রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ওহুদ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ-২

 

ওহুদ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ-২

১. দুই বৃদ্ধের শাহাদাত লাভ :
━━━━━━━━━━━━━━━━
দুইজন অতি বৃদ্ধ সাহাবী হযরত ইয়ামান ও সাবিত বিন ওয়াক্বশ (ثابت بن وَقْش)-কে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঘাঁটিতে রেখে এসেছিলেন প্রহরা ও ছোটখাট কাজের জন্য। কিন্তু বিপর্যয়কালে তাঁরা শাহাদাত লাভের আকাংখায় ময়দানে ছুটে যান এবং প্রথমজন ভুলক্রমে মুসলমানের হাতে এবং দ্বিতীয় জন কাফিরের হাতে শহীদ হন।[ইবনু হিশাম ২/৮৭; সীরাহ সহীহাহ ২/৩৮৯; হাকেম হা/৪৯০৯]


২. মু‘জেযাসমূহ, যা বিশুদ্ধভাবে প্রমাণিত নয় :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(১) প্রসিদ্ধ আছে যে, ওহুদ যুদ্ধের দিন হযরত ক্বাতাদাহ বিন নু‘মানের একটি চোখ যখমী হওয়ায় তা বেরিয়ে ঝুলে পড়ে। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) নিজ হাতে ওটাকে যথাস্থানে ঢুকিয়ে দেন। তাতে চোখ ঠিক হয়ে যায় এবং তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায় ও দৃষ্টি শক্তি আগের চেয়ে তীক্ষ্ণ হয়।[আর-রাহীক্ব ২৭২ পৃঃ; হাকেম হা/৫২৮১]
(২) ঘাঁটিতে পৌঁছে রাসূল (সাঃ)-কে হামলাকারী উবাই বিন খালাফকে মারার জন্য রাসূল (সাঃ) হারেছ ইবনুছ ছিম্মাহর কাছ থেকে নিয়ে যে বর্শাটি নিক্ষেপ করেছিলেন, তাতে তার গলায় কেবল অাঁচড় কেটে গিয়েছিল। যাতে রক্তপাত পর্যন্ত হয়নি। অথচ তাতেই সে ওহুদ থেকে ফেরার পথে কয়েকদিন পর মক্কায় পৌঁছার আগেই ‘সারিফ’ নামক স্থানে মারা পড়ল।[আর-রাহীক্ব ২৭৫ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭৮; ইবনু হিশাম ২/৮৪]
(৩) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ঘাঁটিতে অবস্থানকালে আবু সুফিয়ান ও খালেদ বিন অলীদের নেতৃত্বে যে দলটি তাঁকে হামলা করার জন্য পাহাড়ে উঠে যায়, তারা যাতে নিকটে পৌঁছতে না পারে, সেজন্য রাসূল (সাঃ) আল্লাহর নিকটে দো‘আ করেন, اللَّهُمَّ إنَّهُ لاَ يَنْبَغِي لَهُمْ أَنْ يَعْلُونَا ‘হে আল্লাহ! তাদের জন্য এটা উচিৎ হবে না যে, তারা আমাদের নিকট উপরে উঠে আসে’। অতঃপর উমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাঃ) ও একদল মুহাজির তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করে পাহাড় থেকে নামিয়ে দিলেন’।[ইবনু হিশাম ২/৮৬] ইবনু ইসহাক এটি সনদবিহীনভাবে বর্ণনা করেছেন। তবে হাদীছে এটিاللَّهُمَّ إِنَّهُ لَيْسَ لَهُمْ أَنْ يَعْلُونَا মর্মে এসেছে।[ আহমাদ হা/২৬০৯; হাকেম হা/৩১৬৩] কিন্তু সেখানে উমর ইবনুল খাত্ত্বাব ও মুহাজিরদের একটি দল তাদের নামিয়ে দেন, এ মর্মে কিছুই বলা হয়নি। বরং ঐ সময় রাসূল (সাঃ)-এর নির্দেশক্রমে আবু সুফিয়ানের সঙ্গে উমর ইবনুল খাত্ত্বাবের কথোপকথন প্রমাণিত আছে।
(৪) একই সময়ে রাসূল (সাঃ) সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছকে বলেন,اُجْنُبْهُمْ او يَقُولُ اُرْدُدْهُمْ ‘ওদেরকে দুর্বল করে দাও। অথবা বললেন, ওদেরকে ফিরিয়ে দাও’। তখন সা‘দ বললেন,كَيْفَ أَجْنُبُهُمْ وَحْدِي ‘কিভাবে আমি একা ওদের দুর্বল করে দেব’? অতঃপর রাসূল (সাঃ) তাকে তিনবার একই নির্দেশ দিলে তিনি নিজের তূণ থেকে একটা তীর বের করে নিক্ষেপ করেন। তাতে শত্রুপক্ষের একজন নিহত হয়। তিনি বলেন, অতঃপর আমি ঐ তীর নিয়ে নিলাম এবং দ্বিতীয় আরেক শত্রুকে মারলাম। সেও নিহত হল। আমি আবার ঐ তীর নিয়ে নিলাম ও তৃতীয় আরেক শত্রুকে মারলাম। তাতে সেও মারা পড়ে। এর ফলে শত্রুরা ভয়ে নীচে নামতে লাগল। আমি ঐ তীর এনে আমার তূণের মধ্যে রেখে দিলাম। আমি বললাম,هَذَا سَهْمٌ مُبَارَكٌ ‘এটা বরকতপূর্ণ তীর’। এই তীরটি সা‘দের নিকটে আমৃত্যু ছিল এবং তাঁর পরে তাঁর সন্তানদের কাছে ছিল (যাদুল মা‘আদ ৩/১৮৪)। অতঃপর হযরত উমর ও মুহাজিরগণের একটি দল ধাওয়া করে তাদেরকে পাহাড়ের উপর থেকে নীচে নামিয়ে দেয় (আর-রাহীক্ব ২৭৬ পৃঃ)।


