খায়বর বিজয়ের পর
জা‘ফর, আবু মূসা আশ‘আরী ও আবু হুরায়রা-র আগমন :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
এসময় জা‘ফর, আবু মূসা আশ‘আরী ও আবু হুরায়রা (রাঃ) খায়বরে আগমন করেন। ফলে উক্ত গণীমতে তাদেরকেও শরীক করা হয়। আবু হুরায়রা (রাঃ) মুসলমান হয়ে মদীনায় যান। অতঃপর সেখান থেকে খায়বর আসেন (আল-ইছাবাহ, আবু হুরায়রা ক্রমিক ১০৬৭৪)। তখন যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। উক্ত গণীমতে জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব ও আবু মূসা আশ‘আরীসহ হাবশা হতে সদ্য আগত সাহাবীগণকেও শরীক করা হয়। যাদের সংখ্যা ছিল ১৬ জন। ‘আমর বিন উমাইয়া যামরীকে পূর্বেই আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বাদশাহ নাজাশীর দরবারে পাঠিয়েছিলেন এদেরকে মদীনায় নিয়ে আসার জন্য। রাসূল (সাঃ) এই সময় জা‘ফরকে পেয়ে এত খুশী হয়েছিলেন যে, তিনি উঠে তাকে আলিঙ্গন করলেন এবং বললেন,وَاللهِ مَا أَدْرِي بِأَيِّهِمَا أَفْرَحُ، بِفَتْحِ خَيْبَرَ أَمْ بِقُدُومِ جَعْفَرٍ؟ ‘আল্লাহর কসম! আমি জানি না কোনটাতে আমি বেশী খুশী হয়েছি। খায়বর বিজয়ে না জা‘ফরের আগমনে’?[1] এসময় বাদশাহ নাজাশী জা‘ফরের মাধ্যমে বহুমূল্য উপঢৌকনাদি সহ ভাতিজা যূ-মিখমারকে(ذُو مِخْمَرٍ) রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতের জন্য পাঠিয়েছিলেন (আল-বিদায়াহ ৩/৭৮)।
উল্লেখ্য যে, রাসূল (সাঃ)-এর আবির্ভাবের খবর শুনে আবু মূসা আশ‘আরী ইয়ামন হতে তার গোত্রের ৫০-এর অধিক লোক নিয়ে মদীনার উদ্দেশ্যে হিজরত করেন। কিন্তু পথিমধ্যে তাদের নৌকা পথ হারিয়ে তাদেরকে নাজাশীর দেশে নামিয়ে দেয়। আর সেখানেই জা‘ফর (রাঃ)-এর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়ে যায়। ফলে তারা তাদের সঙ্গেই সেখানে অবস্থান করেন ও পরে সেখান থেকে খায়বরে আসেন ও রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন।[আল-ইছাবাহ ক্রমিক ৪৯০১; বুখারী হা/৩১৩৬; মুসলিম হা/২৫০২]
বেদুঈনের ঈমান :
━━━━━━━━━━━
শাদ্দাদ বিন হাদ (রাঃ) বলেন, জনৈক বেদুঈন মুসলমান হলে খায়বরের যুদ্ধের গণীমতের অংশ তাকেও দেয়া হয়। সে দুম্বা চরাত। গণীমতের মাল নিয়ে সে রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে উপস্থিত হল এবং বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমি তো এজন্য আপনার সাথী হইনি। আমি তো এসেছিলাম এজন্য যাতে আমার কণ্ঠনালীতে একটা তীর লাগে। আর আমি শহীদ হয়ে জান্নাতে প্রবেশ করি’। রাসূল(সাঃ) বললেন, যদি তুমি সত্য হও, তাহলে আল্লাহ তোমার আকাংখা পূর্ণ করবেন। এরপর সে যুদ্ধে গমন করল এবং কণ্ঠনালীতে তীর লেগে সে শহীদ হয়ে গেল। তার লাশের পাশ দিয়ে যাবার সময় রাসূল (সাঃ) তাকে চিনতে পেরে বলেন, এ ব্যক্তি কি সেই-ই? লোকেরা বলল, হ্যাঁ। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন, আল্লাহর সঙ্গে তার কারবার সত্য ছিল। আল্লাহ তার আকাংখা পূর্ণ করেছেন। অতঃপর তিনি স্বীয় জুববা দিয়ে তার কাফন পরান ও জানাযা করেন। তার জন্য তিনি দো‘আ করেন, হে আল্লাহ! এটি তোমার বান্দা। বেরিয়েছিল তোমার রাস্তায় মুহাজির হিসাবে। অতঃপর শহীদ হয়ে গেছে। আমি তার সাক্ষী’।[বায়হাক্বী হা/৭০৬৫; হাকেম হা/৬৫২৭; নাসাঈ হা/১৯৫৩, সনদ সহীহ]
একই ঘটনা জাবের বিন আব্দুল্লাহ বলেন, আমরা রাসূল (সাঃ)-এর সাথে খায়বর যুদ্ধে ছিলাম। অতঃপর একটি ছোট সেনাদল বেরিয়ে যায়। তারা একজন মেষচারককে ধরে আনে। সে রাসূল (সাঃ)-কে এসে বলে যে, আমি আপনার উপর ঈমান এনেছি এবং যুদ্ধ করে শহীদ হতে চাই। কিন্তু আমার এই মেষপালের উপায় কি হবে? এগুলি আমার নিকট অন্যের আমানত। জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, তুমি এগুলি স্ব স্ব মনিবের বাড়ীর উদ্দেশ্যে হাঁকিয়ে দাও’। সে তাই করল। রাসূল (সাঃ) তাদের সম্মুখ দিকে একমুষ্টি মাটি ছুঁড়ে মারলেন। অতঃপর প্রত্যেকটি দুম্বা স্ব স্ব মালিকের বাড়ীতে পৌঁছে গেলে সে ফিরে এল এবং যুদ্ধে যোগদান করল। অতঃপর সে একটি তীর বিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়ে গেল। অথচ ঐ ব্যক্তি আল্লাহর জন্য কখনো একটি সিজদাও করেনি’(وَلَمْ يُصَلِّ لِلَّهِ سَجْدَةً قَطُّ)।[2]
খায়বর বিজয়ের পর :
━━━━━━━━━━━━━
খায়বর বিজয় সম্পন্ন করার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পার্শ্ববর্তী ইহূদী জনপদ ওয়াদিল ক্বোরা(وَادِي الْقُرَى) এবং তায়মা (تَيْمَاء)-এর দিকে মনোনিবেশ করলেন, যাতে এরা পরবর্তীতে মাথা চাড়া না দেয়। এদের সাথে আরবদের একটি দল গিয়ে মিলিত হয়েছিল।
(১) ওয়াদিল ক্বোরা জয়(فتح وادى القرى) : মুসলিম বাহিনী ওয়াদিল ক্বোরা উপস্থিত হলে ইহূদীরা তীর নিক্ষেপ শুরু করল। তাতে মিদ‘আম (مِدْعَم) নামক রাসূল (সাঃ)-এর জনৈক গোলাম মৃত্যুবরণ করে। সাথীরা তাকে সম্ভাষণ জানিয়ে বলে ওঠেন, الْجَنَّةُ ‘তার জন্য জান্নাত’। তখন রাসূল (সাঃ) রাগতঃস্বরে বললেন,كَلاَّ وَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ إِنَّ الشَّمْلَةَ الَّتِى أَخَذَهَا يَوْمَ خَيْبَرَ مِنَ الْمَغَانِمِ، لَمْ تُصِبْهَا الْمَقَاسِمُ، لَتَشْتَعِلُ عَلَيْهِ نَارًا ‘কখনোই না। সেই সত্তার কসম! যার হাতে আমার জীবন, এই ব্যক্তি খায়বরের দিন গণীমত বণ্টনের পূর্বেই তা থেকে একটা চাদর নিয়েছিল। সে চাদর এখন তার উপরে অবশ্যই আগুন হয়ে জ্বলবে’। একথা শুনে কেউ জুতার একটি ফিতা বা দু’টি ফিতা যা গোপনে নিয়েছিল, সব এনে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে জমা দিল। রাসূল (সাঃ) বললেন, এ ফিতা ছিল আগুনের’(شِرَاكٌ أَوْ شِرَاكَانِ مِنْ نَارٍ)।[বুখারী হা/৪২৩৪; মুসলিম হা/১১৫]
এরপর ইহূদীদের নিকটে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ইসলামের দাওয়াত দিলেন। তারা যথারীতি দাওয়াত প্রত্যাখ্যান করল। তাদের মধ্য হতে একজন এসে দ্বৈতযুদ্ধে আহবান করল। তখন রাসূল (সাঃ)-এর পক্ষে যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম গিয়ে তাকে খতম করে দেন। এইভাবে তাদের ১১ জন পরপর নিহত হয়। প্রতিবারে দ্বৈতযুদ্ধের পূর্বে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তাদেরকে ইসলাম কবুলের আহবান জানাতেন। কিন্তু তারা অহংকার বশে বারবার তা প্রত্যাখ্যান করত। এভাবে একদিন গত হল। পরদিন রাসূল (সাঃ) আবার গিয়ে তাদের দাওয়াত দিলেন। তখন তারা আত্মসমর্পণ করে এবং বহু গণীমত হস্তগত হয়। যা সাহাবীগণের মধ্যে বণ্টিত হয়। তবে জমি-জমা ও খেজুর বাগান ইহূদীদের নিকটে অর্ধাংশের বিনিময়ে রেখে দেওয়া হয়, যেমন খায়বরবাসীদের সাথে চুক্তি করা হয়েছিল।[যাদুল মা‘আদ ৩/৩১৪; আল-বিদায়াহ ৪/২১৮; আর-রাহীক্ব ৩৭৮ পৃঃ]
(২) তায়মা বিজয়(فتح تيماء) : খায়বর ও ওয়াদিল ক্বোরার ইহূদীদের শোচনীয় পরাজয়ের খবর জানতে পেরে তায়মার ইহূদীরা শক্তি প্রদর্শনের চিন্তা বাদ দিয়ে সরাসরি রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সন্ধিচুক্তি করে (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৭৪; আল-বিদায়াহ ৪/২১৮)। যার ভাষ্য ছিল নিম্নরূপ-هَذَا كِتَابٌ مِنْ مُحمدٍ رَسولِ اللهِ لِبَنِي غَادِيَا أنَّ لَهُمُ الذِّمَّةَ وَعَلَيْهِمُ الْجِزْيَةَ وَلا عَدَاءَ وَلا جَلاءَ اللَّيْلُ مَدٌّ وَالنَّهَارُ شَدٌّ ‘এ দলীল লিখিত হল আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদের পক্ষ হতে বনু গাদিয়ার জন্য। তাদের জন্য রইল (আমাদের) যিম্মাদারী এবং তাদের উপরে রইল জিযিয়া। কোন শত্রুতা নয়, কোন বিতাড়ন নয়। তাদের রাত্রি ও দিন হবে নিরাপদ’। চুক্তিনামাটি লিপিবদ্ধ করেন খালেদ ইবনু সাঈদ (রাঃ)।[ইবনু সা‘দ ১/২১৩; আর-রাহীক্ব ৩৭৮-৭৯ পৃঃ] চুক্তির ভাষা ও বক্তব্য অতীব চমৎকার ও সারগর্ভ, যা অনন্য ও অভূতপূর্ব।
খালেদ বিন সা‘ঈদ ইবনুল ‘আছ উমুভী ছিলেন ৪র্থ অথবা ৫ম মুসলিম। যিনি স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর পিতা তাঁকে অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করছেন এবং রাসূল (সাঃ) তাঁকে দু’হাত ধরে সেখান থেকে উদ্ধার করেন। এ স্বপ্ন দেখে পরদিন তিনি আবুবকরের নিকটে চলে আসেন এবং বলেন, মুহাম্মাদ অবশ্যই আল্লাহর রাসূল। অতঃপর তিনি ইসলাম কবুল করেন। এ খবর জানতে পেরে তাঁর পিতা তাঁর খানা-পিনা বন্ধ করে দেন এবং তাঁর ভাইদেরকে তাঁর সাথে কথাবার্তা নিষিদ্ধ করে দেন। ফলে তিনি স্ত্রীসহ হাবশায় হিজরত করেন। সেখান থেকে জা‘ফর বিন আবু ত্বালিবের সাথে খায়বরে এসে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে মিলিত হন। আবুবকর (রাঃ)-এর খেলাফতের শেষ দিকে আজনাদায়েন-এর যুদ্ধে তিনি শহীদ হন (আল-ইছাবাহ, খালেদ বিন সা‘ঈদ ক্রমিক ২১৬৯)।
মদীনায় প্রত্যাবর্তন :
━━━━━━━━━━━━
তায়মাবাসী ইহূদীদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি সম্পাদনের পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন। পথিমধ্যে এক স্থানে শেষ রাত্রিতে যাত্রা বিরতি করেন ও বেলালকে পাহারায় নিযুক্ত করে বলেন,اكْلأْ لَنَا اللَّيْلَ ‘রাত্রিতে আমাদের দিকে খেয়াল রেখো (অর্থাৎ ফজরে জাগিয়ে দিয়ো)। কিন্তু বেলালের চোখেও ঘুম চেপে গেল। ফলে সকালের রোদ গায়ে লাগলেও কারু ঘুম ভাঙ্গেনি। রাসূল (সাঃ)-ই সর্বপ্রথম ঘুম থেকে ওঠেন। অতঃপর ঐ উপত্যকা ছেড়ে কিছু দূর গিয়ে সবাইকে নিয়ে ফজর পড়েন। অতঃপর তিনি বলেন,مَنْ نَسِىَ الصَّلاَةَ فَلْيُصَلِّهَا إِذَا ذَكَرَهَا فَإِنَّ اللهَ قَالَ (أَقِمِ الصَّلاَةَ لِذِكْرِى) ‘যে ব্যক্তি সালাত ভুলে যাবে, সে যেন স্মরণ হওয়ার পরে সেটা পড়ে। কেননা আল্লাহ বলেন, তোমরা আমার স্মরণে সালাত কায়েম কর’ (ত্বোয়াহা ২০/১৪)।[মুসলিম হা/৬৮০ (৩০৯); মিশকাত হা/৬৮৪]
অতঃপর ৭ম হিজরীর ছফর মাসের শেষভাগে অথবা রবীউল আউয়াল মাসে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মাসাধিককাল পর মদীনায় প্রত্যাবর্তন করেন।
[1]. শারহুস সুন্নাহ, মিশকাত হা/৪৬৮৭; সহীহাহ হা/২৬৫৭; ফিক্বহুস সীরাহ ৩৪৭ পৃঃ; সনদ হাসান। উল্লেখ্য যে, এ সময় রাসূল (সাঃ) তার ‘কপালে চুমু খান’ বলে যে বর্ণনা এসেছে, তা ‘মুরসাল’ ও যঈফ (হাকেম হা/৪৯৪১, আহমাদ হা/২১৯১২)।
[2]. হাকেম হা/২৬০৯। হাকেম ‘সহীহ’ বলেছেন। কিন্তু যাহাবী একজন রাবী শুরাহবীল বিন সা‘দকে ‘মিথ্যায় অপবাদগ্রস্ত’ বলেছেন; বায়হাক্বী হা/১৮২০৫, ৯/১৪৩ পৃঃ সনদ ‘মুরসাল’।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন