বিদায় হজ্জ পর্ব-৩
আইয়ামে তাশরীক্বের কার্যাবলী :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
ত্বাওয়াফে এফাযাহ শেষে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মিনায় ফিরে এসে যোহর পড়েন। এদিন রাসূল (সাঃ) কোথায় যোহর পড়েছিলেন, সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে। আয়েশা (রাঃ)-এর হাদীছ অনুযায়ী তিনি হারামে যোহর পড়েছিলেন। এতে সমস্যা এই যে, মক্কায় থাকাকালে রাসূল (সাঃ) নিজের অবস্থানস্থল আবত্বাহ (الْأَبْطَح) ব্যতীত অন্য কোথাও মুসলমানদের নিয়ে জামা‘আত করেননি (যাদুল মা‘আদ ২/২৬০)। দ্বিতীয়তঃ আয়েশার হাদীছে এটি স্পষ্ট নয় যে, তিনি ঐদিন মক্কায় যোহর পড়েছিলেন। কেননা সেখানে বলা হয়েছে, أَفَاضَ رَسُولُ اللهِ- صلى الله عليه وسلم- مِنْ آخِرِ يَوْمِهِ حِينَ صَلَّى الظُّهْرَ ثُمَّ رَجَعَ إِلَى مِنًى‘রাসূল (সাঃ) দিন শেষে তাওয়াফে এফাযাহ করেন। যখন তিনি যোহরের সালাত আদায় করেন। অতঃপর মিনায় ফিরে আসেন’। উক্ত হাদীছ সম্পর্কে শায়খ আলবানী বলেন, হাদীছটি সহীহ হলেও حِينَ صَلَّى الظُّهْرَ ‘যখন তিনি যোহরের সালাত আদায় করেন’ বাক্যটি ‘মুনকার’ বা যঈফ (আবুদাঊদ হা/১৯৭৩)। অতএব এক্ষেত্রে ইবনু উমরের স্পষ্ট হাদীছই অগ্রাধিকারযোগ্য। যেখানে তিনি বলেন, أَنَّ رَسُولَ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- أَفَاضَ يَوْمَ النَّحْرِ ثُمَّ رَجَعَ فَصَلَّى الظُّهْرَ بِمِنًى ‘কুরবানীর দিন রাসূল (সাঃ) তাওয়াফে এফাযাহ করেন। অতঃপর মিনায় ফিরে এসে যোহরের সালাত আদায় করেন’ (মুসলিম হা/১৩০৮; আহমাদ হা/৪৮৯৮)। জাবের (রাঃ) বর্ণিত হাদীছে হারামে তাওয়াফ শেষের দু’রাক‘আত নফল সালাতকে (মুসলিম হা/১২১৮ (১৪৭) সম্ভবতঃ যোহরের দু’রাক‘আত ধারণা করা হয়েছে (যাদুল মা‘আদ ২/২৫৮-৬১)।
অতঃপর ১১, ১২, ১৩ আইয়ামে তাশরীক্বের তিনদিন সেখানে অবস্থান করেন। ১১ ও ১২ তারিখে সূর্য ঢলার পর ১ম, ২য় ও ৩য় জামরায় প্রতিটিতে ৭টি করে কংকর নিক্ষেপ করেন এবং হজ্জের বিভিন্ন নিয়ম-কানূন জনগণকে শিক্ষা দেন। এ সময় তিনি শিরকের নিদর্শনগুলি ধ্বংস করে দেন। তিনি যিকর-আযকারে লিপ্ত থাকেন এবং জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে হেদায়াত দান করেন।
১ম ও ২য় জামরায় কংকর নিক্ষেপের পর একটু দূরে গিয়ে ক্বিবলামুখী হয়ে দীর্ঘক্ষণ দো‘আ করেন। হাদীছ সমূহের বর্ণনা অনুযায়ী সূর্য ঢলার পর কংকর নিক্ষেপ করতেন (তিরমিযী হা/৮৯৮; ইবনু মাজাহ হা/৩০৫৪)। ফলে ফিরে এসে যোহর পড়তেন বলেই প্রতীয়মান হয় (যাদুল মা‘আদ ২/২৬৩-৬৪)। এসময় হাজীদের পানি পান করানোর দায়িত্বশীল হওয়ায় আববাস (রাঃ)-কে মক্কায় অবস্থানের অনুমতি দেওয়া হয় (বুখারী হা/১৬৩৪; মুসলিম