ওহুদ যুদ্ধ
৩য় হিজরীর জুমাদাল আখেরাহ। মদীনার পথে ব্যবসায়ের প্রতিবন্ধকতার কথা ভেবে কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা মদীনার পূর্বদিক দিয়ে দীর্ঘ পথ ঘুরে সম্পূর্ণ অজানা পথে নাজদ হয়ে সিরিয়া যাবার মনস্থ করে। এ খবর মদীনায় পৌঁছে গেলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যায়েদ বিন হারেছাহর নেতৃত্বে ১০০ জনের একটি অশ্বারোহী দল প্রেরণ করেন। তারা অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সাথে অগ্রসর হয়ে ‘ক্বারদাহ’ (قَرْدة) নামক প্রস্রবণের কাছে পৌঁছে তাদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। অতর্কিতে এই হামলার মুকাবিলায় ব্যর্থ হয়ে কাফেলা নেতা সাফওয়ান বিন উমাইয়া সবকিছু ফেলে পালিয়ে যান। মজুরীর বিনিময়ে নেওয়া কুরায়েশদের পথ প্রদর্শক ফুরাত বিন হাইয়ান(فُرَاتُ بنُ حَيَّانَ) এবং বলা হয়েছে যে, আরও অন্য দুজন বন্দী হয়ে মদীনায় নীত হয়। অতঃপর তারা রাসূল (সাঃ)-এর হাতে বায়‘আত করে ইসলাম কবুল করেন। এই সফরে বড় বড় ব্যবসায়ী ছিলেন। যাদের মধ্যে কুরায়েশ নেতা আবু সুফিয়ান ইবনু হারবের নিকটেই ছিল সর্বাধিক রৌপ্য ও রৌপ্য সামগ্রীসমূহ। ফলে আনুমানিক এক লক্ষ দেরহামের রৌপ্য সহ বিপুল পরিমাণ গণীমতের মাল হস্তগত হয়। এই পরাজয়ে কুরায়েশরা হতাশ হয়ে পড়ে। এখন তাদের সামনে মাত্র দু’টি পথই খোলা রইল। যিদ ও অহংকার পরিত্যাগ করে মুসলমানদের সাথে সন্ধি করা অথবা যুদ্ধের মাধ্যমে হৃত গৌরব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করা।
বলা বাহুল্য, তারা শেষটাই গ্রহণ করে এবং যা ওহুদ যুদ্ধকে অনিবার্য করে তোলে। সোজাপথে না গিয়ে পালানো পথে সিরিয়া গমনের কাপুরুষতাকে কটাক্ষ করে রাসূল (সাঃ)-এর সভাকবি হাসসান বিন সাবেত আনছারী (রাঃ) কুরায়েশ নেতাদের বিরুদ্ধে এ সময় কবিতা পাঠ করেন।[ইবনু সা‘দ ২/২৭; ইবনু হিশাম ২/৫০]
ওহুদ যুদ্ধ : (৩য় হিজরীর ৭ই শাওয়াল শনিবার সকাল)
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কুরায়েশরা আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে ৩০০০ সৈন্যের সুসজ্জিত বাহিনী নিয়ে মদীনার তিন মাইল উত্তরে ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে শিবির সন্নিবেশ করে। এই বাহিনীর সাথে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে ওৎবার নেতৃত্বে ১৫ জনের একটি মহিলা দল ছিল, যারা নেচে-গেয়ে ও উত্তেজক কবিতা পাঠ করে তাদের সৈন্যদের উত্তেজিত করে। এই যুদ্ধে রাসূল (সাঃ)-এর নেতৃত্বে প্রায় ৭০০ সৈন্য ছিলেন। প্রচন্ড যুদ্ধ শেষে একটি ভুলের জন্য মুসলমানদের সাক্ষাৎ বিজয় অবশেষে বিপর্যয়ে পরিণত হয়। মুসলিম পক্ষে ৭০ জন শহীদ ও ৪০ জন আহত হন। তার মধ্যে মুহাজির ৪ জন, আনছার ৬৫ জন। যাদের মধ্যে আউস ২৪, খাযরাজ ৪১ এবং ইহূদী ১ জন। কুরায়েশ পক্ষে ৩৭ জন নিহত হয়। তবে এই হিসাব চূড়ান্ত নয়। বরং কুরায়েশ পক্ষে হতাহতের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী (‘জয়-পরাজয় পর্যালোচনা’ অনুচ্ছেদ দ্রষ্টব্য)।
এই যুদ্ধে মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কুরায়েশরা বিজয়ী হয়নি। বরং তারা ভীত হয়ে ফিরে যায়। এ যুদ্ধ প্রসঙ্গে সূরা আলে ইমরানের ১২১-১৭৯ পর্যন্ত ৬০টি আয়াত নাযিল হয়। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নরূপ।-
ওহুদ-এর পরিচয় :
━━━━━━━━━━━
