রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ওহুদ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ-১

 

ওহুদ যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ-১

১. ‘আব্দুল্লাহ’ নামের কাফেরগণ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(ক) কুরায়েশ বাহিনীর পতাকাবাহী বনু ‘আব্দিদ্দার-এর নিহত ১০জন পতাকাবাহীর প্রথম ৬ জনের সকলেই ছিল আব্দুল্লাহ বিন উসমান ইবনু ‘আব্দিদ্দারের পুত্র অথবা পৌত্র।
(খ) কুরায়েশ তীরন্দায বাহিনীর অধিনায়ক ছিল বদর যুদ্ধে নিহত উৎবাহর ভাই আব্দুল্লাহ বিন রাবী‘আহ।
(গ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর উপরে সরাসরি আঘাতকারী তিনজন কাফের সৈন্যের দ্বিতীয় জন ছিল আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব যুহরী, যার আঘাতে রাসূল (সাঃ)-এর ললাট রক্তাক্ত হয়। ইনি ছিলেন পরবর্তীকালে বিখ্যাত তাবেঈ মুহাম্মাদ ইবনে শিহাব যুহরী (৫০-১২৪ হি.)-এর দাদা (আল-ইছাবাহ, ক্রমিক ৪৭৫৫)। তৃতীয় জন ছিল আব্দুল্লাহ বিন ক্বামিআহ লায়ছী, যার আঘাতে শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া রাসূল (সাঃ)-এর চোখের নীচে হাঁড়ের মধ্যে ঢুকে যায়। শেষোক্ত ব্যক্তি একই সময়ে মুহাজিরগণের পতাকাবাহী মুছ‘আব বিন ওমায়েরকে হত্যা করে এবং চেহারায় মিল থাকার কারণে তাকেই রাসূল ভেবে ‘মুহাম্মাদ নিহত হয়েছেন’ বলে সে সর্বত্র রটিয়ে দেয়। মুছ‘আব শহীদ হওয়ার পরে রাসূল (সাঃ) যুদ্ধের পতাকা হযরত আলী (রাঃ)-এর হাতে অর্পণ করেন।
(ঘ) রাসূলুল্লাহ (সাঃ) যখন তাঁর সৈন্যদের শিবিরে ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন, তখন তাঁর উপরে হামলাকারী প্রথম কাফের সৈন্যটির নাম ছিল উসমান বিন আব্দুল্লাহ বিন মুগীরাহ। দ্বিতীয় কাফির সৈন্যটির নাম ছিল আব্দুল্লাহ বিন জাবের। প্রথমজন হারেছ ইবনুছ ছিম্মাহর আঘাতে এবং দ্বিতীয় জন আবু দুজানার হাতে নিহত হয়। এইসব আব্দুল্লাহগণ আল্লাহ ও আখেরাতে বিশ্বাসী হওয়া সত্ত্বেও এরা আল্লাহর বিধান মানতে ও রিসালাত-এর উপরে ঈমান আনতে রাজি ছিল না। এক কথায় তারা তাওহীদে রুবূরিয়াতে বিশ্বাসী ছিল। কিন্তু তওহীদে ইবাদতে বিশ্বাসী ছিল না। মুমিন হওয়ার জন্য যা অপরিহার্য শর্ত। এ যুগেও এমন আব্দুল্লাহদের অভাব নেই।


২. পিতা ও পুত্র পরস্পরের বিপক্ষে :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
হিজরতের পূর্বে মদীনার আউস গোত্রের সর্দার ও ধর্মযাজক ছিলেন আবু ‘আমের আর-রাহেব’। হিজরতের পরে তিনি মক্কায় চলে যান এবং কুরায়েশদের পক্ষে ওহুদ যুদ্ধে যোগদান করেন। সেজন্য রাসূল (সাঃ) তার লকব দেন আবু ‘আমের আল-ফাসেক্ব’। পক্ষান্তরে তার পুত্র ‘হানযালা’ ছিলেন মুসলিম বাহিনীর সেই তরুণ সৈন্য যিনি সবেমাত্র বিয়ে করে বাসর যাপন করছিলেন। অতঃপর যুদ্ধের ঘোষণা শুনেই নাপাক অবস্থায় ময়দানে চলে আসেন এবং ভীষণ তেজে যুদ্ধ করে শহীদ হন। ফেরেশতাগণ তাকে গোসল দেন। এজন্য তাঁকে ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’ বলা হয়’।[ইবনু হিশাম ২/৭৫; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭২; আর-রাহীক্ব ২৮১ পৃঃ]


৩. দুই ভাই পরস্পরের বিপক্ষে :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
ওহুদ যুদ্ধে রাসূল (সাঃ)-এর উপরে হামলাকারী তিন জনের প্রথম জন ছিল উৎবাহ বিন আবু ওয়াকক্বাছ। তার নিক্ষিপ্ত পাথরের আঘাতেই রাসূল (সাঃ)-এর ডান দিকের নীচের রুবাঈ দাঁত ভেঙ্গে যায়। এই উৎবাহর ভাই ছিলেন ‘ইসলামে প্রথম রক্ত প্রবাহিতকারী’ এবং মুসলিম বাহিনীর খ্যাতনামা বীর ও পরবর্তীকালে ইরাক বিজেতা সেনাপতি হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ)।


৪. ওহুদ যুদ্ধে কুরায়েশ মহিলাদের তৎপরতা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(ক) কুরায়েশ পক্ষে প্রধান সেনাপতি আবু সুফিয়ানের স্ত্রী হিন্দ বিনতে উৎবাহ ১৫ জনের মহিলা দলের নেতৃত্ব দেন। তারা নেচে গেয়ে তাদের সৈন্যদের উত্তেজিত করেন। যুদ্ধে আবু দুজানার তরবারির হাত থেকে হিন্দা বেঁচে যান তার হায় হায় শব্দে তাকে নারী হিসাবে চিনতে পারার কারণে।[ইবনু হিশাম ২/৬৯; আর-রাহীক্ব ২৬১ পৃঃ] (খ) পলায়নপর কুরায়েশ বাহিনী যখন পুনরায় অরক্ষিত গিরিপথ দিয়ে ময়দানে আবির্ভূত হয়, তখন কুরায়েশ বাহিনীর ভূলুণ্ঠিত যুদ্ধ পতাকা ‘আমরাহ বিনতে ‘আলক্বামাহ নাম্মী এক কুরায়েশ মহিলা অসীম বীরত্বের সাথে দ্রুত উঁচু করে তুলে ধরেন। যা দেখে বিক্ষিপ্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত কুরায়েশ বাহিনী পুনরায় যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে আসে ও গণীমত কুড়ানোয় ব্যস্ত মুসলিম বাহিনীকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে’ (আর-রাহীক্ব ২৬৪ পৃঃ)।


৫. ওহুদ যুদ্ধে মুসলিম মহিলাদের ভূমিকা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
(ক) যুদ্ধ শেষে কিছু মুসলিম মহিলা ময়দানে আগমন করেন। তাঁদের মধ্যে হযরত আয়েশা বিনতে আবুবকর (রাঃ), আনাস (রাঃ)-এর মা উম্মে সুলায়েম(أم سُلَيم) আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ)-এর মা উম্মে সুলাইত্ব(أم سُلَيط) মুছ‘আব বিন উমায়ের (রাঃ)-এর স্ত্রী হামনাহ বিনতে জাহশ আল-আসাদিইয়াহ প্রমুখ ছিলেন। যারা পিঠে পানির মশক বহন করে এনে আহত সৈনিকদের পানি পান করান ও চিকিৎসা সেবা দান করেন।[বুখারী হা/৪০৬৪, ২৮৮১; মাজমা‘উয যাওয়ায়েদ হা/১৫৪২৪]
(খ) যুদ্ধ শেষে ঘাঁটিতে স্থিতিশীল হওয়ার পর কন্যা ফাতেমা রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর যখম ধুয়ে ছাফ করেন এবং জামাতা আলী তার ঢালে করে পানি এনে তাতে ঢেলে দেন। কিন্তু যখন দেখা গেল যে, তাতে রক্ত বন্ধ হচ্ছে না। তখন ফাতেমা (রাঃ) চাটাইয়ের একটা অংশ জ্বালিয়ে তার ভস্ম ক্ষতস্থানে লাগিয়ে দেন। তাতে রক্ত বন্ধ হয়ে যায়।[বুখারী হা/৪০৭৫] এতে প্রমাণিত হয় যে, চিকিৎসা গ্রহণ করা নবীগণের মর্যাদার বিরোধী নয় এবং এটি আল্লাহর উপরে ভরসা করারও বিরোধী নয়। এটাও প্রমাণিত হয় যে, মেয়েরা চিকিৎসক হতে পারে। যদি তা তাদের পর্দা ও মর্যাদার খেলাফ না হয়।


৬. ফেরেশতারা যাঁকে গোসল দিলেন :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
যুদ্ধে যাওয়ার ঘোষণা শুনেই বাসর ঘর ছেড়ে ত্বরিৎ গতিতে যুদ্ধের ময়দানে এসে শত্রুদের উপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন সদ্য বিবাহিত যুবক হানযালা বিন আবু ‘আমের আর-রাহেব। অমিত বিক্রমে যুদ্ধ করতে করতে তিনি শত্রু বাহিনীর সারিগুলি তছনছ করে মধ্যভাগে পৌঁছে যান। অতঃপর কুরায়েশ সেনাপতি আবু সুফিয়ানের মাথার উপরে তরবারি উত্তোলন করেন তাকে খতম করে দেবার জন্য। কিন্তু সেই মুহূর্তে শত্রুপক্ষের শাদ্দাদ বিন আউসের আঘাতে তিনি ধরাশায়ী হন ও শাহাদাত বরণ করেন।
যুদ্ধশেষে হানযালার মৃত দেহ অদৃশ্য ছিল। অনেক সন্ধানের পর এক স্থানে এমন অবস্থায় পাওয়া গেল যে, যমীন হতে উপরে রয়েছে এবং ওটা হতে টপটপ করে পানি পড়ছে। এ দৃশ্য দেখে রাসূলুল্লাহ (সাঃ) সাহাবায়ে কেরামকে বললেন, ‘ফেরেশতারা তাকে গোসল দিচ্ছে’। পরে তার স্ত্রীর কাছে প্রকৃত ব্যাপারটি জানা যায় যে, তিনি নাপাকীর গোসল ছাড়াই যুদ্ধের ময়দানে ছুটে এসেছিলেন। ফলে তখন থেকে হানযালা ‘গাসীলুল মালায়েকাহ’ (غَسِيلُ الْمَلاَئِكَةِ) বা ‘ফেরেশতাগণ কর্তৃক গোসলকৃত’ বলে অভিহিত হন।[হাকেম হা/৪৯১৭; সহীহাহ হা/৩২৬ সনদ হাসান] অপর হাদীছ থেকে জানা যায় রাসূল (সাঃ) হামযা (রাঃ) ও হানযালা (রাঃ) উভয়কেই ফেরেশতা কর্তৃক গোসল দিতে দেখেছিলেন, কেননা তারা উভয়েই নাপাক ছিলেন।[ত্বাবারাণী কাবীর হা/১২০৯৪; আলবানী, আহকামুল জানায়েয ১/৫৬]