হা/১৩১৫)। একইভাবে রাখালদেরও অনুমতি দেওয়া হয় মিনার বাইরে গিয়ে উট চরানোর জন্য। তাদেরকে বলা হয় ১১-১২ দু’দিনের কংকর যেকোন একদিনে একসাথে মারার জন্য (তিরমিযী হা/৯৫৫; মিশকাত হা/২৬৭৭)। ইমাম মালেক বলেন, আমি ধারণা করি, তাদেরকে বলা হয় ১১ তারিখে কংকর মারতে এবং ফেরার দিন ১৩ তারিখে কংকর মারতে। সুফিয়ান বিন ওয়ায়না বলেন, এর ফলে তাদেরকে একদিন পর একদিন কংকর মারার অনুমতি দেওয়া হয়। তাছাড়া তারা মিনায় রাত্রি যাপন থেকে রুখছত পায় এবং দিনের বদলে রাত্রিতে কংকর মারার অনুমতি পায়। অতএব তাদেরকে যখন ওযর বশতঃ রুখছত দেওয়া হয়েছে সে হিসাবে রোগ কিংবা অন্যকোন বাধ্যগত কারণে অন্যেরাও উক্ত রুখছত পেতে পারে’ (যাদুল মা‘আদ ২/২৬৭)।
আইয়ামে তাশরীক্বের ১ম দিনের ভাষণ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
উম্মুল হুছাইন (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহা) বলেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে বিদায় হজ্জ করেছি। অতঃপর জামরায় কংকর নিক্ষেপের পর ফিরে এসে জাদ‘আ (الْجَدْعَاء) উটনীর উপর বসা অবস্থায় তাঁকে বলতে শুনেছি,إِنْ أُمِّرَ عَلَيْكُمْ عَبْدٌ مُجَدَّعٌ أَسْوَدُ يَقُودُكُمْ بِكِتَابِ اللهِ فَاسْمَعُوا لَهُ وَأَطِيعُوا ‘যদি তোমাদের উপর নাক-কান কাটা কৃষ্ণকায় গোলামও আমীর নিযুক্ত হন, যিনি তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী পরিচালিত করেন, তোমরা তাঁর কথা শোন ও মান্য কর’।[আহমাদ হা/২২২১৫; মুসলিম হা/১২৯৮; মিশকাত হা/৩৬৬২]
সূরা নছর নাযিল :
━━━━━━━━━━
আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রাঃ) বলেন, আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী দিনে অর্থাৎ ১২ই যিলহাজ্জে মিনায় সূরা নছর নাযিল হয়। অতঃপর তিনি ক্বাছওয়া (القَصْواء) উটনীতে সওয়ার হয়ে জামরায়ে আক্বাবায় গমন করেন। অতঃপর কংকর নিক্ষেপ শেষে ফিরে এসে জনগণের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রসিদ্ধ ভাষণটি প্রদান করেন’।[বায়হাক্বী ৫/১৫২, হা/৯৪৬৪; আবুদাঊদ হা/১৯৫২]
সূরা নছর:إِذَا جَاءَ نَصْرُ اللهِ وَالْفَتْحُ، وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُوْنَ فِيْ دِيْنِ اللهِ أَفْوَاجًا، فَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ وَاسْتَغْفِرْهُ إِنَّهُ كَانَ تَوَّابًا ‘যখন এসে গেছে আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়’। ‘এবং তুমি লোকদের দলে দলে আল্লাহর দ্বীনের মধ্যে প্রবেশ করতে দেখছ’। ‘তখন তুমি তোমার পালনকর্তার প্রশংসা সহ পবিত্রতা বর্ণনা কর এবং তাঁর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি সর্বাধিক তওবা কবুলকারী’ (নাছর ১১০/১-৩)।
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এটিই ছিল কুরআনের সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ সূরা’ (মুসলিম হা/৩০২৪ ‘তাফসীর’ অধ্যায়)। তিনি বলেন,إِنَّمَا هُوَ أَجَلُ رَسُوْلِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَعْلَمَهُ لَهُ ‘এ সূরার মাধ্যমে আল্লাহ তাঁর রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যু ঘনিয়ে আসার কথা জানিয়ে দিয়েছেন’ (বুখারী হা/৪৯৭০)। এজন্য এ সূরাকে সূরা তাওদী‘ (التَّوْدِيع) বা বিদায়ী সূরা বলা হয় (কুরতুবী)।
আইয়ামে তাশরীক্বের ২য় দিনের ভাষণ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
১. জাবের বিন আব্দুল্লাহ (রাঃ) বলেন,
عَنْ جَابِرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ قَالَ: خَطَبَنَا رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي وَسَطِ أَيَّامِ التَّشْرِيقِ خُطْبَةَ الْوَدَاعِ، فَقَالَ: يَا أَيُّهَا النَّاسُ، إِنَّ رَبَّكُمْ وَاحِدٌ، وَإِنَّ أَبَاكُمْ وَاحِدٌ، أَلاَ لاَ فَضْلَ لِعَرَبِيٍّ عَلَى عَجَمِيٍّ، وَلاَ لِعَجَمِيٍّ عَلَى عَرَبِيٍّ، وَلاَ لِأَحْمَرَ عَلَى أَسْوَدَ، وَلاَ أَسْوَدَ عَلَى أَحْمَرَ، إِلاَّ بِالتَّقْوَى، إِنَّ أَكْرَمَكُمْ عِنْدَ اللهِ أَتْقَاكُمْ، أَلاَ هَلْ بَلَّغْتُ؟ قَالُوا: بَلَى يَا رَسُولَ اللهِ، قَالَ: فَلْيُبَلِّغِ الشَّاهِدُ الْغَائِبَ- رواه البيهقى فى الشُّعَب و رواه أحمد-
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আমাদেরকে আইয়ামে তাশরীক্বের মধ্যবর্তী দিনে আমাদের উদ্দেশ্যে বিদায়ী ভাষণ দিয়ে বলেন, ‘হে জনগণ! নিশ্চয় তোমাদের পালনকর্তা মাত্র একজন। তোমাদের পিতাও মাত্র একজন। মনে রেখ! আরবের জন্য অনারবের উপর, অনারবের জন্য আরবের উপর, লালের জন্য কালোর উপর এবং কালোর জন্য লালের উপর কোনরূপ প্রাধান্য নেই আল্লাহভীরুতা ব্যতীত’। নিশ্চয়ই তোমাদের মধ্যে আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত সেই ব্যক্তি, যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক আল্লাহভীরু। তিনি বলেন, আমি কি তোমাদের নিকট পৌঁছে দিলাম? লোকেরা বলল, হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! তিনি বললেন, অতএব উপস্থিতগণ যেন অনুপস্থিতদের নিকট পৌঁছে দেয়’ (আহমাদ হা/২৩৫৩৬)।
২. আব্দুল্লাহ বিন উমর (রাঃ) বলেন, এদিন রাসূল (সাঃ) হামদ ও ছানার পর ‘দাজ্জাল’ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেন। অতঃপর বলেন,
مَا بَعَثَ اللهُ مِنْ نَبِيٍّ إِلاَّ قَدْ أَنْذَرَهُ أُمَّتَهُ، لَقَدْ أَنْذَرَهُ نُوحٌ وَالنَّبِيُّونَ مِنْ بَعْدِهِ، وَإِنَّهُ يَخْرُجُ فِيكُمْ، وَمَا خَفِيَ عَلَيْكُمْ مِنْ شَأْنِهِ، فَلاَ يَخْفَى عَلَيْكُمْ إِنَّهُ أَعْوَرُ عَيْنِ الْيُمْنَى كَأَنَّهَا عِنَبَةٌ طَافِيَةٌ ثُمَّ قَالَ: وَيْلَكُمْ أَوْ وَيْحَكُمْ انْظُرُوا لاَ تَرْجِعُوا بَعْدِي كُفَّارًا يَضْرِبُ بَعْضُكُمْ رِقَابَ بَعْضٍ-
‘আল্লাহ এমন কোন নবী প্রেরণ করেননি, যিনি তার উম্মতকে এ বিষয়ে সতর্ক করেননি। নূহ এবং তাঁর পরবর্তী নবীগণ তাদের স্ব স্ব উম্মতকে এ বিষয়ে সতর্ক করেছেন। সে তোমাদের মধ্যে বহির্গত হবে। তার অবস্থা তোমাদের নিকট গোপন থাকবে না। তার ডান চোখ হবে কানা, ফোলা আঙ্গুরের মত’। অতঃপর তিনি বলেন, তোমরা সাবধান থেকো। আমার পরে তোমরা একে অপরের গর্দান মেরে যেন পুনরায় কাফের হয়ে যেয়ো না’ (আবু ইয়া‘লা হা/৫৫৮৬)। এর অর্থ খুনোখুনি মহাপাপে লিপ্ত হয়ো না। যা সবচেয়ে বড় পাপ। এর অর্থ প্রকৃত কাফের নয়। যা ইসলাম থেকে বের করে দেয়। যেমন অন্য হাদীছে এসেছে,سِبَابُ الْمُسْلِمِ فُسُوقٌ، وَقِتَالُهُ كُفْرٌ ‘মুসলিমকে গালি দেওয়া ফাসেক্বী এবং তাকে হত্যা করা কুফরী’ (বুখারী হা/৪৮)। দুর্ভাগ্য মুসলমানেরা রাসূল (সাঃ)-এর এ নির্দেশ মানেনি।
৩. আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, বিদায় হজ্জের ভাষণে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,
يَا أَيُّهَا النَّاسُ إِنِّي قَدْ تَرَكْتُ فِيكُمْ مَا إِنِ اعْتَصَمْتُمْ بِهِ فَلَنْ تَضِلُّوا أَبَدًا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ-
‘হে জনগণ! আমি তোমাদের নিকট এমন বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি, যা মযবুতভাবে ধারণ করলে তোমরা কখনই পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ’ (হাকেম হা/৩১৮, হাদীছ সহীহ)।
মালেক বিন আনাস (রহঃ) বলেন, তার নিকটে হাদীছ পৌঁছেছে যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন,
عَنْ مَالِكٍ أَنَّهُ بَلَغَهُ أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ تَرَكْتُ فِيكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ- رَواهُ فِي الْمُوَطَّأِ-
‘আমি তোমাদের মাঝে দু’টি বস্ত্ত রেখে যাচ্ছি। যতদিন তোমরা তা মযবুতভাবে আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তাঁর নবীর সুন্নাহ’।[1]
এভাবে আরাফাতের ময়দানে ৬টি হাদীছে ১৬টি বিষয় এবং কুরবানীর দিন ও মিনার প্রথম দু’দিন সহ তিনদিনে উপরে বর্ণিত ৭টি হাদীছে ১৫টি বিষয় সহ সর্বমোট ১৩টি হাদীছে ৩১টি বিষয় বর্ণিত হয়েছে। যার প্রতিটি মানব জীবনে চিরন্তন দিক নির্দেশনা মূলক। যা মেনে চলা মানব জাতির জন্য একান্ত আবশ্যক।
বিদায়ী ত্বাওয়াফ এবং মদীনায় রওয়ানা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
