ لا تَجْعَلْ قَبْرِي وَثَنًا يُعْبَدُ، اشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلَى قَوْمٍ اتَّخَذُوْا قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার কবরকে মূর্তি বানিয়ো না, যাকে পূজা করা হয়। ঐ কওমের উপরে আল্লাহর প্রচন্ড ক্রোধ রয়েছে, যারা নবীগণের কবরসমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করে’ (আহমাদ হা/৭৩৫২; মিশকাত হা/৭৫০)। কা‘ব বিন মালেক (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সাঃ) বলেন, إِنِّيْ أَنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ، اللَّهُمَّ هَلْ بَلَّغْتُ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ ثُمَّ قَالَ اللَّهُمَّ اشْهَدْ ثَلاَثَ مَرَّاتٍ ‘আমি তোমাদেরকে এ বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি’। দেখো, আমি কি তোমাদেরকে পৌঁছে দিলাম’ (৩ বার)? হে আল্লাহ তুমি সাক্ষী থাক’ (৩ বার)।[ত্বাবারাণী হা/৮৯; সহীহ আত-তারগীব হা/২২৮৮]
আয়েশা (রাঃ) বলেন, অতঃপর তিনি বেহুঁশ হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরলে তিনি বলেন, ‘তোমরা বিভিন্ন কূয়া থেকে পানি এনে আমার উপরে সাত মশক পানি ঢাল। যাতে আমি বাইরে যেতে পারি এবং লোকদের উপদেশ দিতে পারি। অতঃপর আমরা তাঁকে হাফছা বিনতে উমরের পাথর অথবা তাম্র নির্মিত একটি বড় পাত্রের মধ্যে বসিয়ে দিলাম এবং তাঁর উপরে পানি ঢালতে লাগলাম। এক পর্যায়ে তিনি বলতে থাকেন,حَسْبُكُمْ حَسْبُكُمْ ‘ক্ষান্ত হও, ক্ষান্ত হও’। অতঃপর একটু হালকা বোধ করলে তিনি মাথায় কাপড় দিয়ে যোহরের প্রাক্কালে মসজিদে প্রবেশ করেন। অতঃপর সালাত আদায় করেন এবং তাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন’।[2]
এদিন বের হবার মূল কারণ ছিল আনছারদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখা। যেমন হযরত আনাস (রাঃ) বলেন যে, আবুবকর ও আববাস (রাঃ) আনছারদের এক মজলিসের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তাঁরা তাদেরকে ক্রন্দনরত অবস্থায় দেখতে পান। কারণ জিজ্ঞেস করলে তারা বলেন যে, আমরা আমাদের সঙ্গে রাসূল (সাঃ)-এর উঠাবসার কথা স্মরণ করছিলাম। অতঃপর তাঁদের একজন রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে গিয়ে আনছারদের এই অভিব্যক্তির কথা অবহিত করেন। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাদের প্রতি সহানুভূতি জানাতে চাদরের এক প্রান্ত মাথায় বাঁধা অবস্থায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসেন ও মিম্বরে আরোহন করেন। এদিনের পর তিনি আর মিম্বরে আরোহন করেননি’। অতঃপর সমবেত লোকদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন,
(১) أُوْصِيْكُمْ بِالأَنْصَارِ، فَإِنَّهُمْ كَرِشِى وَعَيْبَتِى، وَقَدْ قَضَوُا الَّذِى عَلَيْهِمْ، وَبَقِىَ الَّذِى لَهُمْ، فَاقْبَلُوْا مِنْ مُحْسِنِهِمْ، وَتَجَاوَزُوْا عَنْ مُسِيْئِهِمْ ‘আমি তোমাদেরকে আনছারদের বিষয়ে অছিয়ত করে যাচ্ছি। তারা আমার বিশ্বস্ত ও অন্তরঙ্গ। তারা তাদের দায়িত্ব সম্পূর্ণ করেছে। কিন্তু তাদের প্রাপ্য বাকী রয়েছে। অতএব তোমরা তাদের উত্তমগুলি গ্রহণ করো এবং মন্দগুলি ক্ষমা করে দিয়ো’।[বুখারী হা/৩৭৯৯, আনাস (রাঃ) হতে; মিশকাত হা/৬২১২] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন,فَإِنَّ النَّاسَ يَكْثُرُونَ وَيَقِلُّ الأَنْصَارُ، حَتَّى يَكُونُوا فِى النَّاسِ بِمَنْزِلَةِ الْمِلْحِ فِى الطَّعَامِ، فَمَنْ وَلِىَ مِنْكُمْ شَيْئًا يَضُرُّ فِيهِ قَوْمًا، وَيَنْفَعُ فِيهِ آخَرِينَ، فَلْيَقْبَلْ مِنْ مُحْسِنِهِمْ، وَيَتَجَاوَزْ عَنْ مُسِيْئِهِمْ ‘মানুষ ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকবে। কিন্তু আনছারদের সংখ্যা কমতে থাকবে। এমনকি তাদের অবস্থা হবে খাদ্যের মধ্যে লবনের ন্যায়(كَالْمِلْحِ فِي الطَّعَامِ)। অতএব তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কারু ক্ষতি বা উপকার করার মালিক হবে (অর্থাৎ নেতৃত্বে আসবে), সে যেন তাদের উত্তমগুলি গ্রহণ করে এবং মন্দগুলি ক্ষমা করে’ (বুখারী হা/৩৬২৮)।
(২) জুনদুব বিন আব্দুল্লাহ আল-বাজালী (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)-কে তাঁর মৃত্যুর পাঁচ দিন পূর্বে বলতে শুনেছি,
إِنِّىْ أَبْرَأُ إِلَى اللهِ أَنْ يَكُونَ لِى مِنْكُمْ خَلِيْلٌ فَإِنَّ اللهَ تَعَالَى قَدِ اتَّخَذَنِىْ خَلِيْلاً كَمَا اتَّخَذَ إِبْرَاهِيمَ خَلِيْلاً وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا مِنْ أُمَّتِىْ خَلِيْلاً لاَتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ خَلِيْلاً، لَكِنَّهُ أَخِيْ وَ صَاحِبِيْ، إنَّ مِنْ أَمَنِّ النَّاسِ عَلَيَّ فِيْ صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبُوْ بَكْرٍ وَإِنَّ مَنْ كَانَ قَبْلَكُمْ كَانُوْا يَتَّخِذُوْنَ قُبُوْرَ أَنْبِيَائِهِمْ وَصَالِحِيْهِمْ مَسَاجِدَ أَلاَ فَلاَ تَتَّخِذُوا الْقُبُوْرَ مَسَاجِدَ، إنِّيْ أنْهَاكُمْ عَنْ ذَلِكَ-
‘আমি আল্লাহর নিকট দায়মুক্ত এজন্য যে, তিনি আমাকে তোমাদের মধ্যে কাউকে ‘বন্ধু’(خَلِيْل) হিসাবে গ্রহণ করার অনুমতি দেননি। কেননা আল্লাহ আমাকে ‘বন্ধু’ হিসাবে গ্রহণ করেছেন। যেমন তিনি ইবরাহীমকে ‘বন্ধু’ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন। তবে যদি আমি আমার উম্মতের মধ্যে কাউকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম, তাহলে আবুবকরকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করতাম। কিন্তু তিনি আমার ভাই ও সাথী। লোকদের মধ্যে নিজের সাহচর্য ও সম্পদ দিয়ে আমার প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ প্রদর্শন করেছেন আবুবকর। মনে রেখ, তোমাদের পূর্বে যারা ছিল তারা তাদের নবী ও নেককার লোকদের কবর সমূহকে সিজদার স্থানে পরিণত করেছিল। তোমরা যেন এরূপ করো না’। আমি তোমাদেরকে এ বিষয়ে নিষেধ করে যাচ্ছি’।[বুখারী হা/৪৬৭; মুসলিম হা/২৩৮২; মিশকাত হা/৬০১০-১১]
(৩) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, এদিন তিনি মিম্বরে বসে আরও বলেন,إِنَّ عَبْدًا خَيَّرَهُ اللهُ بَيْنَ أَنْ يُؤْتِيَهُ مِنْ زَهْرَةِ الدُّنْيَا مَا شَاءَ، وَبَيْنَ مَا عِنْدَهُ، فَاخْتَارَ مَا عِنْدَهُ ‘একজন বান্দাকে আল্লাহ এখতিয়ার দিয়েছেন যে, সে চাইলে দুনিয়ার জাঁকজমক সবকিছু তাকে দেওয়া হবে অথবা আল্লাহর নিকটে যা আছে তা সে গ্রহণ করবে। অতঃপর সে বান্দা সেটাকেই পসন্দ করেছে, যা আল্লাহর নিকটে রয়েছে’। একথার তাৎপর্য বুঝতে পেরে আবুবকর (রাঃ) কেঁদে উঠে বললেন,فَدَيْنَاكَ بِآبَائِنَا وَأُمَّهَاتِنَا ‘আমাদের পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গীত হৌন’ (বুখারী হা/৪৬৬; মিশকাত হা/৫৯৫৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে,وَأَنْفُسِنَا وَأَمْوَالِنَا ‘আমাদের জীবন ও সম্পদ সমূহ’।[দারেমী হা/৭৭; মিশকাত হা/৫৯৬৮] রাবী বলেন, আমি মনে মনে বললাম, এই শায়খ কাঁদছেন কেন? এতে কাঁদবার কি আছে? বস্ত্ততঃ ‘আবুবকর ছিলেন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে জ্ঞানী ব্যক্তি’(وَكَانَ أَبُو بَكْرٍ هُوَ أَعْلَمُنَا)। অতঃপর তিনি বললেন,يَا أَبَا بَكْرٍ لاَ تَبْكِ، إِنَّ أَمَنَّ النَّاسِ عَلَىَّ فِى صُحْبَتِهِ وَمَالِهِ أَبُو بَكْرٍ، وَلَوْ كُنْتُ مُتَّخِذًا خَلِيلاً مِنْ أُمَّتِى لاَتَّخَذْتُ أَبَا بَكْرٍ، وَلَكِنْ أُخُوَّةُ الإِسْلاَمِ وَمَوَدَّتُهُ، لاَ يَبْقَيَنَّ فِى الْمَسْجِدِ بَابٌ إِلاَّ سُدَّ إِلاَّ بَابُ أَبِى بَكْرٍ ‘হে আবুবকর! তুমি কেঁদো না। নিশ্চয় লোকদের মধ্যে সাহচর্য ও সম্পদ দিয়ে আমার প্রতি সর্বাধিক অনুগ্রহ করেছেন আবুবকর। যদি আমি উম্মতের মধ্যে কাউকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম, তাহলে আবুবকরকেই করতাম। কিন্তু ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও ভালোবাসাই উত্তম। আর মসজিদের সকল দরজা বন্ধ হবে কেবল আবুবকরের দরজা ব্যতীত’।[বুখারী হা/৪৬৬; মুসলিম হা/২৩৮২ (২)]


মৃত্যুর চার দিন পূর্বে শেষ বৃহস্পতিবার :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
বৃহস্পতিবার রাসূল (সাঃ)-এর রোগযন্ত্রণা বেড়ে যায়। পরে যন্ত্রণা খুব বৃদ্ধি পেলে রাসূল (সাঃ) বলে ওঠেন,هَلُمُّوا أَكْتُبْ لَكُمْ كِتَابًا لاَ تَضِلُّوْا بَعْدَهُ ‘কাগজ-কলম নিয়ে এসো! আমি তোমাদের জন্য লিখে দিয়ে যাই। যাতে তোমরা পরে পথভ্রষ্ট না হও’। উপস্থিত লোকদের মধ্যে উমর (রাঃ) বললেন,قَدْ غَلَبَهُ الْوَجَعُ وَعِنْدَكُمُ الْقُرْآنُ، حَسْبُنَا كِتَابُ اللهِ ‘তাঁর উপরে এখন রোগ যন্ত্রণা বেড়ে গেছে। তোমাদের নিকটে কুরআন রয়েছে। আমাদের জন্য আল্লাহর কিতাবই যথেষ্ট’। এতে গৃহবাসীদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়ে গেল। কেউ কাগজ-কলম আনতে চান। কেউ নিষেধ করেন। ফলে এক পর্যায়ে রাসূল (সাঃ) বললেন,قُوْمُوْا عَنِّىْ ‘তোমরা এখান থেকে চলে যাও’।[3]
আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর মৃত্যুকালীন রোগশয্যায় আমাকে বললেন,ادْعِى لِى أَبَا بَكْرٍ وَأَخَاكِ حَتَّى أَكْتُبَ كِتَابًا فَإِنِّى أَخَافُ أَنْ يَتَمَنَّى مُتَمَنٍّ وَيَقُولَ قَائِلٌ أَنَا أَوْلَى. وَيَأْبَى اللهُ وَالْمُؤْمِنُونَ إِلاَّ أَبَا بَكْرٍ ‘তোমার পিতা আবুবকর ও তোমার ভাই (আব্দুর রহমান)-কে আমার কাছে ডেকে আন। আমি তাদেরকে একটি কাগজ লিখে দেব। কেননা আমি ভয় পাচ্ছি যে, কোন উচ্চাভিলাষী (খেলাফতের) উচ্চাকাংখা পোষণ করতে পারে এবং কোন ব্যক্তি দাবী করতে পারে যে, আমিই এর অধিক হকদার(أَنَا أَوْلَى)। অথচ আল্লাহ ও মুমিনগণ আবুবকর ব্যতীত অন্য সবাইকে প্রত্যাখ্যান করে’।[মুসলিম হা/২৩৮৭; বুখারী হা/৫৬৬৬; মিশকাত হা/৫৯৭০]
এতে বুঝা যায় যে, খিলাফত লিখে দিলে তিনি আবুবকর (রাঃ)-এর নামেই লিখতেন। আয়েশা (রাঃ)-এর বাধার কারণেই সেটা সম্ভব হয়নি। অথচ আলী (রাঃ) প্রথম খলীফা না হওয়ার জন্য শী‘আরা অন্যায়ভাবে তাঁকেই দায়ী করে থাকে।


তিনটি অছিয়ত :
━━━━━━━━━━
অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সবাইকে তিনটি অছিয়ত করেন।-
(১) ইহূদী, নাছারা ও মুশরিকদের আরব উপদ্বীপ থেকে বের করে দিয়ো।
(২) প্রতিনিধিদলের সম্মান ও আপ্যায়ন অনুরূপভাবে করো, যেভাবে আমি করতাম।[বুখারী হা/৩০৫৩; মুসলিম হা/১৬৩৭]
(৩) তৃতীয় অছিয়তটির কথা রাবী সুলায়মান আল-আহওয়ালের বর্ণনায় আসেনি’ (বুখারী হা/৩১৬৮)। তবে সহীহ বুখারীর ‘অছিয়ত সমূহ’ অধ্যায়ে আব্দুল্লাহ বিন আবু ‘আওফা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, সেটি ছিল আল্লাহর কিতাবকে অাঁকড়ে ধরো’ (বুখারী হা/২৭৪০)।


সর্বশেষ ইমামতি :
━━━━━━━━━━
মৃত্যুর চারদিন পূর্বে বৃহস্পতিবার মাগরিবের সালাতের ইমামতিই ছিল তাঁর জীবনের সর্বশেষ ইমামতি। অসুখ সত্ত্বেও তিনি এযাবত প্রতি ওয়াক্ত সালাতে ইমামতি করেছেন। সর্বশেষ এই ইমামতিতে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) প্রথম দু’রাক‘আতে সূরা মুরসালাত পাঠ করেন’। যার সর্বশেষ আয়াত ছিলفَبِأَيِّ حَدِيْثٍ بَعْدَهُ يُؤْمِنُوْنَ ‘এর পরে কোন্ বাণীর উপরে তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করবে’? (মুরসালাত ৭৭/৫০)। অর্থাৎ কুরআনের পরে আর কোন্ কালামের উপরে তোমরা ঈমান আনবে?
এর দ্বারা যেন তিনি ইঙ্গিত করলেন যে, আল্লাহ পাকের আহবানের সাথে সাথে উম্মতে মুহাম্মাদীর প্রতি আমার জীবনের সর্বশেষ আহবান হল, সর্বাবস্থায় তোমরা কুরআনের বিধান মেনে চলবে। কোন অবস্থাতেই কুরআন ছেড়ে অন্য কিছু গ্রহণ করবে না।[4]


আবু বকরের ইমামতি শুরু :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
এশার সালাতের জন্য আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তিনবার ওযূ করেন ও তিনবার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। অবশেষে ব্যর্থ হয়ে আবুবকরকে ইমামতি করার নির্দেশ পাঠান। এরপর থেকে রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যু পর্যন্ত আবুবকর (রাঃ) একটানা ১৭ ওয়াক্ত সালাতের ইমামতি করেন।[5] লোকেরা খারাপ ধারণা করবে মনে করে আয়েশা (রাঃ) তিন থেকে চারবার তার পিতার ইমামতির ব্যাপারে আপত্তি তুলে অন্যকে ইমামতির দায়িত্ব প্রদানের অনুরোধ করেন। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সাঃ) উক্ত অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে বলেন,إِنَّكُنَّ صَوَاحِبُ يُوْسُفَ، مُرُوْا أَبَا بَكْرٍ فَلْيُصَلِّ بِالنَّاسِ ‘তোমরা ইউসুফের সহচরীদের মত হয়ে গেছ। আবুবকরকে বলে দাও যেন সে সালাতে ইমামতি করে’।[বুখারী হা/৬৭৯; মিশকাত হা/১১৪০] অর্থাৎ যুলায়খা ও তার সহচরী মহিলারা যেভাবে ইউসুফকে অন্যায় কাজে প্রলুব্ধ করতে চেয়েছিল, তোমরাও তেমনি আমাকে আবুবকরকে বাদ দিয়ে অন্যকে ইমামতি করার মত অন্যায় নির্দেশ দানে প্ররোচিত করতে চাও? এর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ খেলাফতের জন্য আবুবকরের প্রতি ইঙ্গিত ছিল। হযরত উমর (রাঃ) সেটা বুঝতে পেরেই সম্ভবতঃ তাঁর নাম খলীফা হিসাবে প্রস্তাব করেছিলেন এবং সাথে সাথেই সর্বসম্মতভাবে তা গৃহীত ও অভিনন্দিত হয়। তাছাড়া তাঁর তুলনীয় ব্যক্তিত্ব উম্মতের মধ্যে তখনও কেউ ছিল না। ভবিষ্যতেও হবে না।


মৃত্যুর দু’দিন পূর্বে সর্বশেষ সামরিক অভিযান প্রেরণ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
শনিবারে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কিছুটা হালকা বোধ করেন।[6] এমতাবস্থায় তিনি দু’জনের কাঁধে ভর করে মসজিদে আগমন করেন। তখন আবুবকর (রাঃ)-এর ইমামতিতে যোহরের জামা‘আত শুরু হয়েছিল। রাসূল (সাঃ)-এর আগমন টের পেয়ে আবুবকর (রাঃ) পিছিয়ে আসার উদ্যোগ নিতেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে ইঙ্গিতে নিষেধ করলেন। অতঃপর রাসূল (সাঃ)-কে আবুবকর (রাঃ)-এর বামপাশে বসিয়ে দেওয়া হল। তিনি তখন রাসূল (সাঃ)-এর ইক্বতেদা করতে থাকেন এবং লোকদেরকে তাকবীর শুনাতে থাকেন’।[বুখারী হা/৭১৩; মুসলিম হা/৪১৮] বস্ত্ততঃ এটাই ছিল সালাতে মুকাবিবর হওয়ার প্রথম ঘটনা। আর আবুবকর (রাঃ) ছিলেন ইসলামের ইতিহাসে প্রথম ‘মুকাবিবর’।
তাছাড়া এদিন তিনি উসামাহ বিন যায়েদ-এর নেতৃত্বে শাম অঞ্চলে সর্বশেষ সেনাদল প্রেরণ করেন (দ্রঃ সারিইয়া ক্রমিক ৯০)।


মৃত্যুর একদিন পূর্বে :
━━━━━━━━━━━━
সম্ভবতঃ মৃত্যুর পূর্বদিন রবিবার তিনি স্ত্রী আয়েশাকে বলেন, দীনারগুলি কি বিতরণ করেছ? তিনি বললেন, আপনার রোগ যন্ত্রণায় ব্যস্ত থাকার কারণে বিতরণের সময় পাইনি। রাসূল (সাঃ) বললেন, ওগুলি আমার কাছে নিয়ে এস। ঐ সময় ঘরে ৫ থেকে ৯টি স্বর্ণমুদ্রা ছিল। আয়েশা (রাঃ) সেগুলি এনে তাঁর হাতে দিলেন। তখন তিনি বললেন, এগুলি এখুনি বিতরণ করে দাও। কেননা কোন নবীর জন্য এটি মর্যাদাকর নয় যে, এইরূপ (নিকৃষ্ট) বস্ত্তগুলি নিয়ে তিনি আল্লাহর সাথে সাক্ষাত করবেন’।[7] অথচ ঐ সময় রাসূল (সাঃ)-এর লৌহবর্মটি এক ইহূদীর নিকটে ৩০ ছা‘ (৭৫ কেজি) যবের বিনিময়ে বন্ধক ছিল।[বুখারী হা/২৯১৬; মিশকাত হা/২৮৮৫]


জীবনের শেষ দিন :
━━━━━━━━━━━━
সোমবার ফজরের জামা‘আত চলা অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ঘরের পর্দা উঠিয়ে একদৃষ্টে মসজিদে জামা‘আতের দিকে তাকিয়ে থাকেন। এতে তাঁর চেহারা খুশীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এবং ঠোটে মুচকি হাসির রেখা ফুটে ওঠে। রাসূল (সাঃ)-এর জামা‘আতে আসার আগ্রহ বুঝতে পেরে আবুবকর (রাঃ) পিছিয়ে আসতে চান। কিন্তু আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ইশারায় তাঁকে থামিয়ে দেন এবং দরজার পর্দা ঝুলিয়ে দেন। রাবী আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর ভাষায় ‘ঐ সময় রাসূল (সাঃ)-এর চেহারা ছিল যেন ‘কুরআনের পাতা’(كَأَنَّ وَجْهَهُ وَرَقَةُ مُصْحَفٍ)। অতঃপর এদিনই তিনি মৃত্যুবরণ করেন’ (বুখারী হা/৬৮০)।
কুরআনের বাস্তব রূপকার, মৃত্যুপথযাত্রী রাসূল (সাঃ)-এর শুচিশুদ্ধ আলোকময় চেহারা যেন পরম পবিত্র সত্যসন্ধ কুরআনের কনকোজ্জ্বল পৃষ্ঠার ন্যায় দীপ্ত ও জ্যোতির্ময় দেখাচ্ছিল। আনাস (রাঃ)-এর এই অপূর্ব তুলনা সত্যি কতই না সুন্দর ও কতই না মনোহর! সালাতের পাগল রাসূল (সাঃ)-এর ভাগ্যে যোহরের ওয়াক্ত আসার সুযোগ আর হয়নি।
এরপর সূর্য কিছুটা উপরে উঠলে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) প্রাণপ্রিয় কন্যা ফাতেমাকে কাছে ডাকেন এবং কানে কানে কিছু কথা বলেন। তাতে তিনি কাঁদতে থাকেন। পরে তাকে আবার ডাকেন এবং কানে কানে কিছু কথা বলেন। তাতে তিনি হেসে ওঠেন। প্রথমবারে রাসূল (সাঃ) তাকে বলেন যে, এই অসুখেই আমার মৃত্যু ঘটবে। তাতে তিনি কাঁদেন। দ্বিতীয়বারে তিনি বলেন যে, পরিবারের মধ্যে তুমিই প্রথম আমার সাথে মিলিত হবে (অর্থাৎ তোমার মৃত্যু হবে)। তাতে তিনি হাসেন।[8] এই সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাঁকে ‘জান্নাতী মহিলাদের নেত্রী’سَيِّدَةُ نِسَاءِ أَهْلِ الْجَنَّةِ হবার সুসংবাদ দান করেন।[9] অতঃপর রাসূল (সাঃ)-এর রোগ-যন্ত্রণার কষ্ট দেখে ফাতেমা (রাঃ) বলে ওঠেন,وَاكَرْبَاهُ ‘হায় কষ্ট’! রাসূল (সাঃ) তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেন,لَيْسَ عَلَى أَبِيْكِ كَرْبٌ بَعْدَ الْيَوْمِ ‘আজকের দিনের পর তোমার পিতার আর কোন কষ্ট নেই’ (বুখারী হা/৪৪৬২)।
অতঃপর তিনি হাসান ও হোসায়েনকে ডাকেন। তাদেরকে আদর করে চুমু দেন ও তাদেরকে সদুপদেশ দেন। উভয়ের বয়স তখন যথাক্রমে ৮ ও ৭ বছর। এরপর স্ত্রীগণকে ডাকেন ও তাদেরকে বিভিন্ন উপদেশ দেন। এ সময় তাঁর রোগ-যন্ত্রণা তীব্র আকার ধারণ করে। তিনি আয়েশা (রাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘হে আয়েশা! খায়বরে যে বিষমিশ্রিত খাদ্য আমি খেয়েছিলাম, সে বিষের প্রভাবে আমার শিরা-উপশিরা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে’ (বুখারী হা/৪৪২৮; মিশকাত হা/৫৯৬৫)। তিনি গিলেননি, ফেলে দিয়েছিলেন। তাতেই যে সামান্য বিষক্রিয়া হয়, সেটিই মৃত্যুকালে তাঁকে কঠিনভাবে কষ্ট দেয়। আর এটাই স্বাভাবিক যে, পুরানো কোন অসুখ যা সুপ্ত থাকে, তা বার্ধক্যে বা মৃত্যুকালে মাথা চাড়া দেয়।
উল্লেখ্য যে, ৭ম হিজরীর মুহাররম মাসে খায়বর বিজয় শেষে ইহূদী বনু নাযীর গোত্রের নেতা সাল্লাম বিন মিশকামের স্ত্রী যয়নব বিনতুল হারেছ তাঁকে দাওয়াত দিয়ে বিষমিশ্রিত বকরীর ভুনা রান খেতে দেয়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেই গোশত মুখে দিয়ে চিবানোর পর না গিলে ফেলে দেন(فَلَمْ يُسِغْهَا، وَلَفَظَهَا) এবং বলেন, এই হাড্ডি আমাকে বলছে যে এতে বিষ মিশানো আছে’।[ইবনু হিশাম ২/৩৩৭-৩৮; আহমাদ হা/৩৫৪৭] অতঃপর তিনি উপস্থিত সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেন,الصَّلاَةُ الصَّلاَةُ وَمَا مَلَكَتْ أَيْمَانُكُمْ ‘সালাত সালাত এবং তোমাদের দাস-দাসী’ অর্থাৎ সালাত ও স্ত্রীজাতির বিষয়ে তোমরা সর্বাধিক খেয়াল রেখো’। আয়েশা (রাঃ) বলেন, একথাটি তিনি বারবার পুনরাবৃত্তি করেন’। আনাস (রাঃ) বলেন, এটিই ছিল রাসূল (সাঃ)-এর সর্বশেষ অছিয়ত’।[আহমাদ হা/২৬৫২৬; মিশকাত হা/৩৩৫৬]


মৃত্যু যন্ত্রণা শুরু :
━━━━━━━━━━
এরপর মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হল। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্ত্রী আয়েশার বুকে ও কাঁধে ঠেস দিয়ে বসা অবস্থায় ছিলেন। এমন সময় আয়েশা (রাঃ)-এর ভাই আব্দুর রহমান (রাঃ) সেখানে উপস্থিত হন। তার হাতে কাঁচা মিসওয়াক দেখে সেদিকে রাসূল (সাঃ)-এর দৃষ্টি গেল। আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমি তাঁর আগ্রহ বুঝতে পেরে তাঁর অনুমতি নিয়ে মিসওয়াকটি চিবিয়ে নরম করে তাঁকে দিলাম। তখন তিনি সুন্দরভাবে মিসওয়াক করলেন ও পাশে রাখা পাত্রে হাত ডুবিয়ে (কুলি সহ) মুখ ধৌত করলেন। এসময় তিনি বলতে থাকেন,لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ، إِنَّ لِلْمَوْتِ سَكَرَاتٍ ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। নিশ্চয়ই মৃত্যুর রয়েছে কঠিন যন্ত্রণা সমূহ’।[বুখারী হা/৪৪৪৯; মিশকাত হা/৫৯৫৯] এমন সময় তিনি ঘরের ছাদের দিকে তাকিয়ে হাত কিংবা আঙ্গুল উঁচিয়ে বলতে থাকলেন,
مَعَ الَّذِيْنَ أَنْعَمَ اللهُ عَلَيْهِمْ مِنَ النَّبِيِّيْنَ وَالصِّدِّيقِيْنَ وَالشُّهَدَاءِ وَالصَّالِحِيْنَ وَحَسُنَ أُولَئِكَ رَفِيْقًا، اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِىْ وَارْحَمْنِىْ وَأَلْحِقْنِىْ بِالرَّفِيْقِ الْأَعْلَى، اللَّهُمَّ الرَّفِيقَ الْأَعْلَى-
‘(হে আল্লাহ!) নবীগণ, ছিদ্দীকগণ, শহীদগণ এবং নেককার ব্যক্তিগণ যাদের তুমি পুরস্কৃত করেছ, আমাকে তাদের সাথী করে নাও। হে আল্লাহ! তুমি আমাকে ক্ষমা কর ও দয়া কর এবং আমাকে আমার সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত কর। হে আল্লাহ! আমার সর্বোচ্চ বন্ধু!’ আয়েশা (রাঃ) বলেন, শেষের কথাটি তিনি তিনবার বলেন। অতঃপর তাঁর হাত এলিয়ে পড়ল, দৃষ্টি নিথর হয়ে গেল’। তিনি সর্বোচ্চ বন্ধুর সাথে মিলিত হলেন।[বুখারী হা/৪৫৮৬, ৫৬৭৪; মিশকাত হা/৫৯৫৯-৬০] আয়েশা (রাঃ) বলেন, আমার উপর আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ এই যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমার ঘরে, আমার পালার দিন এবং আমার বুক ও গলার মধ্যে হেলান দেওয়া অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছেন। আর তাঁর মৃত্যুর পূর্বক্ষণে পার্থিব জীবনের শেষ দিন ও পরকালীন জীবনের প্রথম দিন আল্লাহ আমার মুখের লালার সাথে তাঁর মুখের লালা মিলিয়ে দিয়েছেন। আর আমার ঘরেই তাঁর দাফন হয়েছে’।[বুখারী হা/১৩৮৯, ৪৪৪৯, ৪৪৫১; মিশকাত হা/৫৯৫৯]
আয়েশা (রাঃ) থেকে অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন, যখন মৃত্যু ঘনিয়ে এল, তখন তাঁর মাথা ছিল আমার রানের উপর, তিনি বেহুঁশ হয়ে গেলেন। তারপর হুঁশ ফিরে এল। তখন তিনি ছাদের দিকে চক্ষু নিবদ্ধ করলেন। অতঃপর বললেন,اللَّهُمَّ الرَّفِيْقَ الْأَعْلَي ‘হে আল্লাহ! হে সর্বোচ্চ বন্ধু’! আর এটাই ছিল তাঁর শেষ কথা। আয়েশা (রাঃ) বলেন, এর দ্বারা আমি বুঝলাম, এখন তিনি আর আমাদের পসন্দ করবেন না। বুঝলাম, যে কথা তিনি সুস্থ অবস্থায় বলতেন, সেটাই ঠিক হল। তা এই যে, لَنْ يُقْبَضَ نَبِيٌّ قَطُّ حَتَّى يُرَى مَقْعَدَهُ مِنَ الْجَنَّةِ ثُمَّ يُخَيَّرُ ‘কোন নবী মৃত্যুবরণ করেন না, যতক্ষণ না জান্নাতে তাঁর ঠিকানা দেখানো হয়। অতঃপর তাঁকে এখতিয়ার দেওয়া হয় দুনিয়ায় বেঁচে থাকার অথবা মৃত্যুবরণ করে জান্নাতে যাওয়ার’। আমি বুঝলাম যে, তিনি আখেরাতকেই পসন্দ করলেন।[বুখারী হা/৬৩৪৮; মুসলিম হা/২৪৪৪] অতঃপর আমি তাঁর মাথা বালিশে রাখি এবং অন্যান্য মহিলাদের সাথে কাঁদতে কাঁদতে উঠে আসি’ (ইবনু হিশাম ২/৬৫৫)। ইন্না লিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজে‘ঊন (আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তাঁর দিকে প্রত্যাবর্তনকারী; (বাক্বারাহ ২/১৫৬)।
উপরোক্ত দুই বর্ণনার সমন্বয় এটাই হতে পারে যে, বুকের উপরে মৃত্যুক্ষণ উপস্থিত হলে তিনি তাঁকে স্বীয় রানের উপরে শুইয়ে দেন এবং তখনই রাসূল (সাঃ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
দিনটি ছিল সোমবার (বুখারী হা/১৩৮৭) সূর্য অধিক গরম হওয়ার সময়(حِينَ اشتدَّت الضحي) অর্থাৎ ১০/১১ টার সময়। এ দিন তাঁর বয়স হয়েছিল চান্দ্রবর্ষ হিসাবে ৬৩ বছর (বুখারী হা/৩৫৩৬)[10] চার দিন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/২৫১)।


মৃত্যুতে শোকাবহ প্রতিক্রিয়া :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মৃত্যুতে শোকাতুর কন্যা ফাতেমা বলে ওঠেন,
يَا أَبَتَاهْ، أَجَابَ رَبًّا دَعَاهُ، يَا أَبَتَاهْ مَنْ جَنَّةُ الْفِرْدَوْسِ مَأْوَاهُ، يَا أَبَتَاهْ إِلَى جِبْرِيْلَ نَنْعَاهْ فَلَمَّا دُفِنَ قَالَتْ فَاطِمَةُ، عَلَيْهَا السَّلاَمُ، يَا أَنَسُ، أَطَابَتْ أَنْفُسُكُمْ أَنْ تَحْثُوا عَلَى رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه وسلم التُّرَابَ- رواه البخارىُّ-
‘হায় আববা! যিনি প্রভুর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। হায় আববা! জান্নাতুল ফেরদৌসে যার ঠিকানা। হায় আববা! জিব্রীলকে আমরা তাঁর মৃত্যু সংবাদ জানাচ্ছি’। অতঃপর দাফন হয়ে গেলে তিনি বলেন, হে আনাস! রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপর মাটি ফেলে তোমাদের অন্তর কি খুশী হয়েছে’?[11]
সাধারণভাবে সাহাবীগণের অবস্থা ছিল এই যে, তাঁরা তাঁদের প্রাণপ্রিয় রাসূল (সাঃ)-এর বিয়োগব্যথা সহ্য করতে পারছিলেন না। অনেকে দিগ্বিদিক জ্ঞানহারা হয়ে এদিক-সেদিক ছুটাছুটি করতে থাকেন। অনেকে জঙ্গলে চলে যান। উমর ফারূক (রাঃ) হতবুদ্ধি হয়ে বলতে থাকেন, কিছু মুনাফিক লোক ধারণা করে যে, রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যু হয়েছে। অথচ নিশ্চয়ই তিনি মৃত্যুবরণ করেননি। বরং স্বীয় প্রতিপালকের নিকটে গমন করেছেন। যেমন মূসা (আঃ) নিজ সম্প্রদায় থেকে ৪০ দিন অনুপস্থিত থাকার পর পুনরায় ফিরে এসেছিলেন’ (ইবনু হিশাম ২/৬৫৫)। তিনি বলেন,وَلَيَبْعَثَنَّهُ اللهُ فَلَيَقْطَعَنَّ أَيْدِىَ رِجَالٍ وَأَرْجُلَهُمْ ‘অবশ্যই আল্লাহ তাঁকে ফিরিয়ে দিবেন। অতঃপর তিনি ঐসব লোকদের হাত-পা কেটে দিবেন’ (বুখারী হা/৩৬৬৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি বলেন,وَاللهِ مَا مَاتَ رَسُولُ اللهِ- صلى الله عليه وسلم- وَلاَ يَمُوتُ حَتَّى يَقْطَعَ أَيْدِىَ أُنَاسٍ مِنَ الْمُنَافِقِينَ كَثِيرٍ وَأَرْجُلَهُمْ ‘আল্লাহর কসম! রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মরেননি এবং মরবেনও না, যতক্ষণ না তিনি মুনাফিকদের বহু লোকের হাত-পা কেটে দেন’ (ইবনু মাজাহ হা/১৬২৭, হাদীছ সহীহ)।




[1]. আহমাদ হা/১৬০৪০; মুহাক্কিক শু‘আয়েব আরনাঊত্ব বলেন, হাদীছ সহীহ। কিন্তু আব্দুল্লাহ বিন উমর আল-‘আবলীর অপরিচিতির কারণে সনদ যঈফ। আলবানী, যঈফাহ হা/৬৪৪৭। মুবারকপুরী সূত্র বিহীনভাবে ২৯শে ছফর সোমবার বাক্বী‘ গোরস্থানে একটি জানাযায় অংশগ্রহণ শেষে ফেরার পথে অসুখের সূচনা হয় বলেছেন’ (আর-রাহীক্ব ৪৬৪-৬৫ পৃঃ)। যার কোন প্রমাণ পাওয়া যায় না।
[2]. বুখারী হা/৪৪৪২; ইবনু হিশাম ২/৬৪৯; বর্ণনাটি সহীহ (ঐ, তাহকীক ক্রমিক ২০৭৯)। এদিন রাসূল (সাঃ)-এর একটু সুস্থতাকে উপলক্ষ্য করেই বাংলাদেশে আখেরী চাহার শাম্বা’ (শেষ বুধবার) নামে সরকারী ছুটি পালন করা হয়। যা সম্পূর্ণরূপে বিদ‘আতী প্রথা। এরূপ প্রথা সাহাবায়ে কেরামের যামানায় ছিল না।
[3]. বুখারী হা/৭৩৬৬; মুসলিম হা/১৬৩৭; মিশকাত হা/৫৯৬৬ ‘মক্কা হতে সাহাবীগণের হিজরত ও রাসূল (সাঃ)-এর ওফাত’ অনুচ্ছেদ। এ ঘটনা থেকে শী‘আরা ধারণা করেন যে, রাসূল (সাঃ) হযরত আলীর নামে ‘খিলাফত’ লিখে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু উমর (রাঃ) সেটা হতে দেননি। অতএব আবুবকর, উমর, উসমান সবাই তাদের দৃষ্টিতে অন্যায়ভাবে খেলাফত ছিনতাইকারী এবং কাফের (নাঊযুবিল্লাহ)। এজন্য ইবনু আববাস (রাঃ) রাবী সুলায়মান আল-আহওয়ালের সামনে একদিন কাঁদতে কাঁদতে বলেন, يَوْمُ الْخَمِيسِ، وَمَا يَوْمُ الْخَمِيسِ বৃহস্পতিবার, হায় বৃহস্পতিবার! এসময় তাঁর চোখের পানিতে কংকর-বালু ভিজে যায়। মদীনার শ্রেষ্ঠ সপ্ত ফক্বীহর অন্যতম ওবায়দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন উৎবাহ বিন মাসঊদ বলেন, ইবনু আববাস (রাঃ) উক্ত ঘটনা স্মরণ করে প্রায়ই বলতেন, إِنَّ الرَّزِيَّةَ كُلَّ الرَّزِيَّةِ ‘হায় বিপদ চরম বিপদ, যা লোকদের শোরগোল ও রাসূল (সাঃ)-এর অছিয়ত লিখে দেওয়ার মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছিল’ (বুখারী হা/৪৪৩২; মুসলিম হা/১৬৩৭; মিশকাত হা/৫৯৬৬; বঙ্গানুবাদ হা/৫৭১৪)। অথচ আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত হাদীছ (বুখারী হা/৫৬৬৬; মিশকাত হা/৫৯৭০) দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, আল্লাহর নবী (সাঃ) যদি ‘খিলাফত’ লিখতেন, তবে সেটা আবুবকর (রাঃ)-এর নামেই লিখতেন।
[4]. অথচ উম্মতে মুহাম্মাদী এখন কুরআন ছেড়ে জীবনের প্রায় সর্বক্ষেত্রে নিজেদের মনগড়া বিধান সমূহের অনুসরণ করছে। ফলে পদে পদে তারা লাঞ্ছিত ও অধঃপতিত হচ্ছে।
[5]. এই ১৭ ওয়াক্ত সালাতের কোন ক্বাযা বা কাফফারা রাসূল (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে কেউ আদায় করেননি। কারণ এটি দৈহিক ইবাদত। যা নিজেকেই আদায় করতে হয়। অন্যের উপর তা বর্তায় না। ইবনু উমর (রাঃ) বলেন, لاَ يَصُومُ أَحَدٌ عَنْ أَحَدٍ وَلاَ يُصَلِّي أَحَدٌ عَنْ أَحَدٍ ‘একজনের সিয়াম বা সালাত অন্যজনে আদায় করতে পারে না’ (মুওয়াত্ত্বা হা/১০৬৯; সনদ মুনক্বাতে‘ বা ছিন্নসূত্র। কিন্তু বায়হাক্বীতে এটি সংযুক্ত সনদে এসেছে (বায়হাক্বী হা/৮০০৪, ৪/২৫৪)। যার সনদ সহীহ। আলবানী, হিদায়াতুর রুওয়াত শরহ মিশকাত হা/১৯৭৭ টীকা-২, ২/৩৩৬; মিশকাত হা/২০৩৫)। অতএব জানাযাকালে মৃতের ক্বাযা সিয়াম ও সালাতের কাফফারা স্বরূপ টাকা-পয়সা নেওয়া বা দান করা সম্পূর্ণরূপে একটি বিদ‘আতী প্রথা মাত্র।
[6]. ফাৎহুল বারী ‘যে রোগে তাঁর মৃত্যু হয়, সেই অবস্থায় রাসূল (সাঃ) কর্তৃক উসামার সেনাদল প্রেরণ’ অনুচ্ছেদ-এর আলোচনা হা/৪৪৬৬-এর পরে।
[7]. আহমাদ হা/২৫৫৩১; সহীহ ইবনু হিববান হা/৩২১২; সিলসিলা সহীহাহ হা/২৬৫৩; মিশকাত হা/১৮৮৪, ঐ মিরক্বাত। ‘তিনি এদিন সকল গোলাম আযাদ করে দেন এবং অস্ত্র-শস্ত্র সব মুসলমানদের দিয়ে দেন। অথচ ঐদিন সন্ধ্যায় আয়েশা (রাঃ)-এর গৃহে বাতি জ্বালানোর মত তৈল ছিল না। ফলে প্রতিবেশীর নিকট থেকে তৈল ধার করে আনতে হয়’ (আর-রাহীক্ব ৪৬৭ পৃঃ; রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/২৪৮-৪৯)। কথাগুলির কোন সূত্র পাওয়া যায়নি।
[8]. বুখারী হা/৬২৮৫; মুসলিম হা/২৪৫০; মিশকাত হা/৬১২৯। রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর মাত্র ছয়মাস পরে ১১ হিজরী ৩রা রামাযান মঙ্গলবার ফাতেমা (রাঃ) মৃত্যুবরণ করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৩০ অথবা ৩৫ বছর। তিনি হাসান, হোসায়েন, উম্মে কুলছূম ও যয়নব নামে দু’পুত্র ও দু’কন্যা সন্তান রেখে যান। তাঁর কবর সম্পর্কে মতভেদ আছে। কেউ বলেন, নিজের ঘরেই তাঁকে দাফন করা হয়। কেউ বলেন, বাক্বী‘ গোরস্থানে দাফন করা হয় (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ২/১০৮-১০)।
[9]. বুখারী হা/৩৬২৪; মুসলিম হা/২৪৫০; মিশকাত হা/৬১২৯। আয়েশা (রাঃ) বর্ণিত বুখারী হা/৩৬২৩ দ্বারা বুঝা যায় যে, এই সুসংবাদ তাকে শেষ সপ্তাহে দেওয়া হয়’। হা/৩৬২৬ দ্বারা বুঝা যায় যে, মৃত্যু যন্ত্রণার সময় এই সুসংবাদ দেওয়া হয়। দু’টিই হতে পারে। কেননা আগে বলার পর তাকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য পুনরায় বলাতে দোষের কিছু নেই।
[10]. অধিকাংশ জীবনীকারের মতে দিনটি ছিল ১১ হিজরীর ১২ই রবীউল আউয়াল মোতাবেক ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দের ৬ই জুন। তবে যেহেতু সহীহ হাদীছ অনুযায়ী রাসূল (সাঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যু দু’টিই সোমবারে হয়েছিল (মুসলিম হা/১১৬২; বুখারী হা/১৩৮৭)। অতএব সেটা ঠিক রাখতে গেলে তাঁর জন্ম ৯ই রবীউল আউয়াল সোমবার এবং মৃত্যু ১লা রবীউল আউয়াল সোমবার হয়’ (বিস্তারিত দ্রঃ ‘জন্ম ও মৃত্যু’ অনুচ্ছেদ)। রাসূল (সাঃ)-এর জন্ম ও মৃত্যু তারিখ অস্পষ্ট রাখার মধ্যে শিক্ষণীয় এই, যাতে তাঁর উম্মত অনুষ্ঠানসর্বস্ব হয়ে না পড়ে এবং জন্ম দিবস ও মৃত্যু দিবস পালন করার মত বিদ‘আতী কাজে লিপ্ত না হয়।
[11]. বুখারী হা/৪৪৬২, আনাস হতে; মিশকাত হা/৫৯৬১। উল্লেখ্য যে, আনাস বিন মালেক (রাঃ) ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর দীর্ঘ ১০ বছরের প্রিয়তম গোলাম’ (আবুদাঊদ হা/৪৭৭৪; আহমাদ হা/১৩৩৪১)। এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মৃত্যুর পরে কন্যা ফাতেমা নিম্নোক্ত শোকগাথা পাঠ করেছিলেন।- صُبَّتْ عَلَيَّ مَصَائِبُ لَوْ أنَّهَا + صُبَّتْ عَلَى الْأَيَّامِ عُدْنَ لَيَالِيَا مَاذَا عَلَى مَنْ شَمَّ تُرْبَة َ أَحْمَدٍ + أَنْ لاَ يَشَمَّ مُدَى الزَّمَانِ غَوَالِيَا (১) ‘আমার উপরে এমন বিপদ আপতিত হয়েছে, যদি তা দিনসমূহের উপরে পড়ত, তবে সেগুলি রাতে পরিণত হয়ে যেত’। (২) ‘যে কেউ আহমাদের কবরের মাটি শুঁকবে, তার উপরে ওয়াজিব হবে যে, সে জীবনে আর কোন সুগন্ধি শুঁকবে না’। যাহাবী বলেন, এটি ‘সহীহ নয়’ (لاَ يَصِحُّ) (যাহাবী, সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা ৩/৪২৬)।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...