৭. নিজেদের হাতে নিজেদের মৃত্যু :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
খালেদ বিন ওয়ালীদের অতর্কিত হামলায় দিশেহারা মুসলিম বাহিনীর মধ্যে দু’ধরনের লোকের সৃষ্টি হয়। একদল কাফিরদের বেষ্টনীর মধ্যে পড়ে জান বাঁচানোর জন্য পালিয়ে গিয়ে মদীনায় ঢুকে পড়ে এবং কেউ পাহাড়ের মাথায় উঠে পড়ে। অন্যদল শত্রুসেনাদের মধ্যে মিশে যায়। এ বিষয়ে মা আয়েশা (রাঃ) বলেন, ওহুদ যুদ্ধের দিন মুশরিকরা পরাজিত হয়। এরপর ইবলীস ডাক দিয়ে বলে, أَىْ عِبَادَ اللهِ أُخْرَاكُمْ ‘ওহে আল্লাহর বান্দারা পিছনে’ (অর্থাৎ পিছন দিক থেকে আক্রমণ কর)’। তার কথায় সামনের সারির সৈন্যরা পিছন দিকে ফিরে আসে এবং পিছনের সারির সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। হুযায়ফা (রাঃ) দেখেন যে, তাঁর পিতা ইয়ামানের উপর আক্রমণ করা হচ্ছে। তিনি তখন বলে ওঠেন, أَىْ عِبَادَ اللهِ، أَبِى أَبِى ‘হে আল্লাহর বান্দারা! উনি আমার পিতা, উনি আমার পিতা’। কিন্তু আল্লাহর কসম! (মুসলিম) সৈন্যরা আক্রমণ হতে বিরত হল না। অতঃপর তারা তাঁকে হত্যা করে ফেলল। তখন হুযায়ফা বললেন, আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন! উরওয়া বলেন, ‘আল্লাহর কসম! হুযায়ফা-র মধ্যে সর্বদা কল্যাণ বিরাজমান ছিল। অবশেষে তিনি আল্লাহ তা‘আলার সাথে মিলিত হন’ (বুখারী হা/৪০৬৫)।
অন্য বর্ণনায় এসেছে, তখন হুযায়ফা (রাঃ) বলেন,يَغْفِرُ اللهُ لَكُمْ وَهُوَ أَرْحَمُ الرَّاحِمِينَ ‘আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন! তিনি শ্রেষ্ঠ দয়াশীল’। রাসূল (সাঃ) তাকে তার পিতার রক্তমূল্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা না নিয়ে মাফ করে দেন।[ইবনু হিশাম ২/৮৭-৮৮; হাকেম হা/৪৯০৯, ৩/২০২ পৃঃ]


৮. মুশরিকদের বেষ্টনীতে রাসূল (সাঃ); সাথী মাত্র নয়জন জান কোরবান সাহাবী :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
যুদ্ধ চলা অবস্থায় আল্লাহর রাসূল (সাঃ) সাত জন আনছার ও দু’জন মুহাজির সহ মোট নয় জন সাথী নিয়ে সেনাবাহিনীর পিছনে থেকে সৈন্য পরিচালনা করছিলেন। এমন সময় হঠাৎ দেখতে পান যে, সংকীর্ণ গিরিপথ দিয়ে খালেদ বিন অলীদ সসৈন্যে তীরবেগে ঢুকে পড়ছেন। তখন তিনি সাক্ষাৎ বিপদ বুঝতে পেরে চীৎকার দিয়ে মুসলিম বাহিনীকে ডাক দিলেন ‘হে আল্লাহর বান্দারা এদিকে এসো’ (إِلَيَّ عِبَادَ اللهِ، إِلَيَّ عِبَادَ اللهِ) বলে। এতে মুশরিক বাহিনী তাঁর অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে চারদিক থেকে এসে তাঁকে ঘিরে ফেলে। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, مَنْ يَرُدُّهُمْ عَنَّا وَلَهُ الْجَنَّةُ أَوْ هُوَ رَفِيقِى فِى الْجَنَّة‘যে ব্যক্তি আমাদের থেকে ওদের হটিয়ে দেবে তার জন্য জান্নাত’। অথবা তিনি বলেন, সে ব্যক্তি আমার সাথে জান্নাতে থাকবে’ (মুসলিম হা/১৭৮৯)। তখন তাঁকে বাঁচানোর জন্য সাথী সাত জন আনছার সাহাবীর সকলে জীবন দিলেন। বাকী রইলেন দু’জন মুহাজির সাহাবী হযরত ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ এবং সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ)। তাদের অতুলনীয় বীরত্বের মুখে কাফের বাহিনী এগিয়ে আসতে বাধাগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে কুরআন বলেছে, إِذْ تُصْعِدُوْنَ وَلاَ تَلْوُوْنَ عَلَى أحَدٍ وَالرَّسُوْلُ يَدْعُوْكُمْ فِيْ أُخْرَاكُمْ ‘যখন তোমরা (ভয়ে পাহাড়ের) উপরে উঠে যাচ্ছিলে এবং পিছন দিকে কারু প্রতি ফিরে তাকাচ্ছিলে না, অথচ রাসূল তোমাদের ডাকছিলেন তোমাদের পিছন থেকে... (আলে ইমরান ৩/১৫৩)।


৯. রাসূল (সাঃ)-এর দান্দান মুবারক শহীদ হল :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
ত্বালহা ও সা‘দ ব্যতীত যখন রাসূল (সাঃ)-এর পাশে কেউ নেই,(বুখারী হা/৪০৬০) তখন এই সুযোগে তাঁকে হত্যা করার জন্য কাফেররা তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করে। প্রথমে সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছের ভাই উৎবাহ বিন আবু ওয়াকক্বাছ রাসূল (সাঃ)-এর চেহারা লক্ষ্য করে সজোরে পাথর নিক্ষেপ করে। তাতে রাসূল (সাঃ)-এর ডান দিকের নীচের রুবাঈ দাঁতটি ভেঙ্গে যায় ও নীচের ঠোটটি আহত হয়। এরপর আব্দুল্লাহ ইবনে শিহাব যুহরী এগিয়ে এসে তাঁর ললাটে তরবারির আঘাত করে যখম করে দেয়। এরপর আব্দুল্লাহ বিন ক্বামিআহ নামক এক দুর্ধর্ষ অশ্বারোহী এসে তার কাঁধের উপরে ভীষণ জোরে তরবারির আঘাত করে। যা তাঁর লৌহবর্ম ভেদ করতে না পারলেও তার ব্যথা ও কষ্ট তিনি এক মাসের অধিক সময় অনুভব করেন। তারপর সে দ্বিতীয় বার আঘাত করে। যাতে তাঁর শিরস্ত্রাণের দু’টি কড়া তাঁর চোখের নীচের হাড়ের মধ্যে ঢুকে থেকে যায়’।[ফাৎহুল বারী হা/৪০৬৮; আর-রাহীক্ব ২৬৮ পৃঃ; যাদুল মা‘আদ ৩/১৭৬]


১০. রাসূল (সাঃ)-এর পায়ের উপরে মাথা রেখে প্রাণ দিলেন যিনি :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
কাফেরদের বেষ্টনীতে পড়ে গেলে সেই সংকট মুহূর্তে তরুণ আনছার সাহাবী যিয়াদ ইবনুস সাকান আল-আশহালী, কারু মতে ‘উমারাহ বিন ইয়াযীদ ইবনুস সাকান (রাঃ) তাঁর পাঁচ জন আনছার সাথীকে নিয়ে এগিয়ে আসেন। অতঃপর একে একে সবাই শহীদ হয়ে যান। সবশেষে যিয়াদ ইবনুস সাকান যুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে লুটিয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে অন্যান্য সাহাবীগণ এসে পড়েন ও কাফেরদের হটিয়ে দেন। তখন রাসূল (সাঃ) বলেন, أَدْنُوهُ مِنِّي ‘তোমরা ওকে আমার কাছে নিয়ে এস’। তখন তাঁরা তাকে উঠিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর কাছে নিয়ে যান। রাসূল (সাঃ) তার মুখমন্ডল নিজের পায়ের উপরে রাখেন। অতঃপর তার প্রাণবায়ু নির্গত হয়’।[ইবনু হিশাম ২/৮১; আর-রাহীক্ব ২৬৭ পৃঃ; যিয়াদ বিন সাকান ২৮৫৬] এটাই যেন ছিল তার মনের বাসনা যে, ‘প্রাণ যেন নির্গত হয় আপনার পদচুম্বনে’। এই ঘটনায় উর্দু কবি গেয়েছেন,
سر بوقت ذبح اپنا اس كے زير پائے ہے
يہ نصيب الله اكبر لوٹنے كي جائے ہے
‘যবহের সময় নিজের মাথা
রাসূলের পায়ের উপর
দুনিয়া হতে বিদায়কালে ‘আল্লাহু আকবর’
কতই না বড় সৌভাগ্য তার’! (রহমাতুল্লিল ‘আলামীন ১/১১১)।


১১. রাসূল (সাঃ)-এর দুঃখপূর্ণ দো‘আ :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
আনাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে, দান্দান মুবারক শহীদ হওয়ার পর রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেন, كَيْفَ يُفْلِحُ قَوْمٌ شَجُّوا نَبِيَّهُمْ وَكَسَرُوا رَبَاعِيَتَهُ وَهُوَ يَدْعُوهُمْ إِلَى اللهِ ‘ঐ জাতি কিভাবে সফলকাম হবে, যারা তাদের নবীর মুখমন্ডল আহত করেছে এবং তাঁর দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছে। অথচ তিনি তাদেরকে আল্লাহর দিকে আহবান করছেন’। ইবনু আববাস (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, এ সময় তিনি বলেন,اشْتَدَّ غَضَبُ اللهِ عَلَى قَوْمٍ دَمَّوْا وَجْهَ رَسُولِهِ ‘আল্লাহর কঠিন গজব নাযিল হৌক ঐ জাতির উপরে যারা তাঁর রাসূলের চেহারাকে রক্তাক্ত করেছে’ (আহমাদ হা/২৬০৯, সনদ হাসান )।
ইবনু মাসঊদ (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে যে, এ সময় তিনি বিগত এক নির্যাতিত নবীর বর্ণনা দিয়ে জাতির হেদায়াতের জন্য আল্লাহর নিকটে দো‘আ করে বলেন,رَبِّ اغْفِرْ لِقَوْمِى فَإِنَّهُمْ لاَ يَعْلَمُونَ ‘হে আমার পালনকর্তা! তুমি আমার কওমকে হেদায়াত কর। কেননা তারা (আমাকে) জানে না’।[বুখারী হা/৩৪৭৭; মুসলিম হা/১৭৯২; মিশকাত হা/৫৩১৩] আবু হুরায়রা (রাঃ)-এর বর্ণনায় এসেছে তিনি বলেন, إِنِّى لَمْ أُبْعَثْ لَعَّانًا وَإِنَّمَا بُعِثْتُ رَحْمَةً ‘আমি লা‘নতকারী হিসাবে প্রেরিত হইনি। বরং আমি প্রেরিত হয়েছি রহমত হিসাবে।[মুসলিম হা/২৫৯৯; মিশকাত হা/৫৮১২।]
একইরূপ কথা তিনি বলেন ঘাঁটিতে স্থিতি লাভের পর।[ইবনু হিশাম ২/৮৬; বুখারী হা/৪০৭৩-৭৬] তখন নিম্নোক্ত আয়াত নাযিল হয়, لَيْسَ لَكَ مِنَ الأَمْرِ شَيْءٌ أَوْ يَتُوْبَ عَلَيْهِمْ أَوْ يُعَذَّبَهُمْ فَإِنَّهُمْ ظَالِمُوْنَ ‘আল্লাহ তাদের ক্ষমা করবেন অথবা শাস্তি দিবেন, সে বিষয়ে তোমার কিছুই করার নেই। কেননা তারা হল যালেম’ (আলে ইমরান ৩/১২৮)।[মুসলিম হা/১৭৯১] এতে বুঝা যায় যে, যালেমদের শাস্তি দানের বিষয়টি সম্পূর্ণরূপে আললাহর ইচ্ছাধীন। যখন চাইবেন তখন তিনি তাদের শাস্তি দিবেন। বান্দা কেবল দো‘আ করতে পারে। কবুল করার মালিক আল্লাহ।


১২. চলমান শহীদ :
━━━━━━━━━━━
(ক) ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ : কাফিরদের বেষ্টনীতে পড়ার সংকটকালীন সময়ে রাসূল (সাঃ)-কে রক্ষাকারী নয় জনের মধ্যে ৭ জন আনছার সাহাবী শহীদ হওয়ার পর সর্বশেষ দু’জন মুহাজির সাহাবী হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ ও ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ অতুলনীয় বীরত্বের সাথে লড়াই করে কাফিরদের ঠেকিয়ে রাখেন। দু’জনেই ছিলেন আরবের সেরা তীরন্দায। তাদের লক্ষ্যভেদী তীরের অবিরাম বর্ষণে কাফির সৈন্যরা রাসূল (সাঃ)-এর কাছে ভিড়তে পারেনি। এই সময় রাসূল (সাঃ) স্বীয় তূণ হতে তীর বের করে সা‘দকে দেন ও বলেন ارْمِ فِدَاكَ أَبِى وَأُمِّى ‘তীর চালাও! তোমার উপরে আমার পিতা-মাতা উৎসর্গীত হউন’। তার বীরত্বের প্রতি রাসূল (সাঃ) কতবড় আস্থাশীল ছিলেন, একথাই তার প্রমাণ। কেননা আলী (রাঃ) বলেন, সা‘দ ব্যতীত অন্য কারুর জন্য আল্লাহর রাসূল (সাঃ) স্বীয় পিতা-মাতা উৎসর্গীত হউন, এরূপ কথা বলেননি।[1]
অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি তার জন্য দো‘আ করে বলেন,اللَّهُمَّ سَدِّدْ رَمْيَتَهُ، وَأَجِبْ دَعْوَتَهُ ‘হে আল্লাহ! তুমি তার নিক্ষিপ্ত তীরকে লক্ষ্যভেদী কর এবং তার দো‘আ কবুল কর’।[হাকেম হা/৪৩১৪, সনদ সহীহ]
দ্বিতীয় মুহাজির সাহাবী হযরত ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহ সম্পর্কে হযরত জাবের বিন আব্দুললাহ (রাঃ) বলেন যে, ঐদিন তিনি একাই এগারো জনের সঙ্গে লড়াই করেন। এইদিন তিনি ৩৫ বা ৩৯টি আঘাত পান। তাঁর শাহাদাত ও মধ্যমা অঙ্গুলী কেটে যায় ও পরে তা অবশ হয়ে যায়। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) তার সম্পর্কে বলেন,مَنْ سَرَّهُ أَنْ يَنْظُرَ إِلَى شَهِيدٍ يَمْشِى عَلَى وَجْهِ الأَرْضِ فَلْيَنْظُرْ إِلَى طَلْحَةَ بْنِ عُبَيْدِ اللهِ ‘যদি কেউ ভূপৃষ্ঠে চলমান কোন শহীদকে দেখতে চায়, তবে সে যেন ত্বালহা বিন ওবায়দুল্লাহকে দেখে’।[2] বস্ত্ততঃ তিনি শহীদ হন হযরত আলীর খেলাফতকালে ‘উটের যুদ্ধে’র দিন কুচক্রীদের হামলায়। আবুবকর (রাঃ) ওহুদ যুদ্ধের প্রসঙ্গ উঠলে বলতেন,ذَاكَ يَوْمٌ كُلُّهُ لِطَلْحَةَ ‘ঐ দিনটি ছিল পুরোপুরি ত্বালহার’ (আল-বিদায়াহ ৪/২৯)। অর্থাৎ নিঃসঙ্গ রাসূলকে বাঁচানোর জন্য সেদিন যে ত্যাগ তিনি স্বীকার করেছিলেন, তা ছিল তুলনাহীন।


১৩. ফেরেশতা নাযিল হল :
━━━━━━━━━━━━━━━━
হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ) বলেন, ওহুদ যুদ্ধের দিন আমি রাসূল (সাঃ)-এর সাথে দু’জন সাদা পোশাকধারী লোককে দেখি, যারা তাঁর পক্ষ হতে প্রচন্ড বেগে লড়াই করছিলেন। যাঁদেরকে আমি এর পূর্বে বা পরে আর কখনো দেখিনি- অর্থাৎ জিব্রীল ও মীকাঈল।[বুখারী হা/৪০৫৪; মুসলিম হা/২৩০৬]
ফেরেশতাগণ সংকট মুহূর্তেই কেবল সহযোগিতা করেছেন, সর্বক্ষণের জন্য নয়। এই সহযোগিতা ছিল প্রেরণামূলক। যাতে রাসূল (সাঃ) ও মুসলমানদের হিম্মত বৃদ্ধি পায়। নইলে একা জিব্রীলই যথেষ্ট ছিলেন কাফির বাহিনীকে নির্মূল করার জন্য।


১৪. যুদ্ধক্ষেত্রে তন্দ্রা :
━━━━━━━━━━━━━
কাফিরদের বেষ্টনী থেকে মুসলিম বাহিনীকে মুক্ত করে যখন আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ধীরে ধীরে পাহাড়ের উচ্চভূমির ঘাঁটিতে ফিরে আসছিলেন, তখন হঠাৎ করে অনেকের মধ্যে তন্দ্রা নেমে আসে। বদর যুদ্ধের ন্যায় এটা ছিল তাদের জন্য আল্লাহ প্রেরিত এক ধরনের প্রশান্তি। হযরত আবু ত্বালহা (রাঃ) বলেন, ওহুদ যুদ্ধের দিন যারা তন্দ্রাভিভূত হয়ে পড়েন, আমি ছিলাম তাদের অন্যতম। এমনকি এদিন আমার হাত থেকে কয়েকবার তরবারি পড়ে যায়। অবস্থা এমন ছিল যে, ওটা পড়ে যাচ্ছিল, আর আমি ধরে নিচ্ছিলাম। আবার পড়ে যাচ্ছিল, আবার ধরে নিচ্ছিলাম’ (বুখারী হা/৪৫৬২)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন,ثُمَّ أَنْزَلَ عَلَيْكُمْ مِنْ بَعْدِ الْغَمِّ أَمَنَةً نُعَاسًا يَغْشَى طَائِفَةً مِنْكُمْ وَطَائِفَةٌ قَدْ أَهَمَّتْهُمْ أَنْفُسُهُمْ يَظُنُّونَ بِاللهِ غَيْرَ الْحَقِّ ظَنَّ الْجَاهِلِيَّةِ يَقُولُونَ هَلْ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ مِنْ شَيْءٍ قُلْ إِنَّ الْأَمْرَ كُلَّهُ لِلَّهِ يُخْفُونَ فِي أَنْفُسِهِمْ مَا لاَ يُبْدُونَ لَكَ يَقُولُونَ لَوْ كَانَ لَنَا مِنَ الْأَمْرِ شَيْءٌ مَا قُتِلْنَا هَاهُنَا قُلْ لَوْ كُنْتُمْ فِي بُيُوتِكُمْ لَبَرَزَ الَّذِينَ كُتِبَ عَلَيْهِمُ الْقَتْلُ إِلَى مَضَاجِعِهِمْ وَلِيَبْتَلِيَ اللهُ مَا فِي صُدُورِكُمْ وَلِيُمَحِّصَ مَا فِي قُلُوبِكُمْ وَاللهُ عَلِيمٌ بِذَاتِ الصُّدُورِ ‘অতঃপর আল্লাহ তোমাদের উপর দুঃখের পরে তন্দ্রার শান্তি নাযিল করলেন, যা তোমাদের একদলকে (দৃঢ়চেতাগণকে) আচ্ছন্ন করেছিল। আরেকদল (দুর্বলচেতাগণ) নিজেদের জান নিয়ে ভাবছিল। তারা আল্লাহ সম্পর্কে মূর্খদের মতো অন্যায় ধারণা করছিল। তারা বলছিল, এ বিষয়ে আমাদের কি কিছু করার আছে? তুমি বলে দাও যে, সকল কর্তৃত্ব আল্লাহর। ওরা বুকের মধ্যে লুকিয়ে রাখে, যা ওরা তোমার নিকট প্রকাশ করে না। ওরা বলে, যদি আমাদের কোন কর্তৃত্ব থাকত, তাহলে এখানে আমরা নিহত হতাম না। তুমি বল, যদি তোমরা তোমাদের বাড়ীতে থাকতে, তবুও যাদের উপর হত্যা নির্ধারিত হয়ে গেছে, তারা অবশ্যই তাদের বধ্যভূমিতে উপস্থিত হত। আর আল্লাহ এটা করেছেন, তোমাদের বুকের মধ্যে যা লুকানো আছে তা পরীক্ষা করার জন্য এবং অন্তরে যা আছে, তা নির্মল করার জন্য। বস্ত্ততঃ আল্লাহ তোমাদের বুকের মধ্যে লুকানো বিষয়ে সম্যক অবহিত’ (আলে ইমরান ৩/১৫৪)। আল্লাহর উক্ত বাণীর মধ্যে ওহুদ যুদ্ধের বিপর্যয়ে মুসলমানদের অনেকের মধ্যে যে দোদুল্যমান অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল, সেটা প্রমাণিত হয়।


১৫. ত্বালহার কাঁধে রাসূল (সাঃ) :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
পাহাড়ের ঘাঁটিতে প্রত্যাবর্তনের পথে একটা টিলা পড়ে যায়। রাসূল (সাঃ) চেষ্টা করেও তার উপরে উঠতে সক্ষম হলেন না। তখন ৩৯টি আঘাতে জর্জরিত উৎসর্গীতপ্রাণ সাহাবী ত্বালহা বিন উবায়দুল্লাহ মাটিতে বসে রাসূল (সাঃ)-কে কাঁধে উঠিয়ে নেন। অতঃপর টিলার উপরে চলে যান। এ সময় রাসূলুল্লাহ (সাঃ) খুশী হয়ে বলেন, أَوْجَبَ طَلْحَةُ أَيِ الْجَنَّةَ ‘ত্বালহা জান্নাতকে ওয়াজিব করে নিল’।[তিরমিযী হা/৩৭৩৮; আহমাদ হা/১৪১৭; মিশকাত হা/৬১১২]


১৬. রাসূল (সাঃ)-এর শহীদ হবার খবর ও তার প্রতিক্রিয়া :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
মুসলিম বাহিনীর পতাকাবাহী মদীনায় প্রেরিত ইসলামের প্রথম দাঈ বীরকেশরী মুছ‘আব বিন ওমায়ের শহীদ হবার পর তাঁকে আঘাতকারী আব্দুল্লাহ বিন ক্বামিআহ ফিরে গিয়ে সানন্দে ঘোষণা করে যে,إِنَّ مُحَمَّدًا قَدْ قُتِلَ ‘মুহাম্মাদ নিহত হয়েছে’। কেননা রাসূল (সাঃ)-এর চেহারার সাথে মুছ‘আবের চেহারায় অনেকটা মিল ছিল। এই খবর উভয় শিবিরে দারুণ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মুসলমানগণ ক্ষণিকের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। ফলে পরস্পরকে চিনতে ব্যর্থ হয়ে মুসলমানের হাতেই কোন কোন মুসলমান শহীদ হয়ে যান। এমনই অবস্থার শিকার হ’য়ে খ্যাতনামা সাহাবী হযরত হুযায়ফা (রাঃ)-এর বৃদ্ধ পিতা হযরত ইয়ামান (রাঃ) শহীদ হয়ে যান’ (বুখারী হা/৪০৬৫)।


১৭. নাক-কান কাটা ভাগিনা ও মামা এক কবরে :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর এর ফুফাতো ভাই আব্দুল্লাহ বিন জাহশ (রাঃ) ও তার মামা রাসূল (সাঃ)-এর চাচা হামযাহ বিন আব্দুল মুত্ত্বালিব (রাঃ)-কে একই কবরে দাফন করা হয়’।[3] আব্দুল্লাহ বিন জাহ্শ যুদ্ধে নামার আগের দিন দো‘আ করেছিলেন,اللَّهم ارْزُقْنِي غدًا رجلاً شديدًا بأسُهُ شديدًا حَرْدُهُ، فأُقَاتِلُه فيك و يُقَاتِلُنِي ثم يَأْخُذُنِي فَيُجَدِّعُ أَنْفِي و أُذُنِي فإذا لَقِيْتُكَ غدًا قلتَ : يا عبدَ الله فِيْمَ جُدِّعَ أَنْفُكَ و أُذُنُكَ؟ فأقولُ فِيْكَ و في رسولِكَ فيقولُ : صَدَقْتَ ‘হে আল্লাহ! আগামীকাল আমাকে এমন একজন বীর ও দুর্ধর্ষ যোদ্ধার মুখোমুখি কর, যে আমাকে প্রচন্ড লড়াই শেষে হত্যা করবে এবং আমার নাক ও কান কেটে দেবে। তারপর আমি তোমার সামনে হাযির হলে তুমি বলবে, হে আব্দুল্লাহ! তোমার নাক-কান কাটা কেন? আমি বলব, হে আল্লাহ! তোমার জন্য ও তোমার রাসূলের জন্য(فِيكَ وَفِى رَسُولِكَ)। তখন তুমি বলবে, صَدَقْتَ ‘তুমি সত্য বলেছ’ (হাকেম হা/২৪০৯, হাদীছ সহীহ)। এ দো‘আর সত্যায়ন করে হযরত সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ (রাঃ) বলেন, আমার চেয়ে তার দো‘আ উত্তম ছিল এবং সেভাবেই তিনি শাহাদাত লাভে ধন্য হয়েছেন। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) নিজে হামযা ও আব্দুল্লাহ দু’জনকে একই কবরে দাফন করেন। এ সময় তাঁর বয়স ছিল ৪০-এর কিছু বেশী। যুবায়ের (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ বিন জাহশকে ‘আল্লাহর পথে নাক-কান কাটা’(الْمُجَدَّعُ فِي اللهِ) বলে অভিহিত করা হয়। যেটা ওহুদের যুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর করা হয়েছিল।[15]


১৮. আবু সুফিয়ানের প্রতি নাখোশ তার সেনাপতি :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
উবাইশ গোত্রের নেতা(سَيِّدُ الْأُبَيْشِ) হুলাইস বিন যাববান(حُلَيْسُ بْنُ زَبَّان) যুদ্ধশেষে আবু সুফিয়ানের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় আবু সুফিয়ান নিহত হামযা বিন আব্দুল মুত্ত্বালিবের চোয়ালে বর্শা দিয়ে খোঁচা মারছিলেন আর বলছিলেন,ذُقْ عُقَقْ অর্থাৎذُقْ يَا عَاقُّ ‘মজা চাখো হে অবাধ্য! এ দৃশ্য দেখে হুলাইস বলে উঠলেন, হে বনু কিনানাহ! ইনি হলেন কুরাইশের নেতা। দেখ তিনি তার ভাতিজার মৃত লাশের সাথে কিরূপ আচরণ করছেন? তখন আবু সুফিয়ান লজ্জিত হয়ে বলে উঠলেন,وَيْحَكَ! اُكْتُمْهَا عَنِّي، فَإِنَّهَا كَانَتْ زَلَّةً ‘তোমার ধ্বংস হৌক! চুপ থাক। এটা একটা পদস্খলন’ (ইবনু হিশাম ২/৯৩)।


১৯. রাসূল (সাঃ)-এর জন্য ঢাল হলেন যাঁরা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━━━
আনাস (রাঃ) বলেন, ওহুদের দিন সংকট মুহূর্তে লোকেরা যখন এদিক-ওদিক ছুটছে, তখন আবু ত্বালহা স্বীয় ঢাল নিয়ে রাসূল (সাঃ)-এর সামনে দাঁড়িয়ে যান। রাসূল (সাঃ) এবং তিনি একই ঢালের আড়ালে থাকেন। রাসূলুল্লাহ(সাঃ) আবু ত্বালহার নিক্ষিপ্ত তীর কোথায় পড়ছে, দেখার জন্য একটু মাথা উঁচু করলেই আবু ত্বালহা বলে উঠতেন,يَا نَبِىَّ اللهِ بِأَبِى أَنْتَ وَأُمِّى، لاَ تُشْرِفْ يُصِيبُكَ سَهْمٌ مِنْ سِهَامِ الْقَوْمِ، نَحْرِى دُونَ نَحْرِكَ ‘হে আল্লাহর নবী! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য উৎসর্গীত হৌন- আপনি মাথা উঁচু করবেন না। তাহলে ওদের নিক্ষিপ্ত তীর আপনার গায়ে লেগে যাবে। আমার বুক হৌক আপনার বুক’।[বুখারী হা/৩৮১১; মুসলিম হা/১৮১১] আবু ত্বালহা ছিলেন একজন দক্ষ তীরন্দায। এইদিন তিনি দু’টি বা তিনটি ধনুক ভেঙ্গেছিলেন। শত্রুর দিক থেকে তীর এলেই তিনি রাসূল (সাঃ)-কে বাঁচানোর জন্য নিজের বুক উঁচু করে ধরতেন। রাসূল (সাঃ) তার তীর চালনায় খুশী হয়ে বলেন, لَصَوْتُ أَبِى طَلْحَةَ فِى الْجَيْشِ أَشَدُّ عَلَى الْمُشْرِكِينَ مِنْ فِئَةٍ ‘যুদ্ধে আবু ত্বালহার কণ্ঠস্বর মুশরিকদের উপরে একটি দলের হামলার চাইতে ভয়ংকর ছিল’ (আহমাদ হা/১৩১২৭, সনদ সহীহ)।


২০. প্রাণ নিয়ে খেললেন যারা :
━━━━━━━━━━━━━━━━━━
রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-এর দান্দান মুবারক শহীদ হওয়ার পর সেই কঠিন মুহূর্তে মুষ্টিমেয় যে কয়জন সাহাবী রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে ছুটে এসে তাঁকে বাঁচানোর জন্য নিজেদের জীবন নিয়ে খেলতে থাকেন, তাঁরা ছিলেন হযরত আবু দুজানা, মুছ‘আব বিন ওমায়ের, আলী ইবনু আবী ত্বালেব, সাহ্ল বিন হুনায়েফ, মালেক ইবনু সিনান (আবু সাঈদ খুদরীর পিতা), উম্মে ‘উমারাহ নুসাইবাহ বিনতে কা‘ব আল-মাযেনিয়াহ, ক্বাতাদাহ বিন নু‘মান, উমর ইবনুল খাত্ত্বাব এবং আবু ত্বালহা (রাযিয়াল্লাহু ‘আনহুম)। এঁদের মধ্যে মুছ‘আব বিন উমায়ের এবং মালেক ইবনু সিনান শহীদ হয়ে যান’ (আর-রাহীক্ব ২৭০ পৃঃ)।




[1]. ইবনু হিশাম ২/৮২; বুখারী হা/৪০৫৫; উল্লেখ্য যে, বুখারী হা/৪০৫৯ হাদীছে সা‘দ বিন মালেক বলা হয়েছে। মূলতঃ সা‘দ বিন আবু ওয়াকক্বাছ-এর মূল নাম হল সা‘দ বিন মালেক। আবু ওয়াকক্বাছ হল তাঁর কুনিয়াত বা উপনাম। মুসলিম হা/২৪১১; মিশকাত হা/৬১০৩।
[2]. ইবনু হিশাম ২/৮০; তিরমিযী হা/৩৭৩৯, সনদ সহীহ; মিশকাত হা/৬১১৩। প্রসিদ্ধ আছে যে, এই সময় রাসূল (সাঃ) বলেছিলেন, دُونَكُمْ أَخَاكُمْ فَقَدْ أَوْجَبَ ‘তোমাদের ভাইকে ধর, সে জান্নাতকে ওয়াজিব করে নিয়েছে’ (আর-রাহীক্ব ২৭০ পৃঃ)। কথাটি যঈফ। মুশরিক বাহিনী কর্তৃক ঘেরাওকালীন সংকট মুহূর্তে সর্বপ্রথম আবুবকর (রাঃ) রাসূল (সাঃ)-এর নিকটে এসেছিলেন বলে আয়েশা (রাঃ) প্রমুখাৎ সহীহ ইবনু হিববান-এর বর্ণনাটিও (আর-রাহীক্ব ২৭০ পৃঃ) ‘যঈফ’ (ঐ, তা‘লীক্ব ১৪৭ পৃঃ)। তবে أَوْجَبَ طَلْحَةُ (‘ত্বালহা জান্নাতকে ওয়াজিব করে নিয়েছে’) কথাটি ‘সহীহ’ (আলবানী, সহীহাহ হা/৯৪৫)।
[3]. আর-রাহীক্ব ২৮১ পৃঃ। মুবারকপুরী এখানে আব্দুল্লাহ বিন জাহশকে রাসূল (সাঃ)-এর দুধ ভাই বলেছেন। যা প্রমাণিত নয়। কেবলমাত্র সুহায়লী ‘বলা হয়ে থাকে’ (يقال) মর্মে সনদ বিহীনভাবে কথাটি উল্লেখ করেছেন (ইবনু হিশাম ১/১৬১ টীকা-৬; আর-রওযুল উনুফ ১/২৮৩)। এটি মেনে নিলে তার আপন বোন যয়নাব বিনতে জাহশকে বিবাহ করা রাসূল (সাঃ)-এর উপর হারাম হয়ে যেত। কারণ তখন তিনি হতেন রাসূল (সাঃ)-এর দুধ বোন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা

  মু‘জিযা সমূহ পর্যালোচনা মু‘জেযা সমূহ মূলতঃ নবুঅতের প্রমাণ স্বরূপ। যা দু’ভাগে বিভক্ত। (১) আধ্যাত্মিক (معنوية) এবং (২) বাহ্যিক (حسية)। আধ্যা...