রবিবার, ৫ অক্টোবর, ২০২৫

মক্কা বিজয়

 

মক্কা বিজয়

(৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান সোমবার মোতাবেক ৮ই জানুয়ারী ৬৩০ খৃ.)
৮ম হিজরীর ৭ই রামাযান[1] মোতাবেক ৬২৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৯শে ডিসেম্বর শুক্রবার ১০,০০০ সাহাবী নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মদীনা হতে রওয়ানা হন এবং ১৭ই রামাযান মোতাবেক ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ৮ই জানুয়ারী সোমবার এক প্রকার বিনা যুদ্ধে মক্কা বিজয় সম্পন্ন হয়। মুসলিম পক্ষে দলছুট ২ জন শহীদ ও কাফের পক্ষে অতি উৎসাহী হয়ে অগ্রবর্তী ১২ জন নিহত হয়। এ সময় মদীনার দায়িত্বে ছিলেন আবু রুহুম কুলছূম(أبو رُهْمٍ كُلثومُ بنُ حُصَينِ) বিন হোছায়েন আল-গেফারী।[ইবনু হিশাম ২/৩৯৯; আর-রাউযুল উনুফ ৪/১৫৩] এটি ছিল একটি সিদ্ধান্তকারী যুদ্ধ। এই যুদ্ধের পর রাসূল (সাঃ)-এর সত্যতার ব্যাপারে সমগ্র আরব বিশ্বে সকল দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দূর হয়ে যায়। কেননা ইতিপূর্বে কা‘বাগৃহের উপর কর্তৃত্বের কারণে মানুষ কুরায়েশ নেতাদের প্রতি একটা অন্ধ আবেগ ও আনুগত্য পোষণ করত। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-
জন্মভূমি মক্কা হতে হিজরত করার ৭ বছর ৩ মাস ২৭ দিন পর বিজয়ীর বেশে পুনরায় মক্কায় ফিরে এলেন মক্কার শ্রেষ্ঠ সন্তান বিশ্ব মানবতার মুক্তিদূত, নবীকুল শিরোমণি শেষনবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম)। বিনা যুদ্ধেই মক্কার নেতারা তাঁর নিকটে আত্মসমর্পণ করলেন। এতদিন যারা ছিলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ও মুসলমানদের যাবতীয় দুঃখ-কষ্টের মূল। বিজয়ী রাসূল (সাঃ) তাদের কারু প্রতি কোনরূপ প্রতিশোধ নিলেন না। সবাইকে উদারতা ও ক্ষমার চাদরে ঢেকে দিয়ে বললেন, ‘আজ তোমাদের উপরে কোনরূপ অভিযোগ নেই, তোমরা মুক্ত’। কিন্তু কি ছিল এর কারণ? কিভাবে ঘটলো হঠাৎ করে এ ঐতিহাসিক বিজয়? দু’বছর আগেও যে মুসলিম বাহিনীতে তিন হাযার লোক সংগ্রহ করাও দুঃসাধ্য ছিল, তারা কোথা থেকে কিভাবে দশ হাযার লোক নিয়ে ঝড়ের বেগে হঠাৎ ধূমকেতুর মত আবির্ভূত হল মক্কার উপরে? অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে দেখল মক্কার নেতারা ফ্যালফ্যাল করে। টুঁ শব্দটি করার সাহস কারু হল না? নিমেষে বন্ধ হয়ে গেল মক্কা-মদীনার সংঘাত। পৌত্তলিক মক্কা দু’দিনের মধ্যেই হয়ে গেল তাওহীদবাদী মুসলমান। কা‘বাগৃহ হল মূর্তিশূন্য। ‘উয্যার বদলে শুরু হল আল্লাহর জয়গান। শিরকী সমাজ পরিবর্তিত হল ইসলামী সমাজে। সমস্ত আরব উপদ্বীপে বয়ে চলল শান্তির সুবাতাস। কি সে কারণ? কিভাবে সম্ভব হল এই অসম্ভব কান্ড? এক্ষণে আমরা সে বিষয়ে আলোকপাত করব।-


অভিযানের কারণ :
━━━━━━━━━━━
প্রায় দু’বছর পূর্বে ৬ষ্ঠ হিজরীর যুলক্বা‘দাহ মাসে সম্পাদিত হোদায়বিয়ার চার দফা সন্ধিচুক্তির তৃতীয় দফায় বর্ণিত ছিল যে, ‘যে সকল গোত্র মুসলমান বা কুরায়েশ পক্ষের সাথে চুক্তিবদ্ধ হবে, তারা তাদের দলভুক্ত বলে গণ্য হবে এবং তাদের কারু উপরে অত্যাচার করা হলে সংশ্লিষ্ট দলের উপরে অত্যাচার বলে ধরে নেওয়া হবে’। উক্ত শর্তের আওতায় মক্কার নিকটবর্তী গোত্র বনু খোযা‘আহ(بَنُو خُزَاعَة) মুসলমানদের সাথে এবং বনু বকর(بَنُو بَكْرٍ) কুরায়েশদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে সংশ্লিষ্ট দলের মিত্রপক্ষ হিসাবে গণ্য হয়। কিন্তু দু’বছর পুরা না হতেই বনু বকর উক্ত চুক্তি ভঙ্গ করল এবং ৮ম হিজরীর শা‘বান মাসে রাত্রির অন্ধকারে বনু খোযা‘আহর উপরে অতর্কিতে হামলা চালিয়ে বহু লোককে হতাহত করল। ঐসময় বনু খোযা‘আহ গোত্র ‘ওয়াতীর’ (الْوَتِيرُ) নামক প্রস্রবণের ধারে বসবাস করত, যা ছিল মক্কার নিম্নভূমিতে অবস্থিত (মু‘জামুল বুলদান)।
বনু বকরের এই অন্যায় আক্রমণে কুরায়েশদের ইন্ধন ছিল। তারা অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করেছিল। এমনকি কুরায়েশ নেতা ইকরিমা বিন আবু জাহ্ল, সাফওয়ান বিন উমাইয়া এবং খোদ হোদায়বিয়া সন্ধিচুক্তিতে কুরায়েশ পক্ষের আলোচক ও স্বাক্ষর দানকারী সোহায়েল বিন ‘আমর সশরীরে উক্ত হামলায় অংশগ্রহণ করেন।[2]
বনু খোযা‘আহ গোত্রের এই হৃদয়বিদারক দুঃসংবাদ নিয়ে ‘আমের বিন সালেম আল-খোযাঈ ৪০ জনের একটি দল সহ দ্রুত মদীনায় আসেন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) তখন মসজিদে নববীতে সাহাবায়ে কেরাম সহ অবস্থান করছিলেন। এমন সময় ‘আমের কবিতা পাঠ করতে করতে রাসূল (সাঃ)-এর সামনে এসে মর্মস্পর্শী ভাষায় তাদের নির্মম হত্যাকান্ড এবং কুরায়েশদের চুক্তি ভঙ্গের কথা বিবৃত করেন। সাড়ে আট লাইনের সেই কবিতার শেষের সাড়ে চার লাইন ছিল নিম্নরূপ:
إنَّ قُرَيْشًا أَخْـلَفُوْكَ الْمَوْعِدَا * وَنَقَضُوْا مِيْثَـاقَكَ الْمُؤَكَّدَا
وَجَعَلُوْا لِيْ فِيْ كَدَاءٍ رُصَّدَا * وَزَعَمُوْا أَنْ لَسْتُ أَدْعُوْ أَحَدَا
وَهُـمْ أَذَلُّ وَأَقَـلُّ عَـدَدَا * هُمْ بَيَّتُـوْنَا بِالْوَتِيْـرِ هُجَّدًا
وَقَتَلُـوْنَا رُكَّـعًا وَّسُجَّدَا * فَانْصُرْ هَدَاك اللهُ نَصْرًا أَيِّدَا
نَحْنُ وَلَدْنَاك فَكُنْتَ وَلَدًا -
(১) ‘নিশ্চয়ই কুরায়েশগণ আপনার সাথে কৃত ওয়াদা খেলাফ করেছে এবং আপনাকে দেওয়া পাক্কা অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে’। (২) ‘তারা ‘কাদা’ নামক স্থানে আমার জন্য ওঁৎ পেতে আছে। তারা ধারণা করেছে যে আমি সাহায্যের জন্য কাউকে আহবান করবো না’। (৩) ‘তারা নিকৃষ্ট ও সংখ্যায় অল্প। তারা ‘ওয়াতীর’ নামক স্থানে রাত্রি বেলায় ঘুমন্ত অবস্থায় আমাদের উপরে হামলা চালিয়েছে’। (৪) ‘তারা রুকূ ও সিজদারত অবস্থায় আমাদেরকে হত্যা করেছে। অতএব আপনি আমাদেরকে দৃঢ় হস্তে সাহায্য করুন। ‘আল্লাহ আপনাকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন’। (৫) ‘আমরা আপনাকে প্রসব করেছি। অতএব আপনি আমাদের সন্তান’ (ইবনু হিশাম ২/৩৯৪-৯৫)।
কবিতার শেষের চরণ দ্বারা বুঝা যায় যে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ তখন মুসলমান হয়েছিলেন। যদিও জীবনীকারগণ এ বিষয়ে একমত যে, ঐ সময় পর্যন্ত তারা মুসলমান হয়নি’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৪৯)।


বনু খোযা‘আহর পরিচয় :
━━━━━━━━━━━━━━━━
বনু খোযা‘আহ গোত্রের সাথে বনু হাশেমের মৈত্রীচুক্তি আব্দুল মুত্ত্বালিবের যুগ হতেই চলে আসছিল। কুরায়েশ বংশের প্রবাদ প্রতীম নেতা কুছাই বিন কিলাবের স্ত্রী অর্থাৎ ‘আব্দে মানাফের মা ছিলেন খোযা‘আহ গোত্রের মহিলা। সে হিসাবে বনু হাশেমকে তারা তাদের সন্তান মনে করত। তারও পূর্বের ঘটনা এই যে, বনু খোযা‘আহ ছিল এক সময় বায়তুল্লাহর তত্ত্বাবধায়ক ও মক্কার শাসকগোত্র। তাদের সর্বশেষ নেতা ‘হুলাইল’(حُلَيْل) তার কন্যা হুবাই (حُبَيّ) বা হুববা (حُبَّى)-কে কুছাই বিন কিলাবের সাথে বিবাহ দেন এবং বিয়ের সময় বায়তুল্লাহর মুতাওয়াল্লীর দায়িত্ব কন্যাকে অর্পণ করেন। সাথে সাথে আবু গুবশান(أبو غُبْشَان) কে কন্যার উকিল নিয়োগ করেন। হুলাইলের মৃত্যুর পর আবু গুবশান এক মশক শরাবের বিনিময়ে তার উকিলের দায়িত্ব কুছাইকে অর্পণ করেন। এভাবে কুছাই বিন কিলাব তার স্ত্রীর উকিল হিসাবে বায়তুল্লাহর তত্ত্বাবধায়ক নিযুক্ত হন। তাছাড়া বনু খোযা‘আহ ধারণা করত যে, তাদের নেতা হুলাইল তার জামাতা কুছাইকে পরবর্তী নেতা হিসাবে অছিয়ত করে গেছেন। অতঃপর কুছাই তার মেধা ও দূরদর্শিতার বদৌলতে বিভক্ত কুরায়েশ বংশকে ঐক্যবদ্ধ করেন এবং তার অবিসংবাদিত নেতা হিসাবে বরিত হন (ইবনু হিশাম ১/১১৭-১৮)।
উপরোক্ত বিষয়গুলি বিবেচনা করে বনু খোযা‘আহ সর্বদা বনু হাশেমের মিত্র হিসাবে থাকত। মুসলমান না হওয়া সত্ত্বেও কেবল বনু হাশেমের সন্তান হিসাবে তারা সর্বদা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পক্ষে অবস্থান নিত।


বনু খোযা‘আহর আবেদনে রাসূল (সাঃ)-এর সাড়া :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
এরপর বনু খোযা‘আহর আরেকটি প্রতিনিধিদল নিয়ে বুদাইল বিন অরক্বা আল-খোযাঈ(بُدَيْلُ بنُ وَرْقَاءَ الْخُزَاعِيُّ) আগমন করেন এবং তাদের গোত্রের কারা কারা নিহত হয়েছে ও কুরায়েশরা কিভাবে বনু বকরকে সাহায্য করেছে, তার পূর্ণ বিবরণ পেশ করেন। রাসূল (সাঃ) তাদের আবেদনে সাড়া দেন। অতঃপর তারা মক্কায় ফিরে যান।[আর-রাহীক্ব ৩৯৫ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৪৯]


রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর প্রস্তুততি :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
অতঃপর বাহ্যিক কৌশল হিসাবে তিনি আবু ক্বাতাদাহ হারেছ বিন রিব্‘ঈ(أَبُو قَتَادَةَ الْحَارِث بن رِبْعِي) এর নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি দলকে ১লা রামাযান তারিখে ‘ইযাম’(بَطْن إِضَم) উপত্যকার দিকে রওয়ানা করে দেন। যাতে শত্রুরা ভাবে যে, অভিযান ঐদিকেই পরিচালিত হবে। পরে তারা গিয়ে পথিমধ্যে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে মিলিত হন (আর-রাহীক্ব ৩৯৭ পৃঃ)।


অভিযান পরিকল্পনা ফাঁসের ব্যর্থ চেষ্টা ও চিঠি উদ্ধার :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
বদর যুদ্ধের নিবেদিতপ্রাণ সাহাবী এবং রাসূল (সাঃ)-এর দান্দান মুবারক শহীদকারী উৎবা বিন আবু ওয়াকক্বাছের হত্যাকারী (ইয়ামন প্রত্যাগত-কুরতুবী) প্রসিদ্ধ বীর হাতেব বিন আবু বালতা‘আহ (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর আসন্ন মক্কা অভিযানের খবর দিয়ে একটি পত্র লিখে একজন মহিলার মাধ্যমে গোপনে মক্কায় প্রেরণ করেন। অহি-র মাধ্যমে অবগত হয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আলী, যুবায়ের ও মিক্বদাদ (রাঃ)-কে দ্রুত পশ্চাদ্ধাবনের নির্দেশ দিয়ে বলেন, তোমরা ‘খাখ’(رَوْضَةُ خَاخ) নামক বাগিচায় গিয়ে একজন হাওদানশীন মহিলাকে পাবে, যার কাছে কুরায়েশদের নিকটে লিখিত একটি পত্র রয়েছে’। তারা অতি দ্রুত পিছু নিয়ে ১২ মাইল দূরে ঠিক সেখানে গিয়েই মহিলাকে পেলেন ও তাকে পত্রের কথা জিজ্ঞেস করলেন। মহিলা অস্বীকার করলে তার হাওদা তল্লাশি করা হল। কিন্তু না পেয়ে আলী (রাঃ) তাকে বললেন,مَا كَذَبَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، لَتُخْرِجِنَّ الْكِتَابَ أَوْ لَنُجَرِّدَنَّكِ ‘আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মিথ্যা বলেননি। আল্লাহর কসম! অবশ্যই তুমি চিঠিটি বের করে দিবে। নইলে অবশ্যই আমরা তোমাকে উলঙ্গ করব’। তখন মহিলা ভয়ে তার মাথার খোঁপা থেকে চিঠিটা বের করে দিল। পত্রখানা নিয়ে তারা মদীনায় ফিরে এলেন।
তখন হাতেবকে ডেকে রাসূল (সাঃ) কারণ জিজ্ঞেস করলেন। জবাবে তিনি বললেন,يَا رَسُولَ اللهِ، لاَ تَعْجَلْ عَلَىَّ، مَا بِىْ إِلاَّ أَنْ أَكُوْنَ مُؤْمِنًا بِاللهِ وَرَسُولِهِ، وَمَا غَيَّرْتُ وَلاَ بَدَّلْتُ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমার ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিবেন না। আল্লাহর কসম! আমি অবশ্যই আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে বিশ্বাসী। আমার মধ্যে কোনরূপ পরিবর্তন আসেনি বা আমি আমার দ্বীন বদল করিনি’। তবে ব্যাপারটি হল এই যে, আমি কুরায়েশদের গোত্রভুক্ত নই। বরং একজন চুক্তিবদ্ধ মিত্র (حَلِيف) মাত্র। তাদের মধ্যে রয়েছে আমার পরিবার ও সন্তান-সন্ততি। তাদের সাথে আমার কোন আত্মীয়তা নেই, যারা তাদের হেফাযত করবে। অথচ আপনার সাথে যেসকল মুহাজির আছেন, তাদের সেখানে আত্মীয়-স্বজন আছে, যারা তাদের পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে পারে। এজন্য আমি চেয়েছিলাম যে, তাদের প্রতি কিছুটা সহানুভূতি দেখাই, যাতে তারা আমার পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়।وَلَمْ أَفْعَلْهُ ارْتِدَادًا عَنْ دِينِى، وَلاَ رِضًا بِالْكُفْرِ بَعْدَ الإِسْلاَمِ ‘আমি এটা আমার দ্বীন থেকে ‘মুরতাদ’ হয়ে করিনি বা ইসলামের পরে কুফরীতে খুশী হয়ে করিনি’। রাসূল (সাঃ) বললেন,صَدَقَ فَلاَ تَقُولُوا لَهُ إِلاَّ خَيْرًا ‘সে সত্য বলেছে। অতএব তোমরা তার সম্পর্কে ভালো ব্যতীত কিছু বলো না’।
তখন উমর (রাঃ) বলে উঠলেন,إِنَّهُ قَدْ خَانَ اللهَ وَرَسُولَهُ وَالْمُؤْمِنِينَ فَدَعْنِى فَلْأَضْرِبَ عُنُقَهُ ‘সে আল্লাহ, তাঁর রাসূল এবং মুমিনদের সাথে খেয়ানত করেছে। আমাকে ছেড়ে দিন আমি এর গর্দান উড়িয়ে দেই’ (বুখারী হা/৩৯৮৩)। অন্য বর্ণনায় এসেছে,دَعْنِى أَضْرِبْ عُنُقَ هَذَا الْمُنَافِقِ আমাকে ছেড়ে দিন এই মুনাফিকটার গর্দান উড়িয়ে দেই’ (বুখারী হা/৩০০৭)। জবাবে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,إِنَّهُ قَدْ شَهِدَ بَدْرًا ‘সে বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল’। তোমার কি জানা নেই হে উমর! আহলে বদর সম্পর্কে আল্লাহ বলেছেন (হাদীছে কুদসী),اِعْمَلُوْا مَا شِئْتُمْ فَقَدْ غَفَرْتُ لَكُمْ ‘তোমরা যা খুশী করো, আমি তোমাদের ক্ষমা করে দিয়েছি’। একথা শুনে উমরের দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে গেল এবং তিনি বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল অধিক জ্ঞাত’।
অতঃপর আয়াত নাযিল হল,يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا لاَ تَتَّخِذُوا عَدُوِّي وَعَدُوَّكُمْ أَوْلِيَاءَ تُلْقُونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَقَدْ كَفَرُوا بِمَا جَاءَكُمْ مِنَ الْحَقِّ يُخْرِجُونَ الرَّسُولَ وَإِيَّاكُمْ أَنْ تُؤْمِنُوا بِاللَّهِ رَبِّكُمْ إِنْ كُنْتُمْ خَرَجْتُمْ جِهَادًا فِي سَبِيلِي وَابْتِغَاءَ مَرْضَاتِي تُسِرُّونَ إِلَيْهِمْ بِالْمَوَدَّةِ وَأَنَا أَعْلَمُ بِمَا أَخْفَيْتُمْ وَمَا أَعْلَنْتُمْ وَمَنْ يَفْعَلْهُ مِنْكُمْ فَقَدْ ضَلَّ سَوَاءَ السَّبِيلِ ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা আমার শত্রু ও তোমাদের শত্রুকে বন্ধুরূপে গ্রহণ করো না। তোমরা তাদের সাথে বন্ধুত্ব করছ, অথচ তারা তোমাদের নিকট যে সত্য এসেছে, তার সাথে কুফরী করেছে। তারা রাসূলকে ও তোমাদেরকে বহিষ্কার করেছে এই কারণে যে, তোমরা তোমাদের প্রতিপালক আল্লাহর উপরে ঈমান এনেছ। যদি তোমরা আমার সন্তুষ্টি লাভের জন্য আমার রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়ে থাক, তাহলে তোমরা তাদের সাথে গোপনে বন্ধুত্ব করো না। কেননা তোমরা যা গোপন কর এবং যা প্রকাশ কর, তা আমি ভালভাবে অবগত। যে ব্যক্তি তোমাদের মধ্যে এ কাজ করবে, সে সরল পথ থেকে বিচ্যুত হবে’ (মুমতাহিনা ৬০/১)।[বুখারী হা/৩৯৮৩, ৪২৭৪]


মু‘জেযা ও বিধানসমূহ :
━━━━━━━━━━━━━━
গোপনে পত্র প্রেরণের তথ্য উদঘাটনের ফলে অত্র ঘটনায় রাসূল (সাঃ)-এর মু‘জিযা প্রকাশিত হয়েছে। এর দ্বারা এই বিধানও জানা গেছে যে, প্রয়োজনে গুপ্তচরের লজ্জাস্থান নগ্ন করা যাবে। তাছাড়া এই বিধানও জারী হয়েছে যে, কবীরা গুনাহগার মুমিন ব্যক্তি কর্মগত কুফরী করলেও সে বিশ্বাসগতভাবে কাফের হয় না। যেমন এক্ষেত্রে হাতেব (রাঃ) কাফের হননি।


মক্কার পথে রওয়ানা :
━━━━━━━━━━━━
৮ম হিজরীর ৭ই রামাযান শুক্রবার ১০,০০০ সাথী নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মক্কা অভিমুখে রওয়ানা হন। এই সময় মদীনার প্রশাসক নিযুক্ত করে যান আবু রুহুম কুলছূম আল-গেফারী-কে (হাকেম হা/৬৫১৭)। মুহাজির ও আনছারদের সকলেই অত্র অভিযানে যোগদান করেন। এতদ্ব্যতীত মদীনার আশপাশের নওমুসলিম গোত্রসমূহ যেমন আসলাম, গেফার, মুযায়না, জোহায়না, বনু সোলায়েম, আশজা‘ প্রভৃতি গোত্র সমূহ এই সাথে গমন করে। এদের মধ্যে মুযায়না গোত্রের এক হাযার ও বনু সুলায়েম-এর এক হাযার সৈন্য ছিল’ (সীরাহ সহীহাহ ২/৪৭৪)। ইবনু আববাস (রাঃ) বলেন, এদিন রাসূল (সাঃ) সিয়াম অবস্থায় ছিলেন। সাথীগণের কেউ সায়েম ছিলেন, কেউ ছিলেন না। অতঃপর মক্কা থেকে ৪২ মাইল দূরে কুরাউল গামীম পৌঁছে তিনি এক পাত্র পানি চাইলেন এবং তা উঁচু করে সবাইকে দেখিয়ে পান করে দিনের বেলায় সিয়াম ভঙ্গ করলেন’... (মুসলিম হা/১১১৩-১৪)। স্থানটি ছিল আমাজ ও ওসফানের মধ্যবর্তী কুদাইদ নামক স্থানে(كَانَ بِالْكُدَيْدِ، بَيْنَ عُسْفَانَ وَأَمَجٍ)।[ইবনু হিশাম ২/৪০০] কুদাইদ ছিল মক্কা থেকে ৪২ মাইল দূরে একটি ঝর্ণাধারার নাম(الكديد عين جارية على اثنين وأربعين ميلا من مكة)।[মুসলিম, শরহ নববী হা/১১১৩]


পথিমধ্যের ঘটনাবলী :
━━━━━━━━━━━━━
(১) আববাস-এর সাথে সাক্ষাৎ(اللقاء مع العباس) : মদীনা থেকে মক্কার পথে ১৮৭ কি. মি. দূরে জুহফা (الْجُحْفَة) বা তার কিছু পরে পৌঁছে রাসূল (সাঃ)-এর প্রিয় চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের সাথে সাক্ষাৎ হয়। যিনি পরিবার-পরিজনসহ মুসলমান হয়ে মদীনার পথে হিজরতে বের হয়েছিলেন। যদিও আববাস খায়বর বিজয়ের পূর্বেই ইসলাম কবুল করেছিলেন। উল্লেখ্য যে, আববাস ছিলেন রাসূল (সাঃ)-এর বিশ্বস্ত চাচা। যিনি কুরায়েশদের খবরাখবর গোপনে তাঁকে সরবরাহ করতেন এবং আবু তালেবের পরে তিনিই ছিলেন মক্কায় দুর্বল মুসলমানদের প্রধান আশ্রয়স্থল।

(২) চাচাতো ও ফুফাতো ভাইয়ের সাথে সাক্ষাৎ(اللقاء مع الأخوين من العم والعمة) : মদীনা থেকে দক্ষিণে মক্কার পথে ২৫০ কি. মি. দূরে আবওয়া (الْأَبْوَاء), যেখানে রাসূল (সাঃ)-এর মা আমেনার কবর রয়েছে- সেখানে রাসূল (সাঃ)-এর চাচাতো ভাই ও দুধ ভাই আবু সুফিয়ান মুগীরাহ ইবনুল হারেছ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব এবং ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন আবু উমাইয়া বিন মুগীরাহর সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হয়। শেষোক্ত ব্যক্তি উম্মুল মুমিনীন উম্মে সালামার বিমাতা ভাই ছিলেন। তাদের সম্পর্কে উম্মে সালামা অনুরোধ করলে রাসূল (সাঃ) বলেন, তাদের কাছে আমার কোন প্রয়োজন নেই’। চাচাতো ভাই মক্কায় আমার সম্মান বিনষ্ট করেছে এবং ফুফাতো ভাই মক্কায় আমার সম্পর্কে নানারূপ কুৎসা রটনা করেছে’। অতঃপর এ খবর জানতে পেরে তারা বলে উঠলেন, আল্লাহর কসম! হয় আল্লাহর রাসূল আমাদেরকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি দিবেন, না হয় আমরা আমাদের সন্তানাদি নিয়ে একদিকে চলে যাব। অতঃপর ক্ষুধায়-তৃষ্ণায় মারা যাব’। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অন্তর নরম হল এবং তাদেরকে অনুমতি দিলেন’ (অতঃপর তারা ইসলাম কবুল করলেন)।[3]
অন্যদিকে হযরত আলী (রাঃ) আবু সুফিয়ান মুগীরাহ ইবনুল হারেছকে শিখিয়ে দিলেন যে, তুমি রাসূল (সাঃ)-এর সম্মুখে গিয়ে সেই কথাগুলি বল, যা ইউসুফের ভাইয়েরা তাঁকে বলেছিলেন-تَاللهِ لَقَدْ آثَرَكَ اللهُ عَلَيْنَا وَإِنْ كُنَّا لَخَاطِئِيْنَ ‘আল্লাহর কসম! আল্লাহ আপনাকে আমাদের উপরে প্রাধান্য দিয়েছেন এবং আমরা অবশ্যই অপরাধী ছিলাম’ (ইউসুফ ১২/৯১)। আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেছ তাই করলেন। আর সাথে সাথে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সেই জবাবই দিলেন, যা ইউসুফ (আঃ) তার ভাইদের দিয়েছিলেন- لاَ تَثْرَيْبَ عَلَيْكُمُ الْيَوْمَ يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِيْنَ ‘আজ তোমাদের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নেই। আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনি হলেন দয়ালুদের সেরা দয়ালু’ (ইউসুফ ১২/৯২)।
আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেছ ছিলেন আরবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি এবং রাসূল (সাঃ)-এর বড় চাচা হারেছ-এর পুত্র। তিনিও হালীমা সা‘দিয়াহর দুধ পান করেছিলেন। সেকারণে রাসূল (সাঃ) ছিলেন তার দুধ ভাই। অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাকে ক্ষমা করে দিলে খুশীতে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে নয় লাইনের একটি কবিতা পাঠ করেন। যার মধ্যে ৩য় লাইনে তিনি বলেন,
هَدَاني هادٍ غيرُ نفسي ودَلَّني * على الله مَنْ طَرَّدتُ كُلَّ مُطَرَّدٍ
‘আমার নফস ব্যতীত অন্য একজন পথপ্রদর্শক আমাকে পথ দেখিয়েছেন এবং আমাকে আল্লাহর পথের সন্ধান দিয়েছেন, যাকে সকল প্রকারের তিরষ্কারের মাধ্যমে আমি তাড়িয়ে দিতাম’। একথা শুনে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার বুকে থাবা মেরে বললেন, হ্যাঁ।أَنْتَ طَرَّدْتَنِيْ كُلَّ مُطَرَّدٍ ‘তুমিই তো আমাকে সর্বদা তাড়িয়ে দিতে’।[হাকেম হা/৪৩৫৯]
ইসলাম গ্রহণের পর থেকে তিনি কখনো লজ্জায় রাসূল (সাঃ)-এর সামনে মাথা উঁচু করে কথা বলতেন না। মক্কা বিজয়ের মাত্র ১৯ দিন পরে হোনায়েনের যুদ্ধে যে কয়জন সাহাবী রাসূল (সাঃ)-এর সাথে দৃঢ়ভাবে অবস্থান নিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্যতম। তিনি কোনমতেই রাসূল (সাঃ)-এর উটের লাগাম ছাড়েননি। তাঁর ছেলে জা‘ফর হোনায়েন যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। দুই ছেলে জা‘ফর ও আব্দুল্লাহ সাহাবী ছিলেন। রাসূল (সাঃ) তাকে খুবই ভালবাসতেন এবং বলতেন,أَرْجُو أَنْ يَكُوْنَ خَلَفًا مِنْ حَمْزَةَ ‘আশা করি তিনি হামযাহর স্থলাভিষিক্ত হবেন’। তিনি তার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দিয়েছিলেন। তিনি হোদায়বিয়ার সন্ধির প্রাক্কালে বায়‘আতুর রিযওয়ানে উপস্থিত ছিলেন। রাসূল (সাঃ)-এর ওফাতের পর তিনি যে ১০ লাইনের শোকগাথা পাঠ করেন, তা ছিল অতীব মর্মস্পর্শী ও হৃদয় বিদারক। ১৫ অথবা ২০ হিজরীতে তিনি ইন্তেকাল করেন। মৃত্যুকালে তিনি বলেন,لاَ تَبْكُوْا عَلَيَّ فَوَاللهِ مَا نَطَقْتُ بِخَطِيئَةٍ مُنْذُ أَسْلَمْتُ ‘আমার জন্য তোমরা কেঁদো না। আল্লাহর কসম! ইসলাম গ্রহণের পর হতে আমি কোন গোনাহের কথা বলিনি’ (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫২-৩৫৩)।
ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন আবু উমাইয়া, যিনি রাসূল (সাঃ)-এর ফুফু আতেকার পুত্র ছিলেন। ইনিই আবু ত্বালিবের মৃত্যুর সময় তাকে তার পিতৃধর্মের উপরে মৃত্যুর জন্য অন্যতম প্ররোচনা দানকারী ছিলেন। ইনিই সেই ব্যক্তি যিনি রাসূল (সাঃ)-কে বলেছিলেন, আমরা কখনোই তোমার উপরে ঈমান আনবো না, যতক্ষণ না তুমি আমাদের জন্য ভূমি থেকে ঝর্ণাধারা প্রবাহিত করে দিবে’ (ইসরা ১৭/৯০)। অতঃপর আল্লাহ তাকে হেদায়াত দান করেন এবং মক্কা বিজয়ের প্রাক্কালে তিনি ও আবু সুফিয়ান ইবনুল হারেছ ইসলাম কবুলের উদ্দেশ্যে মদীনায় হিজরত করেন। পথিমধ্যে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হয় এবং ইসলাম কবুল করেন।
প্রথম দিকে ইসলামের ঘোর দুশমন থাকলেও ইসলাম গ্রহণের পর সর্বক্ষণ রাসূল (সাঃ)-এর সহযোগী ছিলেন। তিনি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সাথে মক্কা বিজয়, হোনায়েন যুদ্ধ ও ত্বায়েফ যুদ্ধে যোগদান করেন এবং ত্বায়েফে শত্রুপক্ষের তীরের আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন।[4]

(৩) মার্রুয যাহরানে অবতরণ(النزول فى مر الظهران) : মক্কায় প্রবেশের আগের রাতে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মক্কা থেকে ৩০ কি.মি. পূর্বে মার্রুয যাহরান(مَرُّ الظَّهْرَانِ) উপত্যকায় অবতরণ করেন এবং প্রত্যেককে পৃথক পৃথকভাবে আগুন জ্বালাতে বলেন। তাতে সমগ্র উপত্যকা দশ হাযার অগ্নিপিন্ডের এক বিশাল আলোক নগরীতে পরিণত হয়। উমর ইবনুল খাত্ত্বাবকে তিনি পাহারাদার বাহিনীর প্রধান নিয়োগ করেন।
মক্কাবাসীদের উপরে আসন্ন বিপদ অাঁচ করে হযরত আববাস (রাঃ) অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি মনেপ্রাণে চাচ্ছিলেন যে, উপযুক্ত কোন লোক পেলে তিনি তাকে দিয়ে খবর পাঠাবেন যে, রাসূল (সাঃ)-এর মক্কায় প্রবেশের পূর্বেই যেন কুরায়েশ নেতারা অনতিবিলম্বে এসে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে আত্মসমর্পণ করে। অতঃপর তিনি রাসূল (সাঃ)-এর সাদা খচ্চরের উপরে সওয়ার হয়ে রাতের অাঁধারে বেরিয়ে পড়েন।

(৪) আবু সুফিয়ান গ্রেফতার(قبض أبى سفيان) : ভীত ও শংকিত কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান, হাকীম বিন হেযাম ও বনু খোযা‘আহ নেতা বুদাইল বিন ওয়ারক্বা মুসলমানদের খবর জানার জন্য রাত্রিতে ময়দানে বের হয়ে এসেছিলেন। তারা হঠাৎ গভীর রাতে দিগন্তব্যাপী আগুনের শিখা দেখে হতচকিত হয়ে পড়েন ও একে অপরে নানারূপ আশংকার কথা বলাবলি করতে থাকেন। এমন সময় হযরত আববাস (রাঃ) তাদের কণ্ঠস্বর চিনতে পারেন ও কাছে এসে বলেন, কি দেখছ, এগুলি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সেনাবাহিনীর জ্বালানো আগুন। একথা শুনে ভীত কম্পিত আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন,فَمَا الْحِيْلَةُ فِدَاك أَبِيْ وَأُمِّيْ ‘তোমার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হৌন- এখন বাঁচার উপায় কি? আববাস (রাঃ) বললেন,وَاللهِ لَئِنْ ظَفِرَ بِكَ لَيَضْرِبَنَّ عُنُقَكَ ‘আল্লাহর কসম! তোমাকে পেয়ে গেলে তিনি অবশ্যই তোমার গর্দান উড়িয়ে দেবেন’। অতএব এখুনি আমার খচ্চরের পিছনে উঠে বস এবং চলো রাসূল (সাঃ)-এর কাছে গিয়ে আমি তোমার জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করছি’। কোনরূপ দ্বিরুক্তি না করে আবু সুফিয়ান খচ্চরের পিছনে উঠে বসলেন এবং তার সাথী দু’জন ফিরে গেলেন।
রাসূল (সাঃ)-এর তাঁবুতে পৌঁছার আগ পর্যন্ত সকলে রাসূল (সাঃ)-এর সাদা খচ্চর ও তাঁর চাচা আববাসকে দেখে সসম্মানে পথ ছেড়ে দিয়েছে। উমরের নিকটে পৌঁছলে তিনি উঠে কাছে এলেন এবং পিছনে আবু সুফিয়ানকে দেখেই বলে উঠলেন,أَبُو سُفْيَانَ عَدُوُّ اللهِ ‘আবু সুফিয়ান, আল্লাহর দুশমন! আলহামদুলিল্লাহ কোনরূপ চুক্তি ও অঙ্গীকার ছাড়াই আল্লাহ তোমাকে আমাদের নাগালের মধ্যে এনে দিয়েছেন’। বলেই তিনি রাসূল (সাঃ)-এর তাঁবুর দিকে চললেন। আববাস (রাঃ) বলেন, আমিও দ্রুত খচ্চর হাঁকিয়ে দিলাম এবং তার আগেই রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে পৌঁছে গেলাম। অতঃপর তাঁর সম্মুখে বসে গেলাম। ইতিমধ্যে উমর এসে পৌঁছলেন এবং বললেন,يَا رَسُوْلَ اللهِ هَذَا أَبُوْ سُفْيَانَ فَدَعْنِيْ أَضْرِبْ عُنُقَهُ ‘হে আল্লাহর রাসূল! এই সেই আবু সুফিয়ান! আমাকে হুকুম দিন ওর গর্দান উড়িয়ে দেই’। আববাস (রাঃ) তখন রাসূল (সাঃ)-কে বললেন,يَا رَسُوْلَ اللهِ، إنِّيْ قَدْ أَجَرْتُهُ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি তাকে আশ্রয় দিয়েছি’। অতঃপর আমি রাসূল (সাঃ)-এর কাছে উঠে গিয়ে কানে কানে বললাম,وَاللهِ لاَ يُنَاجِيْهِ اللَّيْلَةَ أَحَدٌ دُوْنِيْ ‘আল্লাহর কসম! আমি ছাড়া অন্য কেউ আজ রাতে আপনার সাথে গোপনে কথা বলবে না’। এরপর উমর ও আববাসের মধ্যে কিছু বাক্য বিনিময় হয়। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, হে আববাস! এঁকে আপনার তাঁবুতে নিয়ে যান। সকালে ওঁকে নিয়ে আমার কাছে আসুন’।

(৫) আবু সুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণ(إسلام أبى سفيان) : সকালে তাঁর নিকটে গেলে তিনি আবু সুফিয়ানকে বললেন,وَيْحَكَ يَا أَبَا سُفْيَانَ أَلَمْ يَأْنِ لَكَ أَنْ تَعْلَمَ أَنْ لاَ إلَهَ إلاَّ اللهُ؟ ‘তোমার জন্য দুঃখ হে আবু সুফিয়ান! আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই, একথা উপলব্ধি করার সময় কি তোমার এখনো আসেনি’? আবু সুফিয়ান বললেন,بِأَبِيْ أَنْتَ وَأُمِّيْ مَا أَحْلَمَك وَأَكْرَمَك وَأَوْصَلَك لَقَدْ ظَنَنْتُ أَنْ لَوْ كَانَ مَعَ اللهِ إلَهٌ غَيْرُهُ لَقَدْ أَغْنَى شَيْئًا بَعْدُ ‘আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গীত হউন! আপনি কতইনা সহনশীল, কতই না সম্মানিত ও কতই না আত্মীয়তা রক্ষাকারী। আমি বুঝতে পেরেছি যে, যদি আল্লাহ ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য থাকত, তাহলে এতদিন তা আমার কিছু কাজে আসত’। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন,وَيْحَكَ يَا أَبَا سُفْيَانَ أَلَمْ يَأْنِ لَكَ أَنْ تَعْلَمَ أَنّيْ رَسُوْلُ اللهِ؟ ‘তোমার জন্য দুঃখ হে আবু সুফিয়ান! আমি যে আল্লাহর রাসূল একথা উপলব্ধি করার সময় কি তোমার এখনো আসেনি’? আবু সুফিয়ান বললেন, আপনার জন্য আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হৌন! আপনি কতই না সহনশীল, কতই না সম্মানিত এবং কতই না আত্মীয়তা রক্ষাকারী।أَمَّا هَذِهِ فَإِنَّ فِي النَّفْسِ حَتَّى الْآنَ مِنْهَا شَيْئًا ‘কেবল এই ব্যাপারটিতে আমার মনের মধ্যে এখনো কিছুটা সংশয় রয়েছে’। সঙ্গে সঙ্গে ধমকের সুরে আববাস (রাঃ) তাকে বললেন,وَيْحَكَ أَسْلِمْ وَاشْهَدْ أَنْ لآ إلَهَ إلاَّ اللهُ وَأَنَّ مُحَمَّدًا رَسُوْلُ اللهِ قَبْلَ أَنْ تُضْرَبَ عُنُقُكَ ‘তোমার ধ্বংস হৌক! গর্দান যাওয়ার পূর্বে ইসলাম কবুল কর এবং সাক্ষ্য দাও যে, আল্লাহ ব্যতীত কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মাদ আল্লাহর রাসূল’। সঙ্গে সঙ্গে আবু সুফিয়ান কালেমায়ে শাহাদাত পাঠের মাধ্যমে ইসলাম কবুল করলেন।
অতঃপর হযরত আববাস (রাঃ) বললেন, হে আল্লাহর রাসূল!إنَّ أَبَا سُفْيَانَ رَجُلٌ يُحِبُّ الْفَخْرَ فَاجْعَلْ لَهُ شَيْئًا ‘আবু সুফিয়ান গৌরব প্রিয় মানুষ। অতএব এ ব্যাপারে তাকে কিছু প্রদান করুন’। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন,نَعَم مَنْ دَخَلَ دَارَ أَبِيْ سُفْيَانَ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ أَغْلَقَ عَلَيْهِ بَابَهُ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ أَلْقَى السَّلاَحَ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ دَخَلَ الْمَسْجِدَ الْحَرَامَ فَهُوَ آمِنٌ ‘বেশ, যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি তার ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে, সে নিরাপদ থাকবে। যে ব্যক্তি অস্ত্র ফেলে দিবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে ব্যক্তি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে’।[মুসলিম হা/১৭৮০; মিশকাত হা/৬২১০]


মুসলিম বাহিনীর মার্রুয যাহরান ত্যাগ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
১৭ই রামাযান সোমবার সকালে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) মার্রুয যাহরান ত্যাগ করে মক্কায় প্রবেশের জন্য যাত্রা শুরু করলেন।[5] তিনি আববাসকে বললেন যে, আপনি আবু সুফিয়ানকে নিয়ে উপত্যকা থেকে বের হওয়ার মুখে সংকীর্ণ পথের পার্শ্বে পাহাড়ের উপরে দাঁড়িয়ে থাকবেন। যাতে সে মুসলিম বাহিনীর সংখ্যা ও শক্তি স্বচক্ষে দেখতে পারে। আববাস (রাঃ) তাই-ই করলেন। এরপর যখনই স্ব স্ব পতাকা সহ এক একটি গোত্র ঐ পথ অতিক্রম করে, তখনই আবু সুফিয়ান আববাসের নিকটে ঐ গোত্রের পরিচয় জিজ্ঞেস করেন। যেমন আসলাম, গেফার, জোহায়না, মুযায়না, বনু সোলায়েম ও অন্যান্য গোত্র সমূহ। কিন্তু আবু সুফিয়ান ঐসব লোকদের তেমন মূল্যায়ন না করে বলেন, এদের সাথে আমার কি সম্পর্ক? এরপরে যখন আনছার ও মুহাজির পরিবেষ্টিত হয়ে লোহার বর্ম পরিহিত অবস্থায় জাঁকজমকপূর্ণ পরিবেশে একটি বিরাট দলকে আসতে দেখলেন তখন আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ হে আববাস এরা কারা? আববাস (রাঃ) বললেন, মুহাজির ও আনছার বেষ্টিত হয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আসছেন’। আবু সুফিয়ান বিস্ময় ভরা কণ্ঠে বললেন,مَا لِأَحَدٍ بِهَؤُلاَءِ قِبَلٌ وَلاَ طَاقَةٌ ‘কারু পক্ষে এদের মুকাবিলার ক্ষমতা বা শক্তি হবে না’। অতঃপর বললেন,واللهِ يَا أَبَا الْفَضْلِ لَقَدْ أَصْبَحَ مُلْكُ ابْنِ أَخِيكَ الْيَوْمَ عَظِيمًا ‘আল্লাহর কসম, হে আবুল ফযল! তোমার ভাতিজার সাম্রাজ্য তো আজ অনেক বড় হয়ে গেছে’। আববাস (রাঃ) বললেন,يَا أَبَا سُفْيَانَ إنَّهَا النُّبُوَّةُ ‘হে আবু সুফিয়ান, এটা (রাজত্ব নয় বরং) নবুঅত’। আবু সুফিয়ান বললেন,نَعَمْ إِذَنْ ‘হ্যাঁ, তাহলে তাই’ (ইবনু হিশাম ২/৪০৪)।


সা‘দের পতাকা তার পুত্রের নিকট হস্তান্তর :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
এ সময় একটি ঘটনা ঘটে যায়। আনছারদের পতাকা ছিল খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ (রাঃ)-এর হাতে। তিনি ইতিপূর্বে ঐ স্থান অতিক্রম করার সময় আবু সুফিয়ানকে শুনিয়ে বলেন, الْيَوْمَ يَوْمُ الْمَلْحَمَةِ، الْيَوْمَ تُسْتَحَلُّ الْكَعْبَةُ ‘আজ হল মারপিটের দিন। আজ কা‘বাকে হালাল করা হবে’। অতঃপর রাসূল (সাঃ) ঐ স্থান অতিক্রম করার সময় আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি শুনেছেন সা‘দ কি বলেছে? জিজ্ঞেস করলেন কি বলেছে? তখন তাকে উক্ত কথা বলা হল। তখন রাসূল (সাঃ) বললেন,كَذَبَ سَعْدٌ، وَلَكِنْ هَذَا يَوْمٌ يُعَظِّمُ اللهُ فِيهِ الْكَعْبَةَ ‘সা‘দ মিথ্যা বলেছে। বরং আজ হল সেই দিন যেদিন আল্লাহ তা‘আলা কা‘বাকে সম্মানিত করবেন’ (বুখারী হা/৪২৮০)। তখন হযরত উসমান ও আব্দুর রহমান ইবনু ‘আওফ রাসূল (সাঃ)-কে বললেন, আমরা সা‘দের ব্যাপারে নিশ্চিন্ত নই। হয়ত সে কুরায়েশদের মারপিট শুরু করে দেবে’। একথা শুনে তিনি একজনকে পাঠিয়ে সা‘দের নিকট থেকে পতাকা নিয়ে তার পুত্র ক্বায়েসকে দিলেন। যাতে সে বুঝতে পারে যে, পতাকা তার হাত থেকে বাইরে যায়নি। তবে কেউ কেউ বলেন, পতাকাটি যুবায়ের (রাঃ)-কে প্রদান করা হয় (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫৬)।
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর অতিক্রম করে যাওয়ার পর হযরত আববাস (রাঃ) আবু সুফিয়ানকে বললেন, النَّجَاءُ إلَى قَوْمِكَ ‘তোমার কওমের দিকে দৌড়াও’। আবু সুফিয়ান অতি দ্রুত মক্কায় গিয়ে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলেন,يَا مَعْشَرَ قُرَيْشٍ هَذَا مُحَمَّدٌ قَدْ جَاءَكُمْ فِيْمَا لاَ قِبَلَ لَكُمْ بِهِ فَمَنْ دَخَلَ دَارَ أَبِيْ سُفْيَانَ فَهُوَ آمِنٌ- ‘হে কুরায়েশগণ! মুহাম্মাদ এসে গেছেন, যার মুকাবিলা করার ক্ষমতা তোমাদের নেই। অতএব যে ব্যক্তি আবু সুফিয়ানের গৃহে প্রবেশ করবে, সে নিরাপদ থাকবে’। এ ঘোষণা শুনে তার স্ত্রী হিন্দা এসে তার মোচ ধরে বলে ওঠেন, এই চর্বিওয়ালা শক্ত মাংসধারী মশকটাকে তোমরা মেরে ফেল। এরূপ দুঃসংবাদ দানকারীর মন্দ হৌক’! আবু সুফিয়ান বললেন, তোমরা সাবধান হও! এই মহিলা যেন তোমাদের ধোঁকায় না ফেলে। লোকেরা বলল, হে আবু সুফিয়ান! আপনার গৃহে কয়জনের স্থান হবে? তিনি বললেন, مَنْ أَغْلَقَ بَابَهُ فَهُوَ آمِنٌ وَمَنْ دَخَلَ الْمَسْجِدَ فَهُوَ آمِنٌ ‘যে ব্যক্তি তার নিজের ঘরের দরজা বন্ধ রাখবে, সে নিরাপদ থাকবে এবং যে ব্যক্তি মাসজিদুল হারামে প্রবেশ করবে, সেও নিরাপদ থাকবে’ (সহীহাহ হা/৩৩৪১)। একথা শোনার পর লোকেরা স্ব স্ব গৃহ এবং বায়তুল্লাহর দিকে দৌঁড়াতে শুরু করল। কিন্তু কিছু সংখ্যক নির্বোধ লোক ইকরিমা বিন আবু জাহল, সাফওয়ান বিন উমাইয়া, সোহায়েল বিন আমর প্রমুখের নেতৃত্বে মক্কার ‘খান্দামা’ (الْخَنْدَمَة) পাহাড়ের কাছে গিয়ে জমা হল মুসলিম বাহিনীকে বাধা দেওয়ার জন্য। এদের মধ্যে কুরায়েশ মিত্র বনু বকরের জনৈক বীর হিমাস বিন ক্বায়েস (حِمَاسُ بنُ قَيْس) ছিল। যে ব্যক্তি মুসলমানদের মুকাবিলার জন্য ধারালো অস্ত্র শান দিয়েছিল এবং মুসলমানদের ধরে এনে তার স্ত্রীর গোলাম বানাবার অহংকার প্রদর্শন করে স্ত্রীর সামনে কবিতা পাঠ করেছিল’।[যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫৬-৫৭, ইবনু হিশাম ২/৪০৭]


খান্দামায় মুকাবিলা ও হতাহতের ঘটনা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
মুসলিম বাহিনী খান্দামায় পৌঁছার পর ডান বাহুর সেনাপতি খালেদ বিন অলীদের সাথে তাদের মুকাবিলা হয়। তাতে ১২ জন নিহত হওয়ার পর তাদের মধ্যে পালানোর হিড়িক পড়ে যায়। কিন্তু এই সময় খালেদ বাহিনীর দু’জন শহীদ হন, যারা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন। তারা হলেন হুবাইশ বিন খালেদ বিন রাবী‘আহ এবং কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী। হুবাইশ ছিলেন খ্যাতনামা মহিলা উম্মে মা‘বাদের ভাই। কুরয আল-ফিহরী ছিলেন প্রথম মদীনার উপকণ্ঠে হামলাকারী। যিনি অনেকগুলি গবাদিপশু লুট করে নিয়ে আসেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বদরের কাছাকাছি সাফওয়ান উপত্যকা পর্যন্ত তাকে ধাওয়া করেও ব্যর্থ হন’।[6]
এসময় বনু বকরের সেই স্বঘোষিত মহাবীর হিমাস বিন ক্বায়েস ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌঁড়ে এসে স্ত্রীকে বলে ‘শীঘ্র দরজা বন্ধ কর’। স্ত্রী ঠাট্টা করে বলেন, কোথায় গেল তোমার সেই বীরত্ব? ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে সে সাড়ে তিন লাইন কবিতা বলল, যা ছিল খুবই সারগর্ভ ও অলংকারপূর্ণ। ‘কবিতা হল আরবদের রেজিষ্টার’(الشِّعرُ دِيوانُ العَرَبِ)। এর মধ্যেই তাদের ইতিহাস ও ঘটনাবলীর রেকর্ড থাকে। সেই সাথে পাওয়া যায় তাদের অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর। যেমন ঐ ভীতিপূর্ণ অবস্থায় আদৌ কবিখ্যাতি নেই এমন একজন সাধারণ আরব ঐ সময়ের অবস্থা বর্ণনা করে স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে চমৎকার কবিতা পাঠ করেছিল, তার তুলনা বিরল। কবিতাটিতে সে স্ত্রীর নিকটে পালিয়ে আসার কৈফিয়ত দিয়ে বলছে,
إنَّكِ لَوْ شَهِدْتِ يَوْمَ الْخَنْدَمَهْ + إذْ فَرَّ صَفْوَانُ وَفَرَّ عِكْرِمَهْ
وَأَبُو يَزِيدَ قَائِمٌ كَالْمُوتَمَهْ + وَاسْتَقْبَلَتْهُمْ بِالسُّيُوفِ الْمُسْلِمَهْ
يَقْطَعْنَ كُلَّ سَاعِدٍ وَجُمْجُمَهْ + ضَرْبًا فَلاَ يُسْمَعُ إلاَّ غَمْغَمَهْ
لَهُمْ نَهِيتٌ خَلْفَنَا وَهَمْهَمَهْ + لَمْ تَنْطِقِي فِي اللَّوْمِ أَدْنَى كَلِمَهْ
(১) ‘যদি তুমি খান্দামায় যুদ্ধের অবস্থা স্বচক্ষে দেখতে, যখন সাফওয়ান ও ইকরিমা উর্ধ্বশ্বাসে পালাচ্ছিলেন’। (২) ‘কুরাইশের খতীব আবু ইয়াযীদ বহু ইয়াতীম সন্তান নিয়ে বিপর্যস্ত বিধবা মহিলার মত দাঁড়িয়েছিল। আর খান্দামা পাহাড় তাদেরকে উন্মুক্ত তরবারিসমূহ নিয়ে অভ্যর্থনা জানাচ্ছিল’। (৩) ‘যেগুলি হাতের বাজু ও মাথার খুলিসমূহ তীব্র আঘাতে কচুকাটা করছিল। তখন কিছুই শোনা যাচ্ছিল না কেবল তাদের গুমগাম শব্দ ছাড়া’। (৪) ‘আমাদের পিছনে তখন কেবলই ছিল তাদের তর্জন-গর্জন ও হুমহাম শব্দ। এমতাবস্থায় তুমি আমাকে তিরষ্কারের কোন কথাই বলতে পারতে না’।[যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫৭, ইবনু হিশাম ২/৪০৮]
অতঃপর ডান বাহুর সেনাপতি খালেদ বিন অলীদ (রাঃ) আসলাম, সুলাইম, গেফার, মুযায়না, জুহায়না প্রভৃতি আরব গোত্র সমূহকে নিয়ে মক্কার নিম্নভূমি দিয়ে সাফা পাহাড়ে উপনীত হন। অন্যদিকে বামবাহুর সেনাপতি যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) মক্কার উপরিভাগ দিয়ে প্রবেশ করে হাজূন (حَجُون) নামক স্থানে অবতরণ করেন। অতঃপর সেখানে তিনি রাসূল (সাঃ)-এর জন্য তাঁবু প্রস্তুত করেন এবং রাসূল (সাঃ)-এর পতাকা গেড়ে দেন। যে স্থানটিতে এখন ‘বিজয় মসজিদ’(مسجد الفتح) অবস্থিত। একইভাবে আবু ওবায়দাহ ইবনুল জাররাহ (রাঃ) পদাতিক বাহিনী নিয়ে বাত্বনে ওয়াদীর পথ ধরে মক্কায় উপস্থিত হন। অতঃপর সবশেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেখানে পৌঁছে যান (আর-রাহীক্ব ৪০৩-০৪ পৃঃ)।[7]




[1]. ইমাম যুহরী (৫০-১২৪হিঃ) বলেন, মক্কা বিজয়ের সফরে রাসূল (সাঃ) রাস্তায় ১২ দিন(أَقَامَ فِي الطَّرِيقِ اثْنَيْ عَشَرَ يَوْمًا) অতিবাহিত করেন’ (ফাৎহুল বারী, ‘রামাযানে মক্কা বিজয়ের যুদ্ধ’ অনুচ্ছেদ; হা/৪২৭৫-এর আলোচনা)। সে হিসাবে মদীনা থেকে রওয়ানার তারিখ ৭ই রামাযান হয়। আল্লাহ সর্বাধিক অবগত।
[2]. তারীখু ত্বাবারী ৩/৪৪। এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, বনু বকর বনু খোযা‘আহকে তাড়িয়ে হারাম পর্যন্ত নিয়ে গেলে বনু বকরের লোকেরা তাদের নেতা নওফালকে বলল, আমরা এখন হারামে প্রবেশ করেছি। অতএব إلَهَكَ إلَهَكَ ‘তোমার প্রভুর দোহাই’ ‘তোমার প্রভুর দোহাই’। জবাবে নওফাল তাচ্ছিল্য ভরে ভয়ানক কথা বলে,لاَ إِلَهَ الْيَوْمَ يَا بَنِي بَكْرٍ ‘হে বনু বকর! আজ আর কোন প্রভু নেই’। অতঃপর বলল, তোমরা আজকে বদলা নিয়ে নাও। আমার জীবনের কসম! যদি তোমরা হারামে চুরি কর, তাহলে কি হারামে তার বদলা নিতে না?’ (আল-বিদায়াহ ৪/২৭৯; আর-রাহীক্ব ৩৯৪-৯৫; ইবনু হিশাম ২/৩৯০; যাদুল মা‘আদ ৩/৩৪৮; ফিক্বহুস সীরাহ ৩৭৪ পৃঃ, সনদ যঈফ)।
[3]. হাকেম হা/৪৩৫৯; ত্বাবারাণী কাবীর হা/৭২৬৪; সিলসিলা সহীহাহ হা/৩৩৪১; ইবনু হিশাম ২/৪০০, সনদ সহীহ; ঐ তাহকীক ক্রমিক ১৬৬৪। উল্লেখ্য যে, হাফেয ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) এখানে উম্মে সালামা (রাঃ)-এর কথা উদ্ধৃত করেছেন যে, তিনি রাসূল (সাঃ)-কে বলেন, এটি হওয়া উচিৎ নয় যে, আপনার চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই ও শ্বশুরকুলের লোকেরা আপনার নিকট সবচেয়ে হতভাগ্য হবে (أَشْقَى النَّاسِ بِكَ) (যাদুল মা‘আদ ৩/৩৫২, আর-রাহীক্ব ৩৯৯ পৃঃ)। কথাটি ওয়াক্বেদী (২/৮১০) সূত্রবিহীনভাবে বর্ণনা করেছেন।
[4]. আল-ইছাবাহ, আব্দুল্লাহ বিন আবু উমাইয়া ক্রমিক ৪৫৪৬।
[5]. মানছূরপুরী ৮ম হিজরীর ২০শে রামাযান বলেছেন (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১১৮, ২/৩৬৮)। যা ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের ১১ই জানুয়ারী বৃহস্পতিবার হয়। মুবারকপুরী ৮ম হিজরীর ১৭ই রামাযান মঙ্গলবার বলেছেন (আর-রাহীক্ব ৪০১ পৃঃ)। আধুনিক গণনায় ১৭ই রামাযান সোমবার হয়। আলোচনা দ্রষ্টব্য : ‘মক্কা বিজয়’ অধ্যায়, টীকা-৭৩২-৩৩।
[6]. আল-ইছাবাহ, হুবাইশ বিন খালেদ ক্রমিক ১৬০৯; কুরয বিন জাবের আল-ফিহরী ক্রমিক ৭৩৯৯; গাযওয়া সাফওয়ান ক্রমিক ৬।
[7]. এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, মক্কার নিম্নভূমি ‘যূ-তুওয়া’ (ذُو طُوَى) পৌঁছলে বিজয়ের স্পষ্ট লক্ষণ দেখে রাসূল (সাঃ) আল্লাহ প্রদত্ত বিজয়ের এই মহা সম্মান লাভে অত্যন্ত বিনীত হয়ে পড়েন এবং স্বীয় লাল চাদরের এক প্রান্ত ধরে হাওদার মাঝখানে মাথা নীচু করে দেন। যা তাঁর দাড়ি স্পর্শ করে’ (ইবনু হিশাম ২/৪০৫; আর-রাহীক্ব ৪০৩ পৃঃ)। বর্ণনাটির সনদ ‘যঈফ’ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৭২ পৃঃ)।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...