৩. আবু সুফিয়ান ও হযরত উমরের কথোপকথন :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
যুদ্ধ শেষে মাক্কী বাহিনী প্রত্যাবর্তনের প্রস্তুততি গ্রহণ শেষ করে প্রধান সেনাপতি আবু সুফিয়ান ওহুদ পাহাড়ে উঠে উচ্চৈঃস্বরে বললেন,أَفِيكُمْ مُحَمَّدٌ؟ ‘তোমাদের মধ্যে মুহাম্মাদ আছে কি’?أَفِيكُمْ ابْنُ أَبِي قُحَافَةَ؟ ‘তোমাদের মধ্যে আবু কুহাফার বেটা (আবুবকর) আছে কি’?أَفِيكُمْ عُمَرُ بْنُ الْخَطّابِ؟ ‘তোমাদের মধ্যে উমর ইবনুল খাত্ত্বাব আছে কি’? রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমরা তার কথার জবাব দিয়ো না। তিনবার করে বলার পর জবাব না পেয়ে সে বলে উঠল, নিশ্চয়ই তারা নিহত হয়েছে। বেঁচে থাকলে তারা জবাব দিত। তখন উমর নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি (উচ্চৈঃস্বরে) বললেন, كَذَبْتَ يَا عَدُوَّ اللهِ ، أَبْقَى اللهُ عَلَيْكَ مَا يُخْزِيكَ ‘হে আল্লাহর দুশমন! তুমি মিথ্যা বলেছ। আল্লাহ তোমাকে লাঞ্ছিত করার উৎস সবাইকে বাঁচিয়ে রেখেছেন’। জবাবে আবু সুফিয়ান বলে উঠলেন, أُعْلُ هُبَلُ ‘হোবল দেবতার জয় হৌক’। তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বললেন, তোমরা ওর কথার জবাব দাও। সাহাবীগণ বললেন, আমরা কি বলব? রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমরা বল, اللهُ أعْلَى وأَجَلُّ ‘আল্লাহ সর্বোচ্চ ও সবচেয়ে সম্মানিত’। আবু সুফিয়ান বললেন, لَنَا عُزَّى وَلاَ عُزَّى لَكُمْ ‘আমাদের জন্য ‘উযযা দেবী রয়েছে, তোমাদের ‘উযযা নেই’। জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, তোমরা বল, اللهُ مَوْلاَنَا وَلاَ مَوْلَى لَكُمْ ‘আল্লাহ আমাদের অভিভাবক। আর তোমাদের কোন অভিভাবক নেই’। তখন আবু সুফিয়ান বললেন,يَوْمٌ بِيَوْمِ بَدْرٍ وَإِنَّ الْحَرْبَ سِجَالٌ ‘আজকের দিনটি বদরের দিনের প্রতিশোধ। নিশ্চয়ই যুদ্ধ হল বালতির ন্যায়’। অর্থাৎ যুদ্ধে কখনো একদল জয়ী হয়, কখনো অন্যদল। যেমন বালতি একবার একজনে টেনে তোলে, আরেকবার অন্যজনে (বুখারী হা/৩০৩৯, ৪০৪৩)। জবাবে উমর (রাঃ) বললেন, لاَ سَوَاءٌ قَتْلاَنَا فِي الْجَنَّةِ وَقَتْلاَكُمْ فِي النَّار ‘না সমান নয়। আমাদের নিহতেরা জান্নাতে, আর তোমাদের নিহতেরা জাহান্নামে’। অতঃপর আবু সুফিয়ান (সম্ভবতঃ নিজের পাপবোধ থেকে কৈফিয়তের সুরে) বললেন,أَمَا إِنَّكُمْ سَوْفَ تَجِدُونَ فِى قَتْلاَكُمْ مُثْلاً وَلَمْ يَكُنْ ذَاكَ عَنْ رَأْىِ سَرَاتِنَا. قَالَ ثُمَّ أَدْرَكَتْهُ حَمِيَّةُ الْجَاهِلِيَّةِ قَالَ فَقَالَ أَمَا إِنَّهُ قَدْ كَانَ ذَاكَ وَلَمْ نَكْرَهْهُ ‘তবে তোমরা সত্বর তোমাদের নিহতদের মধ্যে অনেকের অঙ্গহানি দেখতে পাবে। যাতে আমাদের নেতাদের নির্দেশ ছিল না’। রাবী বলেন, এ কথা বলার পরে তাকে জাহেলিয়াতের উত্তেজনা গ্রাস করে। অতঃপর তিনি বলেন, হ্যাঁ এটা হয়েছে। তবে আমরা এটাকে অপসন্দ করিনি’ (আহমাদ হা/২৬০৯, সনদ হাসান)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, وَاللهِ مَا رَضِيتُ، وَمَا سَخِطْتُ، وَمَا نَهَيْتُ، وَمَا أَمَرْتُ ‘আল্লাহর কসম! আমি এতে খুশী নই, নাখোশও নই। আমি এতে নিষেধ করিনি, নির্দেশও দেইনি’।
এরপর আবু সুফিয়ান উমর (রাঃ)-কে কাছে ডাকলে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তাকে অনুমতি দিলেন। কাছে গেলে আবু সুফিয়ান বললেন,أَنْشُدُكَ اللهَ يَا عُمَرُ، أَقَتَلْنَا مُحَمَّدًا؟ ‘আমি তোমাকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে বলছি হে উমর! আমরা কি মুহাম্মাদকে হত্যা করেছি’? উমর বললেন, اللَّهُمَّ لاَ ‘আল্লাহর কসম! না।وَإِنَّهُ لَيَسْمَعُ كَلَامَكَ الْآنَ ‘তিনি এখন তোমার কথা শুনছেন’। জবাবে আবু সুফিয়ান বললেন, أَنْتَ عِنْدِي أَصْدَقُ مِنَ ابْنِ قَمِئَةَ وَأَبَرُّ ‘তুমি আমার নিকটে ইবনু ক্বামিআহর চাইতে অধিক সত্যবাদী ও অধিক সৎ’।[1] কেননা তিনি ধারণা করতেন যে, আব্দুল্লাহ ইবনু ক্বামিআহ লায়ছী রাসূল (সাঃ)-কে হত্যা করেছে।