১৩ই যিলহাজ্জ মঙ্গলবার কংকর মেরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মিনা থেকে রওয়ানা হন। অতঃপর মিনা ও মক্কার মধ্যবর্তী তাঁর অবস্থানস্থল আবত্বাহ (الْأَبْطَحِ) গিয়ে অবতরণ করেন। যা বনু কেনানার প্রশস্ত মুহাছ্ছাব উপত্যকায় (الْمُحَصَّب) অবস্থিত। অতঃপর সেখানে তিনি সবাইকে নিয়ে যোহর, আছর, মাগরিব ও এশার সালাত আদায় করেন। অতঃপর কিছুক্ষণ ঘুমিয়ে তিনি কা‘বা অভিমুখে রওয়ানা হন ও বিদায়ী ত্বাওয়াফ শেষ করেন’ (বুখারী হা/১৭৫৬; মিশকাত হা/২৬৬৪)। মুহাছ্ছাব পাঁচটি নামে পরিচিত : খায়েফ, মুহাছ্ছাব, আবত্বাহ, হাছবা ও বাত্বহা’ (মির‘আত হা/২৬৮৮-এর আলোচনা)।
উল্লেখ্য যে, মুহাছ্ছাব হল সেই উপত্যকার নাম, যেখানে বসে বনু কিনানাহ ও বনু কুরায়েশ বয়কট চুক্তি করেছিল এই মর্মে যে, যতক্ষণ না বনু হাশেম ও বনু মুত্ত্বালিব মুহাম্মাদকে তাদের হাতে তুলে দিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত তাদের সাথে ওঠা-বসা, বিয়ে-শাদী ও ব্যবসা-বাণিজ্য সবই নিষিদ্ধ থাকবে’ (বুখারী হা/১৫৯০; মুসলিম হা/১৩১৪)। ইতিহাসে এটি সর্বাত্মক বয়কট চুক্তি (الْمُقَاطَعَةُ الْعَامَّةُ) নামে পরিচিত। যা তিন বছর স্থায়ী হয় (দ্রঃ সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদ)।
আয়েশা (রাঃ)-এর ওমরাহ :
━━━━━━━━━━━━━━━━
মিনা থেকে ফিরে মুহাছ্ছাবে অবতরণের পর আয়েশা (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-কে বলেন, সবাই হজ্জ ও ওমরার নেকী নিয়ে ফিরবে, আর আমি কেবল হজ্জের নেকী নিয়ে ফিরব? তখন রাসূল (সাঃ) আমাকে আমার ভাই আব্দুর রহমানের সাথে হারামের বাইরে তান‘ঈম পাঠিয়ে দিলেন। অতঃপর সেখান থেকে ওমরার ইহরাম বেঁধে এসে আমি ওমরাহ সম্পন্ন করি’। অতঃপর আমরা মুহাছ্ছাবে ফিরে আসি।[বুখারী হা/৩১৯; মুসলিম হা/১২১১ (১১২)] এসময় রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমরা কাজ শেষ করেছ? আমরা বললাম, হ্যাঁ। তখন তিনি সবাইকে রওয়ানা হওয়ার নির্দেশ দেন এবং ফজরের সালাতের আগেই সকলে কা‘বায় গিয়ে বিদায়ী ত্বাওয়াফ সম্পন্ন করেন। অতঃপর সকলে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন’।[বুখারী হা/১৭৮৮; আবুদাঊদ হা/২০০৫; মিশকাত হা/২৬৬৭] তবে উম্মে সালামাহ (রাঃ)-এর বর্ণনা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হারামে ফজরের সালাত আদায় করেই তাঁরা বেরিয়ে যান’।[বুখারী হা/১৬১৯; মুসলিম হা/১২৭৬] উল্লেখ্য যে, ঋতুবতী হওয়ার কারণে আয়েশা (রাঃ) ওমরাহ করতে পারেননি। পাক হওয়ার পর মদীনায় ফেরার প্রাক্কালে সেটি আদায় করেন’।[বুখারী হা/৩১৯; মুসলিম হা/১২১১]
এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, মক্কাবাসীগণ হারাম এলাকার বাইরে যাবেন ও সেখান থেকে ওমরাহর ইহরাম বেঁধে আসবেন। এজন্য সবচেয়ে নিকটবর্তী হল ৬ কি.মি. উত্তরে তান‘ঈম এলাকা। এটাই হল জমহূর বিদ্বানগণের মত। মুহেববুদ্দীন ত্বাবারী বলেন, ওমরাহর জন্য মক্কাকে মীক্বাত গণ্য করেছেন, এমন কোন বিদ্বান সম্পর্কে আমি অবগত নই’।[2]
এভাবে হজ্জের সকল বিধি-বিধান পালন করার পর ১৪ই যিলহাজ্জ বুধবার হারামে ফজরের সালাত আদায়ের পর রাসূল (সাঃ) তাঁর সাহাবীগণকে নিয়ে মদীনা অভিমুখে রওয়ানা হয়ে যান (যাদুল মা‘আদ ২/২৭৫)।
খুম কূয়ার নিকটে ভাষণ :
━━━━━━━━━━━━━━━
পথে রাবেগের নিকটবর্তী খুম কূয়ার নিকট পৌঁছে বুরাইদা আসলামী (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে হযরত আলী (রাঃ) সম্পর্কে কিছু অভিযোগ পেশ করেন। যা ইয়ামনে গণীমত বণ্টন সংক্রান্ত বিষয়ে ছিল। এতে রাসূল (সাঃ)-এর চেহারা পরিবর্তন হয়ে যায়। অতঃপর তিনি বলেন,يَا بُرَيْدَةُ، أَلَسْتُ أَوْلَى بِالْمُؤْمِنِينَ مِنْ أَنْفُسِهِمْ؟ ‘হে বুরাইদা! আমি কি মুমিনদের নিকট তাদের নিজের চাইতে অধিক ঘনিষ্টতর নই? বুরাইদা বললেন, হ্যাঁ। তখন রাসূল (সাঃ) বলেন, مَنْ كُنْتُ مَوْلاَهُ فَعَلِىٌّ مَوْلاَهُ ‘আমি যার বন্ধু, আলী তার বন্ধু’।[আহমাদ হা/২২৯৯৫; মিশকাত হা/৬০৮২]
মদীনায় প্রত্যাবর্তন :
━━━━━━━━━━━━
মক্কা থেকে দীর্ঘ সফর শেষে যুল-হুলায়ফাতে পৌঁছে রাত্রি যাপন করেন এবং পরদিন দিনের বেলায় তিনি মদীনায় প্রবেশ করেন। এ সময় খুশীতে তিনি তিনবার তাকবীর ধ্বনি করেন ও দো‘আ পাঠ করেন। لا إلَه إلا اللهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ وَهُوَ عَلَى كُلّ شَيْءٍ قَدِيرٌ آيِبُونَ تَائِبُونَ عَابِدُونَ سَاجِدُونَ لِرَبّنَا حَامِدُونَ صَدَقَ اللهُ وَعْدَهُ وَنَصَرَ عَبْدَهُ وَهَزَمَ الْأَحْزَابَ وَحْدَهُ ‘আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই। তিনি এক। তাঁর কোন শরীক নেই। তাঁরই জন্য সমস্ত রাজত্ব ও তাঁরই জন্য সমস্ত প্রশংসা এবং তিনিই সকল বস্ত্তর উপরে ক্ষমতাবান। আমরা সফর হতে প্রত্যাবর্তন করছি তওবাকারী হিসাবে, ইবাদতকারী হিসাবে, সিজদাকারী হিসাবে এবং আমাদের প্রভুর জন্য প্রশংসাকারী হিসাবে। আল্লাহ সত্যে পরিণত করেছেন তাঁর প্রতিশ্রুতিকে, জয়ী করেছেন তাঁর বান্দা (মুহাম্মাদ)-কে এবং পরাজিত করেছেন একাই সম্মিলিত (কুফরী) শক্তিকে’।[বুখারী হা/১৭৯৭; মুসলিম হা/১৩৪৪ (৪২৮)]
এই হজ্জ ছিল রাসূল (সাঃ)-এর জীবনের সর্বশেষ হজ্জ। সেকারণ একে ‘বিদায় হজ্জ’ বা ‘হাজ্জাতুল অদা‘(حَجَّةُ الْوَدَاعِ) বা ‘হাজ্জাতুল বিদা‘(حَجَّةُ الْوِدَاعِ) বলা হয় (মিরক্বাত হা/১৯৫১-এর ব্যাখ্যা)। এই সময় তিনি উম্মতের উদ্দেশ্যে সর্বশেষ উপদেশবাণী প্রদান করেন বিধায় একে ‘হাজ্জাতুল বালাগ’(حَجَّةُ الْبَلاَغِ) বলা হয়। সেই সাথে ইসলামী জীবনে রাসূল (সাঃ)-এর একমাত্র হজ্জ হওয়ার কারণে এবং মানবজাতির জন্য ‘ইসলামকে একমাত্র দ্বীন’ হিসাবে আল্লাহর পক্ষ হতে মনোনীত হওয়ার কারণে ও ইসলামের পূর্ণাঙ্গতার সনদ নাযিল হওয়ার কারণে একে ‘হাজ্জাতুল ইসলাম’(حَجَّةُ الْإِسْلاَمِ) বলা হয় (আল-বিদায়াহ ৫/১০৯)।
মোট সফরকাল :
━━━━━━━━━━
২৪শে যুলক্বা‘দাহ শনিবার বাদ যোহর মদীনা থেকে রওয়ানা হন ও যুল-হুলায়ফাতে গিয়ে ক্বছরের সাথে আছর পড়েন এবং সেখানে রাত্রি যাপন করেন। ৩রা যিলহাজ্জ শনিবার সন্ধ্যার প্রাক্কালে মক্কার নিকটবর্তী ‘যূ-তুওয়া’(ذُو طُوَى) তে অবতরণ করেন ও সেখানে রাত্রি যাপন করেন। পরদিন ৪ঠা যিলহজ্জ রবিবার ৯ দিনের মাথায় মক্কায় পৌঁছেন।[3] অতঃপর ৯ই যিলহজ্জ শুক্রবার পবিত্র হজ্জ অনুষ্ঠিত হয়। তিনি মক্কায় মোট ১০ দিন অবস্থান করেন (বুখারী হা/১০৮১)। ১৪ই যিলহজ্জ বুধবার ফজর সালাত শেষে মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অতঃপর সপ্তাহকাল সফর শেষে যুল-হুলায়ফাতে পৌঁছে রাত্রি যাপন করেন ও পরদিন মদীনায় পৌঁছেন (যাদুল মা‘আদ ২/২৭৫)। এভাবে গড়ে ৯ + ১০ + ৮ = ২৭ দিন সফরে অতিবাহিত হয়।
[1]. মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮, তাহকীক : মুহাম্মাদ মুছত্বফা আল-আ‘যামী; মিশকাত হা/১৮৬, তাহকীক আলবানী, সনদ হাসান ; যুরক্বানী, শরহ মুওয়াত্ত্বা ক্রমিক ১৬১৪; মির‘আত হা/১৮৬-এর ব্যাখ্যা।
[2]. ফাৎহুল বারী হা/১৫২৪-এর আলোচনা দ্রষ্টব্য; সুবুলুস সালাম হা/৬৭৫-এর ব্যাখ্যা, যা গ্রহণযোগ্য নয় (২/৩৮৪-৮৫); মাসিক আত-তাহরীক, রাজশাহী, ১৭/৮ সংখ্যা, মে’১৪ প্রশ্নোত্তর ১/২৪১ দ্রষ্টব্য। বহিরাগত হাজীগণ যারা ওমরাহ করে মক্কায় অবস্থান করেন, তাদের মধ্যে বারবার মক্কার বাইরে গিয়ে তানঈম অর্থাৎ মসজিদে আয়েশা থেকে ইহরাম বেঁধে এসে ভিন্ন ভিন্ন নামে বারবার ওমরাহ করা একটি বিদ‘আতী প্রথা মাত্র। আর এক সফরে একটির বেশী ওমরাহ করা যায় না। যেমন আব্দুর রহমান ওমরাহ করেননি (যাদুল মা‘আদ ২/৯০)। কেননা তিনি ওমরাহ করেছিলেন। কিন্তু আয়েশা ওমরাহ করেন। কেননা তিনি ইতিপূর্বে ওমরাহ করেননি।
[3]. ইবনু সা‘দ বলেন, মদীনা থেকে রওয়ানা দেন যুলক্বা’দাহ মাসের পাঁচদিন বাকী থাকতে (অর্থাৎ ২৫শে যুলক্বা‘দাহ) শনিবার। অতঃপর মক্কার ৮ মাইল দূরবর্তী সারিফ (السَّرِف) নামক স্থানে সোমবার অবতরণ করেন এবং সেখানে রাত্রি যাপন করেন। পরদিন (মঙ্গলবার) তিনি মক্কায় প্রবেশ করেন (ইবনু সা‘দ ২/১৩১)। এতে মদীনা থেকে মক্কায় প্রবেশ পর্যন্ত মোট সফরকাল হয় ১১ দিন। সঠিক খবর আল্লাহ ভাল জানেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন