বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর, ২০২৫

খায়বর যুদ্ধ

 

খায়বর যুদ্ধ

গাযওয়া যী ক্বারাদ :
━━━━━━━━━━━━
৭ম হিজরীর মুহাররম মাস। হোদায়বিয়া থেকে মদীনায় ফেরার মাসাধিক কাল পরে এটাই ছিল রাসূল (সাঃ)-এর প্রথম যুদ্ধ, যা খায়বর যুদ্ধে গমনের মাত্র তিনদিন পূর্বে সংঘটিত হয় (বুখারী, ‘গাযওয়া যী ক্বারাদ’ অনুচ্ছেদ-৩৭)। বনু গাত্বফানের ফাযারাহ গোত্রের আব্দুর রহমান আল-ফাযারীর নেতৃত্বে একটি ডাকাত দল মদীনায় এসে রাসূল (সাঃ)-এর রাখালদের হত্যা করে চারণভূমি থেকে তাঁর উটগুলি লুট করে নিয়ে যায়। দক্ষ তীরন্দায সালামা বিন আকওয়া‘ একাই দৌঁড়ে তাদের পশ্চাদ্ধাবন করে যূ-ক্বারাদ ঝর্ণা পর্যন্ত দীর্ঘ পথ তাড়িয়ে নিয়ে যান। কখনো পাহাড়ের মাথায় উঠে পাথর ছুঁড়ে, কখনো পেছন থেকে তীর ছুঁড়ে তাদেরকে কাবু করে ফেলেন। অবশেষে তারা তাদের সমস্ত উট, অস্ত্রশস্ত্র ও আসবাব-পত্র সমূহ ফেলে পালিয়ে যায়। এ সময় তিনি চিৎকার দিয়ে বলতে থাকেন,أَنَا ابْنُ الأَكْوَعِ، وَالْيَوْمُ يَوْمُ الرُّضَّعِ ‘আমি ইবনুল আকওয়া। আর আজ হল ধ্বংসের দিন’ (বুখারী হা/৪১৯৪)।
ইতিমধ্যে পিছে পিছে রাসূল (সাঃ) ৫০০ সাহাবীর এক বাহিনী নিয়ে সন্ধ্যার পরে উপস্থিত হন। ডাকাত দলের নেতা আব্দুর রহমানের নিক্ষিপ্ত বর্শার আঘাতে সাহাবী আখরাম (أَخرَم) শহীদ হন। পরক্ষণেই আবু ক্বাতাদার বর্শার আঘাতে আব্দুর রহমান নিহত হয়। সালামা বিন আকওয়া‘-এর দুঃসাহস ও বীরত্বের পুরস্কার স্বরূপ আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাকে গণীমতের দুই অংশ দান করেন। যার মধ্যে পদাতিকের একাংশ ও অশ্বারোহীর একাংশ। মদীনায় ফেরার সময় সম্মান স্বরূপ নিজের সবচেয়ে দ্রুতগামী ‘আযবা’ (الْعَضْبَاءُ) উটের পিঠে তাকে বসিয়ে নেন’।[বুখারী হা/৪১৯৪; মুসলিম হা/১৮০৬] এই যুদ্ধে মদীনার আমীর ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূম (রাঃ) এবং পতাকাবাহী ছিলেন মিক্বদাদ বিন ‘আমর (রাঃ)।[যাদুল মা‘আদ; আর-রাহীক্ব ৩৬২-৬৩ পৃঃ]


খায়বর যুদ্ধ :
━━━━━━━
(৭ম হিজরীর মুহাররম মাস)
কুরায়েশদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তির পর সকল ষড়যন্ত্রের মূল ঘাঁটি খায়বরের ইহূদীদের প্রতি এই অভিযান পরিচালিত হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধি ও বায়‘আতে রিযওয়ানে উপস্থিত ১৪০০ সাহাবীকে নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) স্বয়ং এই অভিযান পরিচালনা করেন। তিনি কোন মুনাফিককে এ যুদ্ধে নেননি (আর-রাহীক্ব ৩৬৫ পৃঃ)। এই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষে ১৬ জন শহীদ এবং ইহূদী পক্ষে ৯৩ জন নিহত হয়। ইহূদীদের বিতাড়িত করার সিদ্ধান্ত হয়। তবে তাদের আবেদন মতে উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক ভাগ দেবার শর্তে তাদেরকে সেখানে বসবাস করার সাময়িক অনুমতি দেওয়া হয় (বুখারী হা/৪২৩৫)।
যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ গণীমত হস্তগত হয়। যাতে মুসলমানদের অভাব দূর হয়ে যায়। এই সময়ে ফাদাকের ইহূদীদের নিকটে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুহাইয়েছাহ বিন মাসঊদকে(مُحَيِّصَةُ بنُ مسعودٍ) প্রেরণ করেন। খায়বর বিজয়ের পর তারা নিজেরা রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে দূত পাঠিয়ে আত্মসমর্পণ করে এবং খায়বরবাসীদের ন্যায় অর্ধেক ফসলে সন্ধিচুক্তি করে। বিনাযুদ্ধে ও স্রেফ রাসূল (সাঃ)-এর দাওয়াতে বিজিত হওয়ায় ফাদাক ভূমি কেবল রাসূল (সাঃ)-এর জন্য নির্দিষ্ট করা হয়। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-
যিলহাজ্জের মাঝামাঝিতে হোদায়বিয়া থেকে ফিরে মুহাররম মাসের শেষভাগে কোন একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খায়বর অভিমুখে যাত্রা করেন। এ সময় তিনি সেবা‘ বিন উরফুত্বাহ গেফারীকে মদীনার প্রশাসক নিয়োগ করে যান।[1]
মুসলিম শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধরত তিনটি শক্তি- কুরায়েশ, বনু গাত্বফান ও ইহূদী- এগুলির মধ্যে প্রধান শক্তি কুরায়েশদের সাথে হোদায়বিয়ার সন্ধির ফলে বনু গাত্বফান ও বেদুঈন গোত্রগুলি এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়ে। বাকী রইল ইহূদীরা। যারা মদীনা থেকে বিতাড়িত হয়ে খায়বরে গিয়ে বসতি স্থাপন করে এবং সেখান থেকেই মুসলমানদের বিরুদ্ধে সকল প্রকারের ষড়যন্ত্র করে। বরং বলা চলে যে, খায়বর ছিল তখন মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত সকল চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু। তাই এদেরকে দমন করার জন্য এই অভিযান পরিচালিত হয়। এই অভিযানে যাতে কোন মুনাফিক যেতে না পারে, সেজন্য আল্লাহ পূর্বেই আয়াত নাযিল করেন (ফাৎহ ৪৮/১৫)। তাছাড়া এ যুদ্ধে যে মুসলিম বাহিনী বিজয়ী হবে এবং প্রচুর গণীমত লাভ করবে, সে বিষয়ে আগাম ভবিষ্যদ্বাণী নাযিল হয়েছিল (ফাৎহ ৪৮/২০)। ফলে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কেবলমাত্র ঐ সকল সাথীকে সঙ্গে নিলেন, যারা হোদায়বিয়ার সফরে ‘বায়‘আতুর রিযওয়ানে’ শরীক ছিলেন। যাদের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৪০০। এঁদের সাথে কিছু সংখ্যক মহিলা সাহাবী ছিলেন।[2] যারা আহতদের সেবা-যত্নে নিযুক্ত হন। আল্লাহপাকের এই আগাম হুঁশিয়ারীর কারণ ছিল এই যে, মুনাফিকদের সঙ্গে ইহূদীদের সখ্যতা ছিল বহু পুরাতন। তাই তারা যুদ্ধে গেলে তারা বরং ইহূদীদের স্বার্থেই কাজ করবে, যা মুসলিম বাহিনীর চরম ক্ষতির কারণ হবে।


মুনাফিকদের অপতৎপরতা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর খায়বর অভিযানের গোপন খবর মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই আগেভাগেই ইহূদীদের জানিয়ে দিয়ে তাদের কাছে পত্র পাঠায়। তাতে তাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করা হয় এবং একথাও বলা হয় যে, ‘তোমরা অবশ্যই জিতবে। কেননা মুহাম্মাদের লোকসংখ্যা অতীব নগণ্য এবং তারা প্রায় রিক্তহস্ত’। খয়বরের ইহূদীরা এই খবর পেয়ে তাদের মিত্র বনু গাত্বফানের নিকটে সাহায্য চেয়ে লোক পাঠায়। তাদেরকে বলা হয় যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে জয়লাভ করলে খায়বরের মোট উৎপন্ন ফসলের অর্ধেক তাদেরকে দেওয়া হবে’। উক্ত লোভনীয় প্রস্তাব পেয়ে বনু গাত্বফানের লোকেরা পূর্ণ প্রস্তুততি নিয়ে খায়বর অভিমুখে রওয়ানা হয়। কিছু দূর গিয়েই তারা পিছন দিকে শোরগোল শুনে ভাবল, হয়তবা মুসলিম বাহিনী তাদের সন্তানাদি ও পশুপালের উপরে হামলা চালিয়েছে। ফলে তারা খায়বরের চিন্তা বাদ দিয়ে স্ব স্ব গৃহ অভিমুখে প্রত্যাবর্তন করল। বলা বাহুল্য, এটা ছিল আল্লাহর অদৃশ্য সাহায্য। এর দ্বারা একথাও বুঝা যায় যে, মুসলমানদের ব্যাপারে তারা দারুণ ভীত ছিল। কেননা ইতিপূর্বে তারা খন্দকের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ফিরে এসেছে। এরপর সম্প্রতি কুরায়েশরা মুসলমানদের সঙ্গে হোদায়বিয়ায় সন্ধিচুক্তি করেছে। তাতে মুসলিম ভীতি সর্বত্র আরও ব্যাপকতা লাভ করে।


খায়বরের পথে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
যুদ্ধ কৌশল বিবেচনা করে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উত্তর দিকে সিরিয়ার পথ ধরে খায়বর অভিমুখে যাত্রা করলেন। যাতে বনু গাত্বফানের পক্ষ থেকে ইহূদীদের সাহায্য প্রাপ্তির পথ বন্ধ করা যায় এবং ইহূদীরাও এপথে পালিয়ে যাবার সুযোগ না পায়।


পথিমধ্যের ঘটনাবলী :
━━━━━━━━━━━━━
১. ‘আমের ইবনুল আকওয়ার কবিতা পাঠ(إنشاد عامر بن الأكوع) : সালামা ইবনুল আকওয়া‘ (سَلَمَةُ بنُ الْأَكْوَع) বলেন, খায়বরের পথে আমরা রাতের বেলা পথ চলছিলাম। ইতিমধ্যে জনৈক ব্যক্তি (আমার চাচা) ‘আমের ইবনুল আকওয়া‘(عَامِرُ بنُ الْأَكْوَع) কে বলল,يَا عَامِرُ أَلاَ تُسْمِعُنَا مِنْ هُنَيْهَاتِكَ؟ ‘হে ‘আমের! তুমি কি আমাদেরকে তোমার অসাধারণ কাব্য-কথা কিছু শুনাবে না? ‘আমের ছিলেন একজন উঁচুদরের কবি। একথা শুনে তিনি নিজের বাহন থেকে নামলেন ও নিজ কওমের জন্য প্রার্থনামূলক কবিতা বলা শুরু করলেন।-
اللَّهُمَّ لَوْلاَ أَنْتَ مَا اهْتَدَيْنَا * وَلاَ تَصَدَّقْنَا وَلاَ صَلَّيْنَا
فَاغْفِرْ فِدَاءً لَكَ مَا أَبْقَيْنَا * وَثَبِّتِ الأَقْدَامَ إِنْ لاَقَيْنَا
وَأَلْقِيَنْ سَكِينَةً عَلَيْنَا * إِنَّا إِذَا صِيْحَ بِنَا أَبَيْنَا
وَبِالصِّيَاحِ عَوَّلُوْا عَلَيْنَا
‘হে আল্লাহ! যদি তুমি অনুগ্রহ না করতে, তাহলে আমরা হেদায়াত পেতাম না। ছাদাক্বা করতাম না, সালাতও আদায় করতাম না’। ‘আমরা তোমার জন্য উৎসর্গীত। অতএব তুমি আমাদের ক্ষমা কর যেসব পাপ আমরা অবশিষ্ট রেখেছি (অর্থাৎ যা থেকে তওবা করিনি)। তুমি আমাদের পাগুলিকে দৃঢ় রেখো যদি আমরা যুদ্ধের মুকাবিলা করি’। ‘আমাদের উপরে তুমি প্রশান্তি নাযিল কর। আমাদেরকে যখন ভয় দেখানো হয়, তখন আমরা তা প্রত্যাখ্যান করি’। ‘বস্ত্ততঃ ভয়ের সময় লোকেরা আমাদের উপর ভরসা করে থাকে’ (বুখারী হা/৪১৯৬)।
ইবনু হাজার বলেন, ‘উৎসর্গীত’ কথাটি বান্দার জন্য হয়, আল্লাহর জন্য নয়। তবে এখানে প্রকাশ্য অর্থ উদ্দেশ্য নয়। বরং এর দ্বারা ‘আল্লাহর জন্য আমাদের যাবতীয় সম্মান ও ভালবাসা উৎসর্গীত’ বুঝানো হয়েছে (ফাৎহুল বারী হা/৪১৯৬-এর আলোচনা)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞেস করলেন,مَنْ هَذَا السَّائِقُ؟ ‘এই চালকটি কে’? লোকেরা বলল, ‘আমের ইবনুল আকওয়া‘। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, يَرْحَمُهُ اللهُ ‘আল্লাহ তার উপরে রহম করুন’। তখন একজন ব্যক্তি বলে উঠল, وَجَبَتْ يَا نَبِىَّ اللهِ، لَوْلاَ أَمْتَعْتَنَا بِهِ ‘হে আল্লাহর নবী! তার উপরে তো শাহাদাত ওয়াজিব হয়ে গেল। যদি আপনি তার দ্বারা আমাদের উপকৃত হওয়ার সুযোগ করে দিতেন’![3] অর্থাৎ যদি তার হায়াত বৃদ্ধির জন্য আপনি দো‘আ করতেন’। কেননা সাহাবায়ে কেরাম জানতেন যে, যুদ্ধের সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কারু জন্য ‘রহমত ও মাগফেরাত’-এর দো‘আ করলে তিনি শাহাদাত লাভ করতেন। আর খায়বর যুদ্ধে সেটাই বাস্তবে দেখা গেছে ‘আমের ইবনুল আকওয়া‘-র শাহাদাতের মধ্য দিয়ে। এর দ্বারা যেন এই ভ্রান্ত আক্বীদা সৃষ্টি না হয় যে, রাসূল (সাঃ) গায়েব জানতেন। কেননা গায়েবের চাবিকাঠি আল্লাহর হাতে। তিনি ব্যতীত তা কেউই জানে না’ (আন‘আম ৬/৫৯)। বরং এটি তাঁর উপর ‘অহি’ করা হয়ে থাকতে পারে। কেননা ‘অহি’ ব্যতীত কোন কথা তিনি বলেন না’ (নাজম ৫৩/৩-৪)।
২. জোরে তাকবীর ধ্বনি করার উপর নিষেধাজ্ঞা(نهى عن التكبير بأعلى الصوت) : পথিমধ্যে একটি উপত্যকা অতিক্রম করার সময় সাহাবীগণ জোরে জোরে তাকবীর দিতে থাকেন (আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবর, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ)। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন,ارْبَعُوا عَلَى أَنْفُسِكُمْ ‘তোমরা নরম কণ্ঠে বল’। কেননা إِنَّكُمْ لاَ تَدْعُونَ أَصَمَّ وَلاَ غَائِبًا إِنَّكُمْ تَدْعُونَ سَمِيعًا قَرِيبًا ‘তোমরা কোন বধির বা অনুপস্থিত সত্তাকে ডাকছ না। বরং তোমরা ডাকছ একজন সদা শ্রবণকারী ও সদা নিকটবর্তী এক সত্তাকে’(বুখারী হা/৪২০৫; মুসলিম হা/২৭০৪)। এর অর্থ এটা নয় যে, আদৌ উচ্চৈঃস্বরে তাকবীর দেওয়া যাবে না। বরং প্রয়োজন বোধে অবশ্যই তা করা যাবে। যেমন তালবিয়াহ, লা হাওলা অলা কুওয়াতা.., ইন্না লিল্লাহ ইত্যাদি সরবে পাঠ করা। যেগুলি অন্যান্য হাদীছ সমূহ দ্বারা প্রমাণিত (মুসলিম শরহ নববী হা/২৭০৪)। অবশ্য এখানে যুদ্ধের কোন কৌশল থাকতে পারে।
৩. কেবল ছাতু খেলেন সবাই(أكلهم السويق فقط) : খায়বরের সন্নিকটে ‘সাহবা’ (الصَّهْبَاء) নামক স্থানে অবতরণ করে রাসূল (সাঃ) আছরের সালাত আদায় করেন। অতঃপর তিনি খাবার চাইলেন। কিন্তু কেবল কিছু ছাতু পাওয়া গেল। তিনি তাই মাখাতে বললেন। অতঃপর তিনি খেলেন ও সাহাবায়ে কেরাম খেলেন। অতঃপর শুধুমাত্র কুলি করে একই ওযূতে মাগরিব পড়লেন। অতঃপর এশা পড়লেন।[বুখারী হা/২১৫; ওয়াক্বেদী, মাগাযী ২/৬৩৯] এটা নিঃসন্দেহে রাসূল (সাঃ)-এর একটি মু‘জেযা। যেমনটি ঘটেছিল ইতিপূর্বে খন্দকের যুদ্ধে পেটে পাথর বাঁধা ক্ষুধার্ত নবী ও তাঁর সাহাবীগণের খাদ্যের ব্যাপারে।


খায়বরে উপস্থিতি :
━━━━━━━━━━━
রাসূল (সাঃ)-এর নীতি ছিল কোথাও যুদ্ধের জন্য গেলে আগের দিন রাতে গিয়ে সেখানে অবস্থান নিতেন। অতঃপর সকালে হামলা করতেন। খায়বরের ক্ষেত্রেও তাই করলেন। তবে শিবিরের স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে তিনি পূর্ব সিদ্ধান্ত বাতিল করে অভিজ্ঞ যুদ্ধবিশারদ আনছার সাহাবী হুবাব ইবনুল মুনযির(حُبَابُ بنُ الْمُنذِر) এর পরামর্শকে অগ্রাধিকার দিয়ে খায়বরের এত নিকটে গিয়ে শিবির সন্নিবেশ করলেন, যেখান থেকে শহর পরিষ্কার দেখা যায়। সেখানে পৌঁছে তিনি সবাইকে বললেন, তোমরা থাম। অতঃপর তিনি আল্লাহর নিকট নিম্নোক্তভাবে আকুল প্রার্থনা করলেন।-
اللَّهُمَّ رَبَّ السَّمَاوَاتِ السَّبْعِ وَمَا أَظْلَلْنَ، وَرَبَّ الْأَرَضِينَ السَّبْعِ وَمَا أَقْلَلْنَ، وَرَبَّ الرِّيَاحِ وَمَا ذَرَيْنَ، وَرَبَّ الشَّيَاطِينِ وَمَا أَضْلَلْنَ، نَسْأَلُكَ خَيْرَ هَذِهِ الْقَرْيَةِ وَخَيْرَ أَهْلِهَا، وَنَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَشَرِّ أَهْلِهَا وَشَرِّ مَا فِيهَا-
‘হে আল্লাহ! তুমি সপ্ত আকাশ ও যেসবের উপরে এর ছায়া রয়েছে তার প্রভু। সপ্ত যমীন ও যা কিছু সে বহন করছে তার প্রভু। ঝঞ্ঝা-বায়ু এবং যা কিছু তা উড়িয়ে নেয়, তার প্রভু। শয়তান সমূহ ও যাদেরকে তারা পথভ্রষ্ট করেছে তাদের প্রভু। আমরা তোমার নিকটে এই জনপদের কল্যাণ, এর বাসিন্দাদের কল্যাণ ও এর মধ্যে যা কিছু আছে সবকিছুর কল্যাণ প্রার্থনা করছি। আমরা তোমার নিকটে আশ্রয় প্রার্থনা করছি এই জনপদের অনিষ্টতা হতে, এর বাসিন্দাদের অনিষ্টতা হতে এবং এর মধ্যে যা কিছু আছে, সবকিছুর অনিষ্টতা হতে’।[সহীহ ইবনু হিববান হা/২৭০৯; আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ৩৪০] অতঃপর সৈন্যদের উদ্দেশ্যে বললেন,أَقْدِمُوا بِسْمِ اللهِ ‘আগে বাড়ো, আল্লাহর নামে’। অতঃপর খায়বরের সীমানায় প্রবেশ করে শিবির সন্নিবেশ করলেন।[ত্বাবারাণী; হায়ছামী, মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৭১১৭]


খায়বরের বিবরণ :
━━━━━━━━━━━
মদীনা হতে প্রায় ১৭০ কি. মি. উত্তর-পূর্বে অবস্থিত খায়বর একটি বড় শহরের নাম। শহরটি অনেকগুলি দুর্গবেষ্টিত এবং চাষাবাদ যোগ্য কৃষিজমি সমৃদ্ধ। খায়বরের জনবসতি দু’টি অঞ্চলে বিভক্ত। প্রথম অঞ্চলটিতে ৫টি দুর্গ এবং দ্বিতীয় অঞ্চলটিতে ৩টি দুর্গ ছিল। প্রথম অঞ্চলটি দু’ভাগে বিভক্ত। এক ভাগের নাম ‘নাত্বাত’ (نَطَاةُ)। এ ভাগে ছিল সবচেয়ে বড় না‘এম (نَاعِمٌ)-সহ তিনটি দুর্গ এবং আরেক ভাগের নাম ‘শিক্ব’ (الشِّقُّ)। এভাগে ছিল বাকী দু’টি দুর্গ। অন্য অঞ্চলটির নাম ‘কাতীবাহ’ (الكَتِيبَةُ)। এ অঞ্চলে ছিল প্রসিদ্ধ ‘ক্বামূছ’(حِصْنُ الْقَمُوصِ) দুর্গসহ মোট ৩টি দুর্গ। দুই অঞ্চলের বড় বড় ৮টি দুর্গ ছাড়াও ছোট-বড় আরও কিছু দুর্গ ও কেল্লা ছিল। তবে সেগুলি শক্তি ও নিরাপত্তার দিক দিয়ে উপরোক্ত দুর্গগুলির সমপর্যায়ের ছিল না। খায়বরের যুদ্ধ মূলতঃ প্রথম অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। দ্বিতীয় অঞ্চলের দুর্গ তিনটি বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করে।




[1]. হাকেম হা/৪৩৩৭; সহীহ ইবনু হিববান হা/৪৮৫১; আর-রাহীক্ব ৩৬৫ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/২৮১। ইবনু ইসহাক নুমায়লাহ বিন আব্দুল্লাহ লায়ছীর কথা বলেছেন (ইবনু হিশাম ২/৩২৮)। কিন্তু উরফুত্বাই অধিক সঠিক (ফাৎহুল বারী ‘খায়বর যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ; আর-রাহীক্ব ৩৬৫ পৃঃ)।
[2]. ইবনু হিশাম ও ত্বাবারী সংখ্যা নির্ধারণ করেননি (ইবনু হিশাম ২/৩৪২; তারীখ ত্বাবারী ৩/১৭)। মানছূরপুরী সূত্রহীনভাবে ২০ জন মহিলা সাহাবী লিখেছেন, যারা সেবা করার জন্য এসেছিলেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/২১৯)।
[3]. বুখারী হা/৪১৯৬; মুসলিম হা/১৮০২। এখানে مَا أَبْقَيْنَا, مَا اتَّقَيْنَا, مَا اقْتَفَيْنَا, مَا لَقِينَا শব্দ সমূহ ব্যবহৃত হয়েছে’ (বদরুদ্দীন ‘আয়নী (মৃ. ৮৫৫ হি.), ‘উমদাতুল ক্বারী শরহ ছহীহুল বুখারী (বৈরূত : তাবি) হা/৪১৯৫-এর আলোচনা, ১৭/২৩৫। সবগুলির অর্থ কাছাকাছি মর্মের।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...