৪. জান্নাতের সুগন্ধি লাভ :
━━━━━━━━━━━━━━━
(ক) আনাস বিন নাযার : ইনি আনাস বিন মালেক (রাঃ)-এর চাচা ছিলেন। তিনি বদর যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে না পারায় দুঃখিত ছিলেন এবং ওহুদ যুদ্ধে যোগদান করেন। অতঃপর যুদ্ধের দ্বিতীয় ভাগে মুসলিম বাহিনীর বিপর্যয়কালে তিনি বলেন, اللَّهُمَّ إنِّي أَعْتَذِرُ إلَيْكَ مِمّا صَنَعَ هَؤُلَاءِ يَعْنِي الْمُسْلِمِينَ وَأَبْرَأُ إلَيْكَ مِمّا صَنَعَ هَؤُلاَءِ يَعْنِي الْمُشْرِكِينَ ‘হে আল্লাহ এই লোকগুলি অর্থাৎ (তীরন্দায) মুসলমানেরা যা করেছে সেজন্য আমি তোমার নিকটে ক্ষমা প্রার্থনা করছি এবং ওরা অর্থাৎ মুশরিকেরা যা করছে, তা হতে আমি নিজেকে দায়মুক্ত ঘোষণা করছি’। একথা বলে তিনি সম্মুখে অগ্রসর হলে আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ)-এর সাথে সাক্ষাৎ হয়। তিনি তাকে বললেন, أَيْنَ يَا سَعْدُ إِنِّى أَجِدُ رِيحَ الْجَنَّةِ دُونَ أُحُدٍ ‘কোথায় যাচ্ছ হে সা‘দ! আমি ওহুদের পিছন থেকে জান্নাতের সুগন্ধি পাচ্ছি’।
অতঃপর তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে গেলেন ও প্রাণপণ যুদ্ধ করে শহীদ হলেন। ঐদিন বর্শা, তীর ও তরবারির ৮০টির অধিক যখম লেগে তার দেহ ঝাঝরা হয়ে গিয়েছিল। কেবল আঙ্গুলের মাথাগুলি দেখে তার ভগ্নী রবী‘ বিনতে নযর তাকে চিনতে পারেন। কাফেররা তার বিভিন্ন অঙ্গ কর্তন করেছিল। রাবী আনাস বিন মালেক (রাঃ) বলেন, আমরা ধারণা করতাম যে, সূরা আহযাব ২৩ আয়াতটি তাঁর বা তাঁর মতো অন্যদের কারণেই নাযিল হয়েছে।[বুখারী হা/২৮০৫, ৪৭৮৩] যেখানে বলা হয়েছে, مِنَ الْمُؤْمِنِينَ رِجَالٌ صَدَقُوا مَا عَاهَدُوا اللهَ عَلَيْهِ فَمِنْهُمْ مَنْ قَضَى نَحْبَهُ وَمِنْهُمْ مَنْ يَنْتَظِرُ وَمَا بَدَّلُوا تَبْدِيلاً ‘মুমিনদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি আছে যারা আল্লাহর সাথে কৃত ওয়াদা পূর্ণ করেছে। তাদের মধ্যে কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এবং কেউ প্রতীক্ষা করছে। তারা তাদের সংকল্প মোটেই পরিবর্তন করেনি’ (আহযাব ৩৩/২৩)। বিশেষ কোন প্রেক্ষিতে নাযিল হলেও অত্র আয়াত সকল যুগের সকল মুজাহিদের জন্য প্রযোজ্য।
(খ) সা‘দ বিন রবী‘: যুদ্ধ শেষে আহত ও নিহতদের সন্ধানকালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যায়েদ বিন সাবিতকে পাঠান সা‘দ বিন রবী‘-এর সন্ধানে। বলে দিলেন যদি তাকে জীবিত পাও, তবে আমার সালাম বলো এবং আমার কথা বলবে যে, আল্লাহর রাসূল তোমাকে বলেছেন,كَيْفَ تَجِدُك؟ ‘তুমি নিজেকে কেমন পাচ্ছ? যায়েদ বলেন, আমি তাকে যখন পেলাম, তখন তাঁর মৃত্যুক্ষণ এসে গিয়েছে। তিনি ৭০-এর অধিক যখম প্রাপ্ত হয়েছিলেন। আমি তাকে রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর সালাম জানিয়ে তাঁর কথাটি জানিয়ে দিলাম। তখন তিনি রাসূল (সাঃ)-কে সালাম দিতে বললেন এবং বললেন, তুমি তাঁকে বলো,يَا رَسُولَ اللهِ أَجِدُ رِيحَ الْجَنَّةِ ‘হে আল্লাহর রাসূল! আমি জান্নাতের সুগন্ধি পাচ্ছি’। অতঃপর আমার কওম আনছারদের বলো, তাদের একজনও বেঁচে থাকতে যদি শত্রুরা রাসূল (সাঃ)-এর নিকট পর্যন্ত পৌঁছে যায়, তবে আল্লাহর নিকটে তাদের কোন কৈফিয়ত চলবে না’। পরক্ষণেই তাঁর প্রাণবায়ু নির্গত হল।[হাকেম হা/৪৯০৬, হাদীছ সহীহ] ইনি ছিলেন ১৩ নববী বর্ষে মক্কায় অনুষ্ঠিত বায়‘আতে কুবরার দিন রাসূল (সাঃ)-এর নিযুক্ত ১২ জন নক্বীবের অন্যতম এবং খাযরাজ গোত্রের অন্যতম নেতা।


৫. এক ওয়াক্ত সালাত আদায় না করেও জান্নাতী হলেন যারা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(১) আউস গোত্রের বনু ‘আব্দিল আশহাল শাখার ‘আমর বিন সাবিত আল-উছায়রিম(عَمْرو بن ثابت الْأُصَيْرِمِ) কে আহতদের মধ্যে দেখতে পেয়ে হতাহতদের সন্ধানকারী মুসলিম বাহিনী হতবাক হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন,مَا الَّذِي جَاءَ بِك؟ أَحَدَبٌ عَلَى قَوْمِك أَمْ رَغْبَةٌ فِي الْإِسْلاَمِ؟ ‘কোন বস্ত্ত তোমাকে এখানে এনেছে? নিজ সম্প্রদায়কে সাহায্য করার উত্তেজনা, না-কি ইসলামের আকর্ষণ? উত্তরে তিনি বললেন, بَلْ رَغْبَةٌ فِي الْإِسْلاَمِ آمَنْتُ بِاَللهِ وَرَسُولِهِ ثُمَّ قَاتَلْتُ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ حَتَّى أَصَابَنِي مَا تَرَوْنَ ‘বরং ইসলামের আকর্ষণ। আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের উপরে ঈমান এনেছি। অতঃপর আল্লাহর রাসূল (সাঃ)-এর সাথে যুদ্ধ করেছি। অতঃপর যে অবস্থায় উপনীত হয়েছি, তাতো তোমরা দেখছই’। এরপরেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার বিষয়টি রাসূল (সাঃ)-কে বলা হলে তিনি বলেন, إِنَّهُ لَمِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ ‘নিশ্চয়ই সে জান্নাতবাসী’।[যাদুল মা‘আদ ৩/১৮০; আহমাদ হা/২৩৬৮৪] রাসূলুল্লাহ (সাঃ) আরও বলেন,عَمِلَ قَلِيلاً وَأُجِرَ كَثِيرًا ‘কম আমল করল এবং পুরস্কার বেশী পেল’।[যাদুল মা‘আদ ৩/৪২; বুখারী ফৎহসহ হা/২৮০৮] আবু হুরায়রা (রাঃ) বলেন,وَلَمْ يُصَلِّ لِلَّهِ صَلاَةً قَطٌّ ‘অথচ তিনি আল্লাহর জন্য এক রাক‘আত সালাতও কখনো আদায় করেননি’।[আহমাদ হা/২৩৬৮৪; যাদুল মা‘আদ ৩/১৮০. আর-রাহীক্ব পৃঃ ২৮০, ১৪৬]
উল্লেখ্য যে, দ্বাদশ নববী বর্ষে মক্কায় অনুষ্ঠিত ২য় বায়‘আতের পর ১২ জন মুসলমানের সাথে ইসলামের প্রথম দাঈ হযরত মুছ‘আব বিন ওমায়েরকে মদীনায় পাঠানো হলে তাঁর দাওয়াতে আউস নেতা সা‘দ বিন মু‘আয ইসলাম কবুল করেন এবং স্বীয় গোত্রের সকলকে আল্লাহর দোহাই দিয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই ইসলাম কবুলের আহবান জানান। নইলে তাদের সঙ্গে তিনি কথা বলা হারাম ঘোষণা করেন। এমতাবস্থায় সন্ধ্যার মধ্যে সবাই ইসলাম কবুল করে। কেবলমাত্র উছায়রিম বাকী থাকে। উক্ত ঘটনার চার বছর পরে ওহুদ যুদ্ধের দিন তিনি স্বেচ্ছায় ইসলামের কালেমা পাঠ করে যুদ্ধক্ষেত্রে ছুটে যান এবং শহীদ হয়ে যান।[ইবনু হিশাম ১/৪৩৭, ২/৯০; যাদুল মা‘আদ ৩/১৮০]
(২) আমর ইবনু উক্বাইশ(عَمْرو بن أُقَيْشٍ) : জাহেলী যুগে তার সূদের টাকা পাওনা ছিল। সেগুলি আদায়ের আগ পর্যন্ত তিনি ইসলাম কবুলে অনাগ্রহী ছিলেন। পরে তিনি ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন। অতঃপর তিনি ওহুদের দিন চলে আসেন এবং গোত্র নেতা সা‘দ বিন মু‘আয ও তার গোত্রীয় ভাইদের খোঁজ করেন। তিনি জানতে পারেন যে, তারা সবাই ওহুদের যুদ্ধে চলে গেছেন। তখন তিনি পোশাক পরে যুদ্ধের ময়দানে চলে যান। তাকে এ অবস্থায় দেখে মুসলমানরা নিষেধ করল। কিন্তু তিনি বললেন, ‘আমি ঈমান এনেছি’। অতঃপর তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হন এবং আহত অবস্থায় মদীনায় নীত হন। তখন সা‘দ বিন মু‘আয (রাঃ) তার কাছে গিয়ে তার বোনকে বলেন, তুমি ওকে জিজ্ঞেস কর তুমি কি তোমার গোত্রীয় উত্তেজনায় গিয়েছিলে, নাকি আল্লাহর প্রতি ভালোবাসার টানে গিয়েছিলে? জবাবে তিনি বললেন,بَلْ غَضَبًا لِلَّهِ وَلِرَسُولِهِ فَمَاتَ. فَدَخَلَ الْجَنَّةَ وَمَا صَلَّى لِلَّهِ صَلاَةً ‘বরং আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের মহববতের টানে’। অতঃপর তিনি মৃত্যুবরণ করেন ও জান্নাতে প্রবেশ করেন। অথচ তিনি আল্লাহর জন্য এক ওয়াক্ত সালাতও আদায় করেননি’।[2]


৬. ইসলামের পক্ষে লড়াই করেও জাহান্নামী হল যারা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(১) মদীনার বনু যাফর(بنو ظَفر) গোত্রের ‘কুযমান’ (قُزمان) ওহুদ যুদ্ধে রাসূল (সাঃ)-এর পক্ষে বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেছিল। সে একাই কুরায়েশ বাহিনীর ৪ জন পতাকাবাহীসহ ৭/৮ জন শত্রুসৈন্য খতম করেছিল। যুদ্ধের ময়দানে তাকে আহত অবস্থায় পাওয়া গেলে মুসলিম সেনারা তাকে উঠিয়ে মদীনায় তার মহল্লায় নিয়ে যান এবং জান্নাতের সুসংবাদ শুনান। তখন সে বলল, وَاللهِ إنْ قَاتَلْتُ إلاَّ عَنْ أَحْسَابِ قَوْمِي، وَلَوْلاَ ذَلِكَ مَا قَاتَلْتُ ‘আল্লাহর কসম! আমি যুদ্ধ করেছি আমার বংশের গৌরব রক্ষার জন্য। যদি এটা না থাকত, তাহলে আমি যুদ্ধই করতাম না’। অতঃপর যখন তার যখমের যন্ত্রণা অত্যধিক বৃদ্ধি পেল, তখন সহ্য করতে না পেরে সে নিজের তীর দিয়ে নিজেকে হত্যা করে ফেলল। তার বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে রাসূল (সাঃ) বলেন,إنَّهُ لَمِنْ أَهْلِ النَّارِ ‘নিশ্চয়ই সে জাহান্নামী’। প্রকৃত অর্থে সে ছিল একজন মুনাফিক।[ইবনু হিশাম ২/৮৮] বংশ গৌরবের উত্তেজনাই তাকে যুদ্ধে টেনে এনেছিল। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, إنَّ السَّيْفَ لاَ يَمْحُو النِّفَاقَ ‘তরবারি নিফাককে দূরীভূত করে না’।[মিশকাত হা/৩৮৫৯ ‘জিহাদ’ অধ্যায়, সনদ সহীহ] অর্থাৎ জিহাদে নিহত হলেও মুনাফেকীর পাপের কারণে সে জাহান্নামী হয়।
(২) হারেছ বিন সুওয়াইদ বিন সামেত আনছারী : এ ব্যক্তি বাহ্যিকভাবে মুসলমান ছিল। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে সে মুনাফিক ছিল। মুসলমানদের পক্ষে সে ওহুদ যুদ্ধে যোগদান করে। কিন্তু যুদ্ধের মধ্যে সে তার স্বপক্ষীয় মুজাযযার বিন যিয়াদ আল-বালাওয়া (مُجَذَّر بن زياد البَلَوى) আনছারীকে হত্যা করে মক্কায় পালিয়ে যায়। সে তাকে মেরে কুফরী অবস্থায় আউস ও খাযরাজের মধ্যকার কোন এক যুদ্ধে তার পিতা সুওয়াইদকে হত্যার প্রতিশোধ নিয়েছিল। আর এজন্য সে যুদ্ধের ময়দানকে সুযোগ হিসাবে বেছে নিয়েছিল।[ইবনু সা‘দ ৩/৪১৭; ইবনু হিশাম ২/৮৯]
এতে স্পষ্ট হয় যে, কেবলমাত্র আল্লাহর কালেমাকে বুলন্দ করার উদ্দেশ্য ব্যতীত অন্য কোন উদ্দেশ্যে যুদ্ধকারীর পরিণতি জাহান্নাম ছাড়া কিছুই নয়। রাসূল (সাঃ)-এর পতাকাতলে জিহাদে শরীক হয়েও উক্ত ব্যক্তিদ্বয় জান্নাত থেকে মাহরূম হয়ে গেল নিয়তে ত্রুটি থাকার কারণে। অথচ উছায়রিম ও ‘আমর বিন উক্বাইশ (রাঃ) এক ওয়াক্ত সালাত আদায় না করেও কেবল আল্লাহর কালেমাকে সমুন্নত করার খালেছ নিয়তের কারণে জান্নাতী হলেন। এজন্যেই হাদীছে বলা হয়েছে,إِنَّمَا الأَعْمَالُ بِالنِّيَّاتِ ‘সকল কাজ নিয়তের উপর নির্ভরশীল’।[বুখারী হা/১; মুসলিম হা/১৯০৭]


৭. উত্তম ইহূদী :
━━━━━━━━━
ওহুদ যুদ্ধে মুসলিম বাহিনীর নিহতদের মধ্যে মুখাইরীক্ব (مُخَيْرِيقٌ) নামের এক ইহূদী আলেমকে পাওয়া গেল। যিনি বনু নাযীর ইহূদী গোত্রের বনু ছা‘লাবাহ শাখার অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তিনি খেজুর বাগিচাসহ বহু মাল-সম্পদের অধিকারী ছিলেন। তিনি রাসূল (সাঃ)-এর গুণাবলী সম্পর্কে অবগত ছিলেন এবং তাঁর দ্বীনের প্রতি সর্বদা অনুরক্ত ছিলেন। ইতিমধ্যে ওহুদের যুদ্ধ উপস্থিত হয়। ঐ দিন ছিল শনিবার। যুদ্ধ চলাকালে তিনি স্বীয় গোত্রকে বলেন,يَا مَعْشَرَ يَهُودَ وَاللهِ لَقَدْ عَلِمْتُمْ أَنَّ نَصْرَ مُحَمَّدٍ عَلَيْكُمْ لَحَقٌّ ‘হে ইহূদীগণ! তোমরা জান যে, মুহাম্মাদকে সাহায্য করা তোমাদের উপর অবশ্য কর্তব্য’। তারা বলল, الْيَوْمَ يَوْمُ السَّبْتِ ‘আজকে যে শনিবার’। তিনি বললেন,لاَ سَبْتَ لَكُمْ ‘তোমাদের জন্য কোন শনিবার নেই’। এই বলে তিনি তরবারি ও অন্যান্য যুদ্ধ সরঞ্জামাদি উঠিয়ে নিয়ে বলেন,إِنْ أُصِبْتُ فَمَالِي لِمُحَمَّدٍ يَصْنَعُ فِيهِ مَا شَآءَ ‘যদি আমি আজকে নিহত হই, তাহলে আমার মালামাল সব মুহাম্মাদের হবে। তিনি তা নিয়ে যা খুশী করবেন, যা আল্লাহ তাঁকে নির্দেশ দিবেন’। এরপর তিনি যুদ্ধে গিয়ে নিহত হন। তাঁর সম্পর্কে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন,مُخَيْرِيقُ خَيْرُ يَهُودَ ‘মুখাইরীক্ব একজন উত্তম ইহূদী’।[3] অর্থাৎ ইহূদী থেকে মুসলমান হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে ঐ দিন যারা যুদ্ধে উপস্থিত ছিলেন, তাদের মধ্যে তিনি উত্তম ছিলেন। নইলে ইতিপূর্বে ইসলাম কবুলকারী বিখ্যাত ইহূদী আলেম আব্দুল্লাহ বিন সালাম (রাঃ) ছিলেন সর্বোত্তম ও স্বীয় জীবদ্দশায় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত সাহাবী’ (বুখারী হা/৩৮১২-১৩)। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বনু নাযীর গোত্রে তার পরিত্যক্ত সাতটি খেজুর বাগান আল্লাহর রাস্তায় ওয়াফক করে দেন এবং এটাই ছিল মদীনার প্রথম ওয়াকফ ভূমি।[মুসলিম, শরহ নববী হা/১৭৫৯ (৫৪); ইবনু হিশাম ১/৫১৮]


৮. শহীদের রক্ত মিশকের ন্যায় সুগন্ধিময় :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
ওহুদ যুদ্ধে নিহত শহীদগণের লাশ পরিদর্শনকালে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,أَنَا شَهِيدٌ عَلَى هَؤُلاَءِ ‘আমি এদের উপরে সাক্ষী থাকব’। অতঃপর তিনি বলেন, لاَ يُكْلَمُ أَحَدٌ فِى سَبِيلِ اللهِ- وَاللهُ أَعْلَمُ بِمَنْ يُكْلَمُ فِى سَبِيلِهِ- إِلاَّ جَاءَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ وَجُرْحُهُ يَثْعَبُ، اللَّوْنُ لَوْنُ دَمٍ وَالرِّيحُ رِيحُ مِسْكٍ ‘কেউ আল্লাহর রাস্তায় আহত হলে, আর আল্লাহ ভালো জানেন কে তার রাস্তায় আহত হয়েছে, ক্বিয়ামতের দিন সে এমন অবস্থায় উপস্থিত হবে যে, তার ক্ষতস্থান হতে রক্ত ঝরতে থাকবে। যার রং হবে রক্তের ন্যায়, কিন্তু সুগন্ধি হবে মিশকের ন্যায়’।[বুখারী হা/২৮০৩; মুসলিম হা/১৮৭৬; মিশকাত হা/৩৮০২]


৯. ল্যাংড়া শহীদ :
━━━━━━━━━━
‘আমর ইবনুল জামূহ ল্যাংড়া ছিলেন বিধায় তার ব্যাঘ্রসম চার পুত্র জিহাদে যান ও পিতাকে যেতে নিষেধ করেন। কিন্তু তিনি রাসূল (সাঃ)-কে এসে বললেন, আমি যদি এই ল্যাংড়া পায়ে যুদ্ধ করে নিহত হই, তাহলে কি জান্নাত পাব? জবাবে রাসূল (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ পাবে। কিন্তু তোমার জন্য যুদ্ধ মাফ। তখন তিনি বলে উঠলেন, فَوَاللهِ إنِّي لَأَرْجُو أَنْ أَطَأَ بِعَرْجَتِي هَذِهِ فِي الْجَنَّةِ ‘আল্লাহর কসম! এই ল্যাংড়া পা নিয়েই আজ আমি জান্নাত মাড়াব। তখন রাসূল (সাঃ) তার ছেলেদের উদ্দেশ্যে বললেন,مَا عَلَيْكُمْ أَنْ لاَ تَمْنَعُوهُ، لَعَلَّ اللهَ أَنْ يَرْزُقَهُ الشَّهَادَةَ ‘তোমরা তাকে নিষেধ করো না। আল্লাহ হয়ত এর মাধ্যমে তাঁকে শাহাদাত দান করবেন’। অতঃপর তিনি যুদ্ধে নামেন ও শহীদ হয়ে যান।[ইবনু হিশাম ২/৯০; যাদুল মা‘আদ ৩/১৮৭] অন্য বর্ণনায় এসেছে যে, তার লাশেল পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন,كَأَنِّى أَنْظُرُ إِلَيْكَ تَمْشِى بِرِجْلِكَ هَذِهِ صَحِيحَةً فِى الْجَنَّةِ ‘আমি যেন তোমাকে দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি সুস্থ পা নিয়ে জান্নাতে বিচরণ করছ’ (আহমাদ হা/২২৬০৬, সনদ ‘হাসান’)।


১০. শুহাদা কবরস্থান :
━━━━━━━━━━━━━
অনেকে শহীদদের লাশ মদীনায় স্ব স্ব বাড়ীতে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সব লাশ ফেরত আনার নির্দেশ দেন। অতঃপর বিনা গোসলে তাদের পরিহিত যুদ্ধ পোষাকে (বর্তমান শুহাদা কবরস্থানে) এক একটি কবরে দু’তিনজনকে দাফন করা হয়। একটি কাপড়ে দু’জনকে কাফন পরানো হয়। অতঃপর ‘লাহদ’ বা পাশখুলি কবর খোড়া হয়। অতঃপর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) জিজ্ঞেস করেন,أَيُّهُمْ أَكْثَرُ أَخْذًا لِلْقُرْآنِ؟ এদের মধ্যে সর্বাধিক কুরআন জানতেন কে’? লোকেরা ইঙ্গিত দিলে তিনি তাকেই আগে কবরে নামাতেন। জাবের (রাঃ)-এর পিতা আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর বিন হারাম এবং ‘আমর ইবনুল জামূহকে তিনি এক কবরে রাখেন। কেননা তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল’ (ইবনু হিশাম ২/৯৮)।
অনুরূপ হযরত হামযা (রাঃ) ও আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শকে একই কবরে রাখা হয়। কেননা তিনি ছিলেন মামা-ভাগিনা।[4] তাঁদের উভয়েরই অঙ্গহানি করা হয়েছিল। তবে তাদের কলিজা বের করা হয়নি (ইবনু হিশাম ২/৯৭)। তাদের জন্য কাফনের কাপড় যথেষ্ট না হওয়ায় মাথা ঢেকে দিয়ে পায়ের উপরে ‘ইযখির’ (الإذخر) ঘাস দেওয়া হয়।[আহমাদ হা/২৭২৬২; মিশকাত হা/১৬১৫।] মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর সাথে কেবল একটি চাদর ছিল। তাতে কাফনের কাপড়ে কমতি হলে তাঁরও ইযখির ঘাস দিয়ে পা ঢাকা হয় (বুখারী হা/১২৭৬)। ইবনু মাসঊদ (রাঃ) বলেন, হামযার জন্য দো‘আ করার সময় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) এত কেঁদেছিলেন যে, তাঁর স্বর উঁচু হয়ে যায় এবং আমরা তাঁকে এত কাঁদতে কখনো দেখিনি’ (সীরাহ হালাবিইয়াহ ২/৫৩৪)। এখানেও শহীদদের উদ্দেশ্যে আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেন, أَنَا شَهِيدٌ عَلَى هَؤُلاَءِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ‘ক্বিয়ামতের দিন আমি এদের সকলের উপরে সাক্ষী হব’। তাদের গোসল দেওয়া হয়নি এবং কারু জানাযা হয়নি’।[বুখারী হা/১৩৪৩, ৪০৭৯; মিশকাত হা/১৬৬৫; আহমাদ হা/২৩৭০৭]


১১. ভাইয়ের লাশ দেখতে মানা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
হযরত হামযার বোন ছাফিয়া বিনতে আব্দুল মুত্ত্বালিব ছুটে এসেছেন ভাইয়ের লাশ শেষবারের মত দেখার জন্য। কিন্তু রাসূলুল্লাহ (সাঃ) পুত্র যুবায়েরকে বললেন, তিনি যেন তার মাকে ফিরিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু তিনি বাধা না মেনে বলেন, কেন বাধা দিচ্ছ। আমি শুনেছি, আমার ভাইয়ের নাক-কান কাটা হয়েছে। وَذَلِكَ فِي اللهِ ‘আর তা হয়েছে আল্লাহর পথে’। তাতে আমি সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট রয়েছি। لَأَحْتَسِبَن وَلَأَصْبِرَن إنْ شَآءَ اللهُ ‘আল্লাহ চাহেন তো আমি এতে ছওয়াব কামনা করব এবং অবশ্যই ধৈর্য ধারণ করব’। একথা শোনার পর রাসূল (সাঃ) তাকে অনুমতি দেন। অতঃপর তিনি ভাইয়ের লাশের কাছে পৌঁছেন এবং তার জন্য দো‘আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করেন।[ইবনু হিশাম ২/৯৭; আল-বিদায়াহ ৪/৪২]


১২. শহীদগণের জন্য বিদায়ী দো‘আ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
দাফন শেষে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামকে পিছনে সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে দীর্ঘক্ষণ ধরে আল্লাহর প্রশংসা করেন ও তাঁর নিকটে প্রার্থনা করেন।[বুখারী, আল-আদাবুল মুফরাদ হা/৫৪১; আহমাদ হা/১৫৫৩১, ২২০০১] উল্লেখ্য যে, শোহাদা কবরস্থানটি চারদিকে পাঁচিল দিয়ে বর্তমানে ঘেরা রয়েছে। নির্দিষ্টভাবে কোন কবরের চিহ্ন সেখানে নেই।


১৩. মদীনা ফেরার পথে মহিলাদের আকুতিপূর্ণ ঘটনাবলী :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(ক) হামনাহ বিনতে জাহশ : মদীনায় ফেরার সময় পথিমধ্যে হামনাহ বিনতে জাহ্শের সাথে সাক্ষাৎ হলে তাকে প্রথমে তাঁর ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শ, অতঃপর মামু হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের শাহাদাতের খবর দেওয়া হয়। উভয় খবরে তিনি ইন্নালিল্লাহ পাঠ করেন ও তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এরপর তাঁকে তাঁর স্বামী মুছ‘আব বিন ওমায়ের-এর শাহাদাতের খবর শুনানো হলে তিনি চীৎকার দিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন(فَصَاحَتْ وَوَلْوَلَتْ)।[5] উল্লেখ্য যে, মুছ‘আবকে রাসূল ভেবে হত্যা করেছিল আব্দুল্লাহ বিন ক্বামিআহ লায়ছী (ইবনু হিশাম ২/৭৩)।
(খ) বনু দীনার গোত্রের এক মহিলাকে তার স্বামী, ভাই ও পিতার শাহাদাতের খবর শুনানো হলে তিনি ইন্নালিল্লাহ পাঠ করেন ও তাদের জন্য ইস্তিগফার করেন। অতঃপর তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ)-এর খবর কি? বলা হল, তিনি ভাল আছেন যেমন তুমি চাচ্ছ হে অমুকের মা’। তখন তিনি অস্থির চিত্তে বলে উঠলেন, أَرُونِيهِ حَتّى أَنْظُرَ إلَيْهِ ‘আমাকে দেখিয়ে দাও। যাতে আমি তাঁকে স্বচক্ষে দেখতে পারি’। তারপর তাকে দেখিয়ে দিতেই তিনি খুশী হয়ে রাসূল (সাঃ)-কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, كُلُّ مُصِيبَةٍ بَعْدَكَ جَلَلٌ ‘আপনাকে পাওয়ার পর সব বিপদই তুচ্ছ’। হিন্দ নাম্মী এই মহিলা ছিলেন ল্যাংড়া শহীদ ‘আমর ইবনুল জামূহ আনছারী (রাঃ)-এর স্ত্রী।[ইবনু হিশাম ২/৯৯; যুরক্বানী ৬/২৯০; সীরাহ সহীহাহ ২/৩৯৫]


১৪. কান্নার রোল নিষিদ্ধ :
━━━━━━━━━━━━━━━
(১) জাবের বিন আব্দুল্লাহ বিন ‘আমর বলেন, আমার আববাকে অঙ্গহানি করা অবস্থায় কাপড়ে ঢেকে নিয়ে আসা হয়। তখন আমি বারবার কাপড় উঠিয়ে তাকে দেখছিলাম আর কাঁদছিলাম। লোকেরা এতে আমাকে নিষেধ করে। কিন্তু রাসূল (সাঃ) আমাকে নিষেধ করেননি। এসময় তিনি চিৎকার দানকারিণী কোন মহিলার কণ্ঠ শোনেন। তাঁকে বলা হল, ইনি আমরের মেয়ে অথবা বোন (অর্থাৎ নিহত আব্দুল্লাহর বোন অথবা ফুফু)। তখন তিনি বলেন, ابْكُوهُ أَوْ لاَ تَبْكُوهُ مَا زَالَتِ الْمَلاَئِكَةُ تُظِلُّهُ بِأَجْنِحَتِهَا حَتَّى دَفَنْتُمُوهُ ‘তোমরা কাঁদ বা না কাঁদ, ফেরেশতারা তাকে তাদের ডানা দিয়ে ছায়া করবে, যতক্ষণ না তোমরা তাকে দাফন করবে’।[বুখারী হা/২৮১৬; মুসলিম হা/২৪৭১]
(২) ওহুদ থেকে ফেরার পথে রাসূল (সাঃ) আনছারদের বনু আব্দিল আশহাল ও বনু যাফর গোত্রের মহিলাদের স্ব স্ব নিহতদের জন্য কান্নার রোল শুনতে পেলেন। তাতে তাঁর দু’চোখ অশ্রুসিক্ত হল এবং তিনি কাঁদতে লাগলেন। এক পর্যায়ে তিনি বললেন, সবাই কাঁদছে। কিন্তু আজ হামযার জন্য কাঁদবার কেউ নেই(وَلَكِنَّ حَمْزَةَ لاَ بَوَاكِىَ لَهُ)। অতঃপর যখন গোত্রনেতা সা‘দ বিন মু‘আয ও উসায়েদ বিন হুযায়ের সেখানে এলেন, তারা মহিলাদের বললেন, রাসূলের চাচার শোকে কান্নার জন্য। সেমতে তারা সবাই কাঁদতে কাঁদতে রাসূল ((সাঃ)-এর বাসগৃহের সামনে এসে পৌঁছে গেল। তখন রাসূল (সাঃ) বেরিয়ে এসে তাদের ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, اِرْجِعْنَ يَرْحَمُكُنَّ الله ‘তোমরা ফিরে যাও। আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন! এদিন থেকে কান্নার রোল (النَّوْحُ) নিষিদ্ধ করা হয়’।[ইবনু হিশাম ২/৯৯; ইবনু মাজাহ হা/১৫৯১]
রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন,لَيْسَ مِنَّا مَنْ ضَرَبَ الْخُدُودَ ، وَشَقَّ الْجُيُوبَ ، وَدَعَا بِدَعْوَى الْجَاهِلِيَّةِ ‘সে ব্যক্তি আমাদের দলভুক্ত নয়, যে (মৃতের শোকে) নিজের মুখ চাপড়ায়, জামা ছিঁড়ে এবং জাহেলী যুগের ন্যায় চিৎকার দিয়ে কাঁদে’। মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, রাসূল (সাঃ) বলেন, أَنَا بَرِىءٌ مِمَّنْ حَلَقَ وَسَلَقَ وَخَرَقَ আমি দায়মুক্ত ঐ ব্যক্তি থেকে, যে শোকে মাথা মুন্ডন করে, চিৎকার দিয়ে কাঁদে এবং কাপড় ছিঁড়ে’।[বুখারী হা/১২৯৪; মুসলিম হা/১০৪; মিশকাত হা/১৭২৫-২৬] উল্লেখ্য যে, জাহেলী যুগের এটা রীতি ছিল যে, যার মৃত্যুতে যত বেশী মহিলা কান্নাকাটি করবে, তিনি তত বেশী মর্যাদাবান বলে খ্যাত হবেন। তবে চিৎকার বিহীন সাধারণ কান্না নিষিদ্ধ নয়। যেমন উসমান বিন মাযঊন (রাঃ)-এর মৃত্যুর পর রাসূল (সাঃ) তাকে চুমু খান। এ সময় তাঁর দু’চোখ দিয়ে অবিরল ধারে অশ্রু প্রবাহিত হচ্ছিল।[তিরমিযী হা/৯৮৯; মিশকাত হা/১৬২৩]


১৫. ওহুদের শহীদগণের জন্য আল্লাহর সুসংবাদ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
আব্দুল্লাহ ইবনু আববাস (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন, لَمَّا أُصِيبَ إِخْوَانُكُمْ بِأُحُدٍ جَعَلَ اللهُ أَرْوَاحَهُمْ فِى جَوْفِ طَيْرٍ خُضْرٍ تَرِدُ أَنْهَارَ الْجَنَّةِ تَأْكُلُ مِنْ ثِمَارِهَا وَتَأْوِى إِلَى قَنَادِيلَ مِنْ ذَهَبٍ مُعَلَّقَةٍ فِى ظِلِّ الْعَرْشِ فَلَمَّا وَجَدُوا طِيبَ مَأْكَلِهِمْ وَمَشْرَبِهِمْ وَمَقِيلِهِمْ قَالُوا : مَنْ يُبَلِّغُ إِخْوَانَنَا عَنَّا أَنَّا أَحْيَاءٌ فِى الْجَنَّةِ نُرْزَقُ لِئَلاَّ يَزْهَدُوا فِى الْجِهَادِ وَلاَ يَنْكُلُوا عِنْدَ الْحَرْبِ فَقَالَ اللهُ سُبْحَانَهُ : أَنَا أُبَلِّغُهُمْ عَنْكُمْ. قَالَ : فَأَنْزَلَ اللهُ (وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِى سَبِيلِ اللهِ أَمْوَاتً ‘যখন তোমাদের ভাইয়েরা ওহুদ যুদ্ধে বিপদগ্রস্ত হয়, তখন আল্লাহ তাদের আত্মাগুলিকে সবুজ পাখির পেটে ভরে দেন। যারা জান্নাতের নদীসমূহের কিনারে অবতরণ করে। তারা সেখানে জান্নাতের ফলসমূহ ভক্ষণ করে এবং আরশের ছায়ার নীচে ঝুলন্ত স্বর্ণ নির্মিত লণ্ঠনসমূহে অবস্থান নেয়। এভাবে যখন তারা সেখানে সুন্দর খানা-পিনা ও বিশ্রামস্থল পেয়ে যায়, তখন তারা বলে, কে আমাদের ভাইদেরকে আমাদের পক্ষ থেকে এ খবর পৌঁছে দিবে যে, আমরা জান্নাতে জীবিত আছি। আমরা রূযী প্রাপ্ত হচ্ছি। যেন তারা জিহাদ থেকে দূরে না থাকে এবং যুদ্ধ থেকে বিরত না হয়। তখন মহান আল্লাহ বললেন, আমিই তোমাদের পক্ষ থেকে পৌঁছে দিচ্ছি। রাসূল (সাঃ) বলেন, অতঃপর তিনি নাযিল করেন, وَلاَ تَحْسَبَنَّ الَّذِينَ قُتِلُوا فِي سَبِيلِ اللهِ أَمْوَاتًا بَلْ أَحْيَاءٌ عِنْدَ رَبِّهِمْ يُرْزَقُونَ ‘যারা আল্লাহর রাস্তায় নিহত হয়, তাদেরকে মৃত ভেবো না। বরং তারা জীবিত। তারা তাদের প্রতিপালকের নিকট হতে জীবিকাপ্রাপ্ত হয়’।[হাকেম হা/২৪৪৪; আহমাদ হা/২৩৮৮]
আল্লাহ বলেন,وَلَقَدْ صَدَقَكُمُ اللهُ وَعْدَهُ إِذْ تَحُسُّونَهُمْ بِإِذْنِهِ حَتَّى إِذَا فَشِلْتُمْ وَتَنَازَعْتُمْ فِي الْأَمْرِ وَعَصَيْتُمْ مِنْ بَعْدِ مَا أَرَاكُمْ مَا تُحِبُّونَ مِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الدُّنْيَا وَمِنْكُمْ مَنْ يُرِيدُ الْآخِرَةَ ثُمَّ صَرَفَكُمْ عَنْهُمْ لِيَبْتَلِيَكُمْ وَلَقَدْ عَفَا عَنْكُمْ وَاللهُ ذُو فَضْلٍ عَلَى الْمُؤْمِنِينَ ‘আল্লাহ তোমাদের নিকট (ওহুদ যুদ্ধে) দেওয়া (বিজয়ের) ওয়াদা সত্যে পরিণত করেছেন, যখন তোমরা (দিনের প্রথম ভাগে) ওদের কচুকাটা করছিলে তাঁর হুকুমে। অবশেষে (দিনের শেষভাগে) যখন তোমরা হতোদ্যম হয়ে পড়লে ও কর্তব্য নির্ধারণে ঝগড়ায় লিপ্ত হলে (যেটা তীরন্দাযরা করেছিল) আমি তোমাদেরকে (বিজয়) দেখানোর পর যা তোমরা কামনা করেছিলে, এ সময় তোমাদের মধ্যে কেউ দুনিয়া (গণীমত) কামনা করছিলে এবং কেউ আখেরাত কামনা করছিলে (অর্থাৎ দৃঢ় ছিলে)। অতঃপর তিনি তোমাদেরকে তাদের (উপর বিজয়ী হওয়া) থেকে ফিরিয়ে দিলেন যাতে তিনি তোমাদের পরীক্ষা নিতে পারেন। অবশ্য আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করেছেন। বস্ত্ততঃ আল্লাহ মুমিনদের প্রতি অনুগ্রহশীল’ (আলে ইমরান ৩/১৫২)।




[1]. ইবনু হিশাম ২/৯৪, আলবানী, ফিক্বহুস সীরাহ পৃঃ ২৬০, সনদ সহীহ। এখানে উমর বলার অর্থ তিনি রাসূল (সাঃ)-এর নিকট থেকে শুনে বলেছেন। যেমন পরবর্তীতে হোদায়বিয়া সন্ধিকালে তিনি রাসূল (সাঃ)-কে একইভাবে জিজ্ঞেস করেছিলেন, أَلَيْسَ قَتْلاَنَا فِي الْجَنَّةِ وَقَتْلاَهُمْ فِي النَّارِ؟ ‘আমাদের নিহতেরা কি জান্নাতে নয়? এবং তাদের নিহতেরা জাহান্নামে? রাসূল (সাঃ) বললেন, হ্যাঁ (বুখারী হা/৩১৮২; মুসলিম হা/১৭৮৫ (৯৪)। এখানে প্রসিদ্ধ আছে যে, আবু সুফিয়ান ও তার সাথীরা যখন ফিরে যান, তখন তিনি উচ্চৈঃস্বরে বলেন, إنَّ مَوْعِدَكُمْ بَدْرٌ لِلْعَامِ الْقَابِلِ ‘তোমাদের সঙ্গে আগামী বছর বদরে ওয়াদা রইল’। তখন রাসূল (সাঃ) তাঁর সাথীদের একজনকে বললেন, قُلْ: نَعَمْ، هُوَ بَيْنَنَا وَبَيْنَكُمْ مَوْعِدٌ ‘বল! হ্যাঁ। আমাদের ও তোমাদের মধ্যে ওটাই ওয়াদা রইল’ (ইবনু হিশাম ২/৯৪)। বর্ণনাটি সনদবিহীন (মা শা-‘আ ১৬১ পৃঃ)।
[2]. আবুদাঊদ হা/২৫৩৭; হাকেম হা/২৫৩৩, সনদ সহীহ। ইবনু হাজার উছায়রিম ও ‘আমরকে একই ব্যক্তি বলেছেন। ইনি প্রখ্যাত সাহাবী হুযায়ফা ইবনুল ইয়ামানের বোনের পুত্র ছিলেন। উছায়রিম ছিল ‘আমর বিন উক্বাইশের লক্বব (আল-ইছাবাহ, ‘আমর বিন সাবেত বিন উক্বাইশ ক্রমিক ৫৭৮৯)।
[3]. ইবনু হিশাম ১/৫১৮; ২/৮৮-৮৯; আর-রাহীক্ব ২৮০ পৃঃ। ইবনু ইসহাক এটি বিনা সনদে বর্ণনা করেছেন। ভাষ্যকার সুহায়লী বলেন, মুখাইরীক্ব মুসলিম ছিলেন। এজন্য তাঁকে خَيْرُ يَهُودَ ‘উত্তম ইহূদী’ বলা হয়েছে, خَيْرُ الْيَهُودِ ‘ইহূদীদের মধ্যে উত্তম’ বলা হয়নি (ইবনু হিশাম ১/৫১৮-টীকা; আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৪/৩৭; মা শা-‘আ ১৫৯ পৃঃ)। ইবনু হাজার তাঁকে সাহাবীদের অন্তর্ভুক্ত গণ্য করেছেন (আল-ইছাবাহ, মুখাইরীক্ব ক্রমিক ৭৮৫৫; সীরাহ সহীহাহ ২/৩৮৯)।
[4]. আর-রাহীক্ব ২৮১ পৃঃ। মুবারকপুরী এখানে আব্দুল্লাহ বিন জাহশকে রাসূল (সাঃ)-এর দুধ ভাই বলেছেন। যা প্রমাণিত নয় (আল-ইছাবাহ, ছুওয়াইবাহ ক্রমিক ১০৯৬৪; ইবনু হিশাম ২/৯৬)।
[5]. প্রসিদ্ধ আছে যে, তখন রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, إنّ زَوْجَ الْمَرْأَةِ مِنْهَا لَبِمَكَانِ ‘নিশ্চয়ই স্বামীর জন্য স্ত্রীর নিকটে রয়েছে এক বিশেষ স্থান’ (ইবনু হিশাম ২/৯৮; আর-রাহীক্ব ২৮৩ পৃঃ; সীরাহ সহীহাহ ২/৩৯৫)। বর্ণনাটি ‘যঈফ’ (আর-রাহীক্ব, তা‘লীক্ব ১৫৫ পৃঃ)।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...