শনিবার, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

 

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যাত্মিক বিষয়গুলির মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মু‘জেযা হল তাঁর উপরে কুরআন নাযিল হওয়া। অতঃপর তাঁর মাধ্যমে কুরআনের ব্যাখ্যা হিসাবে হাদীছ বর্ণিত হওয়া।[1] অন্যান্য মু‘জেযা সমূহ তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে বিলুপ্ত হলেও কুরআন ও হাদীছ ক্বিয়ামত পর্যন্ত জীবন্ত মু‘জেযা হিসাবে অব্যাহত থাকবে। কুরআনের মত অনুরূপ একটি গ্রন্থ প্রণয়নের জন্য বা অনুরূপ একটি আয়াত আনয়নের জন্য জিন ও ইনসানের অবিশ্বাসী সমাজের প্রতি মক্কায় পাঁচবার ও মদীনায় একবার চ্যালেঞ্জ করে আয়াতসমূহ নাযিল হয়।[মক্কায় পাঁচবার হল, সূরা ইউনুস ১০/৩৮; হূদ ১১/১৩; ইসরা ১৭/৮৮; ক্বাছাছ ২৮/৪৯; তূর ৫২/৩৪। মদীনায় একবার হল, সূরা বাক্বারাহ ২/২৩] কিন্তু কেউ সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেনি। বস্ত্ততঃ কুরআনের প্রতিটি বাক্য, শব্দ ও বর্ণ আল্লাহ কর্তৃক সুরক্ষিত। ক্বিয়ামত পর্যন্ত যা নিরাপদ থাকবে।
আধ্যাত্মিক মু‘জেযার দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বিষয়টি হল রাসূল (সাঃ)-এর জীবন ও চরিত্র। যা অন্য যেকোন মানুষ থেকে অনন্য এবং সকল মানুষের জন্য অনুকরণীয়।[2]
তাঁর নবুঅতের বাহ্যিক প্রমাণ সমূহের মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হল, চন্দ্র দ্বিখন্ডিত হওয়া এবং মে‘রাজের ঘটনা।[বুখারী হা/৩৮৬৮-৬৯; মুসলিম হা/২৮০০] এছাড়াও অন্যতম আসমানী প্রমাণ হল, তাঁর দো‘আ করার সাথে সাথে মদীনা শহরে বৃষ্টি বর্ষিত হওয়া। অতঃপর লোকদের দাবীর প্রেক্ষিতে পুনরায় দো‘আ করার সাথে সাথে বৃষ্টি বন্ধ হওয়া।[বুখারী হা/১০১৩; মুসলিম হা/৮৯৭]

অতঃপর ইহজাগতিক মু‘জেযা সমূহের মধ্যে কিছু রয়েছে (ক) জড় জগতের সাথে সম্পর্কিত। যেমন পানির পাত্রে হাত দেওয়ার মাধ্যমে পানির প্রবাহ নির্গত হওয়া। খাদ্যের তাসবীহ পাঠ করা। বৃক্ষ হেটে আসা ও ছায়া করা। গাছ ও পাথর সিজদা করা। খাদ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হওয়া। মরা খেজুর গাছের খুঁটি ক্রন্দন করা ইত্যাদি।
অতঃপর (খ) প্রাণী জগতের সাথে সম্পর্কিত মু‘জেযা সমূহের মধ্যে রয়েছে বাচ্চা বকরীর পালানে দুধ আসা, নেকড়ের কথা বলা, উট কর্তৃক অভিযোগ পেশ করা ও সিজদা করা ইত্যাদি। এমনকি তাঁর ভক্ত গোলামের প্রতিও আল্লাহর হুকুমে ‘কারামত’ প্রকাশিত হয়েছে। যেমন তাঁর মৃত্যু পরবর্তীকালে রোমকদের বিরুদ্ধে একটি যুদ্ধে তাঁর মুক্তদাস সাফীনাহ বন্দী হলে সেখান থেকে পালিয়ে এসে অথবা যেকোন কারণে মূল বাহিনী থেকে বিচ্ছিন্ন হলে নিজের সেনাবাহিনীর সন্ধানে তিনি গভীর জঙ্গলে পথ হারিয়ে ফেলেন। এমন সময় একটি বাঘ তাঁর দিকে ধেয়ে আসে। তখন তিনি বলেন, হে আবুল হারেছ! ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর গোলাম। আমি এই এই সমস্যায় আছি’। তিনি বলেন, একথা শুনে বাঘটি মাথা নীচু করল এবং আমার পাশে এসে গা ঘেঁষতে লাগল। অতঃপর সে আমাকে পথ দেখিয়ে দীর্ঘ পথ হেঁটে সেনাবাহিনীর নিকট পৌঁছে দিল। বিদায়ের সময় সে হামহুম শব্দের মাধ্যমে আমাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল’।[হাকেম হা/৪২৩৫; মিশকাত হা/৫৯৪৯] যুগে যুগে পবিত্র কুরআন ও সহীহ হাদীছের অনুসারী প্রকৃত আল্লাহভীরু মুমিনগণকে আল্লাহ এভাবে হেফাযত করবেন ও সম্মানিত করবেন ইনশাআল্লাহ।




[1]. আল্লাহ বলেন, ‘রাসূল নিজ থেকে কোন কথা বলেন না’। ‘এটি তো কেবল অহি, যা তাঁর নিকটে প্রত্যাদেশ করা হয়’ (নাজম ৫৩/৩-৪)। কুরআন হেফাযতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে সূরা হিজর ১৫/৯ আয়াতে। অতঃপর কুরআন ও হাদীছ উভয়টির হেফাযতের প্রতিশ্রুতি রয়েছে সূরা ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৬-১৯ আয়াতে।
[2]. আল্লাহ বলেন, إِنَّكَ لَعَلَى خُلُقٍ عَظِيمٍ ‘নিশ্চয় তুমি মহান চরিত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত’ (ক্বলম ৬৮/৪)। তিনি আরও বলেন,لَقَدْ كَانَ لَكُمْ فِيُ رَسُوْلِ اللهِ أُسْوَةٌ حَسَنَةٌ لِمَنْ كَانَ يَرْجُو اللهَ وَالْيَوْمَ الْآخِرَ وَذَكَرَ اللهَ كَثِيْرًا ‘নিশ্চয়ই আল্লাহর রাসূলের মধ্যে তোমাদের জন্য উত্তম আদর্শ নিহিত রয়েছে, যে ব্যক্তি আল্লাহ ও শেষ দিবসকে কামনা করে ও অধিকহারে আল্লাহকে স্মরণ করে’ (আহযাব ৩৩/২১)।

মু‘জেযা সমূহ

 

মু‘জেযা সমূহ

রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মু‘জেযা সমূহ গণনা করা সম্ভব নয়। প্রসিদ্ধগুলি নিম্নরূপ:

(১) চন্দ্র দ্বিখন্ডিত করণ।[বুখারী হা/৩৮৬৮-৬৯; মুসলিম হা/২৮০০]
(২) মি‘রাজের ঘটনা।[বুখারী হা/৩৮৮৭; মুসলিম হা/১৬২]
(৩) কা‘বাগৃহে সালাতরত অবস্থায় মাথায় উটের ভুঁড়ি চাপানো যে সাত জনের বিরুদ্ধে তিনি বদ দো‘আ করেছিলেন, তাদের বদর যুদ্ধে নিহত হওয়া।[বুখারী হা/২৪০, ৫২০; মুসলিম হা/১৭৯৪]
(৪) কা‘বাগৃহে সালাতরত অবস্থায় রাসূল (সাঃ)-এর মাথা পা দিয়ে পিষে দেওয়ার জন্য এগিয়ে এলে আবু জাহল সম্মুখে অগ্নিগহবর দেখে ভয়ে পিছিয়ে যায়।[মুসলিম হা/২৭৯৭; মিশকাত হা/৫৮৫৬]
(৫) ইয়ামনের যেমাদ আযদী রাসূল (সাঃ)-কে জিনে ধরা রোগী মনে করে ঝাড়-ফুঁক করতে এলে তিনি তাঁর মুখে ইন্নাল হামদা লিল্লাহ, নাহমাদুহূ.. শুনে ইসলাম কবুল করেন।[মুসলিম হা/৮৬৮; মিশকাত হা/৫৮৬০]
(৬) মক্কায় একদিন আবুবকরকে সাথে নিয়ে রাসূল (সাঃ) কোথাও যাচ্ছিলেন। ইবনু মাসঊদ বলেন, তখন আমি উক্ববা বিন আবু মু‘আইতের বকরী চরাচ্ছিলাম। তিনি বললেন, হে বৎস! দুধ আছে কি? আমি বললাম, আছে। কিন্তু আমি তো আমানতদার মাত্র। তখন তিনি বললেন, বাচ্চা (নাবালিকা) ছাগীটি নিয়ে এস। অতঃপর আমি নিয়ে গেলে তিনি তার বাঁট ছুঁয়ে দিলেন। তখন দুধ নেমে আসে। ফলে তিনি ও আবুবকর পেট ভরে পান করেন। অতঃপর তিনি পুনরায় বাঁটে হাত দেন ও দুধ বন্ধ হয়ে যায়। যাওয়ার সময় তিনি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, হে বৎস! আল্লাহ তোমাকে অনুগ্রহ করুন’।[আহমাদ হা/৩৫৯৮, সনদ ‘হাসান’]
(৭) হিজরতের শুরুতে ছওর গিরিগুহায় অবস্থানকালে শত্রুর আগমন টের পেয়ে তিনি বলেন, আমরা দু’জন নই, তৃতীয় জন আমাদের সাথে আল্লাহ আছেন।[বুখারী হা/৩৬৫৩; মুসলিম হা/২৩৮১]
(৮) হিজরতকালে উম্মে মা‘বাদের রুগ্ন বকরীর শুষ্ক পালান দুধে ভরে যাওয়া।[হাকেম হা/৪২৭৪; মিশকাত হা/৫৯৪৩]
(৯) পিছু ধাওয়াকারী সুরাক্বা বিন মালেকের ঘোড়ার পাগুলি মাটিতে দেবে যাওয়া। অতঃপর ফিরে যাওয়া।[বুখারী হা/৩৬১৫; মিশকাত হা/৫৮৬৯]
(১০) হিজরতের পরপরই ইহূদী পন্ডিত আব্দুল্লাহ বিন সালামের তিনটি প্রশ্নের জওয়াব দেওয়া। যা নবী ব্যতীত কারু পক্ষে সম্ভব ছিল না।[বুখারী হা/৪৪৮০; মিশকাত হা/৫৮৭০]


(১১) হোদায়বিয়ার কূয়া থেকে এবং তাবূকের সফরে হাতের আঙ্গুল সমূহ থেকে শুষ্ক ঝর্ণায় পানির প্রবাহ নির্গমন।[বুখারী হা/৩৫৭৬, ৪১৫০; মুসলিম হা/৭০৬ (১০)]
(১২) অন্য এক সফরে তৃষ্ণার্ত হলে সওয়ারী এক মহিলার দু’টি মশক থেকে পানি নিয়ে একটি পাত্রে ঢালেন। অতঃপর তা থেকে সাথী ৪০ জন ও সওয়ারীর পশুগুলি পান করে। অতঃপর সমস্ত পাত্র ভরে নেওয়া হয়। এরপরেও মহিলাকে তার মশক দু’টি পূর্ণভাবে পানি ভর্তি অবস্থায় ফেরৎ দেওয়া হয়।[বুখারী হা/৩৫৭১; মিশকাত হা/৫৮৮৪]
(১৩) একবার মদীনার ‘যাওরা’ বাজারে রাসূল (সাঃ) একটি পানির পাত্রে হাত রাখলে আঙ্গুল সমূহের ফাঁক দিয়ে এত বেশী পানি প্রবাহিত হয় যে, ৩০০ বা তার কাছাকাছি মানুষ তা পান করে পরিতৃপ্ত হয়।[বুখারী হা/৩৫৭২; মিশকাত হা/৫৯০৯]
(১৪) মসজিদে নববীতে দূরাগত মুছল্লীদের ওযূর পানিতে কমতি হলে রাসূল (সাঃ) ছোট্ট একটি পাত্রে হাত ডুবিয়ে দেন। অতঃপর তা থেকে ৮০ জনের অধিক মুছল্লী ওযূ করেন (বুখারী হা/১৯৫)।
(১৫) মসজিদে নববীতে মিম্বর স্থাপিত হলে রাসূল (সাঃ) ইতিপূর্বে খেজুর গাছের যে খুঁটিতে ঠেস দিয়ে খুৎবা দিতেন, সেটি ত্যাগ করে মিম্বরে বসেন। তখন খুঁটিটি শিশুর মত চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকে। রাসূল (সাঃ) নীচে নেমে তার গায়ে হাত বুলিয়ে দিলে সে থেমে যায়।[বুখারী হা/৩৫৮৪-৮৫; মিশকাত হা/৫৯০৩] তিনি বলেন, যদি আমি তাকে বুকে টেনে আদর না করতাম, তাহলে সে ক্বিয়ামত পর্যন্ত এভাবেই কাঁদতে থাকত।[ইবনু মাজাহ /১৪১৫; সহীহাহ হা/২১৭৪]
(১৬) গাছ ও পাথরের সিজদা করা।[তিরমিযী হা/৩৬২০; মিশকাত হা/৫৯১৮]
(১৭) বৃক্ষের হেঁটে চলে আসা ও পুনরায় তার স্থানে ফিরে যাওয়া [আহমাদ হা/১২১৩৩; মিশকাত হা/৫৯২৪] এবং দু’টি গাছ একত্রিত হয়ে তাঁর জন্য নীচু হয়ে তাঁর হাজত সারার জন্য আড়াল করা।[মুসলিম হা/৩০১২; মিশকাত হা/৫৮৮৫]
(১৮) বদর যুদ্ধের দিন মুশরিক নেতাদের নিহত হওয়ার স্থান সমূহ নির্দেশ করা।[মুসলিম হা/১৭৭৯ (৮৩); মিশকাত হা/৫৮৭১]
(১৯) ঐ দিন ঘোড় সওয়ার ফেরেশতা কর্তৃক তার ঘোড়ার প্রতি নির্দেশ ‘হায়যূম! আগে বাড়ো’ বলার পরেই নিহত শত্রুর পতন হওয়া।[মুসলিম হা/১৭৬৩ (৫৮); মিশকাত হা/৫৮৭৪]
(২০) ওহুদের যুদ্ধে রাসূল (সাঃ)-এর ডাইনে ও বামে সাদা পোষাকধারী দু’জন ব্যক্তির যুদ্ধ করা’। যারা ছিলেন জিবরাঈল ও মীকাঈল।[বুখারী হা/৫৮২৬; মিশকাত হা/৫৮৭৫]


(২১) তাঁর উম্মৎ সাগরে নৌযুদ্ধে গমন করবে এবং উম্মে হারাম হবেন তাদের অন্যতম। মু‘আবিয়া (রাঃ) ও ইয়াযীদের মাধ্যমে তা বাস্তবায়িত হয়।[বুখারী হা/২৭৮৮-৮৯; মুসলিম হা/১৯১২]
(২২) রোমকরা পরাজিত হলে তিনি বলেন, কয়েক বছরের মধ্যেই রোমকরা বিজয়ী হবে
(২৩) রোম ও পারস্য সাম্রাজ্য বিজিত হবে। উমর ও উসমান (রাঃ)-এর সময় যা বাস্তবায়িত হয়।
(২৪) হাসান বিন আলীর মাধ্যমে মুসলমানদের বিবদমান দু’টি বড় দলের মধ্যে সন্ধি হবে। হাসান (রাঃ)-এর খেলাফত ত্যাগ ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর খেলাফত গ্রহণের মাধ্যমে যা বাস্তবায়িত হয়।
(২৫) নাজাশীর মৃত্যুর দিন মদীনায় সাহাবীদের উক্ত খবর দেওয়া এবং গায়েবানা জানাযা পড়া
(২৬) ভন্ডনবী আসওয়াদ ‘আনাসী আজ রাতে ইয়ামনে নিহত হবে এবং তা বাস্তবায়িত হওয়া
(২৭) খন্দক যুদ্ধে পরিখা খননকালে শক্ত পাথর তাঁর কোদালের আঘাতে গুঁড়া হয়ে বালুর স্তূপে পরিণত হওয়া।[বুখারী হা/৪১০২; মুসলিম হা/২০৩৯]
(২৮) আরেকটি পাথরে আঘাত করার পর তার একাংশ ভেঙ্গে পড়লে তিনি বলেন ওঠেন, আল্লাহু আকবর! আমাকে পারস্যের সাম্রাজ্য দান করা হয়েছে...
(২৯) তিন দিন না খেয়ে পেটে পাথর বাঁধা ক্ষুধার্ত রাসূল-কে খাওয়ানোর জন্য সাহাবী জাবের (রাঃ) একটি বকরীর বাচ্চা যবেহ করলেন এবং তাঁর স্ত্রী এক ছা‘ (আড়াই কেজি) যব পিষে আটা তৈরী করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তখন ঐ সময় পরিখা খননরত ১০০০ সাহাবীর সবাইকে সাথে নিয়ে আসেন। অতঃপর সকলে তৃপ্তির সাথে খাওয়ার পরেও আগের পরিমাণ আটা ও গোশত অবশিষ্ট থেকে যায়।[বুখারী হা/৪১০২; মুসলিম হা/২০৩৯]
(৩০) ক্ষুধার কষ্টে রাসূল (সাঃ)-এর কণ্ঠস্বর দুর্বল বুঝতে পেরে সাহাবী আবু ত্বালহা স্ত্রী উম্মে সুলায়েম-কে বললে তিনি তাঁর জন্য কয়েকটি রুটি কাপড়ে জড়িয়ে পুত্র আনাসকে দিয়ে গোপনে পাঠিয়ে দেন। পরে রাসূল (সাঃ) সকল সাথীকে নিয়ে আবু ত্বালহার বাড়ীতে আসেন। অতঃপর রুটিগুলি টুকরা টুকরা করেন এবং বিসমিল্লাহ বলে ১০ জন করে সবাইকে খেতে বলেন। দেখা গেল ৮০ জন খাওয়ার পরেও আরও উদ্বৃত্ত রইল’।[বুখারী হা/৫৪৫০; মুসলিম হা/২০৪০] মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে, রুটিগুলি দুই মুদ বা অর্ধ মুদ যবের আটার তৈরী ছিল।[আহমাদ হা/১৩৪৫২, ১২৫১৩]


(৩১) ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, আমি রাসূল (সাঃ)-এর সাথে খাদ্য ভক্ষণ অবস্থায় (কখনো কখনো) তার তাসবীহ শুনতে পেতাম’।[মিশকাত হা/৫৯১০]
(৩২) (ক) এক সফরে একটি উট এসে রাসূল (সাঃ)-এর নিকট অভিযোগ পেশ করে। তখন তিনি মালিককে ডেকে বলেন, এই উটের কাছ থেকে অধিক কাজ নেওয়া হয় এবং তাকে খাদ্য কম দেওয়া হয়। অতএব এর সঙ্গে সদাচরণ কর। (খ) কিছু দুর গিয়ে এক স্থানে রাসূল (সাঃ) ঘুমিয়ে পড়লেন। তখন মাটি ফুঁড়ে একটি গাছ উঠে এসে তাঁকে ছায়া করল। অতঃপর চলে গেল। (গ) অতঃপর কিছু দুর গিয়ে একটি ঝর্ণার নিকটে একজন মহিলা তার জিনে ধরা ছেলেকে নিয়ে আসল। রাসূল (সাঃ) তার নাক ধরে বললেন, বেরিয়ে যাও! আমি আল্লাহর রাসূল মুহাম্মাদ’। ফেরার পথে উক্ত মহিলাটি তার ছেলের সুস্থতার কথা জানালো’।[দারেমী হা/১৭; মাজমাউয যাওয়ায়েদ হা/১৪১৬৮; মিশকাত হা/৫৯২২] আনাস (রাঃ) কর্তৃক অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, আনছারদের একটি বাগিচায় গেলে উট এসে তাঁর সামনে সিজদায় পড়ে যায়।[আহমাদ হা/১২৬৩৫; সহীহ ইবনু হিববান হা/৪১৬২]
(৩৩) ৫ম হিজরীতে খন্দক যুদ্ধে পরিখা খননের সময় ‘আম্মার বিন ইয়াসিরকে তিনি বলেন, ‘হে ‘আম্মার! জান্নাতের সুসংবাদ গ্রহণ কর। তোমাকে বিদ্রোহী দল হত্যা করবে’।[মুসলিম হা/২৯১৫; মিশকাত হা/৫৮৭৮] অতঃপর তিনি ৩৭ হিজরীতে আলী ও মু‘আবিয়া (রাঃ)-এর মধ্যে সংঘটিত ছিফফীন যুদ্ধে আলী (রাঃ)-এর পক্ষে যুদ্ধ করা অবস্থায় ৯৩ বছর বয়সে শহীদ হন’।[আল-ইছাবাহ, ‘আম্মার ক্রমিক ৫৭০৮]
(৩৪) ইহূদী নেতা সালাম ইবনুল হুক্বাইক্ব-কে হত্যা শেষে আবু রাফে‘ দুর্গ থেকে ফেরার সময় আব্দুল্লাহ বিন আতীকের এক পা ভেঙ্গে যায়। পরে তাতে হাত বুলিয়ে দেওয়ার পর তিনি সাথে সাথে পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান (বুখারী হা/৪০৩৯)।
(৩৫) তোমরা সত্ত্বর মাসজিদুল হারামে বিজয়ী বেশে প্রবেশ করবে বলে স্বপ্ন বর্ণনা। যা হোদায়বিয়ার সন্ধি ও পরবর্তীতে মক্কা বিজয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।
(৩৬) পারস্যরাজ কিসরা তাঁর চিঠি ছিঁড়ে ফেললে তিনি বলেন, তার সাম্রাজ্যকে ছিন্নভিন্ন করুন।
(৩৭) কিসরার গবর্ণর প্রেরিত দূতদ্বয়কে তাদের সম্রাট আজ রাতেই নিহত হবে বলে খবর দেওয়া এবং তা সত্যে পরিণত হওয়া (সহীহাহ হা/১৪২৯)।
(৩৮) খায়বর যুদ্ধে আহত সালামা বিন আকওয়া‘ পায়ে আঘাত প্রাপ্ত হলে রাসূল (সাঃ) সেখানে তিনবার থুক মারেন। তাতে তিনি সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হয়ে যান।[বুখারী হা/৪২০৬; মিশকাত হা/৫৮৮৬]
(৩৯) খায়বর যুদ্ধে বিজয়ের দিন সকালে তিনি বলেন, আজ আমি যার হাতে পতাকা দিব, তার হাতেই বিজয় আসবে। পরে চোখের অসুখে কাতর আলীকে ডেকে এনে তার চোখে হাত বুলিয়ে দেন। তাতে তিনি সুস্থ হয়ে যান। অতঃপর খায়বরের শ্রেষ্ঠ না‘এম দুর্গ জয় করেন।[বুখারী হা/২৯৪২, ৩৭০১; মুসলিম হা/২৪০৬]
(৪০) মুতার যুদ্ধে গমনের সময় তিনি সেনাপতি যায়েদ, জা‘ফর ও আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা-এর আগাম শাহাদাতের খবর দেন। অতঃপর যুদ্ধের ময়দানে তাঁদের শাহাদাতের পর মদীনায় দাঁড়িয়ে অশ্রুসজল চোখে সবাইকে তিনি খবর দেন এবং খালেদ বিন অলীদের হাতে যুদ্ধ জয়ের সুসংবাদ দেন।[মিশকাত হা/৫৮৮৭; বুখারী হা/৪২৬২]


(৪১) হোনায়েন যুদ্ধে সংকটকালে তিনি এক মুষ্ঠি বালু শত্রুদের দিকে ছুঁড়ে মারেন। তাতে সবাই পালিয়ে যায়।[মুসলিম হা/১৭৭৭ (৮১); মিশকাত হা/৫৮৯১]
(৪২) একই যুদ্ধে মুসলিম পক্ষের জনৈক দুর্ধর্ষ যোদ্ধাকে তিনি বলেন, এই ব্যক্তি জাহান্নামী। পরে দেখা গেল তিনি আত্মহত্যা করে মারা গেলেন।[বুখারী হা/৬৬০৬; মিশকাত হা/৫৮৯২]
(৪৩) মদীনার লাবীদ বিন আ‘ছাম তার মাথার চুল ও চিরুনীতে জাদু করেন। পরে ঘুমন্ত অবস্থায় তার নিকটে দু’জন ব্যক্তি এসে বলেন, ‘যারওয়ান’ কূয়ার নীচে সেটি পাথর চাপা দেওয়া আছে। পরে সেখান থেকে সেটি বের করা হয়।[বুখারী হা/৫৭৬৫; মুসলিম হা/২১৮৯]
(৪৪) হোনায়েন যুদ্ধে গণীমত বণ্টনকালে তাঁর প্রতি ক্ষোভ প্রকাশকারী যুল-খুওয়াইছেরাহ-কে লক্ষ্য করে তিনি বলেন, তার অনুসারী একদল লোক হবে, যাদের সালাত, সিয়াম ও তেলাওয়াত তোমাদের চাইতে উত্তম হবে। এরা ইসলাম থেকে বেরিয়ে যাবে, যেমন তীর ধনুক থেকে বেরিয়ে যায়।[বুখারী হা/৩৩৪৪; মুসলিম হা/১০৬৪] পরবর্তীতে চরমপন্থী খারেজী দলের উদ্ভব উক্ত ছিল ভবিষ্যদ্বাণীরই বাস্তবতা।
(৪৫) আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর দাবীক্রমে তিনি বলেন, চাদর বিছিয়ে দাও। অতঃপর তিনি তাতে দো‘আ করে ফুঁক দিলেন। তাতে তিনি আর কোনদিন হাদীছ ভুলে যাননি।[বুখারী হা/২৩৫০; মুসলিম হা/২৪৯৩]
(৪৬) খরায় আক্রান্ত মদীনায় বৃষ্টির জন্য দো‘আ চাইলে তিনি দো‘আ করেন। ফলে প্রচুর বৃষ্টিতে মদীনার রাস্তা-ঘাট ডুবে যেতে থাকে। তখন তিনি পুনরায় দো‘আ করেন। ফলে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে যায়।[বুখারী হা/১০১৩; মিশকাত হা/৫৯০২]
(৪৭) তাবূক যুদ্ধে গমনের সময় যুল-বিজাদায়েনকে তিনি বলেন, তুমি যদি প্রচন্ড জ্বরে মারা যাও, তাতেও তুমি শহীদ হিসাবে গণ্য হবে। পরে তাবূক পৌঁছে তিনি জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।[তাহকীক ইবনু হিশাম ক্রমিক ১৮৮৭]
(৪৮) ফাযালাহ বিন ওবায়েদ (রাঃ) বলেন, তাবূক থেকে ফেরার পথে আমাদের উটগুলি কষ্টে হাসফাস করতে থাকে। তখন রাসূল (সাঃ) দো‘আ করেন। ফলে মদীনায় আসা পর্যন্ত তারা সবল থাকে’ (আহমাদ হা/২৪০০১, হাদীছ সহীহ)।
(৪৯) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) বলেন, নেকড়ে একটি বকরীকে ধরে নিল। তখন রাখাল সেটি ছিনিয়ে নিল। নেকড়ে বলল, তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না? তুমি আমার রিযিক ছিনিয়ে নিলে। যা আল্লাহ আমার জন্য পাঠিয়েছিলেন। রাখাল বলল, কি আশ্চর্য! আমার সঙ্গে নেকড়ে মানুষের মত কথা বলছে। তখন নেকড়ে বলল, আমি কি তোমার নিকটে এর চাইতে বিস্ময়কর খবর দিব না? মুহাম্মাদ ইয়াছরিবে এসেছেন। তিনি মানুষকে গায়েবের খবর দিচ্ছেন। তখন রাখালটি দ্রুত মদীনায় প্রবেশ করল এবং এসে দেখল রাসূল (সাঃ) সমবেত মুছল্লীদের উদ্দেশ্যে বলছেন, অতদিন ক্বিয়ামত হবে না, যতদিন না পশুরা মানুষের সাথে কথা বলবে (আহমাদ হা/১১৮০৯, হাদীছ সহীহ)।
(৫০) একদিন তিনি আবুবকর, উমর ও উসমানকে সাথে নিয়ে ওহুদ পাহাড়ে ওঠেন। ফলে পাহাড়টি কেঁপে ওঠে। তখন তিনি পা দিয়ে আঘাত করে বলেন, হে পাহাড়! থাম। তোমার উপরে একজন নবী, একজন ছিদ্দীক্ব ও দু’জন শহীদ আছেন’।[বুখারী হা/৩৬৮৬; মিশকাত হা/৬০৭৪] অন্য বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সাঃ) উসমানকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আল্লাহ তোমাকে পোষাক পরাবেন। যদি মুনাফিকরা সেই পোষাক খুলে নিতে চায়, তাহলে তুমি কখনই তা তাদেরকে খুলে দিয়ো না। একথা তিনি তিনবার বলেন’।[তিরমিযী হা/৩৭০৫; ইবনু মাজাহ হা/১১২; মিশকাত হা/৬০৬৮] বস্ত্ততঃ এই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে যায়।

পরিশিষ্ট

 

পরিশিষ্ট

১. অহি লেখকগণ :
━━━━━━━━━━━
যায়েদ বিন সাবিত (রাঃ) ছিলেন অহি লেখকগণের মধ্যে সর্বাগ্রগণ্য। সেকারণ কুরআন জমা করার সময় উসমান (রাঃ) তাঁকেই এ গুরুদায়িত্ব প্রদান করেন (বুখারী হা/৪৬৭৯, ৪৯৭৯)। তিনি ব্যতীত আরও অনেক সাহাবী বিভিন্ন সময়ে এ মহান দায়িত্ব আঞ্জাম দিয়েছেন।
ইবনু হাজার আসক্বালানী (রহঃ) বলেন, অহি নাযিলের শুরু থেকে মক্কায় অহি লেখকদের মধ্যে সর্বপ্রথম ছিলেন উসমান (রাঃ)-এর দুধভাই (১) আব্দুল্লাহ বিন সা‘দ বিন আবু সারাহ। ইনি পরে ‘মুরতাদ’ হয়ে যান। অতঃপর মক্কা বিজয়ের দিন পুনরায় মুসলমান হন। অতঃপর বিভিন্ন সময়ে অহি লেখক ছিলেন (২) আবুবকর (৩) উমর (৪) উসমান (৫) আলী (৬) যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (৭) খালেদ বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ ও তাঁর ভাই (৮) আবান বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ (৯) হানযালা বিন রবী‘ আসাদী (১০) মু‘আইক্বীব বিন আবু ফাতেমা দাওসী (১১) আব্দুল্লাহ বিন আরক্বাম যুহরী (১২) শুরাহবীল বিন হাসানাহ কুরায়শী (১৩) আব্দুল্লাহ বিন রাওয়াহা আনছারী।
মদীনায় প্রথম অহি লেখক ছিলেন (১৪) উবাই বিন কা‘ব। অতঃপর (১৫) যায়েদ বিন সাবিত। তিনি অনুপস্থিত থাকলে অন্যেরা লিখতেন’ (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)।[1] (১৬) এছাড়া বনু নাজ্জারের জনৈক ব্যক্তি, যে খ্রিষ্টান হয়ে যায়। অতঃপর মুসলমান হন।[বুখারী হা/৩৬১৭; মুসলিম হা/২৭৮১]


২. অন্যান্য বিষয়ে লেখকগণ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
(১) আবু সালামাহ মাখযূমী (২) আরক্বাম বিন আবুল আরক্বাম (৩) ‘আমের বিন ফুহায়রাহ (৪) ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ (৫) হাত্বেব বিন ‘আমর আবু বালতা‘আহ (৬) আব্দুল্লাহ বিন আবুবকর (৭) আবু আইয়ূব আনছারী (৮) বুরায়দাহ বিন হুছাইব আসলামী (৯) হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামান (১০) মু‘আয বিন জাবাল (১১) জনৈক আনছার আবু ইয়াযীদ (১২) সাবেত বিন ক্বায়েস বিন শাম্মাস (১৩) আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন ‘আব্দে রবিবহি (১৪) মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহ (১৫) আব্দুল্লাহ বিন আব্দুল্লাহ বিন উবাই (১৬) খালেদ বিন অলীদ (১৭) ‘আমর ইবনুল ‘আছ (১৮) মুগীরাহ বিন শো‘বা ছাক্বাফী (১৯) জুহাম বিন সা‘দ (২০) জুহাইম বিন ছালত (২১) হুছায়েন বিন নুমায়ের (২২) হুয়াইত্বিব বিন আব্দুল ‘উযযা (২৩) সাঈদ বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ (২৪) জা‘ফর বিন আবু ত্বালিব (২৫) হানযালা বিন রবী‘ ও তার ভাই (২৬) রাবাহ ও চাচা (২৭) আকছাম বিন ছায়ফী তামীমী (২৮) ‘আলা ইবনুল হাযরামী (২৯) ‘আলা বিন উক্ববাহ (৩০) আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (৩১) আবু সুফিয়ান বিন হারব (৩২) ঐ পুত্র ইয়াযীদ বিন আবু সুফিয়ান ও (৩৩) মু‘আবিয়া বিন আবু সুফিয়ান রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম।[2] এতদ্ব্যতীত (৩৪) আব্দুল্লাহ বিন আমর ইবনুল ‘আছ যিনি হাদীছ লিখনে প্রসিদ্ধ ছিলেন।
লেখকগণের মধ্যে মদীনায় যাঁরা বিশেষ বিশেষ কাজে প্রসিদ্ধ ছিলেন তাঁরা হলেন, (১) অহি লিখনে আলী, উসমান, উবাই বিন কা‘ব এবং যায়েদ বিন সাবেত। (২) বাদশাহ ও আমীরদের নিকটে পত্র লিখনে যায়েদ বিন সাবেত। (৩) চুক্তি লিখনে আলী ইবনু আবী তালেব। (৪) মানুষের বিভিন্ন প্রয়োজন সমূহ লিখনে মুগীরাহ বিন শো‘বা। (৫) ঋণচুক্তিসমূহ লিখনে আব্দুল্লাহ বিন আরক্বাম। (৬) গণীমতসমূহ নিবন্ধনে মু‘আইকীব। কোন লেখক অনুপস্থিত থাকলে হানযালা বিন রবী‘ লেখকের দায়িত্ব পালন করতেন। সেজন্য তিনি হানযালা আল-কাতেব নামে প্রসিদ্ধ ছিলেন।[3]
এঁদের মধ্যে (১) খালেদ বিন সাঈদ ছিলেন আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর পরে ইসলাম কবুলকারী ৩য়, ৪র্থ অথবা ৫ম ব্যক্তি। কারণ হিসাবে বর্ণিত হয়েছে যে, একদিন তিনি স্বপ্নে দেখেন যে, তিনি জাহান্নামের কিনারে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পিতা তাকে সেদিকে ঠেলে দিচ্ছেন। পক্ষান্তরে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার হাত টেনে ধরেছেন, যাতে তিনি জাহান্নামে নিক্ষিপ্ত না হন। পরদিন এ স্বপ্ন আবুবকর (রাঃ)-কে বললে তিনি বলেন, এটি শুভ স্বপ্ন। ইনিই আল্লাহর রাসূল। অতএব তুমি তাঁর অনুসরণ কর। তাহলে জাহান্নাম থেকে মুক্তি পাবে। যার ভয় তুমি করছ’। অতঃপর তিনি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট আসেন ও ইসলাম কবুল করেন। এ খবর জানতে পেরে তার পিতা তাকে লাঠিপেটা করেন, খানা-পিনা বন্ধ করে দেন ও তাকে বাড়ী থেকে বের করে দেন। পরবর্তীতে তিনি হাবশায় হিজরত করেন। অতঃপর হাবশা থেকে জা‘ফরের সাথে খায়বরে আসেন ও রাসূল (সাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ত্বায়েফবাসীদের সাথে সন্ধির সর্বাত্মক চেষ্টা করেন। পরে সেখান থেকে আগত ছাক্বীফ প্রতিনিধি দলের সাথে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর পক্ষে চুক্তিনামা লিপিবদ্ধ করেন। আবুবকর ছিদ্দীক (রাঃ)-এর খেলাফতকালে তিনি শামের আজনাদাইন যুদ্ধে শহীদ হন।
(২) ‘আমের বিন ফুহায়রা আবুবকর (রাঃ)-এর মুক্তদাস ছিলেন। হিজরতকালে তিনি রাসূল (সাঃ)-এর সাথী ছিলেন। পথিমধ্যে পিছু ধাওয়াকারী সুরাক্বাহ বিন মালেক মুদলেজী-কে রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশে তিনি একটি ‘নিরাপত্তানামা’ (كِتَابُ أَمْنٍ) লিখে দেন। ৪র্থ হিজরীতে বি’রে মাঊনা-র মর্মান্তিক ঘটনায় তিনি শহীদ হন।
(৩) আরক্বাম বিন আবুল আরক্বাম মাখযূমী (রাঃ) প্রথম দিকের ৭ম বা ১০ম মুসলমান ছিলেন। সাফা পাহাড়ে তাঁর গৃহে রাসূল (সাঃ) ইসলামের প্রচার কেন্দ্র স্থাপন করেন। যা ‘দারুল আরক্বাম’ (دَارُ الْأَرْقَمِ) নামে পরিচিত হয়। তিনি ৫৩ অথবা ৫৫ হিজরীতে ৮৫ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন (আল-ইছবাহ, আরক্বাম ক্রমিক ৭৩)।
(৪) আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ বিন ‘আব্দে রবিবহী বায়‘আতে কুবরা-য় শরীক ছিলেন। তাঁর সবচেয়ে উচ্চ মর্যাদা ছিল এই যে, তিনিই প্রথম আযানের স্বপ্ন দেখেন এবং রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে ‘সত্যস্বপ্ন’ (إِنَّهَا لَرُؤْيَا حَقٌّ) বলে আখ্যায়িত করেন এবং আল্লাহর প্রশংসা জ্ঞাপন করে বলেন, ফালিল্লাহিল হাম্দ(فََلِلَّهِ الْحَمْدُ) । অতঃপর বেলালের মাধ্যমে তা চালু করে দেন (আবুদাঊদ হা/৪৯৯)। তিনি ৩২ হিজরীতে ৬৪ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। খলীফা উসমান (রাঃ) স্বয়ং তাঁর জানাযায় ইমামতি করেন (আল-ইছাবাহ, আব্দুল্লাহ বিন যায়েদ ক্রমিক ৪৬৮৯)।
(৫) আব্দুল্লাহ সা‘দ বিন আবু সারাহ উসমান বিন ‘আফফান (রাঃ)-এর দুধভাই ছিলেন। উসমানের মা তাঁকে দুধ পান করিয়েছিলেন। তিনি অহি লিখতেন। কিন্তু পরে ‘মুরতাদ’ হয়ে যান। মক্কা বিজয়ের দিন রাসূল (সাঃ) যাদের রক্ত বৃথা ঘোষণা করেন, তিনি ছিলেন তাদের অন্তর্ভুক্ত। পরে তিনি উসমান (রাঃ)-এর নিকটে এসে আশ্রয় প্রার্থনা করেন। ফলে রাসূল (সাঃ) তাকে আশ্রয় দেন। এরপর থেকে মৃত্যু অবধি তাঁর ইসলাম খুবই সুন্দর ছিল। উসমান (রাঃ)-এর খেলাফতকালে ২৫ হিজরীতে তাঁকে মিসরের গবর্ণর নিযুক্ত করা হয় এবং আফ্রিকা জয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়। অতঃপর তাঁর আমলেই আফ্রিকা বিজিত হয়। উক্ত যুদ্ধে বিখ্যাত তিন ‘আবাদেলাহ’ অর্থাৎ আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের, আব্দুল্লাহ বিন উমর এবং আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর যোগদান করেন। ৩৫ হিজরীতে উসমান (রাঃ)-এর শাহাদাতকালে তিনি মিসরের ‘আসক্বালান’ শহরে ছিলেন। তিনি আল্লাহর নিকট দো‘আ করেন যেন সালাতরত অবস্থায় তাঁর মৃত্যু হয়। অতঃপর একদিন ফজরের সালাত আদায়কালে শেষ বৈঠকে প্রথম সালাম ফিরানোর পর দ্বিতীয় সালাম ফিরানোর আগেই তাঁর মৃত্যু হয়ে যায়। এটি ছিল ৩৬ অথবা ৩৭ হিজরীর ঘটনা।[4]
(৬) উবাই বিন কা‘ব আনছারী (রাঃ) বায়‘আতে কুবরা এবং বদর-ওহুদ সহ সকল যুদ্ধে রাসূল (সাঃ)-এর সাথে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন সাত জন শ্রেষ্ঠ ক্বারীর নেতা। আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, একদিন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) উবাই বিন কা‘বকে বললেন, إِنَّ اللهَ أَمَرَنِىْ أَنْ أَقْرَأَ عَلَيْكَ (لَمْ يَكُنِ الَّذِينَ كَفَرُوْا) قَالَ وَسَمَّانِىْ لَكَ؟ قَالَ: نَعَمْ، فَبَكَى ‘আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন যেন আমি তোমার উপরে সূরা বাইয়েনাহ পাঠ করি। উবাই বললেন, আল্লাহ আপনার নিকটে আমার নাম বলেছেন? রাসূল (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ। তখন উবাই (খুশীতে) কাঁদতে লাগলেন’।[বুখারী হা/৪৯৫৯, মুসলিম হা/৭৯৯] তিনিই প্রথম রাসূল (সাঃ)-এর অহি লেখক ছিলেন এবং অন্যতম ফৎওয়া দানকারী সাহাবী ছিলেন। অধিকাংশের মতে তিনি উমর (রাঃ)-এর খিলাফতকালে ২২ হিজরীতে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুতে উমর (রাঃ) বলেন, আজ মুসলমানদের নেতা মৃত্যুবরণ করল (আল-ইছাবাহ, উবাই ক্রমিক ৩২)।
(৭) যায়েদ বিন সাবেত আনছারী (রাঃ) বয়স কম থাকায় বদরের যুদ্ধে অংশগ্রহণে ব্যর্থ হন। এরপর থেকে সকল যুদ্ধে রাসূল(সাঃ)-এর সাথী ছিলেন। তিনি অহি লিখতেন এবং শিক্ষিত সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন (مِنْ عُلَمَاءِ الصَّحَابَةِ)। আবুবকর (রাঃ)-এর সময় কুরআন সংকলনের দায়িত্ব তাঁর উপরেই প্রদান করা হয়। হিজরতের পর রাসূল (সাঃ)-এর নিকট বনু নাজ্জারের এই তরুণকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলে তিনি তাঁকে কুরআনের ১৭টি সূরা মুখস্থ শুনিয়ে দেন। তাতে বিস্মিত হয়ে রাসূল (সাঃ) বলেন, তুমি ইহূদীদের পত্র পাঠ করা শিখ। তখন আমি ১৫ দিনের মধ্যেই ইহূদীদের ভাষা শিখে ফেলি। অতঃপর রাসূল (সাঃ)-এর পক্ষ থেকে তাদের নিকট আমি পত্র লিখতাম এবং তারা লিখলে আমি তাঁকে তা পড়ে শুনাতাম’ (আল-ইছাবাহ, যায়েদ বিন সাবেত ক্রমিক ২৮৮২)।
(৮) আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ইবনুল ‘আছ সাহমী কুরায়শী (রাঃ) অত্যন্ত ‘আবেদ ও যাহেদ সাহাবী ছিলেন। রাসূল (সাঃ) এই তরুণ সাহাবীকে একদিন অন্তর একদিন সিয়াম রাখার ও সাতদিনে বা সর্বনিম্নে তিনদিনে কুরআন খতম করার অনুমতি দেন (বুখারী হা/৫০৫২)। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর হাদীছসমূহ লিপিবদ্ধ করতেন। তিনি বলেন, আমি নিয়মিত হাদীছ লিখতাম। তাতে কুরায়েশরা আমাকে নিষেধ করে এবং বলে যে, তুমি সব কথা লিখ না। কেননা রাসূল (সাঃ) একজন মানুষ। তিনি ক্রোধের সময় ও খুশীর সময় কথা বলেন। তখন আমি লেখা বন্ধ করি এবং রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে উক্ত বিষয়টি উত্থাপন করি। জবাবে রাসূল (সাঃ) বলেন, اكْتُبْ فَوَالَّذِى نَفْسِى بِيَدِهِ مَا خَرَجَ مِنِّى إِلاَّ حَقٌّ ‘তুমি লেখ। যার হাতে আমার জীবন তার কসম করে বলছি, আমার থেকে হক ব্যতীত কিছুই বের হয় না’ (আহমাদ হা/৬৫১০, হাদীছ সহীহ)। আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন, مَا أَجِدُ مِنْ أَصْحَابِ رَسُولِ اللهِ صلى الله عليه و سلم أَكْثَرَ حَدِيْثًا مِنِّي إِلاَّ مَا كَانَ مِنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو فَإِنَّهُ كَانَ يَكْتُبُ ‘রাসূল (সাঃ)-এর সাহাবীগণের মধ্যে আমি আমার চাইতে অধিক হাদীছ বর্ণনাকারী কাউকে পাইনি আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ব্যতীত। কেননা তিনি হাদীছ লিখতেন’। তিনি ৬৫ হিজরীতে ৭২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর স্থান নিয়ে মতভেদ আছে। কেউ বলেছেন শামে বা ত্বায়েফে বা মিসরে বা মক্কায়’ (আল-ইছাবাহ, আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর ক্রমিক ৪৮৫০)। তাঁর লিখিত হাদীছের সংখ্যা অন্যূন সাতশত।
(৯) অনুরূপভাবে বনু নাজ্জারের জনৈক ব্যক্তি খ্রিষ্টান হয়ে যায়। পরে সে মুসলমান হয়ে ‘অহি’ লেখার দায়িত্ব পায়। অতঃপর সে পালিয়ে গিয়ে পুনরায় খ্রিষ্টান হয়ে যায় এবং অপবাদ দেয় যে, মুহাম্মাদ সেটুকুই জানে, যতটুকু আমি লিখি (مَا يَدْرِى مُحَمَّدٌ إِلاَّ مَا كَتَبْتُ لَهُ)। পরে আল্লাহ তাকে মৃত্যু দান করেন। লোকেরা তাকে দাফন করে। কিন্তু সকালে দেখা গেল যে, মাটি তাকে উগরে ফেলে দিয়েছে। তখন লোকেরা বলল, এসব মুহাম্মাদ ও তাঁর সাথীদের কাজ। অতঃপর তারা খুব গভীর করে তাকে দাফন করল। কিন্তু পরদিন সকালে একইভাবে নিক্ষিপ্ত অবস্থায় তাকে পাওয়া গেল। তখন লোকেরা বলল, এটি মানুষের কাজ নয়। অতঃপর তারা তাকে ফেলে রাখল’ (বুখারী হা/৩৬১৭)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, সে বলেছিল, আমি মুহাম্মাদের চাইতে বেশী জানি। আমি চাইলে এরূপ লিখতে পারি’(أَنَا أَعْلَمُكُمْ بِمُحَمَّدٍ إِنْ كُنْتُ لأَكْتُبُ مَا شِئْتُ)। অতঃপর সে মৃত্যুবরণ করে। তার উপরোক্ত কথা জানতে পেরে রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘মাটি তাকে কখনই কবুল করবে না’ (إِنَّ الأَرْضَ لَنْ تَقْبَلَهُ)। রাবী আনাস (রাঃ) বলেন, আবু ত্বালহা (রাঃ) আমাকে বলেছেন যে, আমি তার মৃত্যুর স্থানে গিয়ে দেখি যে, তার লাশ মাটির উপরে পড়ে আছে। তিনি লোকদের জিজ্ঞেস করলেন। তারা বলল, আমরা তাকে বারবার দাফন করেছি। কিন্তু মাটি তাকে বারবার উপরে ফেলে দিয়েছে’।[5]


৩. মুক্তদাস ও দাসীগণ :
━━━━━━━━━━━━━━
ইমাম নববী বলেন, বিভিন্ন সময়ে রাসূল (সাঃ)-এর মোট ৫০ জন গোলাম ছিল। যেমন, (১) যায়েদ বিন হারেছাহ (২) ছাওবান বিন বুজদুদ (ثوبان بن بجدد) (৩) আবু কাবশাহ সুলায়েম। ইনি বদর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। (৪) বাযাম (৫) রুওয়াইফে‘ (৬) ক্বাছীর (৭) মায়মূন (৮) আবু বাকরাহ (৯) হুরমুয (১০) আবু ছাফিইয়াহ উবায়েদ (১১) আবু সালমা (১২) আনাসাহ (১৩) সালেহ (১৪) শুক্বরান (১৫) রাবাহ (১৬) আসওয়াদ আন-নূবী (১৭) ইয়াসার আর-রা‘ঈ (১৮) আবু রাফে‘ আসলাম (১৯) আবু লাহছাহ (أبو لهثة)। (২০) ফাযালাহ ইয়ামানী (২১) রাফে‘ (২২) মিদ‘আম (২৩) আসওয়াদ (২৪) কিরকিরাহ (২৫) যায়েদ, যিনি হেলাল বিন ইয়াসার-এর দাদা ছিলেন। (২৬) ওবায়দাহ (২৭) ত্বাহমান (অথবা কায়সান, মিহরান, যাকওয়ান, মারওয়ান)। (২৮) মা’বূর আল-ক্বিবত্বী (২৯) ওয়াক্বেদ (৩০) আবু ওয়াক্বেদ (৩১) হিশাম (৩২) আবু যুমাইরাহ (৩৩) হোনায়েন (৩৪) আবু ‘আসীব আহমার (৩৫) আবু ওবায়দাহ (৩৬) মিহরান ওরফে সাফীনাহ (৩৭) সালমান ফারেসী (৩৮) আয়মান বিন উম্মে আয়মান (৩৯) আফলাহ (৪০) সাবেক্ব (৪১) সালেম (৪২) যায়েদ বিন বূলা (زيد بن بولا)। (৪৩) সাঈদ (৪৪) যুমাইরাহ বিন আবু যুমাইরাহ (ضُمَيرة بن أبى ضميرة) (৪৫) ওবায়দুল্লাহ বিন আসলাম (৪৬) নাফে‘ (৪৭) নাবীল (৪৮) ওয়ারদান (৪৯) আবু উছাইলাহ (أبو أثيلة)। (৫০) আবুল হামরা রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম।
ইবনুল ক্বাইয়িম (রহঃ) আরও কয়েকজন মুক্তদাসের নাম বলেছেন। যেমন (১) আনজাশাহ (২) সানদার (سندر) (৩) ক্বাসাম (قسام) (৪) আবু মুওয়াইহিবাহ (যাদুল মা‘আদ ১/১১১-১৩)।
মুক্তদাসী ছিল ১২ জন। যেমন, (১) সালমা (২) উম্মে রাফে‘ (৩) উম্মে আয়মান বারাকাহ (৪) মায়মূনাহ বিনতে সাঈদ (৫) খাযেরাহ (خَضِرَةُ)। (৬) রাযওয়া (رَضْوَى)। (৭) উমাইমাহ (৮) রায়হানা (৯) উম্মে যুমাইরাহ (১০) মারিয়াহ বিনতে শাম‘ঊন আল-ক্বিবত্বিয়াহ (১১) তার বোন শীরীন (১২) উম্মে আববাস। এরা কেউ একসঙ্গে ছিলেন না। বরং বিভিন্ন সময়ে ছিলেন।[6] ইবনুল ক্বাইয়িম আর একজনের নাম বলেছেন, রাযীনাহ (رَزِينَةُ) (যাদুল মা‘আদ ১/১১৩)।
মারিয়াহ ও শীরীন দুই বোনকে মিসর রাজ মুক্বাউক্বিস রাসূল (সাঃ)-এর জন্য উপঢৌকন হিসাবে প্রেরণ করেন। পরে রাসূল (সাঃ) মারিয়াকে রাখেন ও শীরীনকে হাসসান বিন সাবিত আনছারী-কে হাদিয়া দেন। মারিয়ার গর্ভে রাসূল (সাঃ)-এর শেষ সন্তান ইবরাহীমের জন্ম হয় ও শীরীন-এর গর্ভে আব্দুর রহমান বিন হাসসান-এর জন্ম হয় (আল-বিদায়াহ ৫/৩০৭-০৮)।


৪. খাদেমগণ :
━━━━━━━━
(১) আনাস বিন মালেক (২) হিন্দ ও তার ভাই (৩) আসমা বিন হারেছাহ আসলামী (৪) রাবী‘আহ বিন কা‘ব আসলামী (৫) আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ। ইনি রাসূল (সাঃ)-এর জুতা ও মিসওয়াক বহন করতেন। যখনই তিনি উঠতেন জুতা পরিয়ে দিতেন এবং যখনই তিনি বসতেন জুতা জোড়া খুলে নিজ হাতে নিয়ে নিতেন। (৬) ওক্ববাহ বিন ‘আমের আল-জুহানী। সফরকালে তাঁর খচ্চর চালনা করতেন। (৭) বেলাল বিন রাবাহ, মুওয়াযযিন (৮) সা‘দ। দু’জনেই ছিলেন আবুবকর ছিদ্দীক-এর মুক্তদাস। (৯) বাদশাহ নাজাশীর ভাতিজা যূ-মিখমার। যাকে রাসূল (সাঃ)-এর খিদমতের জন্য ৭ম হিজরীতে বাদশাহ পাঠিয়েছিলেন। (১০) বুকায়ের বিন সারাহ লায়ছী (১১) আবু যার গিফারী (১২) আসলা‘ বিন শারীক আ‘রাজী। সওয়ারী পালন করতেন। (১৩) মুহাজির। উম্মে সালামাহ (রাঃ)-এর মুক্তদাস। (১৪) আবুস সাজা‘ (أبو السجع) রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম (টীকা-পূর্বোক্ত)।
(১৫) এছাড়া একটি ইহূদী বালক তাঁর খাদেম ছিল। যে তাঁর ওযূর পানি ও জুতা এগিয়ে দিত। হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়লে রাসূল (সাঃ) তাকে দেখতে যান। তার আসন্ন মৃত্যু বুঝতে পেরে তিনি তাকে ইসলাম কবুলের দাওয়াত দেন। সে তার পিতার দিকে তাকালে পিতা তাকে বললেন, أَطِعْ أَبَا الْقَاسِمِ ‘তুমি আবুল ক্বাসেমের আনুগত্য কর’। তখন ছেলেটি কালেমা শাহাদাত পড়ে ইসলাম কবুল করল। অতঃপর মারা গেল। তখন রাসূল (সাঃ) বেরিয়ে আসার সময় বললেন, الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِى أَنْقَذَهُ بِى مِنَ النَّارِ ‘সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্য যিনি আমার মাধ্যমে ছেলেটিকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিলেন’।[বুখারী হা/১৩৫৬; মিশকাত হা/১৫৭৪]


৫. উট, ঘোড়া, খচ্চর ও গাধা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━
উট : (১) ‘ক্বাছওয়া’ (الْقَصْوَاءُ)। যাতে সওয়ার হয়ে তিনি মক্কা বিজয়ের সফরে গমন করেন এবং হজ্জের সময় আরাফাতের ময়দানে ভাষণ দেন (বুখারী হা/৪৪০০; তিরমিযী হা/৩৭৮৬)। (২) ‘আযবা’ (الْعَضْبَاءُ) ও (৩) ‘জাদ‘আ’(الْجَدْعَاءُ) নামে তাঁর আরও দু’টি উষ্ট্রী ছিল। ‘আযবা’ ছিল অত্যন্ত দ্রুতগামী। যাকে কেউ হারাতে পারত না । একবার জনৈক বেদুঈন সওয়ারী আযবা-কে অতিক্রম করে গেলে রাসূল (সাঃ) সাথীদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেন, ‘দুনিয়াতে আল্লাহর নীতি এটাই যে, কাউকে উঁচু করলে তাকে নীচুও করে থাকেন’ (বুখারী হা/৬৫০১)। বিদায় হজ্জে ঈদুল আযহার দিন এর পিঠে বসে তিনি কংকর মারেন। অতঃপর ভাষণ দেন।[আহমাদ হা/২০০৮৬-৮৭; আবুদাঊদ হা/১৯৫৪] জাদ‘আ (الْجَدْعَاءُ) হিজরতের সময় আবুবকর (রাঃ) তাঁকে প্রদান করেন (বুখারী হা/৪০৯৩)। আইয়ামে তাশরীক্বের সময় এর পিঠে সওয়ার হয়ে তিনি ভাষণ দেন।[বায়হাক্বী ৫/১৫২, হা/৯৪৬৪; আবুদাঊদ হা/১৯৫২] (৪) আরেকটি অত্যন্ত দ্রুতগামী উট ছিল। যাকে কেউ অতিক্রম করতে পারত না। যা তিনি বদরের যুদ্ধে নিহত আবু জাহলের গণীমত হিসাবে পেয়েছিলেন। যার নাকে রূপার নোলক ছিল। এটাকে তিনি হোদায়বিয়ার দিন নহর করেন মুশরিকদের ক্রুদ্ধ করার জন্য’।[বায়হাক্বী হা/৯৬৭৪; তিরমিযী হা/ ৮১৫; আবুদাঊদ হা/১৭৪৯]
ঘোড়া : তাঁর ঘোড়া ছিল ৭টি। (১) ‘সাক্ব’ (السَّكْبُ)। যার রং ছিল কালো ও কপালচিতা। (২) ‘মুরতাজিয’ (الْمُرْتَجِزُ) (৩) ‘লুহাইফ’ (اللُّحَيْفُ) (৪) ‘লেযায’ (اللِّزَازُ) (৫) ‘যারিব’ (الظَّرِبُ) (৬) ‘সাবহাহ’ (السَّبْحَةُ) এবং (৭) ‘ওয়ার্দ’ (الْوَرْدُ)। ঘোড়ার পালানের নাম ছিল ‘দাজ’ (الدَّاجُ)। অনেকে বলেছেন তাঁর ঘোড়া ছিল ১৫টি। তবে এতে মতভেদ আছে।
খচ্চর : তাঁর খচ্চর ছিল ৩টি। (১) ‘দুলদুল’ (دُلْدُلُ)। যা ছিল সাদা-কালো ডোরা কাটা। যা মিসর রাজ মুক্বাউক্বিস হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। (২) ‘ফায্যাহ’ (فَضَّةٌ)। যা ছিল সাদা। যা রোম সম্রাটের পক্ষে মা‘আন (مَعَان)-এর গবর্ণর ফারওয়া আল-জুযামী ইসলাম কবুলের পর তাঁকে হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। (৩) আরেকটি ডোরা কাটা খচ্চর ছিল, যা আয়লার অধিপতি হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে যে, নাজাশীও তাঁর জন্য একটি খচ্চর পাঠিয়েছিলেন, যাতে তিনি সওয়ার হতেন।
গাধা : তাঁর গাধা ছিল ২টি। (১) ইয়া‘ফূর (يَعْفُورٌ) বা ‘উফায়ের (عُفَيْرٌ)। যা ছিল সাদা-কালো ডোরা কাটা। মিসর রাজ মুক্বাউক্বিস তাঁকে হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। (২) অন্যটি ফারওয়া আল-জুযামী হাদিয়া পাঠিয়েছিলেন। বলা হয়েছে যে, সা‘দ বিন উবাদাহ (রাঃ) তাঁকে আরেকটি গাধা হাদিয়া দিয়েছিলেন। যাতে তিনি সওয়ার হতেন।


৬. অস্ত্র-শস্ত্র :
━━━━━━━
তরবারী : রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ৯টি তরবারী ছিল। (১) মা’ছূর (مَأْثُورٌ)। যা তিনি পৈত্রিক উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন। (২) ‘আয্ব (الْعَضْبُ)। (৩) ‘যুল-ফিক্বার’ (ذُو الْفِقَارِ)। এটি তিনি ছাড়তেন না। যার বাঁট ছিল লোহার তৈরী ও রূপা দিয়ে মোড়ানো। (৪) ক্বালাঈ (الْقَلَعِيّ)। (৫) বাত্তার (الْبَتَّارُ)। (৬) হাত্ফ (الْحَتْفُ)। (৭) রাসূব (الرَّسُوبُ)। (৮) মিখযাম (الْمِخْذَمُ)। (৯) ক্বাযীব (الْقَضِيبُ)।
বর্ম : তাঁর বর্ম ছিল ৭টি : (১) ‘যাতুল ফুযূল’(ذَاتُ الْفُضُولِ)। লোহার তৈরী এই বর্মটি মৃত্যুর পূর্বে স্বীয় পরিবারের জন্য রাসূল (সাঃ) জনৈক আবু শাহম (أَبو الشَّحْم) ইহূদীর নিকট ৩০ ছা‘ (৭৫ কেজি) যবের বিনিময়ে এক বছরের জন্য বন্ধক রেখেছিলেন। (২) ‘যাতুল বিশাহ’ (ذَاتُ الْوِشَاحِ)। (৩) ‘যাতুল হাওয়াশী’ (ذَاتُ الْحَوَاشِي)। (৪) সা‘দিয়াহ (السَّعْدِيَّةُ)। (৫) ফিযযাহ (فِضَّةٌ)। (৬) বাতরা (الْبَتْرَاءُ)। (৭) খিরনিক্ব (الْخِرْنِقُ)। (যাদুল মা‘আদ ১/১২৬)।
এতদ্ব্যতীত তাঁর (১) তীরের নাম ছিল ‘সাদাদ’ (السَّدَادُ)। (২) শরাধারের নাম ছিল ‘আল-জাম‘উ’ (الْجَمْعُ)। (৩) বর্শার নাম ছিল ‘সাগা’ (السَّغَاء)। (৪) তাঁর শিরস্ত্রানের নাম ছিল ‘যাক্বান’ (الذَّقَنُ)। (৫) ঢালের নাম ছিল ‘মূজেয’ (الْمُوجِزُ)।[ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ৬/৯]
ব্যবহৃত বস্ত্তসমূহের বিষয় পর্যালোচনা :
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর ব্যবহৃত বস্ত্তসমূহকে বরকতের বস্ত্ত হিসাবে পূজা করার কোনরূপ নির্দেশনা শরী‘আতে নেই। তেমন কিছু থাকলে সাহাবায়ে কেরাম নিজেরাই সেগুলি সংরক্ষণ করতেন। বরং এর বিপরীত তাঁর ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করতে এবং তাঁর কবরে পূজা করতে কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে।[বুখারী হা/৩৪৪৫, ১৩৯০; মিশকাত হা/৭৫০] তাঁর ব্যবহৃত পোষাক, জুতা এমনকি তাঁর চুল ইত্যাদি নিয়ে মুসলিম বিশ্বের কোন কোন অঞ্চলে যেভাবে অতি ভক্তি দেখানো হয়, এমনকি অনেক স্থানে দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও যুদ্ধ-বিগ্রহ পর্যন্ত হয়ে থাকে। এগুলি স্রেফ বাড়াবাড়ি বৈ কিছুই নয়।


৭. দূতগণ :
━━━━━━
(১) ‘আমর বিন উমাইয়া যামরী : বাদশাহ নাজাশীর নিকট প্রেরিত হন। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর পত্র হাতে নিয়ে সিংহাসন থেকে নীচে নেমে মাটিতে বসেন। অতঃপর জা‘ফর বিন আবু ত্বালিবের নিকটে কালেমা পাঠ করে ইসলাম কবুল করেন। তাঁর ইসলাম আমৃত্যু সুন্দর ছিল। (২) দেহিইয়াহ বিন খালীফাহ কালবী : রোম সম্রাট হেরাক্বল-এর নিকট প্রেরিত হন। (৩) আব্দুল্লাহ বিন হুযাফাহ সাহমী : পারস্য সম্রাট কিসরার নিকট। (৪) হাত্বেব বিন আবু বালতা‘আহ লাখমী : মিসর রাজ মুক্বাউক্বিস-এর নিকট। (৫) আমর ইবনুল ‘আছ : ওমানের সম্রাট দুই ভাইয়ের নিকট। (৬) সালীত্ব বিন আমর ‘আলাবী : ইয়ামামার শাসক হাওযাহ বিন আলী-এর নিকট। (৭) শুজা‘ বিন ওয়াহাব আল-আসাদী : শামের বালক্বা-এর শাসক হারেছ বিন আবু শিম্র আল-গাসসানীর নিকট। (৮) মুহাজির বিন আবু উমাইয়াহ মাখযূমী : হারেছ আল-হিমইয়ারীর নিকট। (৯) ‘আলা ইবনুল হাযরামী : বাহরায়েনের শাসক মুনযির বিন সাওয়া আল-‘আব্দীর নিকট। (১০) আবু মূসা আশ‘আরী ও মু‘আয বিন জাবাল : ইয়ামনবাসী ও তাদের শাসকদের নিকট প্রেরিত হন। তাদের শাসকবর্গসহ অধিকাংশ জনগণ ইসলাম কবুল করেন।[7]


৮. তাঁর মুওয়াযযিনগণ :
━━━━━━━━━━━━━
মোট চারজন। তন্মধ্যে দু’জন (১) বেলাল বিন রাবাহ ও (২) আমর ইবনু উম্মে মাকতূম (রাঃ) মদীনায়, ‘আম্মার বিন ইয়াসিরের মুক্তদাস (৩) সা‘দ আল-ক্বারয ক্বোবায় এবং (৪) আবু মাহযূরাহ আউস বিন মুগীরাহ আল-জুমাহী ছিলেন মক্কায় (যাদুল মা‘আদ ১/১২০)।


৯. তাঁর আমীরগণ :
━━━━━━━━━━━
(১) বাযান বিন সামান। পারস্য সম্রাট কিসরা নিহত হওয়ার পর রাসূল (সাঃ) তাকে ইয়ামনের গবর্ণর নিয়োগ করেন। ইনিই ছিলেন ইয়ামনে ইসলামী যুগের প্রথম আমীর ও প্রথম অনারব মুসলিম। বাযানের মৃত্যুর পর তার পুত্র শাহর বিন বাযানকে আমীর নিযুক্ত হন। পরে তিনি নিহত হলে রাসূল (সাঃ) খালেদ বিন সাঈদ ইবনুল ‘আছ (রাঃ)-কে সেখানকার আমীর নিয়োগ করেন।
(২) মুহাজির বিন উমাইয়া মাখযূমীকে রাসূল (সাঃ) কিন্দাহ ও ছাদিফ (الصَّدِف) এলাকার আমীর নিযুক্ত করেন। রাসূল (সাঃ)-এর মৃত্যুর পর আবুবকর (রাঃ) সেখানকার কিছু মুরতাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অভিযান প্রেরণ করেন।
(৩) যিয়াদ বিন উমাইয়া আনছারীকে হাযরামাঊত (৪) আবু মূসা আশ‘আরীকে যাবীদ (زَبِيد), আদন ও সাগর তীরবর্তী এলাকা (৫) মু‘আয বিন জাবালকে জান্দ (الْجَنْد) এলাকা (৬) আবু সুফিয়ান ছাখর বিন হারবকে নাজরান এবং তাঁর পুত্র (৭) ইয়াযীদকে তায়মা (৮) আত্তাব বিন আসীদকে মক্কা (৯) আলী ইবনু আবী ত্বালেবকে ইয়ামন (১০) আমর ইবনুল ‘আছকে ওমান এলাকার প্রশাসক নিয়োগ করেন। এতদ্ব্যতীত (১১) আবুবকর (রাঃ)-কে ৯ম হিজরীতে হজ্জের আমীর নিযুক্ত করেন। যদিও আল্লাহর শত্রু রাফেযী শী‘আরা বলে থাকে যে, আলীকে পাঠিয়ে আবুবকরকে বরখাস্ত করা হয়’ (যাদুল মা‘আদ ১/১২১-২২)।


১০. হজ্জ ও ওমরাহসমূহ :
━━━━━━━━━━━━━━━
আনাস (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) মাত্র ১টি হজ্জ করেন এবং হিজরতের পরে মোট চারটি ওমরাহ করেন। (১) ৬ষ্ঠ হিজরীতে হোদায়বিয়ার ওমরাহ (عُمْرَةُ الْحُدَيْبِيَةِ), যা পূর্ণ না হওয়ায় তিনি সন্ধি করে ফিরে যান (২) ৭ম হিজরীতে গত বছরের সন্ধি মতে ওমরাহ (عُمْرَةُ الْقَضَاءِ) আদায় (৩) ৮ম হিজরীতে মক্কা বিজয় ও হোনায়েন যুদ্ধের পর গণীমত বণ্টন শেষে জি‘ইর্রা-নাহ হতে ওমরাহ (عُمْرَةِ الْجِعِرَّانَةِ) আদায় এবং (৪) সবশেষে ১০ম হিজরীতে বিদায় হজ্জের সাথে একত্রিতভাবে ওমরাহ আদায়। সবগুলিই তিনি করেছিলেন যুলক্বা‘দাহ মাসে’।[বুখারী হা/৪১৪৮; মুসলিম হা/১২৫৩] উক্ত হিসাবে দেখা যায় যে, তিনি পৃথক ও স্বতন্ত্রভাবে কেবল দু’টি ওমরাহ করেছেন। একটি ৭ম হিজরীতে ওমরাতুল ক্বাযা এবং অন্যটি ৮ম হিজরীতে ওমরাতুল জি‘ইর্রানাহ। সম্ভবতঃ একারণেই সাহাবী বারা বিন আযেব (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর হজ্জের পূর্বে দু’টি ওমরাহ করেছেন যুলক্বা‘দাহ মাসে’।[বুখারী হা/১৭৮১; মিশকাত হা/২৫১৯]




[1]. ফাৎহুল বারী হা/৪৯৯০-এর পূর্বে ‘নবী(সাঃ)-এর লেখক’ অনুচ্ছেদ, ৯/২২ পৃঃ।
[2]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৫/৩৩৯-৩৫৫; মুছত্বফা আ‘যামী, কুত্তাবুন নবী (বৈরূত : ১৩৯৮/১৯৭৮ খৃঃ)।
[3]. মাহমূদ শাকের, আত-তারীখুল ইসলামী (বৈরূত : আল-মাকতাবুল ইসলামী, তাবি) ২/৩৫৫ পৃঃ।
[4]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৫/৩৩৯-৩৫৫, ‘অহি লেখকগণ’ অনুচ্ছেদ।
[5]. সহীহ ইবনু হিববান হা/৭৪৪; আহমাদ হা/১২২৩৬, সনদ সহীহ। মিশকাত হা/৫৮৯৮ ‘মু‘জিযা সমূহ’ অনুচ্ছেদ। মিশকাতে বর্ণিত হাদীছে তার মুরতাদ হওয়ার খবর শুনে রাসূল (সাঃ) ‘মাটি তাকে কবুল করবে না’ (إن الأرض لا تقبله) বলেন। অতঃপর শেষে ‘মুত্তাফাক্ব ‘আলাইহ’ লেখা হয়েছে। কিন্তু বুখারী ও মুসলিমে কোথাও উক্ত বক্তব্য পাওয়া যায়নি। বরং তার মৃত্যুর পরে তিনি বলেছিলেনإِنَّ الأَرْضَ لَنْ تَقْبَلَهُ (সহীহ ইবনু হিববান হা/৭৪৪) অথবা إِنَّ الأَرْضَ لَمْ تَقْبَلَهُ (আহমাদ হা/১২২৩৬)।
[6]. ইমাম নববী (৬৩১-৬৭৬ হি.), তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত, তাহকীক : মুছত্বফা আব্দুল ক্বাদের ‘আত্বা ১/৩৮-৩৯ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ১/১১১-১৩।
[7]. নববী, তাহযীবুল আসমা ওয়াল লুগাত, তাহকীক : মুছত্বফা আব্দুল ক্বাদের ‘আত্বা ১/৩৯ পৃঃ।

রাসূল চরিত পর্যালোচনা

 

রাসূল চরিত পর্যালোচনা

সাধারণতঃ লোকেরা নবী-রাসূলগণকে ধর্মনেতা হিসাবেই ভাবতে অভ্যস্ত। যারা দুনিয়াদারী থেকে সর্বদা দূরে থাকেন ও কেবল আল্লাহর যিকরে মশগূল থাকেন। আসলে ব্যাপারটি ঠিক তা নয়। বরং তাঁরা মানুষকে তার সার্বিক জীবনে শয়তানের দাসত্ব হতে মুক্ত করে আল্লাহর দাসত্বে ফিরিয়ে নিতে সর্বদা প্রচেষ্টা চালিয়েছেন। বিভিন্ন যুগে নবী-রসূলগণ যে নির্যাতিত হয়েছেন, তা ছিল মূলতঃ তাদের আনীত ধর্ম বিশ্বাসের সাথে মানুষের মনগড়া ধারণা ও রীতি-নীতি সমূহের মধ্যে বিরোধ হওয়ার কারণেই। তবে হযরত মূসা (আঃ)-এর সঙ্গে ফেরাঊনের সংঘর্ষ ধর্মবিশ্বাসগত হওয়া ছাড়াও নির্যাতিত বনু ইস্রাঈলদের মুক্তির মত রাজনৈতিক বিষয়টিও জড়িত ছিল। কেননা বনু ইস্রাঈলকে ফেরাঊনের গোত্র ক্বিবতীরা দাস-দাসী হিসাবে ব্যবহার করত এবং তাদের উপরে অমানুষিক নির্যাতন চালাত। মূসা (আঃ) তাদেরকে ফেরাঊনের কবল থেকে মুক্ত করে তাদের আদি বাসস্থান শামে ফেরৎ নিতে চেয়েছিলেন। হযরত ঈসা (আঃ)-এর দাওয়াতের মধ্যে রাজনীতির নাম-গন্ধ না থাকলেও সমসাময়িক রাজা তাঁর জনপ্রিয়তায় ভীত হয়ে এবং ইহূদীদের চক্রান্তে তাঁকে হত্যা করার প্রয়াস চালান। কেননা ইহূদীরা হযরত ঈসা (আঃ)-কে নবী হিসাবে মানেনি। উপরন্তু তাওরাতের কিছু বিধান পরিবর্তন করায় তারা তাঁর ঘোর দুশমন ছিল। ফলে আল্লাহ ঈসা (আঃ)-কে আসমানে জীবিত উঠিয়ে নেন (আলে ইমরান ৩/৫৫; নিসা ৪/১৫৭)।
পক্ষান্তরে শেষনবী মুহাম্মাদ (সাঃ) দুনিয়াতে প্রেরিত হয়েছিলেন মানবজাতির জন্য উসওয়ায়ে হাসানাহ বা ‘সর্বোত্তম নমুনা’ হিসাবে (আহযাব ৩৩/২১)। সেকারণ মানবজীবনে প্রয়োজনীয় সকল কল্যাণকর বিষয়ে সর্বোত্তম আদর্শ হিসাবে আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেন। ফলে তিনি একাধারে ধর্মনেতা, রাজনৈতিক নেতা, সমাজনেতা, অর্থনৈতিক বিধানদাতা, সমরনেতা, বিচারপতি এবং বিচার বিভাগীয় নীতি ও দর্শনদাতা- এক কথায় বিশ্ব পরিচালনার সামগ্রিক পথপ্রদর্শক হিসাবে আল্লাহ তাঁকে প্রেরণ করেছিলেন এবং সেটা তিনি বাস্তবে দেখিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিক দিয়ে বিচার করলে মুহাম্মাদ (সাঃ) বিগত সকল নবী থেকে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য, গুণাবলী ও বিশেষ মর্যাদার অধিকারী ছিলেন।

একজন আধ্যাত্মিক ব্যক্তি নিয়মিত তাহাজ্জুদগোযার এবং নফল সিয়াম ও ই‘তিকাফকারী রাসূলকে পাবেন শ্রেষ্ঠতম আধ্যাত্মিক নেতা হিসাবে। আগে-পিছে সব গোনাহ মাফ হওয়া সত্ত্বেও নৈশ ইবাদতে মগ্ন থাকা ও ক্ষমা প্রার্থনার বিষয়ে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন, أَفَلاَ أَكُوْنُ عَبْدًا شَكُوْرًا؟ ‘আমি কি একজন কৃতজ্ঞ বান্দা হব না’?[বুখারী হা/১১৩০, মুসলিম হা/২৮১৯-২০; মিশকাত হা/১২২০] একজন রাজনীতিক তার পথ খুঁজে পাবেন হোদায়বিয়ার সন্ধিতে ও মক্কা বিজয়ী রাসূল (সাঃ)-এর কুশাগ্রবুদ্ধি ও দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের মধ্যে। একজন অকুতোভয় সেনাপতি তার আদর্শ দেখতে পাবেন বদর-খন্দক-হোনায়েন বিজেতা সেনাপতি মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর সমর কুশলতার মধ্যে। একজন সমাজনেতা তার আদর্শ খুঁজে পাবেন মক্কা ও মদীনার কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ সংশোধনে দক্ষ সমাজনেতা মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর মধ্যে। একজন বিচারপতি তার আদর্শ খুঁজে পাবেন আল্লাহর দন্ডবিধিসমূহ বাস্তবায়নে দৃঢ়চিত্ত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর নিরপেক্ষ বিচারের মধ্যে। যিনি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেন, أَيُّهَا النَّاسُ إِنَّمَا أَهْلَكَ الَّذِينَ قَبْلَكُمْ أَنَّهُمْ كَانُوا إِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الشَّرِيفُ تَرَكُوهُ وَإِذَا سَرَقَ فِيهِمُ الضَّعِيفُ أَقَامُوا عَلَيْهِ الْحَدَّ وَايْمُ اللهِ لَوْ أَنَّ فَاطِمَةَ بِنْتَ مُحَمَّدٍ سَرَقَتْ لَقَطَعْتُ يَدَهَا ‘হে জনগণ! তোমাদের পূর্বেকার উম্মতেরা ধ্বংস হয়েছে এ কারণে যে, তাদের মধ্যে উঁচু শ্রেণীর কোন লোক চুরি করলে তারা তাকে ছেড়ে দিত এবং দুর্বল শ্রেণীর কেউ চুরি করলে তার উপরে দন্ডবিধি প্রয়োগ করত। আল্লাহর কসম! যদি মুহাম্মাদের কন্যা ফাতেমাও চুরি করে, আমি অবশ্যই তার হাত কেটে দেব’।[মুসলিম হা/১৬৮৮; বুখারী হা/৬৭৮৭-৮৮; মিশকাত হা/৩৬১০]

এমনিভাবে মানবজীবনের সকল দিক ও বিভাগে একজন পূর্ণাঙ্গ আদর্শের মানুষ হিসাবে তাঁকে আমরা দেখতে পাই। অতএব জীবনের কোন একটি বা দু’টি বিভাগে রাসূল (সাঃ)-কে আদর্শ মেনে অন্য বিভাগে অন্য কোন মানুষকে আদর্শ মানলে পূর্ণ মুমিন হওয়া যাবে না। পরকালে জান্নাতও আশা করা যাবে না। মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর জীবনচরিত তাই একজন কল্যাণকামী সমাজনেতার জন্য আদর্শ জীবনচরিত। যা যুগে যুগে মানবজাতিকে সত্য ও ন্যায়ের আলোকস্তম্ভ রূপে পথ দেখাবে। মযলূম মানবতাকে যালেমদের হাত থেকে মুক্তির দিশা দিবে।
মুহাম্মাদ (সাঃ) অস্ত্র নিয়ে ময়দানে আসেননি। এসেছিলেন একটি অভ্রান্ত আদর্শ নিয়ে। যার মাধ্যমে তিনি মানুষের ভ্রান্ত আক্বীদা ও কপোল-কল্পিত ধারণা-বিশ্বাসে পরিবর্তন এনেছিলেন। আর তাতেই সৃষ্টি হয়েছিল সর্বাত্মক সমাজ বিপ্লব। দুনিয়াপূজারী মানুষকে তিনি আল্লাহ ও আখেরাতে দৃঢ় বিশ্বাসী করতে সমর্থ হয়েছিলেন। তাওহীদ, রিসালাত ও আখেরাত বিশ্বাসের ভিত্তিতে তিনি সমাজের আমূল পরিবর্তনে সক্ষম হয়েছিলেন। আজও যদি সেই দৃঢ় বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে আবারো সেই হারানো মানবতা ও হারানো ইসলামী খেলাফত ফিরে পাওয়া সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন একদল যিন্দাদিল নিবেদিত প্রাণ মুর্দে মুমিন। আল্লাহ আমাদেরকে তাঁর প্রিয় বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করুন- আমীন!

ছেড়ে যাওয়া দুই আলোকস্তম্ভ

 

ছেড়ে যাওয়া দুই আলোকস্তম্ভ

বিদায় হজ্জের ভাষণসমূহের এক স্থানে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, تَرَكْتُ فِيْكُمْ أَمْرَيْنِ لَنْ تَضِلُّوْا مَا تَمَسَّكْتُمْ بِهِمَا كِتَابَ اللهِ وَسُنَّةَ نَبِيِّهِ ‘আমি তোমাদের মাঝে ছেড়ে যাচ্ছি দু’টি বস্ত্ত। যতদিন তোমরা এ দু’টি বস্ত্ত আঁকড়ে থাকবে, ততদিন তোমরা পথভ্রষ্ট হবে না। আল্লাহর কিতাব ও তার নবীর সুন্নাহ’।[মুওয়াত্ত্বা হা/৩৩৩৮; মিশকাত হা/১৮৬] তিনি বলেন,الأَنْبِيَاءُ لَمْ يَرِثُوا دِينَاراً وَلاَ دِرْهَماً وَإِنَّمَا وَرَّثُوا الْعِلْمَ ‘নবীগণ কোন দীনার ও দিরহাম ছেড়ে যান না। ছেড়ে যান কেবল ইল্ম’।[আহমাদ হা/২১৭৬৩; মিশকাত হা/২১২] আর শেষনবী (সাঃ)-এর ছেড়ে যাওয়া সেই ইল্ম হল কুরআন ও হাদীছ। দীনার ও দিরহামের ক্ষয় আছে, লয় আছে। কিন্তু ইল্মের কোন ক্ষয় নেই লয় নেই। ইল্ম চির জীবন্ত। যে ঘরে হাদীছের পঠন-পাঠন হয়, সে ঘরে যেন স্বয়ং শেষনবী (সাঃ) কথা বলেন। যেমন ইমাম তিরমিযী স্বীয় হাদীছগ্রন্থ সম্পর্কে বলেন, مَنْ كَانَ فِي بَيْتِهِ هَذَا الْكِتَابُ فَكَأَنَّمَا فِي بَيْتِهِ نَبِيٌّ يَتَكَلَّمُ ‘যার ঘরে এই কিতাব থাকে, তার গৃহে যেন স্বয়ং নবী কথা বলেন’।[1] যিনি হাদীছ বর্ণনা করেন, স্বয়ং রাসূল (সাঃ)-এর বাণী তার মুখ দিয়ে বের হয়।
যিনি হাদীছ অনুযায়ী আমল করেন, তিনি স্বয়ং নবীর আনুগত্য করেন। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি হাদীছকে অগ্রাহ্য করে, সে স্বয়ং নবীকে অগ্রাহ্য করে। আল্লাহ বলেন, فَلْيَحْذَرِ الَّذِيْنَ يُخَالِفُوْنَ عَنْ أَمْرِهِ أَنْ تُصِيْبَهُمْ فِتْنَةٌ أَوْ يُصِيْبَهُمْ عَذَابٌ أَلِيْمٌ ‘অতএব যারা রাসূল-এর আদেশ-নিষেধের বিরোধিতা করবে, তারা এ বিষয়ে সাবধান হৌক যে, ফিৎনা তাদেরকে গ্রেফতার করবে এবং যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি তাদেরকে গ্রাস করবে’ (নূর ২৪/৬৩)। শুধু তাই নয় তার সমস্ত আমল আল্লাহর নিকটে বাতিল বলে গণ্য হবে (মুহাম্মাদ ৪৭/৩৩)। রাসূল (সাঃ) বলেন, ‘জগদ্বাসীকে জান্নাতের প্রতি আল্লাহর পক্ষ হতে আহবানকারী (الدَّاعِى) হলেন মুহাম্মাদ! যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে ব্যক্তি আল্লাহর আনুগত্য করল। আর যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের অবাধ্যতা করল, সে ব্যক্তি আল্লাহর অবাধ্যতা করল। মুহাম্মাদ হলেন مُحَمَّدٌ فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ ‘মানুষের মধ্যে পার্থক্যকারী মানদন্ড’।[বুখারী হা/৭২৮১; মিশকাত হা/১৪৪] রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, أَلاَ إِنِّى أُوتِيتُ الْكِتَابَ وَمِثْلَهُ مَعَهُ ‘জেনে রেখ, আমি কুরআন প্রাপ্ত হয়েছি এবং তার ন্যায় আরেকটি বস্ত্ত (অর্থাৎ হাদীছ)।[আবুদাঊদ হা/৪৬০৪; মিশকাত হা/১৬৩]

عَنْ أَبِىْ رَافِعٍ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لاَ أُلْفِيَنَّ أَحَدَكُمْ مُتَّكِئًا عَلَى أَرِيكَتِهِ يَأْتِيْهِ الأَمْرُ مِنْ أَمْرِى مِمَّا أَمَرْتُ بِهِ أَوْ نَهَيْتُ عَنْهُ فَيَقُوْلُ لاَ أَدْرِى مَا وَجَدْنَا فِى كِتَابِ اللهِ اتَّبَعْنَاهُ ، رَوَاهُ أَحْمَدُ وَأَبُوْ دَاؤُدَ وَالتِّرْمِذِىُّ-
‘আবু রাফে‘ (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহে ওয়া সাল্লাম এরশাদ করেন, ‘আমি যেন তোমাদের কাউকে এরূপ না দেখি যে, সে তার গদীতে ঠেস দিয়ে বসে থাকবে, আর তার কাছে আমার কোন আদেশ বা নিষেধাজ্ঞা পৌঁছলে সে বলবে যে, আমি এসব কিছু জানিনা। যা আল্লাহর কিতাবে পাব, তারই আমরা অনুসরণ করব’।[তিরমিযী হা/২৬৬৩; মিশকাত হা/১৬২]
কুরআন ও হাদীছ হল রাসূল (সাঃ)-এর রেখে যাওয়া দুই অনন্য উত্তরাধিকার, দুই জীবন্ত মু‘জেযা। যা মানবজাতির জন্য চিরন্তন মুক্তির দিশা। অতএব ইহকালে ও পরকালে সফলকাম হওয়ার জন্য সর্বাবস্থায় সেদিকেই আমাদের ফিরে যেতে হবে। আল্লাহ আমাদের সেই তাওফীক দান করুন- আমীন!




[1]. শামসুদ্দীন যাহাবী (৬৭৩-৭৪৮ হি.), তাযকেরাতুল হুফফায ২/৬৩৪ পৃঃ ক্রমিক সংখ্যা ৬৫৮; সুনান তিরমিযী, তাহকীক : আহমাদ মুহাম্মাদ শাকির (বৈরূত : ১ম সংস্করণ, ১৪০৮/১৯৮৭) পৃঃ ৩।

হাদীছের পরিচয়

 

হাদীছের পরিচয়

আল্লাহ বলেন, وَمَا آتَاكُمُ الرَّسُوْلُ فَخُذُوْهُ وَمَا نَهَاكُمْ عَنْهُ فَانْتَهُوْا ‘আমার রাসূল তোমাদেরকে যা দেন, তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন, তা থেকে বিরত হও’ (হাশর ৫৯/৭)। তিনি বলেন, وَمَا يَنْطِقُ عَنِ الْهَوَى، إِنْ هُوَ إِلاَّ وَحْيٌ يُوْحَى ‘তিনি নিজ থেকে (দ্বীন বিষয়ে) কোন কথা বলেন না’। ‘যা বলেন অহী করা হলেই তবে বলেন’ (নাজম ৫৩/৩-৪)। সেকারণ রাসূল (সাঃ)-এর হাদীছ হেফাযতের দায়িত্বও আল্লাহ নিয়েছেন। যেমন তিনি বলেন, ثُمَّ إِنَّ عَلَيْنَا بَيَانَهُ ‘অতঃপর কুরআনের ব্যাখ্যা দানের দায়িত্ব আমাদেরই’ (ক্বিয়ামাহ ৭৫/১৯)। তিনি বলেন وَمَا أَنْزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلاَّ لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُوا فِيهِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ ‘আমি তোমার প্রতি কুরআন নাযিল করেছি কেবল এজন্য যে, তুমি তাদেরকে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে দিবে যেসব বিষয়ে তারা মতভেদ করে এবং (এটি নাযিল করেছি) মুমিনদের জন্য হেদায়াত ও রহমত স্বরূপ’ (নাহল ১৬/৬৪)। অন্যত্র আল্লাহ বলেন, وَنَزَّلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ تِبْيَاناً لِّكُلِّ شَيْءٍ ‘আর আমি তোমার উপর কুরআন নাযিল করেছি সকল বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা হিসাবে’ (নাহল ১৬/৮৯)। ইমাম আওযাঈ (৮৮-১৫৭ হি.) বলেন, এর অর্থ بِالسُّنَّةِ ‘সুন্নাহ দ্বারা’ (ইবনু কাছীর)। অর্থাৎ সুন্নাহ সহ কুরআন সকল বিষয়ে স্পষ্ট ব্যাখ্যা স্বরূপ। যেমন কুরআনে সালাত, সিয়াম, যাকাত ও হজ্জ ফরয করা হয়েছে। কিন্তু হাদীছে তার নিয়ম-কানূন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেকারণ আল্লাহ বলেন, مَنْ يُطِعِ الرَّسُولَ فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ ‘যে ব্যক্তি রাসূলের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল’ (নিসা ৪/৮০)। আর সেটাই হল রাসূল প্রেরণের মূল উদ্দেশ্য। যেমন আল্লাহ বলেন, وَمَا أَرْسَلْنَا مِنْ رَسُولٍ إِلاَّ لِيُطَاعَ بِإِذْنِ اللهِ ‘আর আমি রাসূল প্রেরণ করেছি কেবল এজন্য যে, তাদের আনুগত্য করা হবে আল্লাহর অনুমতিক্রমে (নিসা ৪/৬৪)।
একদা আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) হাদীছ শুনিয়ে বলেন, আল্লাহ লা‘নত করেছেন ঐসব মহিলাদের প্রতি, যারা অপরের অঙ্গে উল্কি করে ও নিজেদের অঙ্গে উল্কি করে। যারা (কপাল বা ভ্রুর) চুল উপড়িয়ে ফেলে এবং সৌন্দর্যের জন্য দাঁত সরু ও তার ফাঁক বড় করে। যারা আল্লাহর সৃষ্টিকে বদলিয়ে ফেলে। এ কথা বনু আসাদ গোত্রের জনৈকা মহিলা উম্মে ইয়াকূবের কর্ণগোচর হলে তিনি এসে ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-কে বলেন, আপনি নাকি এরূপ এরূপ কথা বলেছেন? জবাবে তিনি বলেন, আমি কেন তাকে লা‘নত করব না, যাকে আল্লাহর রাসূল লা‘নত করেছেন এবং যা আল্লাহর কিতাবে আছে? মহিলা বললেন, আমি কুরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়েছি। কিন্তু কোথাও একথা পাইনি। ইবনু মাসঊদ বললেন, আপনি মনোযোগ দিয়ে পড়লে অবশ্যই পেতেন। আপনি কি পড়েননি যে আল্লাহ বলেছেন, ‘রাসূল তোমাদেরকে যা দেন তা গ্রহণ কর এবং যা নিষেধ করেন তা বর্জন কর’ (সূরা হাশর ৫৯/৭)। মহিলা বললেন, হ্যাঁ, পড়েছি। তখন তিনি বললেন, রাসূল (সাঃ) এটি নিষেধ করেছেন। এরপর মহিলাটি বললেন, সম্ভবতঃ আপনার পরিবারে এটি করা হয়। ইবনু মাসঊদ বললেন, তাহলে যেয়ে দেখে আসুন। অতঃপর মহিলাটি ভিতরে গেলেন। কিন্তু সেরূপ কিছু না পেয়ে ফিরে এসে বললেন, আমি কিছুই পেলাম না। তখন ইবনু মাসঊদ বললেন, এরূপ কিছু থাকলে আমরা কখনোই একত্রিত থাকতাম না (অর্থাৎ তালাক দিতাম)।[বুখারী হা/৪৮৮৬; মুসলিম হা/২১২৫; মিশকাত হা/৪৪৩১]

বস্ত্ততঃ রাসূল (সাঃ) হলেন মানদন্ড। যেমন তিনি বলেন, فَمَنْ أَطَاعَ مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم فَقَدْ أَطَاعَ اللهَ، وَمَنْ عَصَى مُحَمَّدًا فَقَدْ عَصَى اللهَ، وَمُحَمَّدٌ فَرْقٌ بَيْنَ النَّاسِ- ‘যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের আনুগত্য করল, সে আল্লাহর আনুগত্য করল এবং যে ব্যক্তি মুহাম্মাদের অবাধ্যতা করল, সে আল্লাহর অবাধ্যতা করল। মুহাম্মাদ হলেন মানুষের মধ্যে পার্থক্যকারী মানদন্ড’।[বুখারী হা/৭২৮১; মিশকাত হা/১৪৪] প্রখ্যাত তাবেঈ সুফিয়ান ইবনু উয়ায়না (১০৭-১৯৮ হিঃ) বলেন, الْمِيزَانُ الْأَكْبَرُ هُوَ النَّبِيُّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، تُعْرَضُ الْأَشْيَاءُ كُلُّهَا عَلَيْهِ ... فَمَا وَافَقَهُ فَهُوَ حَقٌّ، وَمَا خَالَفَهُ فَهُوَ بَاطِلٌّ ‘শ্রেষ্ঠতম মানদন্ড হলেন রাসূলুল্লাহ (সাঃ)। সকল বিষয় তার উপরেই ন্যস্ত হবে।... অতঃপর যেটি তার অনুকূলে হবে, সেটি সত্য এবং যেটি তার বিরোধী হবে, সেটি মিথ্যা’।[1]
কুরআন সংক্ষিপ্ত ও মৌলিক বিধান সম্বলিত। সেকারণ তা সবার মুখস্থ এবং তা অবিরত ধারায় বর্ণিত (মুতাওয়াতির)। কিন্তু হাদীছ হল শাখা-প্রশাখা সহ বিস্তারিত ব্যাখ্যা সম্বলিত। তাই কেবল শ্রোতার নিকটেই তা মুখস্থ। শ্রোতার সংখ্যা একাধিক হলে ও সকল যুগে বহুল প্রচারিত হলে তা হয় ‘মুতাওয়াতির’। যা সব হাদীছের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়। কুচক্রীরা তাই সুযোগ নিয়েছিল জাল হাদীছ বানানোর। কিন্তু আল্লাহ সে চক্রান্ত নস্যাৎ করে দিয়েছেন এবং তাঁর রাসূলের হাদীছসমূহকে হেফাযত করেছেন। ইমাম মালেক, ইমাম বুখারী, ইমাম মুসলিম প্রমুখের ন্যায় অনন্য প্রতিভাধর ব্যক্তি সৃষ্টি করে আল্লাহ সহীহ হাদীছগুলিকে পৃথক করে নিয়েছেন। ফলে জাল-যঈফের হামলা থেকে হাদীছ শাস্ত্র নিরাপদ হয়ে গেছে। পৃথিবীর কোন নবী-রাসূলের বাণী ও কর্মের হেফাযতের জন্য এমন নিখুঁত ব্যবস্থাপনা কেউ কখনো দেখেনি বা শোনেনি।
রাসূল বিদ্বেষী জার্মান প্রাচ্যবিদ ড. স্প্রেঙ্গার (১৮১৩-১৮৯৩) হাফেয ইবনু হাজারের আল-ইছাবাহ গ্রন্থ রিভিউ করে তার ভূমিকায় নিরুপায় হয়ে বলতে বাধ্য হয়েছেন যে, ‘পৃথিবীতে এমন কোন জাতি অতীতে ছিল না এবং বর্তমানেও নেই, যারা মুসলমানদের ন্যায় রিজাল শাস্ত্রের অনুরূপ কোন শাস্ত্র সৃষ্টি করেছে। যার ফলে আজ প্রায় পাঁচ লক্ষ জীবন চরিত সম্পর্কে জানা যায়’ (মর্মার্থ)।[2] বলা বাহুল্য, এগুলি কেবল বর্ণনাকারী সাহাবীদের হিসাব নয়, বরং তাঁদের নিকট থেকে যারা শুনেছেন, সেই সকল সূত্র সমূহের সামষ্টিক হিসাব হতে পারে। রাসূল (সাঃ)-এর হাদীছকে হেফাযতের জন্য এত বিরাট সংখ্যক মানুষের এই অতুলনীয় প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে তার জীবন্ত মো‘জেযা হওয়ার অন্যতম দলীল।




[1]. খত্বীব বাগদাদী, আল-জামে‘ লি আখলাক্বির রাবী হা/৮ (মর্মার্থ)।
[2]. সুলায়মান নাদভী, Muhammad The Ideal Prophet পৃঃ ৪০; গৃহীত : Al-Isabah, I, P. 1.
There is no nation, nor there has been any which like them has during twelve centuries recorded the life of every man of letters. If the biographical records of the Mohammadans were collected, we should probably have accounts of the lives of half a million of distinguished persons, and it would be found that there is not a decennium of their history, not a place of importance which has not its representatives. Al-Isabah, I, P. 1.

কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ পর্ব-২

 

কুরআনের মু‘জেযা হওয়ার প্রমাণ সমূহ পর্ব-২

১৬. সকলের পাঠযোগ্য (قابل القراءة للجميع) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা আল্লাহর কালাম হিসাবে কেবল নবী পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং উম্মতে মুহাম্মাদীর সবাই তা পাঠ করে ধন্য হতে পারে। মানুষ দুনিয়াতে তার সৃষ্টিকর্তা আল্লাহকে দেখতে পাবে না ঠিকই। কিন্তু তাঁর কালাম পাঠ করে ও শ্রবণ করে এক অনির্বচনীয় ভাবানুভূতিতে ডুবে যেতে পারে। ঠিক যেমন পিতার রেখে যাওয়া হস্তলিখিত পত্র বা লেখনী পাঠ করে প্রিয় সন্তান তার হারানো পিতার মহান স্মৃতিতে ব্যাকুল হয়ে ওঠে। তাই কুরআনের পাঠক ও অনুসারী উম্মতে মুহাম্মাদীর চাইতে সৌভাগ্যবান জাতি পৃথিবীতে আর কেউ নেই। মূসা (আঃ)-এর সাথে আল্লাহ কথা বলেছিলেন ঠিকই। কিন্তু তওরাত সে কথার সমষ্টি নয়। তাই বাইবেলের অনুসারীরা আল্লাহর সরাসরি কালাম থেকে বঞ্চিত। আর বর্তমান বাইবেল তো আদৌ প্রকৃত তওরাত নয়। অন্যদিকে হিন্দুদের বেদ তো কেবল ব্রাহ্মণদেরই পাঠের অনুমতি রয়েছে, সাধারণ হিন্দুদের নেই।


১৭. স্মৃতিতে সুরক্ষিত (المحفوظ فى الذاكرة) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআনই একমাত্র ইলাহী কিতাব, যা মানুষের স্মৃতিতে সংরক্ষিত হয়েছে। কুরআনের পূর্বে কোন এলাহী গ্রন্থ মুখস্থ করা হয়নি। কুরআন আল্লাহ কর্তৃক হেফাযতের এটি একটি বড় প্রমাণ। পৃথিবীর প্রান্তে প্রান্তে শহরে-গ্রামে, এমনকি নির্জন কারা কক্ষে বসে অগণিত মুসলমান কুরআনের হাফেয হচ্ছে এবং এইসব হাফেযে কুরআনের মুখে সর্বদা কুরআন পঠিত হচ্ছে। অন্যেরা সবাই পুরা কুরআনের হাফেয না হলেও এমন কোন মুসলমান দুনিয়াতে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে যে, কুরআনের কিছু অংশ তার মুখস্থ নেই। ২০০৫ সালের একটি হিসাবে জানা যায় যে, প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে বসবাসকারী ফিলিস্তীনীদের মধ্যে সে বছর চল্লিশ হাযার কিশোর-কিশোরী কুরআনের হাফেয হয়েছে’ (মাজাল্লা আল-ফুরক্বান (কুয়েত : জামঈয়াতু এহইয়াইত তুরাছিল ইসলামী) )। আলহামদুলিল্লাহ।


১৮. সহজে মুখস্থ হবার যোগ্য (قابل الحفظ باليسر) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআন এমনই এক গ্রন্থ যা সহজে মুখস্থ হয়ে যায়। একটু চেষ্টা করলেই তা মানুষের স্মৃতিতে গেঁথে যায়। মাতৃভাষা বাংলায় একশ’ পৃষ্ঠার একটা গদ্য বা পদ্যের বই হুবহু কেউ মুখস্থ করতে পারবে কি-না সন্দেহ। অথচ ছয়শো পৃষ্ঠার অধিক পুরো কুরআন মুখস্থকারী বাংলাভাষীর সংখ্যা নিঃসন্দেহে লাখ লাখ হবে।
ইহূদী, নাছারা, ফার্সী, হিন্দু, বৌদ্ধ কেউ কি একথা দাবী করতে পারবে যে, তাদের কেউ তাদের ধর্মগ্রন্থ আগাগোড়া মুখস্থ বলতে পারে? এ দাবী কেবল মুসলমানেরাই করতে পারে। আর কেউ নয়। ফালিল্লাহিল হাম্দ। বস্ত্ততঃ কুরআনকে হেফাযতের জন্য প্রদত্ত আল্লাহর ওয়াদার এটাও একটি জ্বলন্ত প্রমাণ।


১৯. সর্বাধিক পঠিত ইলাহী গ্রন্থ (الكةاب الإلهى الأكثر قراءة) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআন পৃথিবীর সর্বাধিক পঠিত ও প্রচারিত ইলাহী গ্রন্থ। আল্লাহ বলেন, وَكِتَابٍ مَسْطُوْرٍ، فِيْ رَقٍّ مَنْشُوْرٍ ‘কসম ঐ কেতাবের যা লিখিত হয়েছে’ ‘বিস্তৃত পত্রে’ (তূর ৫২/২-৩)। এখানে কুরআন মজীদের তিনটি বিশেষণ বর্ণিত হয়েছে- ‘কিতাব’ (গ্রন্থ), ‘মাসতূর’ (লিখিত) এবং ‘মানশূর’ (বিস্তৃত)। বস্ত্ততঃ কুরআন সর্বাধিক উচ্চারিত ও বিস্তৃত গ্রন্থ এ কারণে যে, তা মানুষের মুখে মুখে প্রচারিত হয়েছে। কুরআন প্রচারের জন্য কোন প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া অপরিহার্য নয়। যেকোন মুমিন কুরআন মুখস্থ করে সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারে। ফলে যতদিন পৃথিবীতে মুসলমান থাকবে, ততদিন পৃথিবীতে কুরআন থাকবে ইনশাআল্লাহ।


২০. সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ (المملوء بالصدق والعدل) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআন এমনই একটি গ্রন্থ, যার প্রতিটি কথাই চূড়ান্ত সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। পরিস্থিতির কারণে যে সত্যের কোন পরিবর্তন হয় না। আল্লাহ বলেন, وَتَمَّتْ كَلِمَتُ رَبِّكَ صِدْقًا وَّعَدْلاً لاَ مُبَدِّلَ لِكَلِمَاتِهِ وَهُوَ السَّمِيْعُ الْعَلِيْمُ ‘তোমার প্রভুর কালাম সত্য ও ন্যায় দ্বারা পূর্ণ। তাঁর কালামের পরিবর্তনকারী কেউ নেই। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ’ (আন‘আম ৬/১১৫)।
মানুষ সাধারণতঃ অধিকাংশের মত অনুযায়ী চলে। তাই অধিকাংশের দোহাই দিয়ে মানুষ যেন সত্যকে এড়িয়ে না যায়, সে বিষয়ে সাবধান করে পরের আয়াতেই আল্লাহ স্বীয় নবীকে বলেন, وَإِنْ تُطِعْ أَكْثَرَ مَنْ فِي الْأَرْضِ يُضِلُّوكَ عَنْ سَبِيلِ اللهِ إِنْ يَتَّبِعُونَ إِلاَّ الظَّنَّ وَإِنْ هُمْ إِلاَّ يَخْرُصُونَ ‘অতএব যদি তুমি জনপদের অধিকাংশ লোকের কথা মেনে চল, তাহলে ওরা তোমাকে আল্লাহর পথ থেকে বিচ্যুত করবে। তারা তো কেবল ধারণার অনুসরণ করে এবং তারা তো কেবল অনুমান ভিত্তিক কথা বলে’ (আন‘আম ৬/১১৬)।


২২. ব্যাপক অর্থবোধক গ্রন্থ (الكتاب ذو معنى شامل) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, এর কোন আয়াত কোন বিশেষ উপলক্ষ্যে নাযিল হলেও তার অর্থ হয় ব্যাপক ও সর্বযুগীয়। যাতে সকল যুগের সকল মানুষ এর দ্বারা উদ্বুদ্ধ ও উপকৃত হয়। যেমন (১) সূরা ‘আলাক্ব’-এর ৬ থেকে ১৯ আয়াত পর্যন্ত মক্কার মুশরিক নেতা আবু জাহ্ল সম্পর্কে নাযিল হয়েছে। কিন্তু এর বক্তব্য সকল যুগের ইসলামদ্রোহী নেতাদের প্রতি প্রযোজ্য। অমনিভাবে (২) আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস (রাঃ) বলেন, সূরা আহক্বাফ ১৫ আয়াতটি হযরত আবুবকর (রাঃ) সম্পর্কে নাযিল হয়। যেখানে আল্লাহ বলেন, حَتَّى إِذَا بَلَغَ أَشُدَّهُ وَبَلَغَ أَرْبَعِيْنَ سَنَةً قَالَ رَبِّ أَوْزِعْنِيْ أَنْ أَشْكُرَ نِعْمَتَكَ الَّتِيْ أَنْعَمْتَ عَلَيَّ وَعَلَى وَالِدَيَّ وَأَنْ أَعْمَلَ صَالِحًا تَرْضَاهُ وَأَصْلِحْ لِيْ فِيْ ذُرِّيَّتِي إِنِّيْ تُبْتُ إِلَيْكَ وَإِنِّيْ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ ‘... অবশেষে যখন সে পূর্ণ বয়স্ক হয় এবং চল্লিশ বছরে উপনীত হয় তখন সে বলে, হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমাকে শক্তি দাও, যাতে আমি তোমার নে‘মতের শুকরিয়া আদায় করতে পারি, যা তুমি আমাকে ও আমার পিতামাতাকে দান করেছ এবং আমি তোমার পসন্দনীয় সৎকর্ম সমূহ করতে পারি। তুমি আমার জন্য আমার সন্তানদের মধ্যে কল্যাণ দান কর। আমি তোমার দিকে ফিরে গেলাম (তওবা করলাম) এবং আমি তোমার আজ্ঞাবহদের অন্যতম’ (কুরতুবী, তাফসীর সূরা আহক্বাফ ৪৬/১৫)।
এই দো‘আ কবুল করে আল্লাহ তাকে এমন তাওফীক দান করেন যে, তাঁর চার পুরুষ অর্থাৎ তিনি নিজে, তাঁর পিতা-মাতা, সন্তানাদি ও পৌত্রাদি ক্রমে সবাই মুসলমান হয়ে যান। সাহাবায়ে কেরামের মধ্যে কেবল আবুবকর (রাঃ)-কেই আল্লাহ এই সৌভাগ্য দান করেন। কিন্তু আয়াতের উদ্দেশ্য হল সকল মুসলমানকে এই নির্দেশনা দেওয়া যে, বয়স চল্লিশ বছর হয়ে গেলে তার মধ্যে পরকাল চিন্তা প্রবল হওয়া উচিত এবং বিগত গোনাহসমূহ হতে তওবা করা উচিত। আর সন্তান-সন্ততিকে দ্বীনদার ও সৎকর্মশীল করার জন্য সাধ্যমত চেষ্টার সাথে সাথে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করা উচিত। নির্দিষ্ট ও ব্যাপক অর্থবোধক এই দ্বৈত ভাবধারা কুরআনী ভাষা ও বর্ণনাভঙ্গির এক অনন্য দিক, যা অন্য কোন ধর্মগ্রন্থে নেই।
(২) কুরআনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর ‘মাছানী’ (مَثَانِي) নীতি। অর্থাৎ যেখানেই জান্নাতের সুসংবাদ। তার পরেই জাহান্নামের ভয় প্রদর্শন। যেমন আল্লাহ বলেন, أَمَّا الَّذِينَ آمَنُوا وَعَمِلُوا الصَّالِحَاتِ فَلَهُمْ جَنَّاتُ الْمَأْوَى نُزُلًا بِمَا كَانُوا يَعْمَلُونَ- وَأَمَّا الَّذِينَ فَسَقُوا فَمَأْوَاهُمُ النَّارُ كُلَّمَا أَرَادُوا أَنْ يَخْرُجُوا مِنْهَا أُعِيدُوا فِيهَا وَقِيلَ لَهُمْ ذُوقُوا عَذَابَ النَّارِ الَّذِي كُنْتُمْ بِهِ تُكَذِّبُونَ- ‘যারা ঈমান আনে ও সৎকর্মসমূহ সম্পাদন করে, তাদের জন্য তাদের কৃতকর্মের আপ্যায়ন স্বরূপ রয়েছে বসবাসের জান্নাত’। ‘আর যারা অবাধ্যতা করে, তাদের ঠিকানা হল জাহান্নাম। যখনই তারা সেখান থেকে বের হতে চাইবে, তখনই তাদেরকে সেখানে ফিরিয়ে দেওয়া হবে এবং বলা হবে, জাহান্নামের যে শাস্তিকে তোমরা মিথ্যা বলতে, তার স্বাদ আস্বাদন করো’ (সাজদাহ ৩২/১৯-২০)। কুরআনের প্রায় প্রতি পৃষ্ঠায় এরূপ প্রমাণ মিলবে। যাতে পাঠকের মনে বারবার জান্নাত ও জাহান্নামের দোলা দেয়। যাতে তার মধ্যে জাহান্নাম থেকে বাঁচার আকুতি সৃষ্টি হয় ও জান্নাতের প্রতি আকাংখা প্রবল হয়। এভাবে সে প্রকাশ্য ও গোপন সকল পাপ থেকে ফিরে আসতে উদ্বুদ্ধ হয়।


২৩. পূর্ববর্তী সকল ইলাহী কিতাবের সত্যায়নকারী (المصدق لجميع الكةب الإلهية السابقة) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যা পূর্ববর্তী সকল এলাহী কিতাবের সত্যায়ন করেছে এবং সেগুলির সুন্দর শিক্ষাসমূহের প্রশংসা করেছে। এজন্য কুরআনের একটি নাম হল مُصَدِّقًا لِمَا بَيْنَ يَدَيْهِ ‘পূর্ববর্তী কিতাব সমূহের সত্যায়নকারী’।[বাক্বারাহ ২/৯৭; ফাত্বির ৩৫/৩১; আহক্বাফ ৪৬/৩০]


২৪. জিন ও ইনসানকে চ্যালেঞ্জকারী (متحدى إلى الجن والإنس) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ যা জিন ও ইনসান উভয় জাতিকে চ্যালেঞ্জ করেছে অনুরূপ একটি গ্রন্থ রচনার জন্য এবং তারা যে ব্যর্থ হবে, সে কথাও বলে দিয়েছে। আল্লাহ বলেন, قُلْ لَئِنِ اجْتَمَعَتِ الْإِنْسُ وَالْجِنُّ عَلَى أَنْ يَأْتُوْا بِمِثْلِ هَذَا الْقُرْآنِ لاَ يَأْتُوْنَ بِمِثْلِهِ وَلَوْ كَانَ بَعْضُهُمْ لِبَعْضٍ ظَهِيْرًا ‘তুমি বলে দাও, যদি মানুষ ও জিন জাতি একত্রিত হয়ে পরস্পরের সহযোগিতায় কুরআনের ন্যায় একটি কিতাব নিয়ে আসতে চায়, তবুও তারা তা পারবে না’ (ইসরা ১৭/৮৮)। এমনকি তারা অনুরূপ একটি ‘সূরা’ (বাক্বারাহ ২/২৩-২৪) বা ১০টি আয়াতও (হূদ ১১/১৩-১৪) রচনা করতে পারবে না। অর্থাৎ একটিও নয়। এভাবে কুরআন মক্কায় মুশরিকদের চারবার[ইউনুস ১০/৩৮; হূদ ১১/১৩; ইসরা ১৭/৮৮] এবং মদীনায় ইহূদী-নাছারাদের একবার (বাক্বারাহ ২/২৩-২৪) চালেঞ্জ করেছে। কিন্তু ঐ চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সাহস তখনও কারু হয়নি, আজও হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। এটা কুরআনের জীবন্ত মু‘জেযা হওয়ার অন্যতম দলীল। যা পৃথিবীর সর্বযুগের সকল বিদ্বানকে পরাজিত করেছে ও তাদেরকে মাথা নত করতে বাধ্য করেছে।


২৫. বাতিল হতে নিরাপদ(السالم من الأباطيل) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআনই একমাত্র গ্রন্থ, যা সর্বাবস্থায় বাতিল ও মিথ্যা হতে নিরাপদ। কুরআনের শত্রুরা এতে একটি বর্ণও ঢুকাতে পারেনি বা বের করতে পারেনি এবং পারবেও না কখনো। যেমন আল্লাহ বলেন, لاَ يَأْتِيْهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلاَ مِنْ خَلْفِهِ تَنْزِيْلٌ مِنْ حَكِيْمٍ حَمِيْدٍ ‘তার সম্মুখ দিয়ে বা পিছন দিয়ে কখনোই বাতিল প্রবেশ করে না। এটি প্রজ্ঞাময় ও মহা প্রশংসিত সত্তার পক্ষ হতে অবতীর্ণ’ (হামীম সাজদাহ ৪১/৪২)। তিনি বলেন, وَبِالْحَقِّ أَنْزَلْنَاهُ وَبِالْحَقِّ نَزَلَ وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلاَّ مُبَشِّرًا وَنَذِيْرًا ‘আমি সত্যসহ এ কোরআন নাযিল করেছি এবং সত্যসহ এটা নাযিল হয়েছে। আমি তো আপনাকে শুধু সুসংবাদাতা ও সতর্ককারী রূপে প্রেরণ করেছি (বনু ইসরাঈল ১৭/১০৫)।


২৬. কুরআন থেকে মুখ ফিরানোই হল জাতির অধঃপতনের মূল কারণ(الإعراض عن القرآن هو السبب الحقيقى لانحطاط الأمة) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরআন থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়াকেই উম্মতের অধঃপতনের কারণ বলে ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) স্বীয় পালনকর্তার নিকটে ওযর পেশ করে বলবেন, وَقَالَ الرَّسُوْلُ يَا رَبِّ إِنَّ قَوْمِي اتَّخَذُوْا هَذَا الْقُرْآنَ مَهْجُوْرًا ‘হে আমার পালনকর্তা! আমার কওম এই কুরআনকে পরিত্যাজ্য গণ্য করেছিল’ (ফুরক্বান ২৫/৩০)। অন্যদিকে যালেমদের কৈফিয়ত হবে আরও করুণ।
যেমন আল্লাহ বলেন, وَيَوْمَ يَعَضُّ الظَّالِمُ عَلَى يَدَيْهِ يَقُولُ يَا لَيْتَنِي اتَّخَذْتُ مَعَ الرَّسُولِ سَبِيلاً- يَا وَيْلَتَى لَيْتَنِي لَمْ أَتَّخِذْ فُلاَنًا خَلِيلاً- لَقَدْ أَضَلَّنِي عَنِ الذِّكْرِ بَعْدَ إِذْ جَاءَنِي وَكَانَ الشَّيْطَانُ لِلْإِنْسَانِ خَذُولاً- ‘যেদিন যালেম নিজের দু’হাত কামড়িয়ে বলবে, হায়! যদি আমি (দুনিয়াতে) রাসূল-এর সাথে সৎপথ অবলম্বন করতাম’! ‘হায়! যদি আমি অমুককে (শয়তানকে) বন্ধুরূপে গ্রহণ না করতাম’! ‘আমাকে তো সে বিভ্রান্ত করেছিল আমার নিকটে উপদেশ (কুরআন) এসে যাবার পর। বস্ত্ততঃ শয়তান মানুষের জন্য মহা প্রতারক’ (ফুরক্বান ২৫/২৭-২৯)।

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...