মদীনার ওহুদ পাহাড়ের নামে এই যুদ্ধের নামকরণ হয়েছে। পাহাড়টি অন্য পাহাড়ের সাথে যুক্ত না থেকে ‘একক’ হওয়ায় এর নাম ওহুদ (أُحُدٌ) হয়েছে। যার পর থেকে ত্বায়েফের পাহাড় (جَبَلُ الطائف) শুরু হয়েছে। এটি মসজিদে নববীর ‘মাজীদী দরজা’ (باب الْمَجِيدى) থেকে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত। এই পাহাড়ের কতগুলি চূড়া রয়েছে। এর সরাসরি দক্ষিণে ছোট্ট পাহাড়টির নাম ‘আয়নায়েন’(عَيْنَين) যা পরবর্তীতে ‘জাবালুর রুমাত’ (جَبَلُ الرُّمَاة) বা তীরন্দাযদের পাহাড় বলে পরিচিত হয়। এ দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তী বৃহৎ উপত্যকার নাম ‘কুনাত’ (وَادِى قُنَاة)। যেখানে ওহুদ যুদ্ধ সংঘটিত হয় বদর যুদ্ধের প্রায় ১১ মাস পরে’ (সীরাহ সহীহাহ ২/৩৭৮)।
যুদ্ধের কারণ :
━━━━━━━━
মক্কা থেকে শামে কুরায়েশদের ব্যবসায়ের পথ নিরংকুশ ও নিরাপদ করাই ছিল তাদের এই যুদ্ধের মূল কারণ।
অতঃপর প্রত্যক্ষ কারণ ছিল, বদর যুদ্ধে কুরায়েশদের শোচনীয় পরাজয়, ‘সাভীক্ব’ যুদ্ধে ছাতুর বস্তাসহ অন্যান্য সাজ-সরঞ্জাম ফেলে আবু সুফিয়ানের পালিয়ে আসার গ্লানিকর অভিজ্ঞতা এবং সবশেষে সাফওয়ান বিন উমাইয়ার নেতৃত্বে মদীনার সোজা পথ ছেড়ে নাজদের ঘোরা পথ ধরে সিরিয়া গমনকারী কুরায়েশ বাণিজ্য কাফেলা মুসলিম বাহিনী কর্তৃক লুট হওয়া এবং দলনেতা সাফওয়ানের কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আসার লজ্জাকর ঘটনা। যার প্রেক্ষাপটে কুরায়েশ নেতারা মুসলমানদের সাথে কালবিলম্ব না করে একটা চূড়ান্ত ফায়ছালাকারী যুদ্ধের জন্য প্রস্তুততি গ্রহণ করে। সঙ্গত কারণেই এ ব্যাপারে বদর যুদ্ধে নিহত নেতা আবু জাহলের পুত্র ইকরিমা, উৎবাহর ভাই আব্দুল্লাহ ও সাভীক যুদ্ধে পালিয়ে আসা আবু সুফিয়ান এবং সর্বশেষ বাণিজ্য কাফেলা ফেলে পালিয়ে আসা সাফওয়ান বিন উমাইয়া অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
যুদ্ধের পুঁজি :
━━━━━━━━
বদর যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসাবে বিবেচিত কুরাইশের যে বাণিজ্য কাফেলা আবু সুফিয়ান স্বীয় বুদ্ধিবলে মুসলিম বাহিনীর কবল থেকে বাঁচিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই বাণিজ্য সম্ভারের সবটুকুই মালিকদের সম্মতিক্রমে ওহুদ যুদ্ধের পুঁজি হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত হয়’ (ইবনু হিশাম ২/৬০)।[1]
মাক্কীদের যুদ্ধ প্রস্তুতি :
━━━━━━━━━━━━━
মুসলিম শক্তিকে সমূলে উৎখাত করার জন্য তারা সাধারণ বিজ্ঞপ্তি জারী করে দিল যে, মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্বেচ্ছায় যুদ্ধে যেতে ইচ্ছুক বেদুঈন, কেনানা ও তেহামার অধিবাসীদের মধ্যকার যেকোন ব্যক্তি যেন এই যুদ্ধে কুরায়েশ বাহিনীতে শরীক হয়। লোকদের উত্তেজিত ও উৎসাহিত করার জন্য দু’জন কবি আবু ‘আযযাহ(أَبُو عَزَّةَ) এবং মুসাফে‘ বিন ‘আব্দে মানাফ আল-জুমাহী(مُسَافِعُ بْنُ عَبْدِ مَنَافِ الْجُمَحِيُّ) কে কাজে লাগানো হয়। প্রথমজন বদর যুদ্ধে বন্দী হয়েছিল। পরে রাসূল (সাঃ)-এর বিরোধিতা করবে না, এই শর্তে কোনরূপ মুক্তিপণ ছাড়াই সে মুক্তি পায়। তাকে গোত্রনেতা সাফওয়ান বিন উমাইয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে, যুদ্ধ থেকে নিরাপদে ফিরে আসলে তাকে ধনশালী করে দিবেন। আর নিহত হলে তার কন্যাদের লালন-পালনের দায়িত্ব নেবেন’। ফলে উক্ত দুই কবি অর্থ-সম্পদের লোভে সর্বত্র যুদ্ধের উন্মাদনা সৃষ্টিতে তৎপর হয়ে উঠলো। দেখতে দেখতে বছর ঘুরে আসতেই মক্কায় তিন হাযার সুসজ্জিত সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী প্রস্তুত হয়ে গেল। আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হেন্দার নেতৃত্বে ১৫ জন মহিলাকেও সঙ্গে নেওয়া হল, যাতে তাদের দেওয়া উৎসাহে সৈন্যরা অধিক উৎসাহিত হয় এবং তাদের সম্ভ্রম রক্ষার্থে সৈন্যরা জীবনপণ লড়াইয়ে উদ্বুদ্ধ হয়।
যুদ্ধ সম্ভারের মধ্যে ছিল বাহন হিসাবে ৩০০০ উট, ২০০ যুদ্ধাশ্ব এবং ৭০০ লৌহবর্ম। খালেদ ইবনু অলীদ ও ইকরিমা বিন আবু জাহলকে অশ্বারোহী বাহিনীর অধিনায়ক ও সহ-অধিনায়ক করা হয়। আবু সুফিয়ান হলেন পুরা বাহিনীর অধিনায়ক এবং যুদ্ধের পতাকা অর্পণ করা হয় প্রথা অনুযায়ী বনু ‘আব্দিদ্দার গোত্রের হাতে।[ওয়াক্বেদী, মাগাযী ১/২০৮; আর-রাহীক্ব ২৪৯ পৃঃ]
মদীনায় সংবাদ প্রাপ্তি :
━━━━━━━━━━━━━
কুরায়েশ নেতাদের এই ব্যাপক যুদ্ধ প্রস্তুততির খবর রাসূল (সাঃ)-এর চাচা আববাস বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (যিনি তখনো প্রকাশ্যে মুসলমান হননি) একজন বিশ্বস্ত পত্রবাহকের মাধ্যমে দ্রুত মদীনায় পাঠিয়ে দেন এবং তাতে তিনি সবকিছুর বিস্তারিত বিবরণ জানিয়ে দেন। ৪৬০ কিলোমিটার রাস্তা মাত্র তিনদিনে অতিক্রম করে পত্রবাহক সরাসরি গিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর হাতে পত্রটি পৌঁছে দেয়। তিনি তখন ক্বোবায় অবস্থান করছিলেন। উবাই ইবনু কা‘ব (রাঃ) পত্রটি রাসূল (সাঃ)-কে পাঠ করে শুনান। তিনি উবাইকে পত্র প্রাপ্তির বিষয়টি গোপন রাখতে বলেন ও দ্রুত মদীনায় এসে মুহাজির ও আনছার নেতৃবৃন্দের সঙ্গে পরামর্শ বৈঠকে বসেন। অন্যদিকে মদীনার চারপাশে পাহারা দাঁড় করানো হল। স্বয়ং রাসূল (সাঃ)-এর দ্বাররক্ষী হিসাবে রাত্রি জেগে পাহারা দেবার জন্য আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয, খাযরাজ নেতা সা‘দ বিন ওবাদাহ এবং উসায়েদ বিন হুযায়ের প্রমুখ আনছার নেতৃবৃন্দ নিজেদেরকে নিয়োজিত করলেন। চারদিকে গোয়েন্দা প্রেরণ করা হল মাক্কী বাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর নেওয়ার জন্য। গোয়েন্দাগণ নিয়মিতভাবে রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে তাদের খবর পৌঁছে দিতে থাকেন।
মাক্কী বাহিনীর অবস্থান ও শ্রেণীবিন্যাস :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
মাক্কী বাহিনী ৩য় হিজরীর ৬ই শাওয়াল শুক্রবার মদীনার উত্তরে ওহুদ পাহাড়ের কাছাকাছি ‘আয়নায়েন’ (عَيْنَيْن) টীলার নিকটবর্তী স্থানে শিবির সন্নিবেশ করে।[2] তাদের ডান বাহুর অধিনায়ক ছিলেন খালেদ বিন অলীদ এবং বাম বাহুর অধিনায়ক ছিলেন ইকরিমা বিন আবু জাহল। তীরন্দায বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনু রাবী‘আহ এবং পদাতিক বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন সাফওয়ান বিন উমাইয়া। আবু সুফিয়ান ছিলেন সর্বাধিনায়ক এবং তিনি মধ্যভাগে অবস্থান নেন’ (আর-রাহীক্ব ২৫০-৫১ পৃঃ)।
ইসলামী বাহিনীর বিন্যাস ও অগ্রযাত্রা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
দক্ষ গোয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে মাক্কী বাহিনীর যাবতীয় খবর রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে পৌঁছে যায়। তিনি তাদেরকে বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে ত্বরিৎ আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেন এবং ৬ই শাওয়াল শুক্রবার বাদ আছর রওয়ানা হন। ইতিপূর্বে তিনি জুম‘আর খুৎবায় লোকদেরকে ধৈর্য ও দৃঢ়তার উপদেশ দেন এবং তার বিনিময়ে জান্নাত লাভের সুসংবাদ শুনান। অন্ধ সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতূমকে তিনি মদীনার দায়িত্বে রেখে যান, যাতে তিনি মসজিদে সালাতের ইমামতি করেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাঁর এক হাযার ফৌজকে মুহাজির, আউস ও খাযরাজ- তিন বাহিনীতে ভাগ করেন। এ সময় যুদ্ধের প্রধান পতাকা ছিল কালো রংয়ের এবং ছোট পতাকা ছিল সাদা রংয়ের।[তিরমিযী হা/১৬৮১; ইবনু মাজাহ হা/২৮১৮; মিশকাত হা/৩৮৮৭] তিনি মুহাজির বাহিনীর পতাকা দেন মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর হাতে। তিনি শহীদ হবার পর দেন আলী (রাঃ)-এর হাতে। আউসদের পতাকা দেন উসায়েদ বিন হুযায়ের-এর হাতে এবং খাযরাজদের পতাকা দেন হুবাব ইবনুল মুনযির-এর হাতে’ (আর-রাহীক্ব ২৫২ পৃঃ)। তবে এই বিন্যাস বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয় (ঐ, তা‘লীক্ব ১৪৪ পৃঃ)। এক হাযারের মধ্যে ১০০ ছিলেন বর্ম পরিহিত। রাসূল (সাঃ) উপরে ও নীচে দু’টি লৌহবর্ম পরিধান করেন (আবুদাঊদ হা/২৫৯০)। অশ্বারোহী কেউ ছিলেন কি-না সে বিষয়ে মতভেদ রয়েছে।
আল্লাহ তাঁকে শত্রু থেকে রক্ষা করবেন (মায়েদাহ ৫/৬৭), এটা জেনেও রাসূল (সাঃ) নিজের জন্য দ্বিগুণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেন স্বীয় উম্মতকে এটা শিক্ষা দেওয়ার জন্য যে, সকল কাজে দুনিয়াবী রক্ষা ব্যবস্থা পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে হবে। অতঃপর আল্লাহর উপর পরিপূর্ণভাবে ভরসা করতে হবে। আর সর্বোচ্চ নেতার জন্য সর্বোচ্চ রক্ষাব্যবস্থা রাখতে হবে। আর এটি আল্লাহর উপরে তাওয়াক্কুলের বিরোধী নয়।
মদীনা থেকে বাদ আছর আউস ও খাযরাজ নেতা দুই সা‘দকে সামনে নিয়ে রওয়ানা দিয়ে ‘শায়খান’ (الشَّيْخَان) নামক স্থানে পৌঁছে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) স্বীয় বাহিনী পরিদর্শন করেন। বয়সে ১৫ বছরের কম ও অনুপযুক্ত বিবেচনা করে তিনি কয়েকজনকে বাদ দেন। ইবনু হিশাম ও ইবনু সাইয়িদিন নাস-এর হিসাব মতে এরা ছিলেন ১৩ জন। তারা হলেন, (১) উসামাহ বিন যায়েদ, (২) আব্দুল্লাহ বিন উমর, (৩) যায়েদ বিন সাবেত, (৪) উসায়েদ বিন যুহায়ের (أُسَيد بْن ظُهَير) (৫) ‘উরাবাহ বিন আউস (عُرابة بن أوس) (৬) বারা বিন ‘আযেব, (৭) আবু সাঈদ খুদরী, (৮) যায়েদ বিন আরক্বাম, (৯) সা‘দ বিন উক্বায়েব (سَعْد بن عُقَيْب) (১০) সা‘দ ইবনু জাবতাহ(سَعْد بن جَبْةة) (১১) যায়েদ বিন জারীয়াহ আনছারী (ইনি যায়েদ বিন হারেছাহ নন), (১২) জাবের বিন আব্দুল্লাহ (১৩) ‘আমর ইবনু হাযম।
১৫ বছর বয়স না হওয়া সত্ত্বেও রাফে‘ বিন খাদীজ ও সামুরাহ বিন জুনদুবকে নেওয়া হয়। এর কারণ ছিল এই যে, দক্ষ তীরন্দায হিসাবে রাফে‘ বিন খাদীজকে নিলে সামুরাহ বলে উঠেন যে, আমি রাফে‘ অপেক্ষা অধিক শক্তিশালী। আমি তাকে কুস্তিতে হারিয়ে দিতে পারি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে সুযোগ দিলে সত্য সত্যই তিনি কুস্তিতে জিতে যান। ফলে দু’জনেই যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি পান।[3] এর মাধ্যমে জিহাদ ও শাহাদাতের প্রতি মুসলিম তরুণদের আগ্রহ পরিমাপ করা যায় এবং এটাও প্রমাণিত হয় যে, জিহাদের জন্য কেবল আকাংখাই যথেষ্ট নয়, বরং দৈহিক শক্তি ও যোগ্যতা এবং আনুষঙ্গিক প্রস্তুততি আবশ্যক।[4]
‘শায়খানে’ সন্ধ্যা নেমে আসায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সেখানেই রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নেন। অতঃপর মাগরিব ও এশার সালাত আদায় করেন। অতঃপর মুহাম্মাদ বিন মাসলামাহর নেতৃত্বে পঞ্চাশ জনকে পাহারায় রেখে বাকী সবাই ঘুমিয়ে যান। এ সময় যাকওয়ান বিন ‘আব্দে ক্বায়েসকে খাছভাবে কেবল রাসূল (সাঃ)-এর পাহারায় নিযুক্ত করা হয়’ (আর-রাহীক্ব ২৫৩ পৃঃ)। শেষ রাতে ফজরের কিছু পূর্বে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বাহিনীসহ আবার চলতে শুরু করেন এবং শাওত্ব (الشوط) নামক স্থানে পৌঁছে ফজর সালাত আদায় করেন। এখান থেকে মাক্কী বাহিনীকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল। বিশাল কুরায়েশ বাহিনীকে দেখে মুনাফিক নেতা আব্দুল্লাহ বিন উবাই তার তিনশ’ অর্থাৎ প্রায় এক তৃতীয়াংশ সেনাদলকে ফিরিয়ে নিয়ে এই কথা বলতে বলতে চলে গেল যে, مَا نَدْرِي عَلاَمَ نَقْتُل أَنْفُسَنَا ‘জানি না আমরা কিসের জন্য জীবন বিসর্জন দিতে যাচ্ছি’? তারপর সে এ যুক্তি পেশ করল যে, إن الرسول صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ تَرَكَ رَأْيَهُ وَأَطَاعَ غَيْرَهُ ‘রাসূল (সাঃ) তাঁর সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করেছেন ও অন্যদের কথা মেনে নিয়েছেন’ (আর-রাহীক্ব ২৫৩ পৃঃ)। অর্থাৎ তিনি আমাদের মূল্যায়ন করেননি। অথচ এখানে তার প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল মুসলিম বাহিনীতে ফাটল ধরানো। যাতে তারা দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মক্কার আগ্রাসী বিশাল বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সাথীরা ধ্বংস হয়ে যায়। তাতে তার নেতৃত্বের প্রতিদ্বন্দ্বী খতম হয়ে যাবে ও তার জন্য পথ পরিষ্কার হয়ে যাবে। ইসলামী সংগঠনে ফাটল সৃষ্টিকারী কপট ও সুবিধাবাদী নেতাদের চরিত্র সকল যুগে প্রায় একই রূপ।
আব্দুল্লাহ ইবনে উবাই ও তার দলের পশ্চাদপসরণ দেখে আউস গোত্রের বনু হারেছাহ এবং খাযরাজ গোত্রের বনু সালামারও পদস্খলন ঘটবার উপক্রম হয়েছিল এবং তারাও মদীনায় ফিরে যাবার চিন্তা করছিল। কিন্তু আল্লাহর বিশেষ রহমতে তাদের চিত্ত চাঞ্চল্য দূরীভূত হয় এবং তারা যুদ্ধের জন্য সংকল্পবদ্ধ হয়। এ দু’টি দলের প্রতি ইঙ্গিত করেই নাযিল হয়, إِذْ هَمَّت طَّآئِفَتَانِ مِنْكُمْ أَنْ تَفْشَلاَ وَاللهُ وَلِيُّهُمَا وَعَلَى اللهِ فَلْيَتَوَكَّلِ الْمُؤْمِنُوْنَ ‘যখন তোমাদের মধ্যকার দু’টি দল সাহস হারাবার উপক্রম করেছিল, অথচ আল্লাহ ছিলেন তাদের অভিভাবক। অতএব আল্লাহর উপরেই যেন বিশ্বাসীগণ ভরসা করে’ (আলে ইমরান ৩/১২২)। এ সময় মুনাফিকদের ফিরানোর জন্য জাবিরের পিতা আব্দুল্লাহ বিন হারাম তাদের পিছে পিছে চলতে থাকেন ও বলতে থাকেন যে,تَعالَوْا قاتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ أَوِ ادْفَعُوا ‘এসো আল্লাহর পথে যুদ্ধ কর অথবা প্রতিরোধ কর’। কিন্তু তারা বলল,لَوْ نَعْلَمُ أَنَّكُمْ تُقَاتِلُونَ لَمْ نَرْجِعْ ‘যদি আমরা জানতাম যে, তোমরা প্রকৃতই যুদ্ধ করবে, তাহলে আমরা ফিরে যেতাম না’। একথা শুনে আব্দুল্লাহ তাদের বলেন, أَبْعَدَكُمْ اللهُ أَعْدَاءَ اللهِ، فَسَيُغْنِي اللهُ عَنْكُمْ نَبِيَّهُ ‘দূর হ আল্লাহর শত্রুরা। সত্বর আল্লাহ তাঁর নবীকে তোদের থেকে মুখাপেক্ষীহীন করবেন’। এ প্রসঙ্গেই নাযিল হয়,وَلِيَعْلَمَ الْمُؤْمِنِينَ، وَلِيَعْلَمَ الَّذِيْنَ نَافَقُوا ‘এর দ্বারা তিনি মুমিনদের বাস্তবে জেনে নেন’ ‘এবং মুনাফিকদেরও জেনে নেন’ (আলে ইমরান ৩/১৬৬-৬৭)। অর্থাৎ মুনাফিকদের উক্ত জওয়াব ছিল কেবল মুখের। ওটা তাদের অন্তরের কথা ছিল না। এভাবেই আল্লাহ মুসলিম সেনাদলকে ইহূদী ও মুনাফিক থেকে মুক্ত করে নেন এবং অবশিষ্ট প্রায় ৭০০ সেনাদল নিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ওহুদের দিকে অগ্রসর হন।[5]
ইসলামী বাহিনীর শিবির সন্নিবেশ ও শ্রেণীবিন্যাস :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
অতঃপর অগ্রসর হয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে অবতরণ করেন ও সেখানে শিবির স্থাপন করেন। শত্রুসেনারা যাতে পিছন দিক থেকে হামলা করতে না পারে, সেজন্য তিনি দক্ষিণ-পূর্বে প্রায় ১৫০ মিটার দূরে সংকীর্ণ ও স্বল্পোচ্চ গিরিপথে আউস গোত্রের বদরী সাহাবী আব্দুল্লাহ ইবনু জুবায়ের আনছারীর নেতৃত্বে ৫০ জনের একটি তীরন্দায দলকে নিযুক্ত করেন’ (আর-রাহীক্ব ২৫৫ পৃঃ)। যে স্থানটি এখন ‘জাবালুর রুমাত’(جَبَلُ الرُّمَاةِ) বা ‘তীরন্দাযদের পাহাড়’ বলে পরিচিত। তাদেরকে বলে দেওয়া হয় যে, জয় বা পরাজয় যাই-ই হৌক, তারা যেন পরবর্তী নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ঐ স্থান ত্যাগ না করে এবং শত্রুপক্ষ যেন কোনভাবেই এপথ দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। তিনি বলেন, إِنْ رَأَيْتُمُونَا تَخْطَفُنَا الطَّيْرُ، فَلاَ تَبْرَحُوا مَكَانَكُمْ هَذَا حَتَّى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ، وَإِنْ رَأَيْتُمُونَا هَزَمْنَا الْقَوْمَ وَأَوْطَأْنَاهُمْ فَلاَ تَبْرَحُوا حَتَّى أُرْسِلَ إِلَيْكُمْ ‘এমনকি তোমরা যদি আমাদের মৃত লাশে পক্ষীকুলকে ছোঁ মারতে দেখ, তথাপি আমি তোমাদের কাছে কাউকে না পাঠানো পর্যন্ত তোমরা উক্ত স্থান ছেড়ে আসবে না। যদি তোমরা দেখ যে, আমরা তাদেরকে পরাজিত করেছি এবং তাদের পদদলিত করছি, তথাপি তোমরা উক্ত স্থান ছেড়ে আসবে না। যতক্ষণ না আমি তোমাদের কাছে কাউকে পাঠাই’।[বুখারী হা/৩০৩৯; ফাৎহুল বারী ৭/৪০৩] কেননা শত্রুপক্ষ পরাজিত হলে কেবলমাত্র এপথেই তাদের পুনরায় হামলা করার আশংকা ছিল। দূরদর্শী সেনানায়ক রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সেটা বুঝতে পেরেই তাদেরকে এমন কঠোর হুঁশিয়ারী প্রদান করেন। তিনি পাহাড়কে আড়াল করে পিছন ও দক্ষিণ বাহুকে নিরাপদ করেন। আর যে গিরিপথ দিয়ে শত্রুপক্ষের প্রবেশের আশংকা ছিল, সেপথটি তীরন্দাযদের মাধ্যমে সুরক্ষিত করে নেন। অতঃপর শিবির স্থাপনের জন্য একটি উঁচু জায়গা নির্বাচন করেন। যাতে পরাজিত হলেও শত্রুপক্ষ সেখানে পৌঁছতে না পারে এবং তেমন কোন ক্ষতি করতে না পারে। এভাবে তিনি অত্যন্ত দূরদর্শিতার সাথে শিবির সন্নিবেশ করেন। অতঃপর তিনি মুনযির বিন ‘আমরকে ডান বাহুর এবং যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়ামকে বাম বাহুর অধিনায়ক নিযুক্ত করেন। মিক্বদাদ ইবনুল আসওয়াদকে তার সহকারী নিয়োগ করেন। বাম বাহুর প্রধান দায়িত্ব ছিল কুরায়েশ অশ্বারোহী বাহিনী ও তাদের অধিনায়ক খালেদ বিন অলীদকে ঠেকানো। তিনি বড় বড় যোদ্ধাদের সম্মুখ বাহিনীতে রাখেন’ (আর-রাহীক্ব ২৫৬ পৃঃ)। অতঃপর নয়জন দেহরক্ষী নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পিছনে অবস্থান নেন ও যুদ্ধ পরিস্থিতি অবলোকন করতে থাকেন, যাদের মধ্যে ৭ জন ছিলেন আনছার ও ২ জন ছিলেন মুহাজির’।[মুসলিম হা/১৭৮৯ (১০০); আর-রাহীক্ব ২৬৪ পৃঃ]
কুরায়েশদের রাজনৈতিক চাল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(১) যুদ্ধ শুরুর কিছু পূর্বে আবু সুফিয়ান আনছারদের কাছে এই মর্মে পয়গাম পাঠান যে, তোমরা আমাদের ও আমাদের স্বগোত্রীয়দের মাঝখান থেকে সরে দাঁড়াও। আমরা তোমাদের থেকে সরে আসব। তোমাদের সাথে আমাদের যুদ্ধের কোন প্রয়োজন নেই’। কিন্তু আনছারগণ তাদের কূটচাল বুঝতে পেরে তাদেরকে ভীষণভাবে তিরষ্কার করে বিদায় দেন।
(২) প্রথম প্রচেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে কুরায়েশ পক্ষ দ্বিতীয় পন্থা গ্রহণ করল। ইসলামের পূর্বে আউস গোত্রের অন্যতম নেতা ও পুরোহিত ছিলেন আবু ‘আমের আর-রাহেব’। আউস গোত্র ইসলাম কবুল করলে তিনি মক্কায় চলে যান এবং কুরায়েশদের সঙ্গে মিলে মুসলমানদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। কুরায়েশদের ধারণা ছিল যে, তিনি ময়দানে উপস্থিত হলে আনছাররা ফিরে যাবে। সেমতে তিনি ময়দানে এসে আনছারদের উচ্চকণ্ঠে ডাক দেন ও তাদেরকে ফিরে যেতে বলেন। কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না (যাদুল মা‘আদ ৩/১৭৫)। সংখ্যার আধিক্য ও সরঞ্জামের প্রাচুর্য থাকা সত্ত্বেও মুসলমানদের ব্যাপারে কুরায়েশরা কিরূপ ভীত ছিল, উপরোক্ত ঘটনায় তার কিছুটা অাঁচ করা যায়।
উল্লেখ্য যে, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর মদীনায় হিজরতের দিন থেকে হোনায়েন যুদ্ধ পর্যন্ত বড় বড় সকল রণাঙ্গনে আবু ‘আমের আর-রাহেব মুসলমানদের বিরুদ্ধে অংশ নেয়। সেই-ই ওহুদের যুদ্ধে গোপনে গর্ত খুঁড়ে রাখে। যাতে পড়ে গিয়ে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) আহত হন এবং তিনি মারা গেছেন বলে রটিয়ে দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ করার চেষ্টা চালানো হয়। তারই চক্রান্তে ক্বোবায় ‘মসজিদে যেরার’ প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারই প্ররোচনায় রোম সম্রাট সরাসরি মদীনায় হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেন। যা প্রতিরোধ করার জন্য প্রচন্ড দুর্ভিক্ষাবস্থার মধ্যেও রাসূল (সাঃ)-কে রোম সীমান্ত অভিমুখে ৯ম হিজরীতে ‘তাবূক’ অভিযান করতে হয়। অবশেষে সে খ্রিষ্টানদের কেন্দ্রস্থল সিরিয়ার ক্বিন্নাসরীন এলাকায় আত্মীয়-স্বজন থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে। অথচ তার পুত্র হানযালা ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী এবং ওহুদ যুদ্ধের খ্যাতিমান শহীদ ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’। আবু ‘আমের-এর ক্ষোভের কারণ ছিল তার ধর্মীয় নেতৃত্ব হারানো। যেমন ইবনু উবাইয়ের ক্ষোভের কারণ ছিল তার রাজনৈতিক নেতৃত্ব হারানো।
ইতিমধ্যে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহর নেতৃত্বে কুরায়েশ মহিলারা বাদ্য বাজিয়ে নেচে গেয়ে নিজেদের সৈন্যদের উত্তেজিত করে তুলল। এক পর্যায়ে তারা গেয়ে উঠল,
إنْ تُقْبِلوا نُعانِقْ + ونَفْرِشُ النَّمارِقْ
او تُدْبِروا نُفارِقْ + فِراقَ غيرَ وَامِقْ
‘যদি তোমরা অগ্রসর হও, তবে আমরা তোমাদের আলিঙ্গন করব ও তোমাদের জন্য শয্যা রচনা করব’। ‘আর যদি তোমরা পৃষ্ঠ প্রদর্শন করো, তবে আমরা পৃথক হয়ে যাব তোমাদের থেকে চিরদিনের মত’।[ইবনু হিশাম ২/৬৭-৬৮; আর-রাহীক্ব ২৫৮ পৃঃ] এ কবিতা শুনে তাদের সবাই একযোগে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
প্রতীক চিহ্ন :
━━━━━━━
ওহুদের দিন মুসলিম বাহিনীর সম্মিলিত প্রতীক চিহ্ন ছিলيا مَنْصُورُ أَمِتْ ‘হে বিজয়ী! মেরে ফেল’। মুহাজিরদের প্রতীক চিহ্ন ছিলيا بني عَبْد الرَّحْمَن ‘হে বনু আব্দুর রাহমান’। খাযরাজদের প্রতীক চিহ্ন ছিলيا بني عَبْد الله ‘হে বনু আব্দুল্লাহ’। আউসদের প্রতীক চিহ্ন ছিলيا بني عُبَيْد الله ‘হে বনু ওবায়দুল্লাহ’ (ইবনু সা‘দ ২/১০)।
[1]. মুবারকপুরী লিখেছেন, যার পরিমাণ ছিল ১,০০০ উট ও ৫০,০০০ স্বর্ণমুদ্রা (ইবনু সা‘দ ২/২৮; আর-রাহীক্ব ২৪৮ পৃঃ)। কিন্তু এ হিসাবের কোন প্রমাণ নেই। তাছাড়া এ প্রসঙ্গে সূরা আনফাল ৩৬ আয়াতটি নাযিল হয়েছে বলে ইবনু সা‘দ যা বলেছেন, সেটিও বিশুদ্ধ সূত্রে প্রমাণিত নয়। যাতে বলা হয়, إِنَّ الَّذِيْنَ كَفَرُوْا يُنْفِقُوْنَ أَمْوَالَهُمْ لِيَصُدُّوْا عَنْ سَبِيْلِ اللهِ فَسَيُنْفِقُوْنَهَا ثُمَّ تَكُوْنُ عَلَيْهِمْ حَسْرَةً ثُمَّ يُغْلَبُوْنَ وَالَّذِيْنَ كَفَرُوْا إِلَى جَهَنَّمَ يُحْشَرُوْنَ- ‘আল্লাহর রাস্তা হতে লোকদের ফিরানোর জন্য কাফেররা যত ধন-সম্পদ ব্যয় করুক না কেন, সবই ওদের মনস্তাপের কারণ হবে। ওরা পরাভূত হবে। অতঃপর কাফেররা জাহান্নামে একত্রিত হবে’ (আনফাল ৮/৩৬)। বরং সকল যুগের কাফের-মুনাফিকরা তাদের মাল-সম্পদ সর্বদা ইসলামের বিজয় ও অগ্রগতির বিরুদ্ধে ব্যয় করবে এটাই স্বাভাবিক।
[2]. মুবারকপুরী এখানে সূত্রবিহীনভাবে উল্লেখ করেছেন যে, আসার পথে ‘আবওয়া’ (الْأَبْوَاءِ) নামক স্থানে পৌছলে আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ রাসূল (সাঃ)-এর আম্মা বিবি আমেনার কবর উৎপাটন করার প্রস্তাব করেন। কিন্তু বাহিনীর নেতৃবৃন্দ তার এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এর ভয়ংকর পরিণতির কথা চিন্তা করে’ (আর-রাহীক্ব ২৫০ পৃঃ)। ঘটনাটি সূত্রবিহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে’ (আলী বিন ইবরাহীম, সীরাহ হালাবিইয়াহ (বৈরূত : ২য় সংস্করণ ১৪২৭ হিঃ) ২/২৯৭ পৃঃ)। অতএব বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। ‘আবওয়া’ মদীনা থেকে মক্কার পথে ২৫০ কি. মি. দূরে অবস্থিত একটি শহরের নাম।
[3]. ইবনু সাইয়িদিন নাস, উয়ূনুল আছার ২/১১-১৩ পৃঃ; ইবনু হিশাম ২/৬৬। সনদ যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১০৯১)। আকরাম যিয়া উমারী ইবনু সাইয়িদিন নাস-এর বরাতে ১৪ জন বালকের কথা বলেছেন (সীরাহ সহীহাহ ২/৩৮৩)। কিন্তু আমরা সেখানে ১২ জনের নাম পেয়েছি। বাড়তি আরেকজন ‘আমর ইবনু হাযম-এর নাম ইবনু হিশাম উল্লেখ করেছেন (ইবনু হিশাম ২/৬৬)।
[4]. মুবারকপুরী (রহঃ) এখানে লিখেছেন যে, ছানিয়াতুল বিদা‘ (ثَنِيَّةُ الْوَدَاع) পৌঁছে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) অস্ত্র-শস্ত্রে সজ্জিত একটি বাহিনী দেখতে পেয়ে তাদের সম্পর্কে জানতে চান। সাথীরা বললেন যে, ওরা আমাদের পক্ষে যুদ্ধে যাবার জন্য বেরিয়েছে। ওরা খাযরাজ গোত্রের মিত্র বনু ক্বায়নুক্বার ইহূদী। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মুশরিকদের বিরুদ্ধে কাফিরদের সাহায্য নিতে অস্বীকার করলেন (فأبى أن يستعين بأهل الكفر على أهل الشرك) (আর-রাহীক্ব ২৫৩ পৃঃ)। জানা আবশ্যক যে, বদর যুদ্ধের পরে বনু ক্বায়নুক্বার ইহূদীদেরকে মদীনা থেকে শামের দিকে বহিষ্কার করা হয়। অতএব ইসলাম গ্রহণ ছাড়াই এবং রাসূল (সাঃ)-এর অনুমতি ছাড়াই ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে তাদের যোগদানের বিষয়টি অযৌক্তিক এবং অকল্পনীয় বটে।
[5]. এ সময় এক অন্ধ মুনাফিক মিরবা‘ বিন ক্বাইযী (مِرْبع بن قَيْظي)-এর বাগানের মধ্য দিয়ে যেতে গেলে সে মুসলিম বাহিনীর মুখের দিকে ধূলো ছুঁড়ে মেরে রাসূল (সাঃ)-এর উদ্দেশ্যে বলে, তুমি যদি সত্যিকারের রাসূল হও, তবে তোমার জন্য আমার এ বাগানে প্রবেশ করার অনুমতি নেই’। মুসলিম সেনারা তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে রাসূল (সাঃ) নিষেধ করে বলেন, ওকে হত্যা করো না। فَهَذَا أَعْمَى الْقَلْبِ، أَعْمَى الْبَصَرِ ‘সে হৃদয়ে অন্ধ, চোখেও অন্ধ’ (যাদুল মা‘আদ ৩/১৭২; ইবনু হিশাম ২/৬৫; আর-রাহীক্ব ২৫৫ পৃঃ)। বক্তব্যটি ‘মুরসাল’ বা যঈফ (তাহকীক ইবনু হিশাম, ক্রমিক ১০৮৮)।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন